বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ৩৩

বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ৩৩
ফাতেমা তুজ নৌশি

বাসায় ফিরেই উষশীকে খুঁজে চলেছে অভিরাজ। লাবণ্য’র হাতে খাবারের বাটি। সেটা রেখে শুধাল,”কি হয়েছে?”
“উষশী কোথায় রে?”
“ছাদে গিয়েছে। কোকো কে নিয়ে সুইমিংপুলে গোসল করছে।”
“আচ্ছা। ব্যাগ গুলো ধর। উষশী’র জন্য জামা কাপড় এনেছি। আর একটা ফোন।”
“এটা ভালো করেছিস।”
“হুম। যাই আমি। তুই খাবার রেডি কর। এসে একসাথে খাব।”

চটজলদি উঠে গেল অভিরাজ। উষশী ভীষণ আনন্দে সুইমিং করছে। কোকো ও বেশ ভালো সঙ্গ দিচ্ছে। ধীর পায়ে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে অভিরাজ। উষশী বেশ গোপনীয় ভাবে কোকোকে কিছু বলছে। সেটা শোনার জন্যেই চুপিসারে এসেছে অভিরাজ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

“কোকো, একটা কথা বলো তো। মিস্টার রাগি আমাকে বেশি ভালোবাসে। নাকি আমি মিস্টার রাগিকে বেশি ভালোবাসি?”
কোকো মিউ মিউ করল। ওর নিজস্ব ভাষা না থাকলেও কথাটা মিলিয়ে নিল কিশোরী। তার মুখটা মলিন হয়ে গেল। কিছুটা মন খারাপের সুর টেনে বলল,”এখন কি হবে? আমি কেমন করে ওনাকে বেশি ভালোবাসব। প্লিজ বলো না কোকো। বলো না কি করলে মনে হবে ওনার থেকেও বেশি ভালোবাসি।”

প্রাণীটা উত্তর না দিতে পারলেও উত্তর দিল অভিরাজ। সে হাসছে। তার হাসিতে যেন সব কেমন সুন্দর হয়ে উঠল।
“নিয়ম করে চুমু দিতে পারো। তাহলেই বেশি ভালোবাসো,প্রমাণ হবে।”
চমকে তাকাল উষশী। ফলস্বরূপ ওর কোল থেকে ছিটকে পানিতে পড়ে গেল কোকো। প্রাণীটা ডুব দিয়ে উঠেছে। সাদা লোম গুলো একেবারে লেপ্টে গিয়েছে। অদ্ভুত দেখাচ্ছে। অভিরাজ তার লম্বা হাতের সাহায্যে পানি থেকে কোকোকে তুলে নিল। হাতের সাহায্যে জল সরিয়ে বলল,”দেখলি কোকো তোর বন্ধু কতটা ভীতু। নিজেকে সাহসী বলার চেষ্টা চালালেও একদমই সাহসী নয়।”

ওর কথায় চোখ ছোট করে ফেলল উষশী। কিছুটা জোর দিয়ে বলল,”মোটেও না। আমি কখন ভয় পেলাম?”
“চুমুর কথা শুনেই তো ভয় পেয়ে গিয়েছ।”
“লিসেন, উষশী পল কাউকে ভয় পায় না।”
“তাই?”
“হুম। ইফ ইউ ওয়ান্ট আই ক্যান প্রুভ।”
বেশ ভাব নিয়ে বলল উষশী। অভিরাজ ও কম যায় না। তার মস্তিষ্কে দুষ্টুমি এল।

“রিয়েলি?”
“হুম। প্রমাণ চাচ্ছেন?”
“হুম। আসি তাহলে?”
“আসুন। আমি কাউকে ভয় পাই না।”
সত্যিই পানিতে নেমে এল অভিরাজ। এতটা আশা করে নি কিশোরী। কোকো উপর থেকে লাফাচ্ছে। ঘুরপাক খাচ্ছে চারপাশ জুড়ে। সে বড়ো আনন্দিত। উষশী সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে বলল,”চ্যালেঞ্জ করলেন?”
“ধরো,তেমনি কিছুটা।”

অভি দেখতে চাইছিল উষশী কতটা যেতে পারে। সে মজার ছলে বললেও বিষয়টা সিরিয়াস ভাবে নিয়েছে কিশোরী। সেটা খুব করে বুঝতে পারল অভিরাজ। তারা এখন বেশ নিকটে অবস্থান করছে। দুজনের দৃষ্টি একে অপরের মুখে। শ্বাসের গতি শোনা যাচ্ছে। নিশ্বাস গুলো বিপরীতে লুটপাট চালাচ্ছে। হুট করেই উষশী তার সিক্ত হাতটা অভিরাজের গালে স্পর্শ করাল। মেয়েলি স্পর্শে অভি’র চিত্ত কেঁপে উঠল। চারপাশ থেকে কেমন মন ভালো করা সুর ভেসে আসছে। আকাশে রয়েছে পূর্ণ চাঁদ। আর সেই চাঁদের আলোতে উষশী’র রূপ যেন কয়েক গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের সুন্দর মুহূর্তে আজ কোনো বৃষ্টি নেই। তবে এক সমুদ্র ভালোবাসা রয়েছে।

ড্রেস চেঞ্জ করে নিচে নেমে এল উষশী। আগেই সেখানে উপস্থিত ছিল অভিরাজ। মেয়েটির কাঁধসম চুল গুলো বড়ো সুন্দর। দেখলেই লোভ জাগে। অভি নজর ঘুরাল। লাবণ্য খাবার বেড়ে দিচ্ছে। খাওয়ার মাঝে হুট করেই কথাটা তুলল লাবণ্য।
“উষশী’র প্যারেন্স এর খোঁজ কতদূর?”

“আগের মতোই। লোকটা খোঁজ পেলে জানাবে বলেছে। তবে বুঝতে পারছি না কতটা লাভ হবে।”
উষশী’র মুখে হাসি নেই। মেয়েটি চুপসে গেল যেন। লাবণ্য’র খারাপ লাগল। কথাটা এখন বলা উচিত হয় নি। এতদিন ধরে পরিবার পরিজন ছেড়ে আছে মেয়েটি। একটা কষ্ট নিশ্চয়ই তাড়া করে বেড়ায়।

“উষশী?”
“হুম আপু।”
“মন খারাপ হলো?”
“উহু।”
“মন খারাপ কোরো না সোনা। তোমার মম কে পেয়ে যাব।”

চেষ্টা করেও উষশী’র মন ভালো করতে পারল না লাবণ্য। হতাশ হতে হলো তাকে। বারং বার মায়ের কথা স্মরণ হচ্ছে কিশোরী’র। অভি এই পুরোটা সময় চুপ ছিল। সত্যি বলতে তার মন মস্তিষ্কের দ্বন্দ্ব চলছে। যখনি উষশী’র চলে যাওয়ার কথা স্মরণ হয় তখনি ভেতরটা জ্বলে উঠে। মনে হয় সব কেমন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। একটা বেদনা সার্বক্ষণিক পিছু নিচ্ছে।
লাবণ্য’র ইন্টার্নশীপ থাকায় তাকে যেতে হচ্ছে।

যাওয়ার পূর্বে অবশ্য উষশী’র সাথে দেখা করল। মেয়েটিকে বেশ আদরের সহিত বোঝাল। তবে কিছুতেই কিছু হলো না। সময় নেই বিধায় চলে যেতে হচ্ছে। তবে ভেতরটা খচখচ করছে। উষশী’র প্রতি কোনোকালেই রাগ ছিল না। সার্বক্ষণিক একটা কষ্ট তাড়া করে বেড়ালেও মেয়েটির প্রতি তার নিখাদ ভালোবাসাটা অস্বীকার করার মতো না।
অভি জানালার পর্দা লাগিয়ে বলল,”উষশী, এতটা মনমড়া হলে চলবে?”

“হুট করেই খুব খারাপ লাগছে।”
“এদিকে আসো।”
উষশী কাছে আসতেই তার বাদামি চুলে হাত গলিয়ে দিল অভিরাজ। একটা ভালো লাগা এসে ভর করল। ছেলেটির শরীরের উষ্ণতায় চুপসে যাচ্ছে সে। বুকের ভেতরে আলোড়ন সৃজন হয়েছে।
“অভ্যাস জিনিসটা অনেক খারাপ উষশী। না ছাড়া যায় আর না সর্বদা ধরে রাখা যায়।”
“হুম।”

“এই যে আমরা। একে অপরের সাথে আছি। বলা বাহুল্য একটা সম্পর্ক পার করছি। অথচ শুরুতে কতটা রিয়েক্ট করেছিলে তুমি। জেদ করেছিলে। এখন সব মানিয়ে নিয়েছ। তবু অভ্যাসটা রয়ে গেছে। অতীত আমাদের পিছু নিতে ভুল করে না। কখনো না কখনো স্মরণ হবেই। এসব চাইলেও ভোলা যায় না। সব মেনে নিয়ে চলতে হবে আমাদের। নতুবা জীবন কাটানো দুষ্কর হয়ে পড়বে।”

“আপনাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে আমার।”
“বোকা মেয়ে। আমরা কখনো একে অপরকে ছাড়ব না। কি ছাড়ব কি?”
“উহু। আপনাকে ছাড়া থাকতেই পারব না।”
মৃদু হাসল অভিরাজ। মেয়েটিকে বুঝ দিলেও নিজের ভেতরটা অশান্ত হয়ে রইল। উষশী’র ফুলের মতো মুখটা দু হাতে স্পর্শ করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছু সময় পর বলল, “সোশ্যাল মিডিয়ায় আছ নিশ্চয়ই?”
“হুম। তবে তেমন যাওয়া হতো না।”

“ফোন এনেছি। সেটা এখন থেকে ব্যবহার করবে। সারাক্ষণ আমি কিংবা লাবণ্য তো পাশে থাকব না। কাজের চাপ বেড়েছে এখন থেকে অনেকটা বুঝদার হতে হবে রেইন।”
সত্যিই বুঝদার হলো উষশী। একটুও মন খারাপ করল না সে। বরং আলগোছে অভি’র বুকে মুখ ডুবিয়ে শ্বাস নিল। ছেলেটা’র শরীর থেকে আসা মারাত্মক ঘ্রাণটা একেবারে মস্তিষ্ক অবধি চলে গেল। পুরো রাত ঘুমাতে পারল না মেয়েটি। শুধু মনে হতে লাগল এই মানুষটা ওর পিছু ছাড়বে না। শারীরিক দূরত্ব হাজার মাইল হয়ে গেলেও মস্তিষ্কের প্রতিটা শিরায় রাজত্ব চালাবে মানুষটার উষ্ণতা।
বর্তমান

ডেনমার্কের সবথেকে বড়ো বারে পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। অভি চাইছে এমন ভাবে সব প্রেজেন্ট করতে যেন নাকোচ করার কোনো অপশন না থাকে। লাবণ্য বেশ সুন্দর পোশাক পরে এসেছে। তাকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। বয়স কমে গিয়ে একত্রিশ থেকে যেন একুশ হয়ে গিয়েছে। আগে হলে অভি প্রশংসা করত। তবে এখন আর তেমনটা হয় না। তবু লাবণ্য ছেলেটার নজরে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে। ঈশান ও এসেছে ওদের সাথে। আকাশ কিছুটা মেঘলা। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। সময় নিয়ে সেটাই দেখল অভিরাজ। লাবণ্য তাগাদা দিয়ে বলল,”ওনারা অপেক্ষা করছে।”

বাহারি আয়োজনে গেস্টদের আপ্যায়ন করা হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই দারুণ আয়োজন করেছে লাবণ্য। অভি সেটার প্রশংসা করতেই একরাশ ভালো লাগা এসে ছুঁয়ে গেল লাবণ্যকে। মেয়েটি আরো দ্বিগুণ গতিতে কাজ করতে লাগল। ঈশান ও নিজের অতীত ভুলে ফ্লাইল রেডি করছে। তাকে দায়িত্বশীল দেখে ভালো লাগছে। অভি ভীড় পেরিয়ে একটু শুনশান জায়গায় এল। চারপাশ থেকে মৃদু সুরে গান বাজছে। তার তালে নেচে চলেছে কিছু ছেলেমেয়ে। সেদিক থেকে নজর ঘুরিয়ে বসতেই একটা মেয়ে এসে বলল,”হেই। ডু ইউ ওয়াননা ডান্স উইথ মি?”

“নো। থ্যাংক ইউ।”
“ওকে। এজ ইউর উইস।”
মেয়েটি চলে গেল। অভি’র ভালো লাগছে না। দীর্ঘ দিন একা থাকার ফলে এত মানুষজন সহ্য হচ্ছে না। কেমন যেন মাথা ব্যথা করছে। ওর জন্য সফট ড্রিঙ্ক পাঠাল লাবণ্য। সেটা নিয়েও কিছু সময় নাড়াচাড়া করল। কিছু খেতেও ইচ্ছে করছে না। এর মধ্যে ঈশান এসে ফাইল গুলো দেখিয়ে নিয়েছে। সব ঠিক ঠাক আছে। সে এখন সেগুলো প্রেজেন্টেশনে পাঠাবে। কাজ শেষ করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেল।

বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ৩২

কোট পরে থাকতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। তাই পোশাকটি খুলে রাখল। তারপর টাই টাও ঢিলে করে নিল। শার্টের হাতা গুটিয়ে বসতেই কিছু মেয়ে এসে ওর চারপাশে ভীড় জমাল। তারা সব নেশা করে আছে। কোনো ইঙ্গিত নয়। সরাসরি রুমডেটের অফার করতে লাগল। এত বিশ্রী অনুভূতি হলো ওর। চোখে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে উঠে যেতে নিল। ওমন সময় উচ্চ শব্দে গান বেজে উঠল। সব গুলো মেয়ে ছুটে গেল সেখানে। হৈ হুল্লোড়ের মাঝে নাচ চলছে। আর তাদের মধ্যে সবথেকে বেশি আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে শর্ট স্কার্ট পরা কাঁধসম বাদামি রঙের চুলযুক্ত শ্বেত রঙা মেয়েটিকে।

বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ৩৪