বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১১

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১১
জাওয়াদ জামী

তাহমিদ খাবার পর আনানকে ফোন করে।
” হ্যাঁ ভাই, বল। ফোন দিয়েছ যে? আমাকে মিস করছিলে বুঝি! ”
” তোকে মিস করার কোন কারনই দেখছিনা। আমি তোকে এটা জানাতে ফোন দিয়েছি, সিনিয়র রাশেদিনের সাথে কথা হয়েছে। সে তোর মু’ন্ডু তার ভুঁড়িতে ঘষতে দিতে রাজি হয়েছে। সে আরও বলছে, তার ছোট মেয়ের বিয়েতে তোকে যেন দুই পিস রোস্ট, আর এক প্লেট বিরিয়ানি বেশি দেয়া হয়। পুষ্টিকর খাবার না পেয়ে তুই নাকি উচ্ছন্নে গেছিস। রোস্ট আর বিরিয়ানি খেলেই তোর পুষ্টির অভাব পূরণ হবে। ”

” তোমার সিনিয়রকে বলে দিও, আমার পোলাপানের মুসলমানিতে তার সাথে তোমাকেও দুইটা ডিমের ভুনা বেশি দিব। হাজার হোক আমার একটাই শ্বশুর হবেন তিনি। তার তুমি আমার বউয়ের ঘারত্যাড়া ভাই। তোমাদের আপ্যায়ন না করলে আমার পাপ হবে পাপ। ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” আজকাল দিবাস্বপ্ন একটু বেশিই দেখছিস মনে হয়! নাকি ভেষজ সেবন করেছিস? তোর বোনের জ্বা’লা’য় অন্যের ঘুম উবে গেছে। আর তুই পাপিষ্ঠ কিনা আমার বোনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিস! অন্যায় ঘোর অন্যায়। আমার রাতের ঘুম হারাম করে তুই দিবাস্বপ্ন দেখবি এটা হতে পারেনা। তোর আগামি একমাসের ঘুম হারাম করার ব্যবস্থা আমি করছি। ওয়েট অ্যান্ড সি। ”

” ভাই ও ভাই, এমন করে বলেনা। আমি নিষ্পাপ একটা বাচ্চা। তোমার বোনের একটামাত্র হবু জামাই। তোমার দুই হালি ভাগ্নে-ভাগ্নীর একটাই অবলা বাপ। আমাকে যত আটকাবে ততই তোমার দুই হালি ভাগ্নে-ভাগ্নীকে পাওয়ার আশা ক্ষীণ হবে। তুমি ডক্টর মানুষ এসবতো আর তোমাকে ভেঙে বলতে হবেনা। আমি আগে তোমার ভাগ্নে-ভাগ্নীকে দুনিয়ায় নিয়ে আসি, তারপর তোমার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করে দিব। ভাগ্নে-ভাগ্নীসহ তোমার বাসর হবে। তোমার বিয়েতে এটাই হবে আমার তরফ থেকে গিফ্ট। গিফ্টটা খুব ইউনিক হবে তাইনা? আজ পর্যন্ত এমন গিফ্ট কেউ কাকে দেয়নি বোধহয়? ”

” আচ্ছা, দেখছি কে, কাকে আগে গিফ্ট দেয়। তবে আমার গিফ্ট পেয়ে তুই যে কাঁদবি, এটা নিশ্চিত থাক। তোর জন্য সর্বকালের সেরা ইউনিক গিফ্ট নিয়ে আমি হাজির হব তোর বিয়েতে। সেই দিনের অপেক্ষা কর, আনান। ”
তাহমিদ ফোন রেখে দিতেই আনানের মুখ চিন্তায় কালো হয়ে যায়। ও ভালো করেই জানে তাহমিদ ওর সাথে কি করতে পারে।

” বোকা আনান, তুই গ’র্দ’ভ। কেন ঐ ঘাড়ত্যাড়া ডক্টরের সাথে এভাবে কথা বলতে যাস! জানিসিই তো সে কোন লেবেলের ত্যাড়া। ও যদি একবার তোর আর সিক্তার মাঝে বাগড়া দেয়, তবে কোনদিনই তুই সিক্তাকে পাবিনা। ঐ পাগলকে কেন বারবার ক্ষেপিয়ে দিস? ” আনান নিজের কপাল চাপড়াচ্ছে। আগামী সাতদিন ও ব্যস্ত থাকবে। ‘ কুঞ্জছায়া’য় এই কয়দিন আর যাওয়া হবেনা।
কায়েস বাড়িতে ফিরে শিউলিকে জিজ্ঞেস করে মেম্বারের কথা।

” জমির উদ্দিন মেম্বার কি আমাদের বাড়িতে এসেছিল? ”
কায়েসের গম্ভীর মুখ দেখে শিউলি একটু ভয় পায়। ও কি উত্তর দিবে ভেবে পায়না। আবার মিথ্যা বলারও সাহস পায়না। যেহেতু কায়েস মেম্বার চাচার কথা জিজ্ঞেস করেছে, সেহেতু সে জেনে গেছে আজ মেম্বার চাচা এসেছিল।
” কথা বলছনা কেন? আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি, শুনতে পাওনি? ”
” হ, আইজ মেম্বার চাচা আইছিল। ”

” কেন এসেছিল? তোমাকে আপারা নিষেধ করে দেয়নি, যাতে মেম্বার বাড়িতে ঢুকতে না পারে? তোমার আপাদের নির্দেশ অমান্য করার সাহস হয় কেমন করে? কেন এসেছিল সে? ” এবার আরেকটু কঠোর শোনায় কায়েসের গলা।
” এম্নেই, গল্প করবার আইছিল। ”

” তুমি এই গ্রামে এসেছ একমাস হলো। এই কয়দিনের মধ্যেই তোমার মেম্বারের সাথে তোমার কি এমন সম্পর্ক হল যে, সে তোমার কাছে গল্প করতে আসল? তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ, আমি বা আপারা তোমাকে যেগুলো নিষেধ করব, তুমি সেই কাজই করবে? তবে তুমি ভুল করবে। যদি নিজের পায়ে কু’ড়া’ল মা’র’তে চাও, তবে আমাদের নিষেধ অমান্য করতেই পার। তা তোমার মেম্বার চাচার সাথে কি গল্প করেছ দেড় ঘন্টায়। ”

এবার শিউলি ভয় পায়। সে কায়েসের কথার উত্তর দিতে ভয় পাচ্ছে।
” চাচা, একটা কামে আইছিল। ” ভয়ে ভয়ে বলে শিউলি।
” তোমার সাথে তার কি এমন কাজ আছে? যে আমার অবর্তমানে সে এই বাড়িতে আসে? আজ যদি তুমি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাও, পরে যদি আমি সেটা জানতে পারি, তবে তোমার নিস্তার নেই। ”

শিউলি মহাফাঁপড়ে পড়েছে। তবে ওর মন বলছে, কায়েসের কাছে কিছু না লুকানোই বোধহয় ওর জন্য মঙ্গল হবে।
” চাচায় আমার মা আর ভাইয়ের লাইগা কিয়ের যানি কার্ড কইরা দিবার চাইছে। আর আইজকা পাঁচ হাজার ট্যাকা দিয়া গেছে। প্রতিমাসেই হেয় নাকি ট্যাকা দিব। ”
শিউলির কথা শোনামাত্রই কায়েসের মাথায় আ’গু’ন জ্ব’ল’তে শুরু করে। সে রাগের চোটে শিউলির গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়।

” তোমার এত লোভ! তুমি আমার সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে মেম্বারের কাছ থেকে টাকা নিয়েছ? আমি বাড়িতে এসেছি, তুমি আর কয়টা দিন দেখতে, আমি তোমার মা’কে সাহায্য করি কিনা। মির্জাপুর থাকতে আমার মেয়েটা ঐ ছোট চাকরি করেও তোমার মা’কে প্রতিমাসে কিছুনা কিছু টাকা দিয়েছে। কিন্তু তুমি এখানে এসে আমাকে সেই সুযোগ না দিয়েই মেম্বারের কাছ থেকে সাহায্য নিলে? লোভী মেয়েমানুষ। আমি জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল করেছি তোমাকে বিয়ে করে।

ভেবেছিলাম তুমি গরীব ঘরের মেয়ে আমার সংসারকে ভালোবাসবে। আমার মা হারা মেয়েটাকে আদরযত্নে আগলে রাখবে। কিন্তু তুমি সব সময়ই তার উল্টোটা করেছ। আমিও অসহায় চোখে সব দেখে গেছি। আমার প্রতিবাদে পাছে যদি তুমি আমার মেয়ের কোন ক্ষতি কর, সেই ভয়ে মুখ রেখেছি। এতদিন চুপ থেকেছি বলে ভেবনা আমি এখনও চুপচাপ সব সহ্য করে যাব। তোমার কোন অন্যায় দেখলে লা’থি মে’রে বাড়ি থেকে বের করে দিতে আমি দুইবার ভাববনা। মনে রেখ মির্জাপুরে আমি একা ছিলাম, আর এখানে আমার সবাই আছে।

তুমি ভুল করেও আমার পরিবারের সম্মান নিয়ে খেলার কথা ভেবনা। আর আমার মা হারা মেয়েটাকেও কটুকথা বলার আগে ভেবে নিও এর ফল কি হতে পারে। যদি নিজের ভালো চাও, তবে এরপর মেম্বার বাড়িতে আসলে তুমি তাকে টাকা দিবে। কিন্তু দেখবে ও যেন বাড়িতে ঢুকতে না পারে। ”
শিউলি কায়েসের থাপ্পড় খেয়ে হতবাক হয়ে গেছে। ও কল্পনায়ও কোনদিন ভাবেনি কায়েস ওর গায়ে হাত তুলবে! তার ওপর আবার বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। তাই ও মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, টাকাগুলো সে ফিরিয়ে দিবে। আগে নিজের সংসার তারপর অন্য কিছু ভাবা যাবে।

রাত বারোটা পঁচিশ। অনেকক্ষণ যাবৎ বই নিয়ে বসে থেকে কুহুর মাথা কেমন ঝিম ধরেছে। এই মুহূর্তে ওর ছাদে যেতে ভিষণ ইচ্ছে করছে। ওর ইচ্ছের কথা সিক্তাকে জানালে, সিক্তা যেতে চায়না। ওর ঘুম পেয়েছে তাই ও ঘুমাবে।
কি আর করা। বাধ্য হয়ে কুহু একাই ছাদে যায়।
আকাশে থালার মত চাঁদ উঠেছে। কি উজ্জ্বল তার কিরণ! রুপোলী আলোয় ধরনী উদ্ভাসিত হয়েছে। চাঁদের আলো গেয়ে মেখে ধরনী যেন লজ্জায় রাঙ্গা বধূর ন্যায় মাথা নুইয়ে আছে। গাছগাছালিরা যেন নিরব সঙ্গীতের সাথে তাল মিলিয়ে নৃত্য করছে। হঠাৎ হঠাৎই রাতচোরা পাখিরা কোথাও ডেকে উঠছে। ঝিঁঝিঁ পোকার দল সমস্বরে ডেকেই চলেছে। আজকের রাতটা যেন একটু বেশিই সুন্দর।

কুহু ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। শীতল মলয় এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে ওর সর্বাঙ্গ। আশেপাশে কি কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে! আজকের মলয়ে যেন বৃষ্টির ঘ্রান! চোখ বন্ধ করে কুহু বৃষ্টির ঘ্রান নিতে ব্যস্ত। কতদিন হয়ে গেল বৃষ্টিতে ভিজেনা। আজ রাতে যদি একটিবার বৃষ্টি হত, তবে ও নিশ্চয়ই ভিজত।
হঠাৎই একটা গন্ধ বাতাসে ভেসে কুহুর নাকে এসে লাগে। কুহু ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করছে গন্ধটা কিসের? ওর মনে হচ্ছে এই গন্ধটা ওর পরিচিত। কিন্তু অনেকবার চেষ্টা করেও বুঝতে পারেনা।

ও এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে এবার চুল খুলে দেয়। বাতাসের জোর একটু বেড়েছে। চুল খুলে দিতেই বাতাসের তোড়ে তারা অবাধ্যের মত এদিকসেদিক এলোমেলো উড়তে থাকে। অবশ্য কুহু তাদের বাঁধা দেয়ার কোন চেষ্টাই করেনা। একরাশ হেসে উপভোগ করতে থাকে চাঁদনি রাতের সৌন্দর্য।

শ্যামলা মুখটা চাঁদের আলোয় ঝলকাছে। কুহুর থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাহমিদ অপলক দেখেই চলেছে তার শ্যামাকন্যাকে। তার মুখে চুলগুলো এসে এলোমেলোভাবে বাড়ি খাচ্ছে। বন্ধ চোখ অথচ তার মুখে মিষ্টি হাসি। আলতো করে মুখ থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছে। যেন খুব খুশির সাথে কাজটা করছে সে। ঐ মুখে বিরক্তির কোন রেশটুকুও নেই।

” উফ্, এই মেয়ে আমাকে আরও কতভাবে পাগল করবে! সারাদিন পাগল করেও শান্তি হয়নি। এই রাত-বিরেতেও পাগল করতে প্রস্তুত হয়ে আছে! আমি ওকে কি করে বোঝাই, ওর উপস্থিতিই যেখানে আমার জন্য শ্বাসরুদ্ধকর, সেখানে ওকে খোলা চুলে এভাবে দেখেতো আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে। শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকা পাগলা ঘোড়ার মত ছুটছে। তাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে ভিষণ। তার ছোঁয়াই একমাত্র পারে আমাকে শান্ত করতে। ”

অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে কুহুর দিকে এগিয়ে আসে তাহমিদ।
” রাতজাগা পাখি, তুমি এত রাতে ছাদে এসেছ কেন? চারপাশ যখন ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন তুমি কেন অন্যের ঘুম হা’রা’ম করতে চাও! তুমি কি জানো, তুমি ঘুমালেই তবে কেউ একজন শান্তিতে ঘুমাবে? ঘুমের বৃষ্টি হয়ে কারও চোখে নামতে পারনা? ভাসাতে পারনা তাকে প্রনয়ের মহা সমুদ্রে? সে যে ভাসতে চায় তোমার প্রনয়ের সরোবরের অতল তলে। সে তার পূর্ণতা খোঁজে তোমাতেই। ”

কুহু নিজের পাশে কারও অস্তিত্ব টের পেয়ে চমকে তাকায়। পরক্ষণেই দেখতে পায় তাহমিদকে। আর তখনই বুঝে যায় সেই গন্ধের উৎস কি। এতক্ষণ সে তাহমিদের পারফিউমের গন্ধ পেয়েছে।
নিজের এত কাছে কাউকে দেখে ঘাবড়ে যায় কুহু। তাহমিদের নেশা ধরানো গলা শুনে একটু থমকায়। কি বলতে চাইছে সে! কিন্তু তাহমিদের কথার কোন জবাব দিতে মন চাইলনা।

হঠাৎই একগাছা চুল উড়ে এসে লুটোপুটি খায় তাহমিদের মুখ আর বুকে। প্রথমে একটু চমকালেও পরে তাহমিদ বেশ উপভোগ করছে তার শ্যামাকন্যার চুলের পরশ। কুহু বুঝতে পেরেই চুলগুলো সরিয়ে নিয়ে হাত খোঁপা করে।
” তোমাকে চুলগুলো বাঁধার অনুমতি দিইনি, রাতজাগা পাখি। তাদেরকে বাঁধন থেকে মুক্ত কর। উড়তে দাও মনের সুখে। কেউ একজন তাদের ছোঁয়া পেতে ছটফট করছে। তার হৃদয়কে শীতল কর এই শীতল রাতের ন্যায়। ”
” আমি আসছি। ” কথাটা বলেই কুহু চলে যেতে চাইলে তাহমিদ কুহুর হাত ধরে আটকে দেয়।
” আমি আসায় বিরক্ত হচ্ছ? আসলে আমারও ঘুম আসছিলনা তাই ছাদে এসেছিলাম। কিন্তু আমি আসায় তোমার বোধহয় অসুবিধা হল? ”

এবার কুহুর লজ্জা পাওয়ার পালা।
” না ঠিক তেমনটা নয়। আসলে অনেকক্ষণ যাবৎ এখানে আছি তাই। ”
” অনেক সময় থাকলেই যখন, আরেকটু সময় থাকতে দোষ কোথায়! বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। বৃষ্টি না আসা পর্যন্ত অন্তত থাক। একটু গল্প করি। ” তাহমিদের গলায় আকুলতা স্পষ্ট।
কুহু ভাবছে মানুষটার সাথে ওর আজকেই দেখা অথচ সে কুহুর ওপর কোননা কোন ভাবে অধিকারবোধ দেখাচ্ছে! এটা কি শুধুই সম্পর্কের সমীকরণ নাকি অন্য কিছু?

” এত রাতে আমাদের একসাথে দেখলে কেউ কিছু ভাবতে পারে। ” কুহুর সরল স্বীকারোক্তি।
তাহমিদ মৃদু হেসে দিগন্তে তাকায়।
” জানো, আজকাল নিজেকে কেমন যেন বেসামাল লাগে। প্রায় একমাস দশদিন আগে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে একটা ক্লিনিকের সামনে সাদা সালোয়ার কামিজ পরা একটা শ্যামবর্নের মেয়েকে দেখেছিলাম। সেদিন শুক্রবার ছিল। মেয়েটা বাজারের ব্যাগ হাতে যাচ্ছিল। মাথায় ওড়না দেয়া থাকলেও ওড়নার নিচ দিয়ে চুলের বেনি ঠিকই উঁকি দিচ্ছিল। একটু পর পরই সে ওড়নার কোনা দিয়ে মুখ মুছছে। এমন দৃশ্য আমার হৃদয়ে কাঁপন ধরায় সেদিন। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেই থেকে আমার রাতজাগা শুরু। ভেবেছিলাম তাকে খুঁজতে আবার সেখানে যাব। কিন্তু তার আগেই সিঙ্গাপুর যেতে হল। তাকে আর খোঁজা হলোনা। ”

কুহু ভাবছে মানুষটা এসব কি এলোমেলো বকছে! কিন্তু সে মির্জাপুর গিয়েছিল! সেখানে কাকে দেখছে? তার বর্ননার মেয়েটার সাথে নিজের বড্ড মিল পাচ্ছে কুহু।
” জানো রাতজাগা পাখি, তার হাতে চিকন একজোড়া পাথরের চুড়ি ছিল। তীব্র রোদে সেই পাথরগুলো চমকাচ্ছিল। তার ঘামে ভেজা মুখ দেখতে বড্ড আদুরে লাগছিল। মনে হচ্ছিল তাকে একটু ছুঁয়ে দিই। তার নাকের ডগায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু রুপোর মত ঘাম মুছিয়ে দিই পরম যত্নে। ”

” আমাকে এসব বলছেন কেন! আমি যাই। ”
এবার আর তাহমিদ কুহুকে আটকায়না।
কুহু ছাদের দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে।
” এভাবে চলে যাচ্ছ, রাতজাগা পাখি! তার কথা আরেকটু শুনে গেলেনা। তার বাম হাতে থাকা এ্যাশ কালারের পার্সটা কিন্তু খুব পছন্দ হয়েছে আমার। পার্সের হালকা নীল রংয়ের ডোরাকাটা দাগটা আমার চোখে এখনও লেগে আছে। ”
এবার কুহুর পা থেমে যায়। থমকায় ওর হৃৎস্পন্দন। সেই এ্যাশ কালারের পার্সে হালকা নীল রংয়ের ডোরাকাটা দাগটা যে ওরই পার্সে আছে! সেই চিকন পাথরের চুড়িজোড়াও যে ওর!

কুহু ঘাড় ঘুরিয়ে তাহমিদের দিকে তাকায়। সে তখনও দিগন্তে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু কুহুর তাকে প্রশ্ন করার সাহস হয়না।
” এপ্রিলের আঠারো তারিখ, শুক্রবার ছিল সেদিন। দুপুর একটায় ঝুমুর ক্লিনিকের নিচে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। রাস্তার অপর পাশের মুদিখানা দোকানের সামনে জ্যামের কারনে দাঁড়িয়ে ছিল সে। ঠিক তখনই আমি মন হারিয়েছিলাম সেই কৃষ্ণময়ীর মায়ায়। সে আমার, সে একান্তই আমার শ্যামাকন্যা। আমার স্বপ্নময়ী, আমার রাতজাগা পাখি সে। ”

কুহুর আর বুঝতে বাকি থাকেনা তাহমিদ কার কথা বলছে। এ-ও কি সম্ভব! তার মত একজন ডক্টর, কুহুর মত সামান্য মেয়ের মাঝে মন হারিয়েছে! কুহুর একটা হার্টবিট মিস করে যায়। প্রায় এক দৌড়ে সে নিচে নামে। রুমে যেয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়৷

” আমার রাতজাগা পাখি, আমি নিজের বিষয়ে বড্ড স্বার্থপর। আর তোমার বেলায়তো সেটা আরও বেশি। আমি তোমাকে হারাতে চাইনা। তাই দেরি না করেই একটু জানালাম। এরপর ধীরে ধীরে সবাই জানবে। তোমাকে পাওয়ার ক্ষেত্রে দেরি আমার সইবেনা। এমনিতেই অনেক বসন্ত পেরিয়ে গেছে। আরেকটা বসন্ত আসার আগেই তোমাকে আমার চাই। সেই বসন্ত দুজন মিলে উদযাপন করব। ” তাহমিদের ঠোঁটে ঝুলছে স্নিগ্ধ হাসি।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১০

কুহু রুমে এসে বিছানায় শুয়ে পরে। ওর মন-মস্তিস্কে কেবল তাহমিদের বলা কথাই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আরও একমাস আগে থেকেই তাহমিদ ওকে চিনত ! ওর সেদিনের খুঁটিনাটি সব তাহমিদ মনে রেখেছে! এটা কিভাবে সম্ভব! তার মত একজন মানুষ কুহুর মত একটা সামান্য মেয়েকে মনে রেখেছে! আবার ওকে নানান নামে ডাকছে! কুহুর কাছে এসব কিছু অবিশ্বাস্য ঠেকছে।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১২