বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১২

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১২
জাওয়াদ জামী

সারারাত কুহু দুচোখের পাতা এক করতে পারেনা। ওর বারবার তাহমিদের বলা কথাগুলো মনে হচ্ছে। মানুষটা কি ওর সাথে মজা করেছে! নাকি তার কথাগুলো সত্যিই ছিল!
ফজরের নামাজ আদায় করে একটু ঘুমায় কুহু। কিন্তু ঘুম থেকে উঠার পর নিচে যাওয়ার সাহস পায়না। কাল ফুপুর কাছ থেকে শুনেছিল, তাহমিদ বাসা থেকে সকাল নয়টায় বের হয়। এখন বাজে আটটা। তাহমিদ বের হওয়ার আগে ও কিছুতেই নিচে যেতে পারবেনা।

তাহমিদ খাবার টেবিলে এসে দেখল কুহু ছাড়া সবাই এসেছে। কুহুকে না দেখে ওর বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে। তবে ওর বুঝতে বাকি থাকেনা, কুহু ওর সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছে কিংবা ওর ভেতরে জড়তা কাজ করছে। বেচারির লজ্জামাখা মুখটার কথা ভাবতেই তাহমিদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
” বড়মা, সবাই এসেছে কিন্তু তোমার রোমিও ভাইয়ের মেয়ে আসেনি যে? সে কোথায়? বাসায় আছে নাকি বাপের কাছে চলে গেছে? ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” বাবু, তুই এসব কি বলছিস বলতো? কায়েস তোর মামা হয়। তুই যে বোনের সামনে তার ভাইকে নিয়ে কথা বলছিস সেটা তোর মনে আছে? তুই কি একটুও বদলাবিনা! ”
” মা, তোমরা জানোই আমি কেমন। তবুও বারবার বদলানোর কথা বল কেন! আর বড়মা কি কখনো অস্বীকার করতে পারবে তার ভাই রোমিও নয়? রোমিও কে রোমিও বলতে দোষ কোথায়, বলতো? এমন রোমিও যেন বাংলার ঘরে ঘরে জন্ম নেয়। আহা কি প্রেম। ”

” বাপ, তুই এতসব না ভেবে এখন খেয়ে নে। নইলে মেডিকেলে পৌঁছাতে তোর দেরি হয়ে যাবে। আর আমার রোমিও ভাইয়ের মেয়ে রুমেই আছে। তার নাকি ক্ষুধা নেই। তাই নিচে আসেনি। ”
বড়মার কথা শুনে আরেক দফা মনে মনে হাসে তাহমিদ। ও বেশ বুঝতে পারছে, ও বাসা থেকে না বেরোলে কুহু নিচে আসবেনা।

” এই যে, সিনিয়র স্যার, আজ মেডিকেলে যেতে হবে সেকথা মনে আছে? আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। এভাবে আর কতদিন কষ্ট করবে। আমি ফোন দিলেই তোমরা রওনা দিও। ”
” মনে আছে, বাপ। তুই চিন্তা করিসনা, আমরা সময়মত পৌঁছে যাব। ”
এরপর আর কোন কথা হয়না। সবাই খেতে শুরু করে।
খাওয়া শেষে তাহমিদ আজও সানাউল রাশেদিনের গালে টুপ করে চুমু দেয়।

” ধন্যবাদ, সিনিয়র রাশেদিন, তুমি না থাকলে আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সময় লাগত। তুমি আমার কাজ সহজ করে দিয়েছ। আজ থেকে তোমার ভুঁড়িটাকেও আমি রেসপেক্ট করব। ”
সানাউল রাশেদিন গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে বসে আছেন। তিনি কি বলবেন বেবে পাচ্ছেননা৷ ততক্ষণে তাহমিদ বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।

” আফরোজা, তোমার এই ছেলে নষ্ট হয়ে গেছে। বেয়াদব ছেলে, শুধু চুমু দেয়ার সুযোগ খুঁজে! ”
” তুমি চুপ কর৷ যাও রুমে যাও। ”
তাহমিদ দরজার কাছে এসে পেছনে ঘুরে তাকায়। উদ্দেশ্য কুহুকে এক নজর দেখতে পাওয়া।
পেছনে তাকাতেই তাহমিদের নজর যায় উপরের সিঁড়িতে। যেখানে এই মুহূর্তে কুহু দাঁড়িয়ে আছে। ও কেবলই নিচে নামতে চাইছে, তখনই তাহমিদ পেছনে তাকায়। কুহুও সামনে তাকাতেই তাহমিদের চোখে চোখ পরে যায়।

অপ্রত্যাশিত এই দর্শনে তাহমিদের ঠোঁট প্রসারিত হয়, যা কুহুর চোখ এড়ায়না। তাহমিদ দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। ওর ঠোঁটে ঝুলছে মোহনীয় হাসি। ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগে কিছুক্ষণ তার শ্যামাকন্যাকে দেখেই তবে রওনা দিবে। তাহমিদের এহেন কাজে কুহু লজ্জা পায়। ও সিঁড়িতে থমকে দাঁড়িয়েছে। কুহুর অস্বস্তি বুঝতে পেরে তাহমিদ স্মিথ হেসে ‘ কুঞ্জছায়া ‘ ত্যাগ করে।
তাহমিদ বেরিয়ে যেতেই কুহু ডাইনিং টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ায়।

” এইতো কুহু সোনা চলে এসেছে। আয় বস। আমি খেতে দিই। ” তাহমিনা আক্তার এগিয়ে এসে কুহুর প্লেটে দুইটা পরোটা তুলে দেন।
” তোমরা খেয়েছ, আন্টি? ”
” না, তুই বস। আমরা একসাথে খাব। ”

” কুহু মা, তোমার বাবার বাড়িতে আমাদের কবে নিয়ে যাচ্ছ? যতদিন শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বেঁচে ছিলেন, ততদিন ভালোই জামাই আদর পেয়েছি। কিন্তু তারা মা’রা যাবার পর থেকে সেখানে যেতে মনে টানেনি। দুই-একবার যা গিয়েছি কিছুক্ষণ থেকেই চলে এসেছি। এবার অনেকদিন পর জামাই আদর পাব মনে হচ্ছে। তোমার মা আছে আমাদের আপ্যায়নের জন্য। আবার তুমি আজ, যে কিনা আমার ছোট শ্বাশুড়ি। ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে যাচ্ছে, বুঝলে কুহু মা? ”
ফুপার কথা শুনে কুহু হেসে উঠে।

” জ্বি ফুপা, এবার আপনারা সবাই একসাথে যাবেন। দাদা-দাদী বেঁচে থাকতে তারা আপনাদের যেমন আপ্যায়ন করত, তেমনই আপ্যায়ন আমি আপনাদের করব। এবার অন্তত শ্বশুর-শ্বাশুড়ির অভাব আপনি বুঝতেই পারবেননা। ? ”
” এইতো মায়ের মত কথা। আমার শ্বাশুড়ির কিছুটা স্বভাব তোমার মধ্যে দেখতে পাই। ” সানাউল রাশেদিন কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

” কিন্তু ফুপু, আমরা কবে যাচ্ছি? ”
” সোনা মা, আমরা আগামী বুধবার সকালে রওনা দিব। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নাজমা ওর পরিবারের সবাইকে নিয়ে এখানে আসবে। বুধবার সকালে শাহনাজ সবাইকে নিয়ে আসলেই রওনা দিব। ”
” সবাইকে নিয়ে একসাথে অনেক আনন্দ করব, ফুপু। এখন থেকেই আমার কেমন খুশি খুশি লাগছে। আগে কখনও এত আনন্দ করিনি। ”

” তোর দুর্ভাগ্য ,সোনা মা। সবকিছু থাকতেও এতদিন কিছুই পাসনি। তবে চিন্তা করিসনা, এতদিন যা কিছুর অভাব ছিল, এখন তার সবটাই পেয়ে যাবি। তোর সামনে এখন শুধুই সুখ আর সুখ। ”
” তাহমিনা, তাহমিদ কি আসবে? ওদেরকে আসার কথা বলেছ তো? ” সানাউল রাশেদিন তাহমিনা আক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন।
” তাওহীদ এখনও কিছু বলেনি। আসলে জানাতে চেয়েছে। তবে নীরা আসার জন্য লাফাচ্ছে। ”
” আচ্ছা, আমি একবার ফোন করব। ”

এভাবেই টুকটাক গল্পের মধ্য দিয়ে খাওয়া শেষ করে সবাই।
সন্ধ্যায় কোচিং থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে দিদুনের রুমে আসে কুহু। বৃদ্ধার সাথে সময় কাটাতে ওর খারাপ লাগেনা।
” কুহু সোনা, তোমার পড়াশোনা কেমন হচ্ছে? অ্যাডমিশন কবে? ”
” পড়াশোনা মোটামুটি হচ্ছে, দিদুন। অ্যাডমিশন সামনে মাস থেকে শুরু হবে। দিদুন, আমি তোমার চুলে তেল দিয়ে দিব? মাথা কেমন উসকোখুসকো হয়ে আছে। ”

” তোমার এখন পড়াশোনা না থাকলে দিয়ে দাও। কিন্তু শোন মোটামুটি পড়াশোনায় কিন্তু কোন কাজ হবেনা। ভালোভাবে পড়াশোনা করলেই তবে উন্নতির শেখরে যেতে পারবে। মনে রেখ, পড়াশোনার কোন বিকল্প নেই। তোমার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিলেও, বিদ্যা কেউ কাড়তে পারবেনা। যতটুকু বিদ্যা তুমি অর্জন করবে, ততটুকুই তোমার নিজের কাজেই লাগবে। আর শোন, সিক্তা কিন্তু খুব ফাঁকিবাজ। ওর সাথে তাল মেলাবেনা কিছুতেই। ”
” আচ্ছা, দিদুন। তোমার সব উপদেশ আমার মনে থাকবে। ”

দিদুনের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে রুমে আসে কুহু। বাবার সাথে, ভাই-বোনের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে। এরপর বই নিয়ে বসে। সাড়ে নয়টা পর্যন্ত এক নাগাড়ে পড়ে। এরপর নিচে যেয়ে খেয়ে নেয়। তাহমিদ তখনও বাসায় আসেনি।
আজও ছাদে যেতে ভিষণ ইচ্ছে করছে। কিন্তু গতরাতের ঘটনার পর আর সাহসে কুলাচ্ছেনা।
সাড়ে দশটার দিকে তাহমিদের কথার আওয়াজ পায় কুহু। আর সাথে সাথেই বিছানায় শুয়ে পরে।
তাহমিদ বাসায় এসে কুহুকে দেখার জন্য ছটফট করতে থাকে। এদিক-ওদিক তাকিয়েও কুহুর দেখা পায়না।

” আশ্চর্য! মেয়েটা গেল কই! তাকে না দেখে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, অথচ তার দেখা নেই! কি ফাজিল মেয়েরে বাবা! আমার আওয়াজ পেয়েই বোধহয় গর্তে সেঁধিয়েছে! ওকে গর্ত থেকে বের করতে হবে। কিন্তু কিভাবে? ভাব তাহমিদ, ভাব। কিছু একটা উপায় বের কর। ”
কিছুক্ষণ ভাবার পর একটা উপায় ওর মাথায় আসে। ও তৎক্ষনাৎ সিক্তার রুমের দরজায় এসে দাঁড়ায়।
” সিক্ত, ভেতরে আছিস? ”

সিক্তা ফোন গুতাচ্ছিল, তাহমিদের ডাক শুনে দরজা খুলে দাঁড়ায়।
” কি ভাইয়া, ডাকছ কেন? একটু আগেই তো আসলে। খেয়েছ? ”
” তোর পড়াশোনা কেমন হচ্ছে? কোচিং-এ পরীক্ষা নেয়? সেখানে কত পার্সেন্ট মার্ক আসছে? ” সিক্তার কথা উত্তর না দিয়ে বলে উঠে তাহমিদ।
” চেষ্টা করছি ভালো করার। সপ্তাহে দুইটা পরীক্ষা হচ্ছে। নাইন্টি পার্সেন্ট নম্বর আসছে সব পরীক্ষায়ই। কখনো কখনো নাইন্টি ফাইভ পার্সেন্টও আসছে। ” সিক্তা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েও জবাব দেয়।

” গুড। তোর এই উন্নতি উপলক্ষে আজ আমি ট্রিট দিব। কি খাবি বল? ”
” ভাইয়া, তুমি সুস্থ আছো? হঠাৎই রাত-বিরেতে খাওয়াতে চাচ্ছ! ”
” বেশি কথা না বলে বল কি খাবি? আমি অর্ডার করব। তারাতারি কর। ”
” ভাইয়া, শুধু আমার জন্যই ট্রিট? তোমাদের সবাইকে রেখে একা একা আমি খাব! ” সিক্তার হতভম্ব ভাব এখনও কাটেনি।
” শুধু তুই খাবি কেন! গর্দভ। তুই উপলক্ষ মাত্র। তোকে অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্য আমার এই সামান্য উদ্যোগ। তোর বোন কোথায়? তাকেও সাথে নে। ছাদে যেয়ে সব ব্যবস্থা কর। সেখানেই আড্ডা দিব। তার আগে কি খাবি বল? ”
সিক্তা মনের খুশিতে ইচ্ছেমত খাবারের নাম বলে।
তাহমিদ খাবার অর্ডার দিয়ে ফোন করে আনানকে।

” হ্যাঁ ভাই, আজকাল আমাকে তোমার ঘন গন মনে পরছে যে! কি সৌভাগ্য আমার। বিজি ডক্টরও ফোন দেয়! ”
” বেশি কথা না বলে, আমি যা বলছি তাই কর। এক্ষুনি বাসায় আয়। আমি খালামুনিকে ফোন দিচ্ছি। ”
” এখন আসতে হবে! কোন সমস্যা, ভাই? ”
” কোন সমস্যা নয়। তুই চলে আয়। এক মিনিট, তুই এখন কোথায়? আশেপাশে লোকজনের আওয়াজ পাচ্ছি, আবার গাড়ির হর্ণও শোনা যাচ্ছে? ”

” আমি এক বন্ধুর কাছে এসেছিলাম। এখন বাসার দিকে যাচ্ছি। ”
” তোর সাথে বাইক আছে নাকি গাড়ি নিয়ে এসেছিস? ”
” বাইক নিয়ে এসেছি, ভাই। আমি তোমার বাসা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের দূরত্বে আছি। সত্যি কি তোমাদের বাসায় আসতে হবে? ”

” চলে আয়। আমি তোর বাসায় ফোন দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছি। ”
শাহনাজ সুলতানার কাছে ফোন দিয়ে তাহমিদ জানিয়ে দেয়।
ওর এবার নিশ্চিন্ত লাগছে। কুহুকে গর্ত থেকে বের করার প্রসেসটা শেষ হয়েছে।
” আমার রাতজাগা পাখি, দেখি কতক্ষণ এভাবে রুমের ভেতরে লুকিয়ে থাক। তোমার কোন ধারনাই নেই, তোমার জন্য, তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি কি কি করতে পারি। একবার আপন করে পেয়ে নিই, তখন বুঝবে আমি কি। ”
” এই কুহু, ওঠ। আমরা ছাদে যাব। সেখানে অনেক কাজ আছে। ” সিক্তা রুমে এসে কুহুকে টেনে তুলে।
কুহু এতক্ষণ রুমে থেকেই তাহমিদের সব কথা শুনেছে৷ তাই ওর মোটেও ছাদে যাওয়ার ইচ্ছে নেই।
” সিক্তা, তুই যা। আমার ঘুম পেয়েছে। প্লিজ এসবের ভেতর আমাকে টানিসনা। ”

” তুই এসব কি বলছিস! আমরা তোকে ছাড়াই আড্ডা দিব! এটা হতেই পারেনা। আর তাছাড়া তুই না গেলে ভাইয়া রাগ করবে। সে তোকেও ছাদে যেতে বলেছে। তুই তারাতারি ওঠ। আমি ততক্ষণে মনি আপাকে ডেকে ছাদে পাঠাই। ”
সিক্তা বাসার সবাইকে ছাদে যেতে বললে সবাই না করে দেয়। আফরোজা নাজনীন ওদের আড্ডা দিতে বলেন।
ডেলিভারি ম্যান এসে খাবার দিয়ে গেছে। আফরোজা নাজনীন খাবারগুলো সুন্দরকরে সাজিয়ে ছাদে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু তাহমিদের জোড়াজুড়িতে ওর মা, বড়মা, দিদুন আর সিনিয়র রাশেদিনকে খাবার খেতে হয়। আবার বাড়ির কাজের সহকারীদের জন্যও রেখে দেয়।

আনানও পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর এসে যায়।
ছাদের ছাউনির নিচে বিছানা বিছিয়ে সেখানে খাবার সাজিয়ে রেখেছে মনি।
কুহু গুটিগুটি পায়ে ছাদে আসে। ও আসতেই চাইছিলনা। কিন্তু ও ফুপুর কথা ফেলতে পারেনি।
আনান আর তাহমিদ ছাদের কোনায় বসে আড্ডা দিচ্ছিল। আনান তাহমিদকে ওর ফোনে কিছু একটা দেখাচ্ছে। সিক্তা কুহুর হাত ধরে ছাদে নিয়ে আসে।

” ভাইয়া, আমরা এসে গেছি। ”
সিক্তার আওয়াজ অনুসরণ করে তাহমিদ ওর দিকে তাকায়। কুহু সিক্তার পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বরাবরের ন্যায় আজও ওর মাথায় ওড়না প্যাঁচানো।
তাহমিদ কুহুর দিকে তাকিয়ে দুচোখের জ্বা’লা জুড়াচ্ছে। যেন কতকাল পর একজোড়া অতৃপ্ত চোখ তার রমনীকে দেখছে! কি আছে এই মেয়ের মাঝে! তাকে যতই দেখে, ততই দেখার তৃষ্ণা বাড়ে! এই মেয়েটা ধীরে ধীরে তাহমিদের অভ্যেস আর আসক্তিতে পরিনত হচ্ছে। কুহুকে ভালোবাসার ভয়ানক এক অসুখ হয়েছে ওর মনে। যে অসুখের একমাত্র পথ্যই ভালোবাসা।

এদিকে কুহু লজ্জায় মরোমরো হচ্ছে। ও বেশ বুঝতে পারছে তাহমিদ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ তুলে তাকানোর মত অবস্থা এখন ওর নেই।
” এদিকে আয়। এখানে বস কিছুক্ষণ। ” তাহমিদ সিক্তাকে ডাকে।
আনান সিক্তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আজ যে ও অপ্রত্যাশিতভাবে সিক্তাকে দেখতে পাবে তা ভাবতেও পারেনি। এজন্য তাহমিদকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিতে ইচ্ছে করছে ওর। একবার মনে হলো এখনই কেন চুমু দিইনা। কিন্তু পরক্ষণেই তাহমিদের রিয়্যাকশন কি হবে তা ভেবে ইচ্ছেকে দমন করে৷
সিক্তা কুহুকে নিয়ে ছাদের কোনায় এসে বসে। কুহু চুপচাপ সিক্তাকে অনুসরণ করছে।

” কোকিলা, কেমন আছিস? ঘুমিয়ে ছিলি নাকি? ”
” না ভাইয়া, শুধু শুয়েছিলাম। ”
” আনান, তুই তোর এই বোনটিকে কোকিলা ডাকিস কেন রে? সে কি কোকিলের মত ভালো গান গায়? ”
” ভাই, এগুলো আদরের ডাক। তবে কোকিলা গান গাইতে পারে কিনা তা আমি জানিনা। কি রে কোকিলা, তুই গান গাইতে জানিস? ”

কুহু বুঝতে পারছে তাহমিদ ওর সাথে কথা বলতে চাইছে। এজন্যই ওকে ইন্ডাইরেক্টলি বলছে।
” না ভাইয়া, আমি কোনও গান জানিনা। ”
” এই নে চকলেট খা। সিক্তা, এই যে তোরটা। ভাই, তুমি চকলেট খাবে? ” আনান পকেট থেকে চকলেট বের করে কুহু আর সিক্তার কাছে দেয়। তাহমিদকেও দিতে চায়।
” আমার ভাগেরটা তোর কোকিলাকে দে। চকলেট খেয়ে যদি ওর মুখে কথা ফোটে। গতকাল সারাদিন মুখ বন্ধ করে থাকতে দেখেছি। এখনও তাই। ”

” আরে ভাই, কোকিলা এমনই। ও একটু কম কথা বলে। কোকিলা, আজ তোরা কোচিং-এ গেছিলি? ”
” হুম, গিয়েছিলাম। ”
” তুমি সাইন্সে পড়? ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর বুক ধুকপুক করতে থাকে।
” উহু। আর্টসে পড়ি। ”
” এসএসসি ‘ র রেজাল্ট কি ছিল? ”
” ৪.৯২ ”

” খারাপ না। তবে বাকি . ০৮ কি দোষ করেছিল? তাদেরকে তোমার সার্টিফিকেটে জায়গা দিতে পারলেনা যে? ”
তাহমিদের প্রশ্নের কি উত্তর দিবে কুহু। ও কিভাবে বলবে ওর জীবনটা সহজ ছিলনা। বাকি পাঁচটা মেয়ের মত ও হেসেখেলে বড় হয়নি। ইচ্ছেমত পড়াশোনা করতে পারেনি।
” ভাই, ওর জীবনটা অন্যরকম ছিল। সৎমায়ের কাছে বড় হয়েছে। বুঝোইতো। ”
তাহমিদ মোটামুটি সব জানে, তবুও প্রশ্ন করেছে কারন ও কুহুর কথা শুনতে চায়।
সিক্তা, আনান একনাগাড়ে বকবক করেই চলেছে। কুহু মাঝেমধ্যে ওদের কথায় সায় দিচ্ছে। বাকিটা সময় চুপচাপ ওদের কথা শুনছে। আর তাহমিদ একভাবে কুহুকে দেখেই চলেছে।

” সিক্ত, খাবার যে ঠান্ডা হয়ে গেল৷ খাবিনা? ”
” চল, ছাউনির নিচে যেয়ে খেতে খেতে গল্প করি। ”
গ্রিল, নান, চিকেন ফ্রাই, কাবাব, সফট ড্রিংকস, জুস সব সাজিয়ে রাখা আছে।
ওরা ছাউনির নিচে আসলে সিক্তা সবাইকে সার্ভ করে।
কুহু কিছু না খেয়ে বসে আছে।

” তুমি খাচ্ছনা যে? শরীর খারাপ করছে? ”
” নাহ্ এমনিতেই। আসলে রাতে খয়েছিতো তাই খেতে ইচ্ছে করছেনা। ”
” এখন রাত বারোটা দশ বাজে। রাতের খাবার এতক্ষণ তোমার পেটে আছে! একটা একটা করে সময় করে খাও। ”
কুহু মাথা ঝাঁকিয়ে জুসের গ্লাসে চুমুক দেয়।

তাহমিদ প্রচন্ড ক্লান্ত। তবুও ও কুহুকে দেখার জন্যই এতসব আয়োজন করেছে। শরীরটাকে আর বসিয়ে রাখতে পারছেনা। হঠাৎই টান কুহুর ডানপাশে শুয়ে পরে। তাহমিদকে শুতে দেখেই ও উঠতে গেলে, তাহমিদ সবার অগোচরে কুহুর হাত চেপে ধরে। তাহমিদের এমন ছোঁয়ায় কুহু কাঁপতে শুরু করে।
সিক্তা, আনান তাহমিদকে শুতে দেখেও কিছুই মনে করেনা। ওদের ভেতর সম্পর্কটাই এমন। ছোট-বড় সবাই ওরা ফ্রেন্ডলি।
খাওয়ার মাঝেই সস শেষ হয়ে যায়। এদিকে আনান সস ছাড়া কিছুই খেতে পারেনা। ও ধমকে সিক্তাকে সস আনতে পাঠিয়ে দেয়।

সিক্তা নিচে গেলেই কাকতালীয়ভাবে আনানের ফোনে ফোন আসে। ফোন হাতে নিতেই আনানের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
” ভাই, আমার ছোট ফুপু ফোন দিয়েছে। তোমরা বস, আমি একটু কথা বলে আসি। ” আনান ফোন রিসিভ করে উঠে যায়। কথা বলতে বলতে ছাদ থেকে নেমে যায়।
ছাদে এখন তাহমিদ আর কুহু একা। তাহমিদ এটাই চাইছিল। ও উঠে বসে। ট্রাউজারের পকেটে হাত গলিয়ে দেয়।
এদিকে কুহু উসখুস করছে। ওর ভিষণ অস্বস্তি লাগছে তাহমিদের সাথে একা থাকতে।
হঠাৎই পায়ে কোন কিছুর স্পর্শে চমকে কুহু।

” ক…কি করছেন! ”
” চুপ কোন কথা নয়। যা করছি করতে দাও। ” তাহমিদ কুহুর পায়ে পায়েল পরিয়ে দেয়।
” কাল থেকে আমি বাসা থেকে বেরোনোর আগে এবং বাসায় আসার পর তোমাকে দেখতে চাই। সকালে একসাথে বসে খেতে চাই। শোন মেয়ে, তুমি আমার শিরায়-উপশিরায় মিশে গেছ। তাই মিছেই পালানোর চেষ্টা করোনা। আমার মত প্রেমের আ’গু’নে জ্ব’ল’তে শিখ। তবেই বুঝবে তোমাকে কতটুকু ভালোবাসি। অবশ্য সারাজীবন মাপলেও আমার ভালোবাসার গভীরতা তুমি খুঁজে পাবেনা। একটু রোমান্টিক হও। আনরোমান্টিক বউকে নিয়ে সংসার করতে আমার আপত্তি আছে। আর এই পায়েলটা কখনোই খুলবেনা। আমি যেদিন খুলতে বলব সেদিন খুলবে। ” কথা শেষ করেই কুহুর জুসের গ্লাসে চুমুক দেয় তাহমিদ।

” ভালোবাসার মানুষের জুসের গ্লাসেও বুঝি মধু মেশানো থাকে আমার রাতজাগা পাখি? এত ভালোবাসা হঠাৎ কেন জন্মালো বলতে পার? কেন তোমাকে না দেখলে আমার ভেতরে হাঁসফাঁস করে! কেন আমার রাতজুড়ে স্বপ্নে তুমি থাক! এমনতো আগে কখনো হয়নি। মেয়ে বন্ধু কম ছিলনা। কারও প্রতি এত আকর্ষন কখনোই হয়নি। খুব শীঘ্রই তুমি আমার হবে। সিক্তর রুম নয় আমার রুমই হবে তোমার আপন ঠিকানা। শোন মেয়ে, আমি তোমার থেকে পজিটিভ উত্তর আশা করছি। অবশ্য পজিটিভ না হলেও সমস্যা নেই। আমি রোমিওর মাধ্যমেই তোমাকে আপন করে নিব। নিজের সস্পদকে কিভাবে নিজের কাছে তা আমি ভালো করেই জানি। তুমি আমার সেই অমুল্য সম্পদ, যার বিনিময়ে আমি দুনিয়ার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারি। যার জন্য আমি প্রেমের জোয়ারে ভাসাতে পারি ধরনী ”

সিঁড়িতে কারও আওয়াজ পেয়ে কথা বন্ধ করে তাহমিদ। শুধু আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায় কুহুর পায়ের পায়েলে।
এতক্ষণ তাহমিদের ফিসফিসানি কথা শুনে কুহু দম বন্ধ করে ছিল। এই মানুষটার হঠাৎ আগমন ওর সব চিন্তাধারাকে তোলপাড় করে দিচ্ছে। যেইনা তাহমিদ ওর পায়ে ঠোঁট ছুঁইয়েছে তখন যেন কুহু কিছু সময়ের জন্য স্থবির হয়ে যায়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে।
সিক্তা সস নিয়ে এসেছে।

” আনান ভাইয়া কোথায়? আমাকে সস আনতে পাঠিয়ে সে হাওয়া হয়ে গেছে! ”
” ওর একটা ফোন এসেছে। কথা বলতে বলতে নিচে গেছে। ”
তাহমিদ কথার ফাঁকে কুহুর প্লেট থেকে একট টুকরা কাবাব নেয়। সিক্তা সেটা লক্ষ্য করেনি। কুহু ওর প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর আধা খাওয়া কাবাবের টুকরাই নিয়েছে তাহমিদ।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১১

পরক্ষনেই তাহমিদের দিকে তাকায় কুহু। কি অবলীলায় সে কুহুর এঁটো কাবাব খাচ্ছে!
কুহু এবার অবাক হয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১৩