কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১৩

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১৩
সাবিকুন নাহার নিপা

শাওনের ওই অবস্থা দেখে পলাশের মাথা খারাপ হয়ে গেল। কী করবে বুঝতে পারছে না। দৌড়ে গিয়ে শাওন কে ধরলো। এরপর রাজুর নাম ধরে ডাকলো। পলাশের চিৎকার শুনে বাকীরাও ছুটে এলো। জুয়েল ভাই ভদ্রলোক অন্য ঘরে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত। সে এসে এই ঘটনা দেখে ঘাবড়ে গেল। সর্বনাশ! এই কাহিনীতে পুলিশ জড়ালে অবস্থা বেগতিক৷ জুয়েল ভাই দাঁতে দাঁত চেপে পলাশ কে বলল,

“এই শা*লা কু** বাচ্চা, আমাগো মা*র্ডার কেসে ফাঁসাবি! ওই তুই তো কইছিলি মাইয়া তোর জন্য পাগল। তাইলে এই কাহিনী কিজন্য।”
পলাশ শাওনের নাম ধরে ডাকছে আর কাঁদছে। রাজু ছেলেটা বিরক্ত গলায় বলল,
“হাসপাতালে নিয়া যাওনের ব্যবস্থা করতে হবে মিয়া। কান্দাকাটি পরে করেন বা*ল।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পলাশের এতক্ষনে খেয়াল হলো। শাওন সেন্সলেস হয়ে গেছে। পলাশ কোলে করে শাওন কে নিচে নামালো। তখন অনেকের চোখেই দৃশ্যটা পড়েছে। সকলের মনেই কৌতূহল! কে এই মেয়ে! এতোগুলো ছেলের সঙ্গে এই ফ্ল্যাটে এসেছে কেন! অঘটন ঘটলো কিভাবে!

সুরমা বেগম ফোন করে যাচ্ছেন শাওন কে। সুহাস এসে একবার বলে গেছে,
“মা এমন কোনো রাত হয় নি যে টেনশন করতে হবে। বিরক্ত লাগছে তোমাকে দেখে।”
সুরমা বেগম বললেন,
“বিরক্ত লাগলে ঘরে গিয়ে বসে থাক। তোর কাছে গিয়ে তো আর বিরক্ত করছি না।”
দীপাও সুহাস কে বলল,

“আপনি বরং ঘরে গিয়েই বসুন।”
সুহাস আরও কিছু বলবে ভেবেছিল কিন্তু বলল না। ঘরে চলে গেল। অফিসের অনেক কাজ পেন্ডিং আছে। সেগুলো কমপ্লিট করতে হবে।

ঠিক কতবার শাওনের নাম্বারে সুরমা বেগম আর দীপা ফোন করেছে তার হিসেব নেই। কিন্তু লাস্ট কল টা রিসিভ হলো শেষমেস। সুরমা বেগম ব্যস্ত গলায় বললেন,
“এই শাওন, কোথায় তুই? ফোন ধরছিলি না কেন মা?”
ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ নেই। সুরমা বেগম ভীত গলায় মেয়েকে ডাকলেন।
“শাওন, শুনছিস? কোথায় তুই?”

দীপা ফোন টা নিতে নিতে বলল,
“দেখি তো মা, আমাকে দিন।”
দীপা দু’বার হ্যালো বলতেই পলাশ কথা বলা শুরু করলো। ভাঙা গলায় বলল,
“শাওন হসপিটালে। ”
“হসপিটালে কেন? কী হইছে আপুর?”
সুরমা বেগম স্তব্ধ হয়ে গেলেন। বিড়বিড় করে অস্পষ্ট গলায় কিছু বললেন।
দীপা ফোন রেখে বলল,
“মা হসপিটালে চলুন। পিজিতে যেতে হবে।”

সুরমা বেগম তখনও ঠায় বসে রইলেন। এতদিন ধরে যে ভয় টা পাচ্ছিলেন সেটাই হলো শেষ পর্যন্ত! তা যেন না হয় মাবুদ, তা যেন না হয়।
দীপা দ্রুত ঘরে গেল। হ্যান্ডব্যাগে টাকা নিলো সঙ্গে যা ছিলো। সুহাস ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“এখন কোথাও যাচ্ছ নাকি?”
দীপাও সমান নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“আপু হসপিটালে আছে। আমি আর মা যাচ্ছি। আপনি ঘরে থাকুন। আমাদের সঙ্গে যেয়ে বিরক্ত হবার দরকার নেই।”
সুহাস লাফিয়ে উঠলো। অস্থির গলায় বলল,
“শাওন হসপিটালে? ওর কী হয়েছে?”
দীপা বেরিয়ে গেল। এই মুহুর্তে সুহাসের কথার জবাব দেয়াটা খুব একটা জরুরী মনে করছে না।

পলাশ হতভম্ব হয়ে বসে আছে। ও’কে সমানে গালাগাল করছে রাজু আর মিজান নামের একটা ছেলে। শাওনের জন্য এখন ওদের সবাই কে ঝামেলা পোহাতে হবে। পুলিশ কেস হলে যে কিসবের মধ্যে যাইতে হবে আল্লাহ জানে।
জুয়েল ভাই ফোন করে পলাশ কে বলল,
“এই শোন পলাশ, কোনো অবস্থায় যেন ওই মেয়ের পরিবার থানার চৌকাঠে না যায়। কোনো ঝামেলা হইলে তোরে পুইত্তা ফালাব কিন্তু। ”

পলাশ হ্যাঁ, না কিছু বলল না। ওর মাথাও কাজ করছে কম। রাজু আর মিজান ও’কে একা রেখে চলে গেল। পকেটে টাকা পয়সাও তেমন নেই। যা আছে তাতে শাওনের ওষুধ হবে না। ওর কাছে যে টাকাগুলো ছিলো সেগুলো বিয়ের বাজার করতে খরচ করে ফেলেছে। অবশ্য সেই টাকা গুলো ওর ছিলো না। শাওনের টাকা ছিলো।

শাওনের কপালের আঘাত টা অতো বেশী না। কিন্তু হাতের ক্ষত টা বেশী। অনেকখানি রক্ত গেছে। শাওনের জ্ঞান ফিরেছে মাত্র। কিন্তু চোখ খুলতে ও ভীষণ ভয় পাচ্ছে। চোখ খুলেই যদি ওই পিশাচটাকে আবার দেখতে পায়! না, শাওন আর কোনোদিন পলাশ কে দেখতে চায় না। ভুলে যেতে চায় আজকের সমস্ত স্মৃতি। আজ সকালে ও দীপার থেকে শাড়ি নিয়ে সেজেগুজে কোথাও যায় নি। এক প্রেমিক পুরুষ কে বিশ্বাসও করে নি। আজ কিচ্ছু হয় নি। সাদামাটা একটা দিন গেছে অন্যান্য দিনের মতো। আজ কিছু হয় নি।

“শাওন!”
শাওন মায়ের গলার আওয়াজ পেল। শরীর কাঁপিয়ে কান্না পেল ওর। শাওন চোখ খুলে আর্তচিৎকার করে মা’কে ডাকলো।
“মা, মাগো.. মা..”
সুরমা বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন শক্ত করে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে শাওন কাঁপছে। ভালো করে কাঁদতেও পারছে না যেন। গলার কাছে এসে শক্ত হয়ে কান্নাটুকু জমাট বেঁধে যাচ্ছে।
দীপা পাশে দাঁড়িয়ে শাওনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সুহাস গেছে শাওনের ওষুধগুলো কিনতে। ওরা এখনো জানেনা যে শাওনের সাথে ঠিক কী ঘটেছে। তবে আন্দাজ করতে পারছে। সুহাস পলাশ কে দেখে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করেছিল,
“শাওনের এই অবস্থা কিভাবে হয়েছে?”
পলাশ জবাব দেয় নি। এলোমেলো চোখে সুহাসের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিলো।

শাওন কে বাসায় আনা হলো। সেই সঙ্গে মাটিচাপা দেয়া হলো পলাশ নামের অধ্যায় টাকে। শাওনকে হারানোর ভয় টা এতদিন কেবল পলাশের কাছে দু:স্বপ্ন ছিলো। এখন সেটা বাস্তব। নিজেকে খানিকটা ধাতস্থ করে শাওন মা’কে বলেছিল,
“মা তুমি সারাজীবন ঠিক ছিলে। আমি ভুল ছিলাম। আমি মানুষ চিনতে ভুল করেছি। আমি ঠকে গেছি মা’গো। আমি খুব খারাপভাবে ঠকে গেছি। ”
সুরমা বেগম আজ মেয়ের উপর কোনো রাগ দেখালেন না, বকলেন না, মারলেন না। কিচ্ছু করলেন না। শুধু নিজের সঙ্গে জড়িয়ে রাখলেন।

পলাশ সুহাসের হাতে মার খেল খুব। না কোনো আত্মপক্ষ সমর্থন আর না কোনো বাঁধা। পড়ে পড়ে মার খেতে লাগলো। সুহাসও সুযোগ পেয়ে ইচ্ছেমতো মারলো। ঘুষি মেরে নাক, মুখ ফাটিয়ে ক্ষ্যান্ত হলো না শুধু। লা* ত্থিও মারলো। দীপা এসে সুহাস কে থামালো। বলল,
“থামুন এখন। ওনাকে মেরে আপনি জেলে যেতে চান।”
সুহাস তখনও রাগে ফুসছে। ও পারলে মেরেই ফেলতো যেন।

সুরমা বেগম মেয়েকে কোনো প্রশ্ন করলেন না। সুহাস, দীপা এরাও না। সারারাত সবাই জেগে বসে রইলো। শাওন সারারাত মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। একটুও থামলো না। এক পর্যায়ে সুরমা বেগম কাতর গলায় বললেন,
“মা’রে সেই কখন থেকে কাঁদছিস একটু ক্লান্তও হচ্ছিস না।”
শাওন কান্না থামায় না। কাঁদতে কাঁদতে নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়। গলা ব্যথা হয়ে আসে। তবুও চোখের পানি ফুরোয় না।

আজকের সকাল টা অন্যান্য সকালগুলোর মতোই। ভোরে পাখির কিচিরমিচির ডাক শোনা যায়, হাড়ি পাতিল, বাসন কোসন এর টুংটাং আওয়াজ শোনা যায়। পাশের বাসার ছেলেটার ঘুম ভাঙানোর আওয়াজ শোনা যায়। বিরক্তিহীন ভাবে ছেলেটার মা ডেকে যাচ্ছে। সাত টার মধ্যে কোচিং ধরতে হবে যে। অথচ এই বাড়িতে আজকের ভোর টা ভীষণ অন্যরকম। সকালে চুলায় চায়ের পানি ফুটেনা। অফিসে, কলেজে যাবার তাড়া নেই। সময় থাকতে থাকতে রান্নাগুলো শেষ করার তাড়াও নেই। এই বাড়ির মানুষ চারটা আজ ভালো নেই।

সুহাস বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট জ্বালায় একের পর এক। দুটো টান দিয়েই ফেলে দেয়। অতো বেশী সিগারেট খাবার অভ্যাস ওর নেইও। খুব ছটফটানি যখন হয় তখন একটা দুটো খায়। দীপা বারান্দায় এসে সুহাস কে দেখে গেল। এক গ্লাস পানি এনে সামনে দিলো। পানি গ্লাস সুহাস হাত বাড়িয়ে নিলো ঠিকই কিন্তু দীপার দিকে তাকালো না। ওর দৃষ্টি বাইরের দিকে। দীপা চলে আসতে গেলে সুহাস ডেকে বলে,

“দীপা শোনো!”
“হু।”
“শাওন কী কিছু বলেছে?”
“না। এখন একটু ঘুমাচ্ছে। ঠিক ঘুম না, তন্দ্রাভাব। ”
“আচ্ছা।”
দীপা আবার পা বাড়ায়। সুহাস আবার ডাকে।
“দীপা।”
“বলুন।”
সুহাস কিছু বলে না। দীপার দিকে তাকিয়ে থাকে দিশেহারা চোখে। দীপাও কিছু বলে না। তাকিয়ে থাকে সুহাসের চোখের দিকে।

গতকাল একটা বিভীষিকাময় দিনের সঙ্গে মোকাবিলা করে নতুন দিনের সূচনা হলো। কিন্তু খারাপ জিনিস কী এতো সহজে পিছু ছাড়ে! শাওনের সেই বোকা কিংবা স্বার্থপর প্রেমিক পুরুষ টি আজ ওর বাসার সামনে এসে হাজির। লোক জানাজানির কিছু বাকী রইলো না আর।

সুহাস মারতে গেলে সুরমা বেগম বাঁধা দিলেন। মারামারিতে ঝামেলা বাড়বে। তিনি অনুরোধ করেন পলাশ কে চলে যেতে। পলাশ যাবে না। শাওনের সঙ্গে দেখা না করে কিছুতেই যাবে না।
এই নাটকীয় ঘটনা পলাশ না ঘটালে হয়তো শাওনের ব্যাপার টা এক্সিডেন্ট বলে চালানো যেত। কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। বেলা যত বাড়তে লাগলো তত লোকজনের আসা যাওয়া প্রশ্নপর্ব চলতে লাগলো। যারা জীবনেও সাতে পাঁচে থাকে না ওদের তারাও এসে ভীড় জমাতে লাগলো।

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১২

সামনের দিনগুলো যে শাওনের জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর হতে যাচ্ছে সেকথা বুঝে যায় বাড়ির সকলে।

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১৪