তুমি শুধু আমারই হও পর্ব ১২

তুমি শুধু আমারই হও পর্ব ১২
লেখনীতে- অরনিশা সাথী

সাড়ে দশটা নাগাদ বাজে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে নূরের বাবা মা নিজদের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছেন। বাকী রইলো উৎসব, সে-ও নিজের ঘরেই আছে। সন্ধ্যায় অর্নি ওভাবে চলে আসার পর রাগে রুমের ভিতর একপ্রকার তান্ডব চালিয়েছে উৎসব। এরপর আর রুম থেকে বের হয়নি। নূর আর ওর আম্মু বেশ কয়েকবার ডাকার পরও আর দরজা খুলেনি। এখনো নিজেকে ঘর-বন্দী করে রেখেছে।

মনে হয় না আজ আর বের হবে ঘর থেকে। তাই বলা চলে পুরো বাসা এখন ফাঁকা। অর্নি ওরা নিশ্চিন্তে বের হতে পারবে। জিন্স পেন্ট, ডিজাইনার শর্ট টপস আর গলায় স্কার্ফ পেঁচিয়ে রেডি হয়ে নিলো নূর আর অর্নি। অতঃপর তিনজনে একসাথে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। যদিওবা এখন কেউ নেই তবুও খুব সাবধানে পা টিপে টিপে তিনজনে বাসা থেকে বেরিয়ে একটা স্বস্তির শ্বাস নেয়। নূরদের বাসা থেকে একটু দূরত্বে গিয়ে তিনজনে দাঁড়িয়ে পড়ে রিকশার জন্য।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

উৎসব ওর রুমের ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো৷ বাসা থেকে এভাবে ওদের তিনজনকে লুকিয়ে বের হতে দেখে কপাল কুঁচকায় উৎসব। এতরাতে তিনজনে এভাবে লুকিয়ে কোথায় যাচ্ছে? প্রশ্নটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো৷ উৎসব দ্রুত রুমে গিয়ে কাবার্ড থেকে শার্ট বের গায়ে জড়িয়ে নিলো। বিছানার পাশ থেকে ফোন এবং ড্রয়ার থেকে ওয়ালেট নিয়ে উৎসব নিজেও বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে।

একটা রিকশা থামিয়ে রুশান আর নূর উঠে বসেছে। অর্নি উঠবে এমন সময় উৎসবের কন্ঠস্বর শুনতে পায়৷ এদিকেই আসছে উৎসব আর ওদেরকে দাঁড়াতে বলছে। অর্নি দ্রুত রিকশায় উঠে বললো,
–“মামা আপনি দ্রুত চালান।”
নূর ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
–“দোস্ত ভাইয়া প্রচন্ড রেগে যাবে৷ আজ না যাই? অন্যদিন সিওর যাবো।”
নূরের কথায় অর্নি চোখ রাঙিয়ে তাকালো। বললো,

–“তুই আমায় প্রমিস করেছিলি__”
–“আমার সেটা মনে আছে। বাট ভাইয়া দেখে ফেললো তো৷”
অর্নি নূরের কথায় পাত্তা না দিয়ে রিকশাওয়ালাকে বলল,
–“আপনি যান তো।”
এমন সময় উৎসব সেখানে এসে রিকশা থামালো৷ তেজী কন্ঠে বললো,
–“দাঁড়াতে বলেছিলাম না?”

অর্নি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে অন্যদিকে ফিরে তাকালো। উৎসব নূরের উদ্দেশ্যে বললো,
–“কোথায় যাচ্ছিস এই রাতের বেলা?”
নূর আমতা আমতা করছে৷ অর্নি উৎসবের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“ঘুরতে যাচ্ছি। আজ মাঝরাত অব্দি এদিক সেদিক ঘুরবো আমরা আর কিছু?”
উৎসব অর্নির হাত ধরে টেনে রিকশা থেকে নামালো। নূর আর রুশানও নেমে পড়লো৷ উৎসব রিকশাওয়ালাকে যেতে বললে উনি চলে গেলেন। অর্নি সেদিকে তাকিয়ে বললো,

–“আপনি রিকশাওয়ালাকে যেতে বললেন কেন? এখন সহজে রিকশা পাবো আমরা?”
উৎসব শান্ত চোখে তাকিয়ে বললো,
–“এই রাতের বেলা কোথাও যাচ্ছো না তোমরা। এখন বাসায় গিয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়বে৷ কাল দিনে ঘুরতে যেও।”
–“নাহ, আমরা রাতেই ঘুরবো।”
নূর অর্নির কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,

–“চল না ইয়ার, বাসায় চলে যাই। দেখ ভাইয়া কিভাবে রেগে আছে। অন্যদিন যাবো পাক্কা।”
–“ঠিক আছে, তাহলে আমি বাসায় ফিরবো এক্ষুনি।”
অর্নির কথায় উৎসব পূর্ন দৃষ্টি মেলে তাকালো ওর দিকে। নূর অসহায় চোখে একবার অর্নির দিকে তাকাচ্ছে একবার উৎসবের দিকে তাকাচ্ছে। রুশান অর্নিকে বললো,

–“দোস্ত এই রাতের বেলা বাসায় ফিরে গেলে আন্টি আর অর্নব ভাই কি ভাববে বল? নেক্সট টাইম আমাদের বাসায় থেকে রাতে ঘুরতে বের হবো পাক্কা। আমার বড় ভাইও নাই বোনও নাই যে বাঁধা দিবে।”
অর্নি কিছু বললো না৷ চুপ করে রইলো। নূর উৎসবের হাত ধরে বললো,
–“ভাইয়া প্লিজ, আজকে একটু ঘুরে আসি?”
উৎসব অর্নির দিকে তাকিয়ে বললো,

–“ওয়েট কর, গাড়ি নিয়ে আসছি আমি।”
নূর খুশিতে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। অর্নি মিনমিন করে বললো,
–“গাড়িতে ঘুরে মজা নেই, রিকশায় ঘুরবো আমি।”
উৎসব ভ্রু কুঁচকে তাকালো অর্নির দিকে। রুশান অর্নির হাত চেপে ধরে বললো,
–“যেতে পারছিস এটাই অনেক অর্নি, এরপর কখন আবার মত পাল্টে যাবে আমাদের যেতে দিবে না এর সিয়রিটি নেই।”
নূর অর্নিকে বললো,

–“দোস্ত ভাইয়া রাজি হইছে এই অনেক। প্লিজ রিকশায় যাওয়ার কথা বলে আবার যাওয়া বন্ধ করে দিস না।”
অর্নি কিছু না বলে সম্মতি জানালো। উৎসব কিছু একটা ভেবে বললো,
–“ওকেহ, রিকশায় করেই যাবো।”
অর্নির খুশিতে চোখদুটো চিকচিক করে উঠলো। নূর খুশিতে ভাইকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বললো,
–“আমার ভাইটা দেখছি অর্নির মন খারাপ একদমই সহ্য করতে পারে না।”
উৎসব নূরের কথায় মুচকি হেসে বললো,

–“তোর ফ্রেন্ড তো সেটা বুঝে না রে নূর। কিভাবে বোঝাবো ওকে আমার চাই? শুধু আমার করেই চাই।”
–“তুমি হাল ছেড়ো না, একদিন ঠিক বুঝবে দেইখো।”
–“হ্যাঁ সেই দিনটা যেন আবার বড্ড বেশি দেরী না হয়ে যায়।”

অন্যমনস্ক ভাবে অর্নির দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল উৎসব। নূর ভাইয়ের কথা শুনে চমকে তাকালো ভাইয়ের দিকে। সত্যিই কি অর্নি বড্ড বেশি দেরী করে ফেলবে উৎসবের ভালোবাসাটা বুঝতে? নিজের মনেই প্রশ্নটা আওড়ালো নূর। উৎসব দুটো রিকশা থামালো৷ অর্নি একটাতে উঠে বসে রুশানকে ডাকলো বসার জন্য। রুশান যাওয়ার আগেই নূর রুশানকে টেনে অন্য রিকশায় উঠে পড়লো। উৎসব গিয়ে বসলো অর্নির পাশে। অর্নি রিকশা থেকে নেমে যেতে চাইলে উৎসব ওর একটা হাত চেপে ধরে বলে,

–“চুপচাপ বসো।”
–“আমি আপনার সাথে যাবো না উৎসব ভাই।”
অর্নি ভাই বলে ডাকাতে উৎসব চোখ রাঙিয়ে তাকালো। অর্নি মাথা নিচু করে বললো,
–“আপনি নূরের সাথে যান, এখানে রুশানকে পাঠান।”
–“আমি কোত্থাও যাচ্ছি না, আমার সাথে এক রিকশায় বসেই তোমার যেতে হবে।”
–“তাহলে আমিও কোথাও যাচ্ছি না।”

বলে অর্নি আবার নামতে গেলে উৎসব অর্নির কোমড় ধরে টান দিয়ে একদম নিজের সাথে লাগিয়ে নেয় অর্নিকে। ফলস্বরূপ অর্নি উৎসবের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠে৷ দাঁতে দাঁত চেপে উৎসব বলে,
–“ওই ছেলেকে জড়িয়ে ধরার সময় তো একবারো এদিক সেদিক তাকাওনি। কি সুন্দর ওই ছেলের বাইকে চেপে বসে বাড়ি চলে গেলে। তাহলে আজ আমার সাথে এক রিকশায় যেতে সমস্যা কোথায় তোমার?”
–“নিহাল ভাই আর আপনি এক না উৎসব ভাই৷ ও আমার কাজিন।”
–“আর আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

চমকে তাকালো অর্নি। উৎসব সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্নি মাথা নিচু করে বললো,
–“ছাড়ুন আমায়, সরে বসবো আমি।”
–“ছাড়ছি, নেক্সট টাইম যেন তোমাকে নিহালের বাইকে না দেখি আমি।”
–“ও আমার কাজিন, ওর সাথে আমাকে অবশ্যই দেখবেন। আপনার কথা শুনে চলতে বাধ্য নই আমি।”

কথাটা বলার সাথে সাথেই উৎসব অর্নির কোমড় জোরে খামচে ধরলো। নখ দিয়ে আঁচড় কাটলো অর্নির কমোড়ের ক্ষানিটা উপরে। জ্বলে যাচ্ছে জায়গটা। ব্যাথা পেয়ে মৃদু চিৎকার করে উঠলো অর্নি। চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। উৎসবের সেদিকে কোনো পাত্তা নেই। সেভাবেই অর্নিকে ধরে রেখে বললো,
–“এরপর নিহালের সাথে দেখলে পরিনাম আরো বেশি খারাপ হবে।”
কথাটা বলে হাত আলগা করলো উৎসব। আলতো ভাবে অর্নির কোমড়ে হাত রেখে অর্নিকে নিজের সাথে চেপে ধরে বসে রইলো উৎসব। অর্নি আর টু শব্দটাও করেনি৷ চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে।

একটা টং দোকানে এসে বসেছে চারজনে। অর্নি বেঞ্চের এককোনে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। কেননা ওর পাশ ঘেঁষেই উৎসব বসেছে। নূর আর রুশান ওদের অপজিট বেঞ্চে বসেছে৷ নূর মৃদু হাসছে ওর ভাইয়ের পাগলামি দেখে। অর্নিকে অনেকটা ভালোবেসে ফেলেছে কিনা। উৎসব সবার জন্য মালাই চা অর্ডার দিয়েছে। কিছুক্ষণ বাদে একটা ছেলে এসে সবাইকে চা দিয়ে গেলো। সবাই বেশ আয়েশ করেই চা খাচ্ছে। অর্নি আবারো চা মুখে নিতে গেলে উৎসব অর্নির কাপটা নিজে নিয়ে নেয়। এবং অর্নির হাতে ওর চায়ের কাপ ধরিয়ে দেয়। অর্নি ভ্রু কুঁচকে বললো,

–“আপনি আমার চা নিলেন কেন?”
–“আমারটা তো তোমাকেই দিয়েছি।”
–“আমার আপনার চা লাগবে না। আপনি আমারটা আমাকে ফেরত দিন।”
উৎসব অর্নির দিকে ঝুঁকে বললো,
–“আমার সবকিছুই তো তোমার।”

অর্নি নিরব থাকলো। এই কথার প্রত্যুত্তরে কি বলা যায় ভেবে পেলো না ও। উৎসব মুচকি হেসে অর্নির খাওয়া চা টা খেতে শুরু করলো। অর্নি চোখ বড়বড় করে দেখছে উৎসবকে। উৎসব অর্নিকে ওর চা ফেরত দিয়ে ইশারা করলো খাওয়ার জন্য৷ অর্নি জানালো খাবে না। উৎসব চোখ রাঙিয়ে তাকায়। অর্নি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। উৎসব অর্নির হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। ফিসফিস করে বললো,
–“আসার সময় কি করেছিলাম ভুলে গেছো? আমার কথার নড়চড় হলে কিন্তু তুমিই কষ্ট পাবে। চুপচাপ আমার কথা শুনো।”

অর্নির চোখ জলে ভরে উঠেছে। লোকটা ওর সাথে এরকম কেন করে? দুনিয়াতে এত মেয়ে থাকতে ওর পেছনেই কেন পড়লো ভাবার চেষ্টা করছে অর্নি। উৎসব তখনো গম্ভীর চোখে দেখছে অর্নিকে। তখন কোমড় খামচে ধরার কথা মনে পড়ে গেলো। এখনও ভীষণ জ্বলছে সেখানটায় বোধহয় চামড়া উঠে গেছে। অর্নি আর ওরকম কিছুর মুখোমুখি হতে চায় না বিধায় চা টা খেয়ে নিলো। উৎসব মুচকি হাসলো।

দোকান থেকে অর্নি আর নূর কোন-আইসক্রিম নিয়েছে। রুশান আর উৎসবের হাতে ক্যানের বোতল। অর্নি কিছু নিতেই চাইছিলো না, নূর জোর করেই আইসক্রিম দিয়েছে। আইসক্রিম খেতে খেতে নূর আর অর্নি একসাথে হাঁটছে। উৎসব আর রুশান ক্ষানিকটা পেছনে। আচমকা উৎসব এসে অর্নির হাত টেনে নেয়৷ অর্নি যেখানে বাইট বসিয়েছে উৎসবও ঠিক সেখান থেকেই এক বাইট আইসক্রিম নেয়৷ নূর মুচকি হাসলো ভাইয়ের কান্ডে। অর্নি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে উৎসবের দিকে। অর্নিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে উৎসব বললো,

–“ওভাবে তাকিয়ে থাকার কিছু নেই, তুমি তো আর দিবে না তাই জোর করেই নিতে হলো। মনে হচ্ছে নিজের জিনিস নিজেকেই আদায় করে নিতে হবে এখন থেকে।”
অর্নি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো৷ উৎসব বললো,
–“আচ্ছা নূর, আমি ওকে ভালোবাসি এটা জানার পর থেকে তোর ফ্রেন্ডের ডিমান্ড বেরে যাচ্ছে তাই না?”
নূর বললো,

–“মোটেও না। ও ডিমান্ড দেখানোর মতো মেয়েই না।”
–“তাহলে ও রাজি হচ্ছে না কেন? আচ্ছা তোর ফ্রেন্ডকে বল, রিলেশন করতে হবে না। বাসায় বিয়ের প্রপোজাল দিবো এতে রাজি হবে তো?”
–“নট ব্যাড।”
নূর আর উৎসবের কথা শুনে অর্নি দাঁড়িয়ে পড়লো। উৎসবের সামনে এসে বললো,
–“দেখুন__”
–“হ্যাঁ দেখছি, দেখাও।”

উৎসবের এমন কথায় নূর রুশান হেসে উঠলো। অর্নি চোখ রাঙিয়ে তাকালো দুজনের দিকে। তারপর উৎসবের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“ধ্যাত! আপনাকে কিছু বলাই বেকার।”
কথাটা বলে সামনের দিকে এগোতে লাগলো অর্নি। উৎসবও গেলো ওর পেছনে। অর্নির হাত স্পর্শ করতেই অর্নি দ্রুত হাত সরিয়ে চোখ রাঙিয়ে তাকালো উৎসবের দিকে৷ উৎসব হেসে বললো,

–“তোমার রাগী চোখের চাহনি দেখলেও আমি নতুন করে প্রেমে পড়ে যাই অর্নি। প্লিজ #তুমি_শুধু_আমারই_হও না? অনেএএএএক ভালোবাসা দিবো তোমায় প্রমিস।”
–“লাগবে না আপনার ভালোবাসা। যারা আপনার জন্য পাগল তাদের মধ্যে কাউকে আপনার ভালোবাসা দিন।”
–“সত্যি তো? আমি যদি তোমার সামনেই অন্যকাউকে ভালোবাসি, অন্য কারো হাত ধরে ঘুরে বেরাই কষ্ট হবে না তোমার?”

তুমি শুধু আমারই হও পর্ব ১১

অর্নি হাঁটা থামিয়ে শান্ত চোখে তাকালো উৎসবের দিকে। তারপর লম্বা একটা শ্বাস ফেলে কিছু না বলে আবারো সামনে এগোতে লাগলো৷ অর্নির ওরকম শান্ত চাহনি দেখে উৎসব মুচকি হাসলো।

তুমি শুধু আমারই হও পর্ব ১৩