কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১৫

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১৫
সাবিকুন নাহার নিপা

সোবাহান সাহেব নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক। এই একটা ব্যাপারে লোকের সঙ্গে তিনি একমত। তার আত্মীয়, অনাত্মীয় কাছের দূরের লোকেরা সামনাসামনি তাকে সম্মান দেখালেও পিছনে যে মুন্ডুপাত করে এটা তিনি জানেন। তাতে তার কিছু যায় আসে না। তার অন্তরে মায়া মহব্বত কম। সবার জন্যই কম।

স্ত্রী, পুত্রর জন্য তিনি খুব একটা মায়া অনুভব করে না। ছেলের পিছনে যাবতীয় খরচা খরচ যা করেছেন সবকিছুই ভবিষ্যৎ ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে করেছেন। স্ত্রীর ক্ষেত্রেও ব্যাপার টা তেমন। শুধুমাত্র নিজের প্রয়োজন আর স্বার্থ ছাড়া এদের প্রতি আর কিছুই অনুভব করেন নি। কিন্তু মেয়ের ক্ষেত্রে এই বাক্য মিলবে না। মেয়েকে তিনি ভালোবাসেন। মায়া, ভালোবাসার ব্যাপার টা তিনি প্রথম অনুভব করেছেন মেয়ের জন্মের পর। তার আগ পর্যন্ত বৃদ্ধ বাবা, মা’র প্রতিও তার কোনো অনুভূতি ছিলো না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শাওনের জন্মের সময় তিনি কাছে ছিলেন না। মেয়েকে দেখতে আসার কোনো প্রয়োজনও অনুভব করে নি তখন। যখন ছুটিতে বাড়িতে এলেন তখন শাওনের বয়স প্রায় পাঁচ মাস। না জানিয়ে যাওয়া। গরমের দিন তখন। সুরমা হঠাৎ স্বামীকে দেখে প্রয়োজনের চেয়ে বেশী সতর্ক হয়ে গেলেন। দুপুরের রান্না জলদি করার চেষ্টায় পাঁচ মাসের মেয়ের কান্নাও তার কানে যায় না। সোবাহান সাহেব বিরক্ত হলেন খানিকটা। সুরমা কে ডাকতে গিয়েও থেমে গেলেন। কী যেন ভেবে মেয়ের কাছে গেলেন। আশ্চর্য ব্যাপার হলো সোবাহান সাহেব কে দেখে শাওন কান্না থামালো। চোখ ভর্তি জল নিয়ে শাওন বাবার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সোবাহান সাহেব মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন। হাত বাড়িয়ে শাওন কে কোলে নিলেন। শাওন কোলে উঠে বাবার দাঁড়ি খামচে ধরে হাসলো।

যে মানুষ টা এতকাল জানতেন মায়া, মমতা বলে জগতে কিছু হয় না। সেই মানুষ টা তার শিশুকন্যার প্রতি প্রগাঢ় মায়া অনুভব করলেন। এই ভালোবাসায় কোনো স্বার্থ নেই, উদ্দেশ্য নেই। সত্যিকারের ভালোবাসা। এই মেয়েকে তিনি সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দিয়েছেন। স্কুলে পড়ার সময় মেয়ে সাইকেল নিয়ে পাড়া বেরিয়েছে তখনও একবারও বাঁধা দেয় নি। মেয়ের মন খারাপ হয়ে যাবে। আর সেই মেয়ে তার বিশ্বাসের এমন প্রতিদান দিলো!

সোবাহান সাহেব বাড়ি এসেছেন সকালে। কারোর সঙ্গে কোনো কথা বলেন নি। সুরমা বেগম এই প্রথম স্বামী কে দেখে তেমন ব্যস্ত হলেন না। দীপা পড়তে না বসলে ও’কে হয়তো বলতেন রান্নাঘরের দিক টা দেখতে। গত কয়েকদিন ধরে টের পাচ্ছেন যে শরীর টা আর চলছে না। একটু বিশ্রাম দরকার। ভালোরকম বিশ্রাম দরকার। কতদিন বিশ্রাম নেয়া হয় না। সকাল, বিকেল বিছানায় শুয়ে থাকবেন। মন চাইলে একটা বই পড়বেন। সময়মতো খাবেন। নিয়ম নীতি বাদ দিয়ে চিনি দিয়ে দুধ চা খাবেন। এমন একটা বিশ্রাম দরকার। কিন্তু এমন কপাল তার নেই।

সুরমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। রুটিগুলোতে পোড়া দাগ পড়েছে। এতো বেখেয়াল হয়েছেন!
সোবাহান সাহেব আজ কিছু বলছেন না। চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছেন। অন্যান্য দিন হলে এই নিয়ে কম করে হলেও দশ টা কথা শোনাতেন। খাওয়া রেখে হঠাৎ সুরমা বেগম কে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার মেয়ের কী অবস্থা?”
সুরমা বেগম স্বাভাবিক গলায় বললেন,
“আমি কোনো অবস্থা দেখছি না।”

“যাই হোক, ওর ব্যাপারে আমার আর কোনো আগ্রহ নেই। আমি চেষ্টা করব আমার বাড়ি থেকে ওকে তাড়াতাড়ি বের করার। তবে একটা কথা মনে রাখবা, ওর পিছনে আমি এক গ্লাস শরবতের খরচাও আর করব না।”
সুরমা বেগম কোনো কথা বললেন না। এই চিন্তা যদি আগে করতো তাহলে আজ আর এই দিন দেখতে হতো না।

শাওনের দিন গুলো আগের মতোই কাটছে। কোনো রাত নির্ঘুম ই কেটে যায়। আবার কোনো রাতে ঘুমের কারনে কিছু টের পায় না। সকাল শুরু হয় আকাশের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে, রাত নামে সিলিং ফ্যানের দিকে শূন্য চোখে চেয়ে থেকে। দশ টা দোকান খুঁজে নীল, সাদা ওড়নাটা পড়ে আছে অবহেলায়। সেটার দিকে তাকালেও কেমন বিতৃষ্ণা লাগে।
শাওন এতো বছরের জীবনে এই প্রথম অবহেলা আর ঘৃনা নামের বিষয় টার সঙ্গে প্রথম পরিচিত হলো। অথচ ও কাউকে কখনো ঘৃনা করে নি। অবহেলার তো প্রশ্নই আসে না। তবুও কেন ওর জীবনে এসব ঘটলো!

দীপার উপর একরকম রেগেই আছে সুহাস। সবসময় চোখ নামিয়ে কথা বলা মেয়েটা চোখে চোখে রেখে স্বার্থপর তকমা টা লাগিয়ে দিলো ওর গায়ে! সুহাস স্তব্ধ হয়ে যায়। মানুষ তার সমগ্র জীবনে সবচেয়ে বেশী ভয় পায় সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে। সুহাসের স্তব্ধ হবার কারণও সম্ভবত সেটাই।
সেই কারনেই রাগী গলায় দীপাকে প্রশ্ন করেছিল,

“আমি স্বার্থপর? ”
“জি। মানতে কষ্ট হলেও এটা সত্যি যে আপনার বাবার স্বার্থপর স্বভাব আপনার মধ্যেও কিছু আছে।”
সুহাস বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে। এই কথার পিঠে বলার কিছু খুঁজে পায় না। বিড়বিড় করে বলে,
“যাও এখান থেকে। ”
দীপা চলে আসে। যতটুকু বলা দরকার ছিলো বলেছে। সুহাস যেমন ভাবে নেয় নিক। ওর তো কিছু হারানো ভয় নেই। হারানোর ভয় তো তার থাকে, যার কিছু আছে। ওর তো কিছুই নেই।

সুরমা বেগম দিলশাদ কে দেখে খুব অবাক হলেন। সেই সঙ্গে খানিকটা অপ্রস্তুতও। দিলশাদ কী বুঝলেন কে জানে! জিজ্ঞেস করলেন,
“না জানিয়ে আসায় সমস্যা হয়েছে নাকি? তোর মুখ টা এমন লাগছে কেন?”
সুরমা বেগম। পাশে দাঁড়ানো রিতিকে একটু আদরও করলেন। বসার ঘরে ঢুকে রিতি জিজ্ঞেস করলো,
“আন্টি শাওন আপু বাসায় নেই?”
সুরমা বেগম প্রসঙ্গ এড়াতে চাইলেন। বললেন,

“কী খাবে মা? ”
দিলশাদ খটকাটা টের পেলেন একটু একটু।
দিলশাদ যতই ছেলেকে মাথা ঘামাতে বারন করুক, নিজে ঠিকই মাথা ঘামাচ্ছেন। সুরমাকে ফোন করেছিলেন, ফোন ধরেনি। ফোন টা বেজে কেটে গেছে। প্রথমবার ভেবেছিল ব্যস্ত, তবুও ব্যস্ততা কেটে গেলে তো একটা ফোন দিতে পারতো ! এর পরে যতবার ফোন করেছে একই ব্যাপার ঘটেছে।

এই ব্যাপার টা সে কারোর সঙ্গে শেয়ার করেন নি। রিশাব কিংবা ওর বাবাকেও না। তবে তারও কেন যেন মনে হচ্ছে শাওনের কোনো বিপদ হয়েছে। কারণ সেদিন ওর মা যেভাবে ওর জন্য কাতর হয়েছেন।
সাত, পাঁচ ভেবে দিলশাদ শাওন দের বাড়িতে গেলেন। সঙ্গে অবশ্য রিতিকে নিয়ে এলেন। রিতির আজ আবার ক্লাশ ছিলো না। তাই সঙ্গে নেয়া।

না চাইতেও দিলশাদ কে সব টা জানাতে হলো। অবশ্য জানানোই ভালো মনে করলেন। দশজনের থেকে দশ রকম কথা না শুনে বরং তার থেকেই শুনুক। দিলশাদ অবাক হয়ে গেলেন শাওন কে দেখে। এই মেয়েটাকে সেদিন কী দেখেছিল আর আজ কী দেখলো। রিতিও খুব মন খারাপ করলো। দু:খী গলায় বলল,

“আন্টি আপুকে ডাক্তার দেখাও৷ আপুর মেন্টাল হেলথের ট্রিটমেন্ট দরকার আন্টি। ”
দিলশাদ শাওনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“এখন কেমন আছ মা?”
দীপা বাদে আরও একজনের আদুরে স্পর্শে শাওনের চোখে পানি এসে গেল। স্মিত হেসে বলল,
“বেঁচে আছি আন্টি।”
দিলশাদ শাওনের একটা হাত ধরে বললেন,

“বেঁচে থাকাটাই আল্লাহর বড় নিয়ামত মা। তুমি যে বললে না, বেঁচে আছ! জানো, অনেকে এটাও বলার সুযোগ পায় না।”
শাওনের চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। দিলশাদ চৌধুরী যতক্ষন ছিলেন শাওনের হাত ধরেই ছিলেন। শাওন নি:শব্দে কেঁদেছে। উনি একবারও বলেন নি যে কেঁদো না। বরং কাঁদতে দিয়েছেন।

দিলশাদ বাসায় আসার পর রিশাবের সঙ্গে কথা বলেছেন। কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই রিশাব কে জিজ্ঞেস করেছেন,
“রিশু আমি কী তোমাকে একটা পার্সোনাল প্রশ্ন করতে পারি?”
রিশাব একটু চমকালো। মাথা নেড়ে বলল,
“হ্যাঁ মা।”
“তুমি কী কমিটেড?”
রিশাব জবাব দিতে দেরি করলো না। মা বললেন,
“তুমি কী শাওন কে বিয়ে করবে?”
হঠাৎ এমন প্রশ্নে রিশাব অপ্রস্তুত হয়ে যায়। মা আরও বলেন,

“শাওনের একটা পাস্ট আছে। মাস খানেক আগে ও ওর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে তার বাসায় যায়। সেখানে ও’কে জোরপূর্বক আটকে রেখে বিয়ের প্ল্যান করা হয়। মেয়েটা সেই ফাঁদ থেকে বুদ্ধির জোরে বেরিয়ে আসে। চঞ্চল, প্রানবন্ত মেয়েটা প্রায় শেষ হবার পথে। আমি ভীতু মানুষ নই।

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১৪

কিন্তু এই মেয়েটাকে দেখে আমি ভীষণ ভয় পেয়েছি৷ আমি তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। কোনো তাড়া নেই। তবে তোমার উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে একটা ব্যাপার তোমাকে মাথায় রাখতে হবে। তুমি কখনো শাওন কে প্রশ্ন করতে পারবে না যে সেদিন ওর সঙ্গে ঠিক কতটা খারাপ হয়েছিল। আমি এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করিনি৷ এটা একটা মেয়ের কাছে জিজ্ঞেস করা মানে তাকে অপমান করা। তুমি যদি প্রশ্নহীন ব্যতিত ওর অতীত মেনে নাও। তবেই এই বিয়েতে হ্যাঁ বলবে।

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১৬