কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২৩

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২৩
লেখায় নামিরা নূর নিদ্রা

কুয়াশা মাটিতে বসার সাথে সাথে আর্শিয়া লুটিয়ে পড়ে তার কোলে। ঘটনার আকষ্মিকতায় কুয়াশা স্তব্ধ হয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে আর্শিয়ার দিকে। মেয়েটা তাকে বাঁচাতে নিজের জীবন দিতে একবারও ভাবল না। এটা ভেবেই কুয়াশার চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রুপাত হতে শুরু করে। কম্পিত কণ্ঠে আর্শিয়াকে বুকে আগলে নিয়ে কুয়াশা বলে,
“এটা কেন করলি তুই?”

ব্যাথায় ছটফট করা মেয়েটা মুহূর্তের মধ্যে হেসে উত্তর দেয়,
“আমার জীবন এমনিতেও ইতি টানত আজ। এরা আমাকে বাঁচতে দিবে না আমি জানি। কিন্তু তোর কিছু হলে আমি নিজেকে মাফ করতে পারতাম না। আমার জন্য তুই নিজের জীবন দিয়ে দিবি তা আমি চাই না। আচ্ছা আমার মৃ ত্যু র পর আমার সন্তানদের নিজের সন্তানের মত আগলে রাখবি তো তুই?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“তোর সন্তান মানে আমারো সন্তান। আমি তো ওদের খালামনি। ওদেরকে নিজের সন্তানের মত করে আগলে রাখা আমার দায়িত্ব। কিন্তু তোর কিছু হতে দিব না আমি। এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাব তোকে।”
“না রে বোন, আমার হাতে বেশি সময় নেই। শোন, আমার ব্যাগে একটা লাল ডায়েরি আছে। ওটা সময় করে পড়ে নিস। তাহলে তুই তোর সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবি।”

“আর্শিয়া ভাইয়া কোথায়?”
“আহনাফ তো আমাদের ছেড়ে আরো আগেই চলে গিয়েছে। পৃথিবীতে আমাকে আর সন্তানদের রেখে সে চলে গিয়েছে দূর আকাশের ঠিকানায়।”
এমন কিছু শোনার জন্য কুয়াশা বিন্দু মাত্র প্রস্তুত ছিল না। নিজের কানকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না যে আহনাফ আর এই পৃথিবীতে নেই।

“আর্শিয়া তোর সাথে এত কিছু হয়ে গেল। তুই আমাকে এসব কিছু জানাসনি কেন?”
“পরিস্থিতি আমার অনুকূলে ছিল না। আমি চেয়েও তোকে কিছু জানাতে পারিনি। আর যখন জানালাম তখন সবকিছু হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। সবই আমার ভাগ্য। আচ্ছা বাচ্চাদের একটু আমার কাছে নিয়ে আয়।”
কুয়াশা ইশারায় মলি আর আদ্রিতাকে বাচ্চাদের নিয়ে আসতে বলে। নিষ্পাপ বাচ্চা দু’টো ভয়ে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেদের। মায়ের কাছে আসতেই যেন তারা প্রাণ ফিরে পায়। মা বলে ডেকে ওঠে আর্শিয়াকে। আর্শিয়া আলতো হাতে বাচ্চাদের ছুঁয়ে দেয়। অতঃপর কাছে টেনে কপালে চুমু দিয়ে কুয়াশার হাতের মুঠোয় বাচ্চাদের হাত তুলে দিয়ে বলে,

“আজ থেকে তুই ওদের মা। ওদের দেখে রাখিস। ভালো থাকিস তোরা সবাই।”
আর কিছু বলতে পারে না সে। ধীরে ধীরে চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে যায় তার। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চিরদিনের মত ঘুমিয়ে পড়েছে আর্শিয়া। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই তার জীবনের আলো নিভে গেল আজ। চলে যাওয়ার আগে কুয়াশার উপর কঠিন একটা দায়িত্ব দিয়ে গেল সে। মা হয়ে ওঠার দায়িত্ব!

নিজের চোখের সামনে প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে এভাবে শেষ হয়ে যেতে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে কুয়াশা। মলি আর আদ্রিতা বাচ্চাদের বুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। আশেপাশের প্রতিটা মানুষের চোখে পানি চিকচিক করছে। ইতিমধ্যে পুলিশ এসে সবাইকে ধরে নিয়েছে। সাফওয়ান উপরে আসার পর কৌশলে পুলিশকে কল করে চলে আসতে বলেছিল। আফসোস একটাই! তারা সময় মত আসতে পারেনি। যদি আসতে পারত তাহলে হয়তো আর্শিয়া আজ বেঁচে যেত।
সাফওয়ান কুয়াশার সামনে বসে তাকে শান্ত করে। আর্শিয়াকে পুলিশ অফিসার মর্গে নিয়ে যেতে চাইলে কুয়াশা তাতে বাঁধা দেয়।

“আর্শিয়াকে মর্গে নিয়ে যাওয়া হবে না।”
“কিন্তু ম্যাডাম এটা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এই কেসের জন্য পোস্ট মর্টেম জরুরি।”
“এই মেয়েটা অনেক কষ্ট বুকে নিয়ে দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছে অফিসার। ওকে নিয়ে আর টানাহেঁচড়া করবেন না।”
“কিন্তু তা কী করে হয়?”

“আমি হাত জোর করে অনুরোধ করছি আপনাদের। এখানে সবাই দেখেছে ওকে ওই শয়তানগুলো মে রে ফেলেছে। তাহলে আর কোন প্রমাণের জন্য ওকে কা টা ছেঁড়া করবেন আপনারা? দয়া করুন অফিসার। ম রা র পর অন্তত ওকে একটু শান্তি দিন।”

“এই কেসের প্রমাণ হিসেবে এটা দরকার।”
“ওর কেস আমি লড়ব। তাই প্রমাণের ব্যাপারটা আমার উপরে ছেড়ে দিন। আপনারা এখন আসতে পারেন।”
অনেক জোরাজুরি করার পরেও কুয়াশা আর্শিয়াকে তাদের হাতে তুলে দিতে নারাজ। পুলিশ অফিসার এক প্রকার বাধ্য হয়েই আর্শিয়ার লা শ না নিয়ে চলে যায়। কুয়াশা সবকিছু সামলিয়ে আর্শিয়াকে নিয়ে ওদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়া হয়। কারণ এই পৃথিবীতে আর্শিয়ার আপন বলতে আর কেউ নেই। তাই যা করার সব কুয়াশাকেই করতে হবে।

বাড়িতে নিয়ে এসে আর্শিয়ার দাফন কার্য শেষ করে কুয়াশা প্রচন্ডভাবে ভেঙে পড়ে। তার চোখের সামনে তার বান্ধবীকে কেউ মে রে ফেলেছে আর সে তাকে বাঁচাতে পারেনি। এই সত্যিটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনে কুয়াশা দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে মলি ছোট্ট ওয়ানিয়াকে নিয়ে তার দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে।

“কলি বাচ্চাটা অনেক্ক্ষণ যাবত কেঁদেই যাচ্ছে। আমরা সবাই অনেক চেষ্টা করেও থামাতে পারছি না। তুই একটু চেষ্টা করে দেখ না।”
কুয়াশা আলতো হাতে আট মাস বয়সী ছোট্ট মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। পরম মমতায় তার কান্না থামানোর চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে সে সফলও হয়। নিজের এমন অর্জন দেখে কুয়াশা এত এত অশান্তির মধ্যে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়।
“মেয়েটা একদম ওর মায়ের মত হয়েছে। মায়ের মতোই মায়াবী। এই বাচ্চাটার কী দোষ বল তো মলি? ওয়ানিয়া আর নিহাল নিষ্পাপ। তবুও একজন আট মাস বয়সে আরেক জন তিন বছর বয়সে অনাথ হয়ে গেল। এমন কেন হলো?”

“সবই নিয়তির খেলা। এতে আমাদের কারোর হাত নেই। আমাদের নিয়তিকে মেনে নিতে হবে।”
“এই বাচ্চাদের আমি মায়ের আদর, যত্ন দিয়ে বড়ো করতে পারব তো?”
“পারবি ইনশাআল্লাহ। আর আমরা সবাই তো আছি। একটা পরিবারের মধ্যে বড়ো হলে ওরা সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনই পাবে দেখে নিস তুই।”
“সব পেলেও বাবার ভালোবাসা তো কখনো পাবে না।”
“কেন? তুই কী আর বিয়ে করবি না?”

“আমি বিয়ে করলে এই বাচ্চাদের কেউ মেনে নিবে?”
“তোকে যেকোনো পরিস্থিতিতে একজন নিজের করে নেওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত আছে।”
মলির এমন কথায় কুয়াশা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
“কে সে?”
“সময় হলে ঠিক জানতে পারবি।”
“তুই জানলি কীভাবে?”

“এতকিছু তোর জানতে হবে না। তুই ওয়ানিয়াকে সামলা। আমি নিহালের কাছে যাই। ওকে আন্টি, আদ্রিতা সবাই মিলে কোনোরকমে শান্ত করে রেখেছে।”
“আরে শোন!”
না, মলি কুয়াশার আর কোনো কথা শোনে না। আপনমনে চলে যায় বাইরে। কুয়াশা ছোট্ট ওয়ানিয়াকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
“কুয়াশা আসব?”

সাফওয়ানকে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কুয়াশা বলে,
“আরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকতে হবে নাকি তুমি? ভেতরে এসো।”
“কারোর ঘরে প্রবেশ করার আগে তার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া এক প্রকার ভদ্রতা।”
“আমার সাথে এত কিছু মেনে কথা বলতে হবে না। তুমি আমার বন্ধু। শুধু বন্ধু নও। খুব ভালো বন্ধু। আর বন্ধুত্বে এসব চলে না। বুঝেছ?”

“হ্যা বুঝেছি। আচ্ছা শোনো, আমি আগামীকাল সকালে ঢাকায় চলে যাব।”
“আরে কী বলছ এসব? এই প্রথম তুমি আমাদের বাড়িতে এলে। এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে কেন? থাকো আরো কিছুদিন।”
“কিন্তু ঢাকায় তো আমাদের অনেক কাজ আছে। তুমি এখন যেতে পারবে না। তাই আমি গিয়ে সব দেখি। আমাদের ওই বাড়িটা পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন করতে হবে তো।”

“এত তাড়া কীসের তোমার? তুমি কী আমাদের ছেড়ে কোথাও চলে যাবে যে এত তাড়াহুড়ো করছ?”
“আরে বোকা মেয়ে, যত দ্রুত সম্ভব আমাদের সব ঠিকঠাক করতে হবে। একটা বৃদ্ধাশ্রম আর এতিমখানা তৈরি করা এত সহজ নাকি?”
“আচ্ছা তুমি যাবে। কিন্তু আগামীকাল নয়। অন্তত আর দুইটা দিন থাকো। আমি একা হাতে সব সামলাতে পারব না। তুমি থাকলে আমি ভরসা পাই।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”

কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে সাফওয়ান কুয়াশার দিকে তাকিয়ে কিছুটা চিন্তিত স্বরে বলে ওঠে,
“কুয়াশা তুমি এই বাচ্চাদের নিয়ে কী ভাবলে?”
“ওরা আমার কাছেই থাকবে আমার সন্তান হয়ে।”
“কিন্তু ওদের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য যদি ওর দাদু বাড়ির লোকজন আসে?”
“আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সাফওয়ান। আমি ওয়ানিয়া আর নিহালকে দত্তক নিব।”
“ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছ?”

“হ্যা।”
“সমাজ কী বলবে?”
“সমাজের কথা ভাবলে তো আমি তুরাবকেও ডিভোর্স দিতাম না।”
“মানলাম তুমি ওদের মা হয়ে উঠবে। তবে ওদের কী বাবার ভালোবাসার প্রয়োজন নেই?”

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২২

সাফওয়ানের এই কথাটা কুয়াশাকে ভাবিয়ে তোলে। সত্যিই তো! ওদের কী বাবার ভালোবাসার প্রয়োজন নেই? কুয়াশা একা হাতে ওদের সব দিতে পারবে কী? সব দিলেও বাবার ভালোবাসা কীভাবে দিবে? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পায় না কুয়াশা।

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২৪