কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২৫

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২৫
লেখায় নামিরা নূর নিদ্রা

“ভালোবাসার বিয়ে ছিল আমাদের। আহনাফ পরিবারের সবার আদরের ছেলে ছিল। ছোট থেকেই সব ভাই-বোনের থেকে ওকে বেশি ভালোবাসা দিত সবাই। এই নিয়ে বাকি ভাই-বোনদের রাগের সীমানা ছিল না। বিয়ের পর প্রায়ই দেখতাম আহনাফের বড়ো বোন আর দুই ভাই আহনাফের সবকিছু কেড়ে নিত। আহনাফ কিছু বলত না। চুপ করে থাকত। আমিও কিছু বলতাম না। কারণ আমাদের কম কিছু ছিল না। তাই অল্পস্বল্প নিলে আমাদের আহামরি ক্ষতি হবে না।

কিন্তু বিপত্তি বাঁধে তখন, যখন আহনাফ ধীরে ধীরে অনেক অসুস্থ হয়ে যায়। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর ডাক্তার বলেছিল ওকে নাকি আগে থেকেই এমন কিছু খাওয়ানো হচ্ছে অল্প অল্প করে যার জন্য ওর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এক পাতায় এতটুকুই লেখা ছিল। কুয়াশা পাতা উল্টিয়ে আবার পড়তে শুরু করে।
“আজ এক চরম সত্যের মুখোমুখি হয়েছি আমি। বাড়ির বাইরে বাগানের ধারে আহনাফের তিন ভাই-বোনের কথা শুনে আমি স্থির থাকতে পারছি না। আহনাফকে তারা ইচ্ছা করে মৃ ত্যু র দিকে ঠেলে দিয়েছে। কেন না আমার শ্বশুর আর শাশুড়ি মা রা যাওয়ার আগে আহনাফের নামে যেটুকু সম্পত্তি লিখে দিয়ে গিয়েছে সেই সম্পত্তি দরকার তাদের।

আমি তো আগেই জানতাম ওরা আহনাফকে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু তার জন্য এমন করবে তা আমি ভাবিনি। দুর্ভাগ্যবশত ওরা আমাকে ওদের কথা শুনতে দেখে নেয়। আমি ছুটে গিয়ে আহনাফকে সব বলে দিই। আমার বলা শেষ হওয়ার আগেই আমার ভালোবাসার মানুষটা আমার সামনে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। এরপর আমার হাত ধরে বলে ওঠে, আমাদের সন্তানদের নিয়ে বহুদূরে চলে যাও। ওদেরকে বাঁচাও আর্শিয়া। আর কিছু বলতে পারেনি সে। নিজের স্বামীর মৃ ত্যু নিজের চোখে দেখেছি আমি। ওরা আমার স্বামীকে মে রে শান্ত হয়নি। আমাকে আর বাচ্চাদেরও মা র তে চেয়েছে। আমি কোনো রকমে পালিয়ে বেঁচেছি।”

আর কিছু পড়ার শক্তি হয় না কুয়াশার। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠেছে। চোখ থেকে পানি পড়ছে অনর্গল। পৃথিবীতে এমন মানুষও হয়? এ যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না সে। আজ তার একটা কথা ভীষণ বলতে ইচ্ছা করছে,
“পৃথিবীতে ভাই-বোনের সম্পর্ক ততদিনই সুন্দর, যতদিন তাদের মধ্যে লোভ জন্ম না নেয়!”
আবারো পাতা ওল্টায় সে। পড়তে শুরু করে পুনরায়।

“বাচ্চাদের নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কিন্তু আর কতদিন? এবার আমার কিছু একটা করতে হবে। অন্তত বাচ্চাদের বাঁচাতে হবে। আমি বাঁচব কিনা জানি না। এমনিতেও আমি তো মনের দিক থেকে সেদিনই ম রে গিয়েছি যেদিন নিজের চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষকে খু ন হতে দেখেছি। সেটাও কিনা আপন মানুষদের হাতে। আমি জানি ওরা আমাকে বাঁচতে দিবে না। কারণ ওদের সকল পাপকর্মের কথা আমি জানি। এমনকি ওদের খু ন করার দৃশ্য আমার কাছে আছে। সেদিন সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ করতে তারা ভুলে গিয়েছিল। তাই সব প্রমাণ আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি।”
কুয়াশা প্রমাণের কথা শুনে চমকে যায়। সমস্ত প্রমান তার মানে আর্শিয়ার কাছে ছিল। কিন্তু কোথায়? সেই মুহূর্তে কুয়াশার চোখে পড়ে একটা ধাঁধা। এবং তার নিচে লেখা,

“এই ধাঁধার মধ্যেই উত্তর লুকিয়ে আছে। প্রমাণ কোথায় আছে সেটা এখানেই লেখা আছে।”
দেখতে দেখতে শেষ পাতায় চোখ বুলায় কুয়াশা। শেষ পাতায় শুধুমাত্র একটা বাক্য লেখা।
“আমার স্বামীর খু নি দের যেন উপযুক্ত শাস্তি হয়। তবেই আমার আ ত্মা শান্তি পাবে।”
আর কিছু লেখা নেই। ডায়েরির পরের পাতাগুলো একদম ফাঁকা। কুয়াশা ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নেয়। তার কাছে এখনো সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগছে। মানুষ কি সত্যিই এতটা নিচে নামতে পারে? মনুষ্যত্ব আজ কোথায়? এটাই কি তবে পবিত্র সম্পর্কের বন্ধন?

আর কিছু ভাবতে পারে না সে। ফোনের রিংটোনের শব্দ পেয়ে কুয়াশা ফোন হাতে নেয়। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নাম দেখে খানিকটা অবাক হয় সে।
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছিস বোন?”
তিন্নির ভেজা কন্ঠস্বর শুনে কুয়াশা পাল্টা প্রশ্ন করে,
“কী হয়েছে? আর তুমি আমাকে কল দিয়েছ কেন?”

“আমার সংসার ভেঙে যাচ্ছে কুয়াশা। জানিস? আমি একটুও ভালো নেই। আমার সংসারটা তুই বাঁচা বোন। আমি জানি একমাত্র তুই পারবি কিছু একটা করে আমার সংসারকে বাঁচাতে।”
এমন কথা শোনার জন্য বেচারি মেয়েটা একদম প্রস্তুত ছিল না। তিন্নির কথাগুলো তার বোধগম্য হতেই অনেকটা সময় লেগে গেল।

“মানে কী? কী বলছ এসব? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”
“ফয়সাল আমাকে আগের মত আর ভালোবাসে না। সে আমার দিকে ভালো করে তাকায় না পর্যন্ত। আমি একা হাতে সব সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। আর পারছি না এভাবে চলতে।”
কুয়াশা মনে হয় তিন্নির কথায় ভারি মজা পেয়েছে। কিছুটা ব্যাঙ্গাত্মক স্বরেই বলে,
“এত মধুর প্রেম জানালা দিয়ে পালিয়েছে বুঝি? মৌমাছি কি এখন অন্য ফুলে মধু খুঁজতে গিয়েছে নাকি?”
“তুই মজা নিচ্ছিস? অবশ্য আমি তোর সাথে যা করেছি তাতে করে তোর রাগ করে থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তোর রাগ তো আমার উপর। আমাদের বাচ্চার উপর তো রাগ নেই। ওও তো তোর মেয়ের মত তাই না? আমার সংসার ভেঙে গেলে আমাদের মেয়েটা বাবা-মায়ের সমান ভালোবাসা পাবে না। আমরা আলাদা হয়ে গেলে ওর কী হবে বল? ওর কথা ভেবে হলেও আমাকে সাহায্য কর। দরকার হলে তুই যা বলবি আমি তাই করব। কিন্তু খালি হাতে আমাকে ফিরিয়ে দিস না বোন।”
কুয়াশা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,
“ঠিক দুর্বল জায়গায় আঘাত দিলে। জানো আমি বাচ্চাদের অনেক ভালোবাসি। সেটারই সুযোগ নিলে তুমি। যাইহোক, বলো কী করতে হবে আমাকে?”
কুয়াশার এহেন কথায় তিন্নি খুশিমনে উত্তর দেয়,
“তুই এমন কোনো বুদ্ধি দে আমাকে যাতে করে ফয়সাল আগের মত আমাকে ভালোবাসে। ওর ভাষ্যমতে আমার সৌন্দর্য আগের মত নেই। তাই আমার কাছে আসার আগ্রহ জন্মায় না ওর মধ্যে।”

“জটিল সমস্যা। তা দেখা করতে পারবে একদিন? ফোনে এতকিছু বলা সম্ভব না। আর আসার সময় আমার মনি মা’কে নিয়ে এসো। জন্মের পর একদিনই দেখেছিলাম। তারপর আর দেখার সৌভাগ্য হয়নি।”
“আচ্ছা। আমি আগামীকাল তোর সাথে দেখা করব। তুই বগুড়াতেই আছিস তো?”
“হ্যা। আগামী পরশু ঢাকায় ফিরব।”
“ঠিক আছে। বাবু কাঁদছে। আমি এখন রাখি?”
“মানা করেছি নাকি আমি?”

অপর পাশ থেকে আর কোনো উত্তর আসে না। কল কে টে গিয়েছে। কুয়াশা ফোন একপাশে রেখে আনমনে ভাবে,
“একেই বুঝি নিয়তি বলে? যে বোনের জন্য আমার জীবনের সমীকরণ এত জটিল হয়ে গেল আজ তার জীবনও একই পথের দিকে ধাবিত হচ্ছে। স্বামী সুখ না পেলে কেমন লাগে এটা এখন আমার বোনও অনুভব করতে পারছে। আচ্ছা, আমার সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি কি তবে পেতে শুরু করেছে সে? তাই হবে হয়তো। নিরব প্রতিশোধ তো এটাকেই বলে!”

এদিকে তুরাব বেচারা বউ হারানোর শোকে একদম ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছে। সারাদিন মদ নিয়ে বসে থাকা ছেলেটার এখন উচিত ছিল নিজেকে দেবদাস বানিয়ে ফেলা। কিন্তু সে তা না করে শয়তানি বুদ্ধি বের করছে তার অলস মস্তিষ্ক থেকে। যে মস্তিষ্ক থেকে কখনো ভালো কোনো বুদ্ধি বের হয় না। হবে কী করে? মানুষটা তো নিজেই আস্ত একটা শয় তা ন। তার মস্তিষ্কে থাকা বুদ্ধিগুলোও এমনই হবে স্বাভাবিক। বদ্ধ ঘরে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে বিরবির করে যাচ্ছে।

“কুয়াশা আমি তোমাকে ছাড়ব না। আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছ তুমি। জীবনে প্রথম কাউকে মন থেকে একটু ভালোবাসতে চাইলাম। আর সেই কিনা আমাকে একলা ফেলে চলে গেল। এই মেয়ে শোনো, তোমার না কখনো ভালো হবে না। একদম ভালো হবে না।”
আচ্ছা শকুনের দোয়ায় কী গরু ম র বে? থুক্কু তুরাবের এমন বদদোয়ায় কী কুয়াশার কোনো ক্ষতি হবে?

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২৪

বিঃদ্রঃ সবার কাছে আমার একটা মাত্র প্রশ্ন। কুয়াশাকে কোনদিক থেকে ন্যাকা মনে হয়? অনুগ্রহ করে আমাকে একটু বলবেন। কারণ এমন মন্তব্য আমি কুয়াশার জন্য আশা করিনি। দ্বিতীয়ত আমার গল্পটা ঠিক কোন দিক থেকে সিনেমা লাগে? দ্বিতীয় বিয়ে না করা এবং অন্যের বাচ্চাকে নিজের বাচ্চার মত আগলে রাখা সিনেমা? আচ্ছা আপনারা কী পুরো বিশ্ব দেখে নিয়েছেন? আমি অবশ্য দেখিনি। কিন্তু আমি আমারই এক মামা এবং মামিকে দেখেছি। যারা অন্যের বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা ভেবে মানুষ করছে। আমি এমনও মেয়ে দেখেছি যে একজনকে ভালোবেসে তাকে না পেয়ে কোনোদিন বিয়েই করেনি। আমি গল্পটা আমার মন থেকে লিখছি। এবং লেখার আগে নিজেকে প্রশ্ন করি, এমন পরিস্থিতিতে আমি থাকলে কী করতাম? আসলে আমি কুয়াশার মতোই করতাম। এখন আমি তো কুয়াশা নই। তাই বলতে পারছি না যে এটা আমি। তবে এটুকু বলতে পারি, পৃথিবীতে সবার চিন্তাধারা এক রকম হয় না। কুয়াশার মত চিন্তাধারা আপনার না হতে পারে। কিন্তু অন্য কারোর ভাবনা এমন হতেই পারে। সুতরাং “এটা বাস্তব নয়” এমন মন্তব্য করার আগে এটা ভাববেন যে পুরো বিশ্বে একেক জনের চিন্তাভাবনা একেক রকম। সুতরাং এমন কুয়াশা বাস্তবে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২৬