কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১৬

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১৬
সাবিকুন নাহার নিপা

এখন মধ্যদুপুর। শাওন দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। আজকাল বারান্দায় দাঁড়াতে আর অস্বস্তি হয় না। কিছু কথা, বাক্য গা সয়ে গেছে। এটা তো হবার ই ছিলো। থমকে যাওয়া সময়ও একসময় চলতে শুরু করে। শাওনের জীবন ওলট, পালট হবার পর এই বারান্দায় প্রথম যেদিন দাঁড়িয়েছিল সেদিনকার ঘটনা অন্যরকম ছিলো।

সামনের বারান্দায় নাইনে পড়ুয়া একটা ছেলে থাকে। ওর রুম আর শাওনের রুম মুখোমুখি। বারান্দায় দেখা হলে শাওন ছেলেটার পড়াশোনার খোঁজ নিতো। ক্রিকেট, ফুটবলের আপডেট জানতো। তুই তোকারির একটা মিষ্টি সহজ সরল সম্পর্ক ছিলো। ছেলেটাও শাওন কে আপু বলে ডাকতো। অথচ সেই ছেলেটা শাওন কে সেদিন ভয়ংকর এক কুৎসিত কথা বলে ফেলল। শাওন রীতিমতো হতভম্ব। মনে হলো কানের মধ্যে কেউ গরম শিশা ঢেলে দিয়েছে। লজ্জা, ঘৃনায় বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। দীপা দরজা খুলে দিলেও শাওন বলতো, দরজা বন্ধ করতে। এই একটা ঘটনা ও’কে কতো মানুষ চেনাচ্ছে!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এর পর শাওন আরেকদিন সন্ধ্যেবেলা বারান্দায় দাঁড়িয়েছে। সেদিনও সেই একই ঘটনা। শাওন সেদিন আর হতভম্ব হয় নি। চোয়াল শক্ত করে ছেলেটার দিকে তাকিয়েছে। বখাটে ছেলেদের মতো খ্যাকখ্যাক হাসি দেখে ঘেন্নায় নয়, রাগে গা জ্বলে গেছে।

শাওন ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এতো উত্তেজিত ছিলো যে জুতা পর্যন্ত পায়ে পরে নি। খালি পায়ে ওই বাসায় চলে যায়। ছেলেটার মা দরজা খুলতেই শাওন ঝড়ের গতিতে ঘরে ঢুকে যায়। ঠাসঠাস কয়েকটা থাপ্পড় মারে। ছেলেটার মা ছেলের হয়ে ওকালতি করতে এলে শাওন তাকে ছেলের কীর্তি শোনায়। শাওনের কথায় বিশ্বাস না করলেও নিজের ছেলের নত হওয়া মাথা দেখে মায়ের মাথাটাও নত হয়।

সেই ভর সন্ধ্যেবেলা শাওন অনুভব করলো যে ওর জীবন টা ততক্ষণই কঠিন থাকবে যতক্ষন ও নিজেকে দূর্বল ভাববে। তাই নিজেকে আর দূর্বল ভাবা যাবে না।
“শাওন, এই শাওন..দরজা খোল।”
মায়ের ডাকে ধ্যান ভাঙে শাওনের। দরজা খুলে দেয়। সুরমা বেগম ঘরে ঢোকেন। মেয়ের মুখের দিকে তাকায়। চোখের নিচের কালচে দাগসহ ই স্নিগ্ধ লাগছে। সুরমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। শাওন প্রশ্ন করে,

“কিছু বলবে?”
“হু।”
শাওনের চোখের দৃষ্টি মায়ের হাতের দিকে। মায়ের হাতে একটা শাড়ি। শাড়িটার রঙ কমলা।
সুরমা বেগম শাড়িটা খাটের উপর রেখে বললেন,
“সুহাস কিনেছে। ”
শাওনের চোয়াল শক্ত হলো। ওর সমস্ত শাড়ি ও পুড়িয়ে দিয়েছে।
সুরমা বললেন,

“রিশাব আসবে আজ।”
“আমি সামনে যাব না মা।”
সুরমা বেগম অসহায় গলায় বলেন,
“তুই কী কোনোদিনই আমার কথা শুনবি না শাওন?”
শাওন চুপ করে থাকে। মা’ও খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যান। শাওন কোনো করুনার জীবন চায় না। একাই থাকতে পারবে বাকী জীবন। কাউকে দরকার নেই ওর জীবনে।

মায়ের দেয়া প্রস্তাবে রিশাবের উত্তর টা হ্যাঁ ছিলো। এই জবাবে ওর খুব বেশী সময় লাগে নি। তবুও মা বলেছিলেন, ভেবে নাও রিশাব। রিশাব মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিল,
“আমি জীবনে কোনো কিছুই প্ল্যান করে করিনি মা। প্ল্যান ছাড়া যা কিছু হয়েছে সব ভালোই হয়েছে। এবারও নিশ্চয়ই ভালোই হবে। ”

তবে এই বিয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন রিশাবের বাবা আর বোন। শাওন কে তারা কিছুতেই মেনে নিবেন না রিশাবের সঙ্গে। রিশাবের বাবা, মায়ের তর্কযুদ্ধও গেল এই বিষয় নিয়ে।
রিশাবের বাবা ও’কে বলেছে,
“রিশু, এই বিয়েতে তুমি কেন রাজি হচ্ছো? তোমার মা চাপিয়ে দিচ্ছে বলে?”
“মা চাপিয়ে দিচ্ছে এই ব্যাপার টা সত্যি নয় বাবা। আমার মন সায় দিয়েছে বলেই রাজি হয়েছি।”
বাবা ছেলের কথায় আশ্বস্ত হতে পারেন না। তিনি বিচলিত হন। তার ছেলে,ভীষণ ভালো ছেলে। কোথাও কারো সঙ্গে কখনো খারাপ আচরণ করে নি। ওর স্কুল, কলেজের বন্ধুরা এখনো কতো আন্তরিক! সেই ছেলে কী সত্যিই এমন মেয়ে ডিজার্ভ করে!

রিশাব বাবাকে বলে,
“ডোন্ট ওরি বাবা, শাওন সত্যিই চমৎকার মেয়ে। তুমি কিন্তু ও’কে দেখোনি। শুধু শুধু কল্পনার ক্যানভাসে একটা বাজে ছবি এঁকে বসে আছ। আমি শিওর যে তুমি ও’কে দেখে লজ্জা পাবে।”
রিশাবের বাবা ছেলের কথায় মৃদু হাসেন। তবুও তিনি স্বস্তি পান না।
রিতির শাওন কে পছন্দ হলেও ভাইয়ের সঙ্গে মানতে পারে না। ওর যুক্তিও অবশ্য ফেলে দেবার মতো নয়। ভালো মেয়েরা কখনো বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ফ্ল্যাটে যায় না, তাতে সম্পর্ক যতই লং টাইম হোক।
দিলশাদ মেয়ের এই যুক্তির বিপরীতে কঠিন এক ধমক দেন। রুক্ষ গলায় বলেন,

“ওখানে তুমি, আমি কেউই উপস্থিত ছিলাম না রিতি। তাই কোনো বাজে কথা বলবে না।”
রিতি এই যুগের স্মার্ট মেয়েদের কাতারে বোধহয় পড়ে। ওর কাছে মায়ের যুক্তি খোড়া মনে হয়। মা বরাবরই জেদি। তিনি সবসময়ই নিজেকে ঠিক ভাবেন। কিন্তু আজকের ভাবনার সঙ্গে রিতি একমত হতে পারে না। বিধ্বস্ত, ভেঙে পড়া শাওন কে দেখে রিতির যে মায়া হয়েছিল সেটা নিমিষেই ধুয়ে মুছে গেল।
রিতি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে রিশাব কে বোঝাতে। রিশাব কারোর কথাই কানে নেয় নি। রিতি অবশ্য সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এই বিয়ের কোনো আয়োজনেই ও থাকবে না।

ইন্টারকমে রিসেপশনিস্ট সু্হাস কে জানালো ওর সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছে। সুহাস জিজ্ঞেস করলো,
“কে এসেছে? নাম বলে নি?”
ফোনের ওপাশ থেকে জানালো, মনিদীপা।
সুহাস দ্রুত বেরিয়ে গেল। ওয়েটিং রুমে গিয়ে দেখলো দীপা দাঁড়িয়ে আছে। সুহাস ব্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“সব ঠিক আছে তো বাড়িতে? শাওনের কিছু হয় নি তো?”
দীপা মাথা নেড়ে না বলল। স্মিত হেসে বলল,
“কিছু হয় নি। একটা জিনিস দিতে এসেছি। ”

সুহাস জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলো। দীপা ব্যাগ থেকে চায়ের ফ্ল্যাস্ক টা বের করে সুহাসের হাতে দিলো। সুহাস চায়ের ফ্ল্যাস্ক হাতে নিয়েই বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো।
“চায়ে চিনি গুলিয়ে দিয়েছি। আপনি যেমন চিনি খান তেমন ই।”
কথাগুলো বলার সময় দীপা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল৷

সুহাসের বিস্ময় এখনো কাটছে না। দীপার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। চারটা সাবজেক্ট হয়েও গেছে। পারিবারিক ঝামেলায় পড়াশোনায় যতটা পিছিয়ে গেছিলো সেগুলো মেকাপ করার জন্য সারাদিন বইয়ের সঙ্গে লেগে থাকতে হয়। সুহাস সেটা দেখেছে। সেই সঙ্গে আরও একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে যে দীপা ওর সঙ্গে একদম ই কথা বলে না। সেদিন নিজেই ওকে স্বার্থপর আরও কতকিছু বলল আবার নিজেই কথা বন্ধ করে দিলো।

এই ব্যাপার টা মেনে নিতে ওর একটু কষ্টও হলো। তাই আগ বাড়িয়ে নিজেই কথা বলতো। সেগুলো অবশ্য প্রয়োজনের কথাই। দীপা চার্জার টা দাও, দীপা এটা দাও এসবই। আজ সকালে স্বাভাবিক ভাবেই দীপাকে বলেছিল, এক কাপ চা দিতে পারবে? দীপা তখন পড়ছিলোও না। কিন্তু হঠাৎই সুহাস কে অবাক করে দিয়ে বলল, মা’কে বলুন। রান্নাঘরে মা আছে।
সুহাস খানিকটা অবাক হলেও বিনা বাক্য ব্যয়ে চা না খেয়েই বেরিয়ে এলো।

দীপা অবশ্য রুক্ষ গলায় ই বলেছিল। বলার কারন ওই একই। অভিমান। কিন্তু সুহাস যখন চা না খেয়ে চলে এলো তখন অসহ্য এক যন্ত্রনা অনুভূত হলো। সকালের খাবার খেতে গিয়েও টের পেল যে গলা দিয়ে নামছে না৷ চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে বারবার। ভর দুপুরে তাই এক ফ্ল্যাস্ক চা বানিয়ে নিয়ে এলো।
সুহাস দীপাকে বলল,

“এখানে মেশিনের কফি হয়। খেতে মন্দ না। খাবে?”
“খাব।”
সুহাস দীপাকে নিয়ে ক্যান্টিনের দিকে গেল। ওর কলিগ রা দীপার সঙ্গে হাই, হ্যালো টাইপ কথাবার্তা বলল। সুহাস সবসময়ই অফিসে প্রাইভেট পার্সন। ওর ব্যক্তিগত ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েও কেউ তেমন পাত্তা পায় না। আজ দীপাকে দেখে সবাই আগ্রহী হয়েই কথা বলতে এলো।

সুহাস নিজেই দীপাকে রিকশায় তুলে দিলো। লাঞ্চের অফার করেছিল কিন্তু দীপা রাজি হয় নি।
রিকশায় যেতে যেতে দীপা কাঁদলো। যে সম্পর্ক টা কোনোদিন গড়েই ওঠে নি, সেই সম্পর্কে মান অভিমান ব্যাপার টা কেন টেনে আনছে। ও তো সবসময় ই চেয়েছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। নিজের মনের কথা, আবেগ সুহাস কে বুঝতে না দিতে। তবুও কেন অভিমান করে বসলো!

দুপুর রোদে রিকশায় চড়তে চড়তে দীপা কাঁদলো। রিকশাওয়ালা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেও নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তার কাজ করতে লাগলো। এমন দৃশ্য তার কাছে নতুন কিছু না বোধহয়।

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১৫

সুহাস ফ্ল্যাস্কের দিকে তাকিয়ে আছে। কোথা থেকে একটা জমাট বাঁধা কষ্ট এসে ভর করেছে। কেন! এই কেন’র উত্তর কারোর জানা নেই। কেউ জানে না।

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১৭