কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২৪

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২৪
লেখায় নামিরা নূর নিদ্রা

বন্ধুদের সাথে বসে ইচ্ছামত মদ্যপান করছে তুরাব। ইতিমধ্যে এত বেশি মদ্যপান করে ফেলেছে যে নিজের পায়ে দাঁড়াতেও অক্ষম সে। চারপাশটা কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে তার চোখে। নিজ জ্ঞানে না থাকা ছেলেটা হঠাৎই বন্ধুদের সামনে বলে বসে,

“আমি কিছুতেই কুয়াশাকে ভালো থাকতে দিব না। আমি ভুল করেছি। মাফও চেয়েছি। কিন্তু সে আমাকে মাফ না করে অহংকার দেখাল। ওর অহংকার শেষ না করা অবধি আমার শান্তি মিলবে না।”
পাশে থাকা একজন তার এমন কথা শুনে বলে ওঠে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কী করবি তুই? তোদের তো ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। তুই ডিভোর্স পেপারে সেদিন রেগে সই করে দিলি। এটাই ভুল করেছিস। ওকে শায়েস্তা করার জন্য হলেও বিয়েটা টিকিয়ে রাখার দরকার ছিল তুরাব।”
“ডিভোর্স হওয়ারই ছিল। কুয়াশা যখন একবার ডিভোর্স চেয়েছে তখন সেটা হবেই স্বাভাবিক। কারণ ওর মত জেদি মেয়ে আমি খুব কমই দেখেছি।”

“তুই যে এত কথা বলছিস, দোষ কী তোর নেই? সব দোষ তো তোর নিজের। মেয়েটা আর কত সহ্য করত ভাই? এখনো কী তোর মেয়ের নেশা কেটেছে? কাটেনি তো!”
বন্ধু মিরাজের কথায় তুরাবের বিরক্তির সীমানা থাকে না।
“এই একদম চুপ থাক তুই। তুই কে বল তো? আমার বন্ধু নাকি শত্রু? সারাক্ষণ কুয়াশার হয়ে কথা বলিস। ওর প্রতি তোর নজর আছে নাকি?”

“মুখ সামলে কথা বল তুরাব। কুয়াশাকে আমি কখনো অন্য নজরে দেখিনি। তবে হ্যা, ওর মত মেয়েকে নিজের ভালোবাসা হিসেবে পেলে যত্ন করে রাখতাম। তোর মত ছেড়ে দিতাম না। এমন একজন মেয়ে বউ হিসেবে থাকতেও তোর বাইরের মেয়ে কেন লাগে ভাই? এটাই তো বুঝতে পারি না আমি।”
“আমি তো চেয়েছিলাম ওর সাথে আবার সংসার করতে। কিন্তু সে তো তাতে রাজি না। তাহলে আমি কেন ওর জন্য নিজের জীবন নষ্ট করব? আমার জীবনটাকে উপভোগ করতে চাই আমি। একজনের প্রেমে পাগল হয়ে দেবদাস হওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।”

তুরাবের কথায় যেন এবার তুরাবের প্রতিটা বন্ধুই ভীষণ বিরক্ত হলো। একজন তো মনে মনে বলেই ফেলল,
“তুই কুয়াশার মত মেয়ের জন্য যোগ্য না ভাই। তার থেকে তোরা আলাদা হয়েছিস, এটাই ভালো হয়েছে।”
মনে মনে কথাটা বললেও সিয়ামের এই কথাটা মুখে বলার সাহস হলো না। হাজার হলেও তুরাব তার অনেক বছরের পুরোনো বন্ধু। একজনের হয়ে কথা বলতে গিয়ে বন্ধুত্ব নষ্ট করার মানে হয় না।

আচমকা তুরাব সবার মধ্যে থেকে উঠে দাঁড়ায়। ঠিকমতো দাঁড়াতে না পারলেও হেঁটে হেঁটে বাইরে চলে আসে। পেছন থেকে বাকি সবাই ডাকলেও তাতে সাড়া দেয় না সে। গাড়িতে বসে আনমনে বলে ওঠে,
“তুমি যদি আমার না হও তবে আর কারোর নও। তোমাকে আমি অন্য কারোর হতে দিব না কুয়াশা!”

সময় বহমান। সময় কারোর জন্য থেমে থাকে না। আর্শিয়া চলে যাওয়ার পর বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হয়েছে। কুয়াশা আজও তার চলে যাওয়ায় চোখের পানি ফেলে। আর্শিয়ার বাচ্চাদের বুকে আগলে রেখেছে সে। সে তো একা। তার জীবনে সংসার নামক কিছু নেই। সংসার না থাকলেও সন্তান আছে। ঘুমন্ত শিশুদের দিকে তাকিয়ে কুয়াশা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“তোরা আমার জীবনে এসে আমার রঙহীন জীবনটাকে রঙিন করে তুলেছিস। তোদের জন্যই এখন আমি শান্তিতে থাকি। তোদের নিষ্পাপ মুখ দেখলে আমার মন খারাপেরা পালিয়ে যায়। তোরা দু’জন এখন আমার ভালো থাকার কারণ!”
কুয়াশার ভাবনায় ছেদ ঘটে তার মা মিসেস নাহারের আগমনে। মেয়ের পাশে বসে মেয়ের মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে তিনি বলেন,

“তোমাকে কিছু কথা বলার আছে।”
কুয়াশা মায়ের কোলে মাথা রেখে বলে,
“হ্যা মা বলো।”
“বাচ্চাদের নিয়ে কী ভাবলে তুমি?”
“ওরা আমার কাছেই থাকবে মা আমার সন্তান হয়ে।”

“কুয়াশা, আমি বলব না ওদের অনাথ আশ্রমে রেখে আসতে। ওদের ছেড়ে দিতেও বলব না। কিন্তু তোমারো তো জীবন আছে মা। তোমার ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে।”
“কী বলতে চাও তুমি?”
“আমি চাই তুমি আবার বিয়ে করে সুখে, শান্তিতে সংসার করো।”
“এটা সম্ভব নয় মা।”
“কেন?”

“আমি সংসারের সুখ আট মাসের জন্য হলেও পেয়েছি। সত্যি বলতে যে আট মাস আমি তুরাবের সাথে ছিলাম সেই মাসগুলোতে আমি তেমন কোনো কষ্ট অনুভব করিনি। তুরাব অভিনয় করলেও আমাকে কষ্টে রাখেনি৷ ভালো স্বামী হওয়ার অভিনয়ে সে দশে দশ পাবে। তাই সংসার সুখ আমি অনুভব করেছি। দ্বিতীয় বার আর কারোর সাথে জড়ানোর বিন্দু মাত্র ইচ্ছা নেই আমার।”

“স্বামী সুখ, সন্তান সুখ চাও না তুমি?”
“স্বামী সুখ চাই না। যতটুকু পেয়েছি তাতেই শুকরিয়া আদায় করি। আর সন্তান সুখের কথা বললে আমি বলব সেই সুখ ওয়ানিয়া আর নিহালই আমাকে দিবে। মা একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি। বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সময় বা সুযোগ কোনোটাই হয়নি এতদিন।”
“কী কথা?”

“আমি এমনিতেও বাচ্চা দত্তক নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার আর প্রয়োজন হলো না। কারণ আর্শিয়া নিজেই আমার কোল ভরিয়ে দিয়েছে ওর দুই সন্তানকে আমার কাছে দিয়ে।”
“তোমার কী নিজের বাচ্চা নেওয়ার ইচ্ছা হয় না?”
“এমন ইচ্ছা কার না হয় মা? আমিও ব্যতিক্রম নই। কিন্তু সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। আমাকে এই সুখ নিতে হলে দ্বিতীয় বার বিয়ে করতে হবে। যা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।”

“কেন সম্ভব নয়? একজনের জন্য সম্পূর্ণ জীবন নষ্ট করে দিবে তুমি? মা হয়ে এটা কীভাবে মেনে নিব আমি?”
“মা ওয়ানিয়া আর নিহালকে আমি জন্ম দিইনি ঠিকই, কিন্তু আর্শিয়ার র ক্ত আমার শরীরে আছে। আমার যেদিন অসুস্থতার কারণে র ক্তে র প্রয়োজন হলো তখন আর্শিয়া আমাকে ওর নিজের র ক্ত দিয়ে বাঁচিয়েছিল। আমার রক্ত সহজেই পাওয়া যায়। ওও না দিলে অন্য কেউ দিত। কিন্তু বিপদের সময় সবার আগে আর্শিয়া এগিয়ে এসেছিল। ছোটবেলা থেকেই অনেক সাহায্য করেছে মেয়েটা আমাকে। সে যখন মৃ ত্যু র আগে আমাকে তার বাচ্চাদের দায়িত্ব দিয়ে গেল তখন সেটা রক্ষা করা কী আমার দায়িত্ব নয়?”

“আচ্ছা তুমি ওদের সাথে নিয়েই থেকো। এতে বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়?”
“প্রথমত ওদের আমার বাচ্চা হিসেবে মেনে নিয়ে কেউ আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে না। সে যত ভালো মানুষই হোক না কেন। দ্বিতীয় এবং প্রধানত আমি ডিভোর্সী হয়ে থাকতে রাজি আছি। কিন্তু দ্বিতীয় কোনো পুরুষের ছোঁয়া পেতে রাজি নই। আমি বিয়ে করতে চাই না মা। একটু তো বোঝার চেষ্টা করো আমার দিকটা। আমি আর কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাই না। দয়া করে আমাকে আর জোর করো না।”

মেয়ের কথায় হতাশ হয়ে মিসেস নাহার মেয়ের ঘর ত্যাগ করেন। তার মেয়ে যেহেতু পূর্ণবয়স্ক, সুতরাং নিজের ভালো সে নিজে বুঝে নিতে পারবে। মা হিসেবে মেয়ের ইচ্ছাকে সম্মান জানানো দরকার। কারণ ছোট থেকেই কুয়াশা কখনো তার অবাধ্য হয়নি। তাই আজ তাকে তার মত করে ছেড়ে দেওয়ায় ভালো। হয়তো এতেই তার ভালো হবে। এসব ভেবে তিনি কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেন।

মা চলে যাওয়ার পর কুয়াশার আর্শিয়ার বলা সেই লাল ডায়েরির কথা মনে পড়ে। এতদিন ডায়েরির কথা তার মাথাতেই ছিল না। সে নিজের আলমারি থেকে আর্শিয়ার ব্যাগ বের করে। এতদিন বেশ যত্ন করেই ব্যাগটা তুলে রেখেছিল সে। ব্যাগ থেকে ডায়েরি বের সে হাতে নেয়।

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২৩

অতঃপর সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে ছাদের এক কোণে বসে সে ডায়েরি খোলে। প্রথম কয়েকটা পাতায় আর্শিয়া আর আহনাফের ভালো মুহূর্তগুলোর কথা লেখা আছে। যেগুলোর প্রায় নব্বই শতাংশ কুয়াশা জানে। তাই সেসব না পড়ে সে পাতা ওল্টায়। পাতা ওল্টানোর এক পর্যায়ে তার চোখ আটকে যায় একটা বাক্যে!
“নিজের স্বামীর মৃ ত্যু নিজ চোখে দেখার মত দুর্ভাগ্য আর কোনো নারীর না হোক!”

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২৫