সংকটময় প্রেম পর্ব ১০

সংকটময় প্রেম পর্ব ১০
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

“কবুল” তিন অক্ষরের বাক্যটিতে নির্ভর করে একজন নর-নারীর এক সঙ্গে জীবন পাড়ি দিয়ার সফর, এক সাথে আবদ্ধ হবার সফর। সুখে -দুঃখের সাথী। অথচ আজ এই সম্পর্কটা আমার জীবনে এক অপ্রত্যাশিত মানুষের সাথে হবে তা আমার কল্পনার বাহিরে ছিলো। আমি এখনো বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। আমার বক্ষস্থল দুরুদুরু করছে। ইউসুফ ভাই কি আদো কবুল বলবে? মৌলবি সাহেব আবারো জিজ্ঞেস করলেন,

” বাবা আপনি কি রাজি?”
ইউসুফ ভাই মাথানত করে আছেন। তার ভাবাবেগ এই মুহূর্তে ধরতে পারছি না। সায়রা মামি বলেছিলেন ইউসুফ ভাইয়ের পছন্দের মানুষ আছেন, ঠিক করে রেখেছেন তার জীবন সঙ্গী। তাহলে কেন করবে সে আমাকে বিয়ে? ভাবতেই দীর্ঘ শ্বাস লুকিয়ে ফেললাম সপ্তপর্ণ। বুকের গহীনে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু কেন হচ্ছে? হোয়াই? সায়রা মামি ইউসুফ ভাইয়ের পাশে গিয়ে তাার কাঁধে হাত রাখলেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এবার মুখ তুলে তাকালেন ইউসুফ ভাই নিজ মায়ের অক্ষিপটে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তার গভীর বিলাই চোখের কাতর, গভীর আকুতি। সায়রা মামি চোখে ইশরায় কিছু বুঝালেন যেন তাকে। ইউসুফ ভাই চোখ বুঝে ফেললেন। যেন বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। পরক্ষণেই মুখের ভাবাবেগ শক্ত, কোঠার করে তাকালেন এক পলক আমার দিকে। যেন পৃথিবীর সকল ঘৃণা ছিলো তার তীক্ষ্ণ নজরে। আমি গুটিয়ে গেলাম সাথে সাথে। আমার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। আমি খিচে বন্ধ করে নিলাম নিজ চোখদ্বয়। শীতল ঝংকার তোলা কন্ঠের, মধুর সেই তিন শব্দ ভেসে এলো,

” ক..বু..ল”
ইউসুফ ভাইয়ের কন্ঠে ‘কবুল’ শব্দটি বার বার গুঞ্জন করছে কানে। কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগছে আমার অজান্তেই চোখের কোন ভিজে উঠলো। কেনো? কেনো এই চোখের কান্না? কেনোই বা সে ফেলছে অঝোর বৃষ্টি?
আমি চোখ মেলে তাকালাম, একপলক দেখার লোভ জাগছে মনে, আমার অর্ধাঙ্গ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিটিকে দেখতে।আল্লাহ তা’লা মেয়েদের ছেলেদের বাঁকা হাড় দ্বারা তৈরি করেন। তাহলে কি সত্যি আমি মাত্রাতিক সুন্দর লোকটির অর্ধাংশ। ভাবতেই বুকের মনিকোঠায় কেউ যেন দামামা বাজাতে শুরু করলো।

কিন্তু ইউসুফ ভাইকে এই বিয়েতে খুব একটা খুশি বলে মনে হলো না। তিনি উঠে গটগট করে চলে গেলেন। মৌলবি সাহেব এবার আমাকে ‘কবুল ‘ বলতে বললে আমি লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে গড়গড় করে বলে দি, কবুল, কবুল, কবুল। সকলেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। হয়তো ভাবছে বিয়ে না করতে চাওয়া মেয়েটি হুট করেই বিয়ে পাগল হয়ে গেলো কিভাবে? অনেকেই তো বলেই বসেছে,

” নির্ঘাত মেয়েটি ইউসুফকেই চাইতো। দেখলি না কিভাবে বলে ফেললো?”
” নির্লজ্জ, বেহায়া মেয়ে”
আমি ঠোঁট কামরালাম। সত্যি বড্ড বেশরমের মতো একটা কাজ করে বসেছি। তবে পরিবারের সবাই খুশি। মিষ্টি মুখ চলছে।আমার বাবা-মায়ের মুখের উজ্জ্বল হাসি বলে দিচ্ছে৷, তাদের দীর্ঘদিনের ইচ্ছে পূরণ হয়ে গেছে। বিয়ের পাঠ চুকিয়ে এবার আমাকে আমার ঘর থেকে পাঠানো হলো ইউসুফ ভাইয়ের ঘরে।

বরাবরের মতো প্রাণোচ্ছল কক্ষটি আঁধারের ফেকাসে রঙের ছোঁয়া লেগেছে। বাহিরের শীতল হুড়হুড় করে ঢুকছে, সাদা রঙ্গের পর্দা গুলো বাতাসের তোর সহ্য করতে না পেরে ফরফর করে উড়ছে। আয়দা আমাকে নিয়ে এসে বসালো ইউসুফ ভাইয়ের বিশাল আকারের রুমের মাস্টার বেডে।এবং পাশের টেবিল ল্যাম্প জালিয়ে দিলো।

হালকা নিয়ন আলোয় ইউসুফ ভাইয়ের কক্ষটি আরো ফুটিয়ে তুলছে। গভীর আকাশের এক চিলতে চাঁদ। নরম তুলতুলে ইউসুফ ভাইয়ের বিছানায় বসতেই দোলা দিয়ে গেলো কিছু একটা মনে। ইচ্ছে করছে ঝাপটা ধরে বিছানায় গড়াগড়ি খাই। আজ থেকে ইউসুফ নামক বিলাই চোখ ওয়ালা আমার অর্ধাঙ্গ ভাবতেই দেহে শিরশির করে উঠলো। কোনো রকম নিজেকে ধরে রাখলাম আয়দার সামনে। আয়দার মুখটা কালো হয়ে আছে।তাই জিজ্ঞেস করলাম,

” তোমার মনখারাপ আয়দা?”
আয়দা মাথা নাড়লো। কোনো ভনিতা ছাড়াই বলে ফেলল,
” বউমনি, আমার ভাইয়ার খেয়াল রেখে। ভাই মুখে কিছু বলে না, আমি জানি তার বুকে অনেক কষ্ট।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
” এত বড় নেতা সাহেবের আবার কিসের কষ্ট আয়দা? সে তো কষ্ট পেতেই পারে না। সে শুধু কষ্ট দিতে জানে, হুকুম করতে জানে। হি ইজ এ্যা ডেঞ্জারাস চৌধুরী! ”
আয়দা ফিক করে হেসে দিলো। আমার গালে হাত রেখে বলল,

” আমি জানি তুমি পাড়বে বউমনি।”
বলে চলে গেলো ধুমধাড়াক্কা। আমি হতবাক। চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ আয়দার যাওয়ার পথে। কিন্তু মস্তিষ্কে ঘুর ঘুর করছে,
” ইউসুফ ভাইয়ের কিসের কষ্ট? ”
কোনো উত্তর নেই আমার কাছে। তবে হুট করেই লুকিয়ে ফেলা ডায়েরির কথা মনে পড়লো। এখন তো এই ঘরের অর্ধেক আমার-ও এবং এই কক্ষের সব জিনিস-ও। ভেবেই শয়তানী মনের দুষ্টুমি নারা দিলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলাম তার স্টাডির কাছে। তচনচ করে খুঁজে পেয়ে-ও গেলাম সেই অতি কাঙ্ক্ষিত বস্তু। ডায়েরি প্রথম পেইজটি খুলতেই কেউ ছো মেরে হাত থেকে নিয়ে গেলো। শানিত কন্ঠে শুধালো,

” হাউ ডেয়ার ইউ?”
ইউসুফ ভাইয়ের কন্ঠে কিছুটা কেঁপে উঠলাম। এভাবে ধরা পড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বললাম,
” আ.. মি একটু দেখছিলাম যা.. এই আর কি।”

ইউসুফ রক্তিম নয়ন নিক্ষেপ করলেন। ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলেন, উনার বলিষ্ঠ হাতের ধাক্কায় আমি ধাম করে নিচে পড়ে যাই। অথচ এই ব্যক্তিটি উদাসীন, নিজ ডায়েরি বুকে জড়িয়ে কিছু বিড়বিড় করতে করতে কক্ষের অন্য পাশে চলে গেলো। ইউসুফ ভাইয়ের উদাসীনতা আমার প্রতি কষ্ট লাগছে, এত কষ্ট যে দুনিয়ার সব কিছুতে আগুন ধরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। পা ছড়িয়ে কেঁদে উঠলাম আমি, ভয়ংকর রকমের কান্না। আমার বর, ইউসুফ বর, যার সাথে কিছুক্ষণ আগে বিয়ে হলো সে আমাকে ছেড়ে ডায়রিতে আবদ্ধ থাকা তার বাবুইপাখিকে সঙ্গে করে চলে গেলো? কেনো? হোয়াই? সে কি ভুলে গেছে,?আমি তার কিছুক্ষণ আগেই বিধিমালা মেনে তার ঘরের রানী হয়ে গেছি?

“হি ইজ মাই গ্রুম নাও?যদি তার মনের মানুষকে সে এতই ভালোবেসে থাকে? তাহলে তো তাকে ভুলতে হবে! যে ছিলো সে অতীত আর আমি তার বর্তমান।”
আমি চোখের পানি মুছে ফেললাম। বিয়ে যেহেতু পছন্দের মানুষটার সাথেই হয়েছে, এবার না হয় শুরু হোক তাকে নিজের করে হাসিল করার খেলা। শুরু হোক কুহু ইউসুফের সংকটময়_প্রেম। ভেবেই চোখ জোড়া মুছে উঠে পড়লাম। না চাওয়া সম্পর্কে যখন আবদ্ধ হয়েছি, তাহলে তাকে যে আমার পুরোটাই চাই। না হয় সব টা উজাড় করে দিবো। আমি নিঃশব্দে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম ইউসুফ ভাইয়ের নরম তুলতুলে বিছানায়।

কখন যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম বুঝতে পারলাম না। গভীর ঘুমে যখন আচ্ছন্ন আমি? ঠিক তখনি কারো উষ্ণ স্পর্শ আমার দেহে পড়তেই বিড়াল ছানার মতো আঁকড়ে ধরলাম তাকে। তার উষ্ণ নিশ্বাস আমার চোখে মুখে পড়ছে।ডিপ ডিপ হৃদপিণ্ডের ছন্দ আমায় যেন মধুর সুর শোনাচ্ছে। ঘুমের মাঝেও মনে হচ্ছে কারো গভীর চাহনি। আমার চোখ মেলতে ইচ্ছে হলো না, ইচ্ছে হলো না আমার অচেতন মনের স্বপ্ন ভেঙে দিতে। মন চাইছে এই ছায়ামানবের অধীনস্থ হতে। ঠিক তখনি আমার কানে ভেসে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ডাক,

” বাবুইপাখি। আমার বাবুইপাখি। ”
আমার মস্তিষ্ক সাথে সাথে সজাগ হয়ে গেলো। চকিতেই চক্ষু মেলে তাকাতেই ইউসুফ ভাইয়ের কাতর মুখখানা দেখতে পাই। যার বুকের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছি আমি। ইউসুফ ভাইয়ের চোখ জোড়া বন্ধ। কাঁপছে চিকন ঠোঁট জোড়া। নিজ বরের বুকে আবদ্ধ থেকে অন্য নারীর জন্য কাকুতি মিনতি দেখে রাগে গা রি রি করে উঠলো। নিজের শরীরেরসর্বশক্তি দিয়ে তাকে ধাক্কা মারলাম। ঘুমন্ত ইউসুফ ভাই হকচকিয়ে উঠলেন। ধমকে বললেন,

” কি সমস্যা তোর? ধাক্কাচ্ছিস কেন?”
আমি রাগের দমকা কমাতে শুঁকনো ঢুক গিললাম। শক্ত কন্ঠে বললাম,
” বউকে বুকে নিয়ে পরনারীর নাম নিতে লজ্জা করে না? নেতাদের বুঝি সত্যি ক্যারেক্টারে দোষ থাকে???”
ইউসুফ হতভম্ব হয়ে গেলেন যেন। গোল গোল চোখে চেয়ে রইলেন শুধু। তার ভাব খানা এমন যেন আমি আষাঢ় মাসের গল্প করছি। উনি কিছু বললেন না।

সংকটময় প্রেম পর্ব ৯

কিছুক্ষণ সেভাবেই তাকিয়ে উল্টো পাশে মুখ করে শুয়ে পড়লেন। তার এহেন কান্ড রাগ বাড়লো বৈকি কমলো না। রাগে গজরাতে গজরাতে আমি শুয়ে পড়লাম। এবং ইউসুফ ভাই আর তার বাবুইপাখির গুষ্টি তুষ্টি করতে লাগলাম। মনে মনে পণ করে ফেললাম, এই বাবুইপাখিটা কে তাকে এবার ধরতেই হবে।

সংকটময় প্রেম পর্ব ১১

4 COMMENTS

Comments are closed.