বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ৩২

বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ৩২
ফাতেমা তুজ নৌশি

জানালার পর্দা খুলতেই একরাশ শুভ্রতার দেখা মিলল। এখানকার কোলাহল মুক্ত পরিবেশ আর মিষ্টি রোদ্দুর মুহূর্তেই মন ভালো করে দিচ্ছে। অভিরাজ পূর্বের স্বভাবে ফিরে গিয়েছে। এখন নিয়ম করে সকালে শরীরচর্চা করে। খাবার খাওয়ার দিকটাও বেশ নিয়মের মাঝে চলে। নরম মিষ্টি রোদ মেখে ফ্রেস হয়ে এল। কিছু সময় পর অভি’র জন্য খাবার নিয়ে এল লাবণ্য।

“খাবারটা কোথায় রাখব?”
“টেবিলে রাখ। ঈশান উঠেছে?”
“হুম।”
“ওর সাথে কথা আছে। একটু পাঠিয়ে দে।”
“দিচ্ছি। বিকেলে কিন্তু মিটিং রয়েছে।”
“হ্যাঁ। মনে আছে।”
লাবণ্য চলে যাচ্ছিল। হুট করেই ডেকে উঠল অভিরাজ। লাবণ্য ফিরে এসে একদম বরাবর দাঁড়াল।
“হু?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

“আর কতটা কষ্ট দিবি নিজেকে?”
“এসব কথা বলতে নিষেধ করেছি অভি।”
“অথচ আমি বিষয় গুলো ভুলতে পারি না। তোর কাছে আমি বড়ো ছোট হয়ে যাচ্ছি। একজন অকতৃঘ্ন মানুষ হিসেবে নিজেকে রাঙিয়ে তুলছি।”
“থাক না এসব কথা। আমার ভালো লাগে না।”
“আমার ও লাগে না।”
“কী?”

“তোকে কষ্ট পেতে দেখলে। আমার জন্য নিজের জীবনের সব থেকে সুন্দর সময় গুলো নষ্ট করে চলেছিস। এর কি ব্যাখা দিব এই পৃথিবী’র কাছে?”
“এর কোনো ব্যাখা নেই অভি। যত দিন না তুই আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে আসছিস অথবা উষশীকে ফিরে পাচ্ছিস ঠিক ততদিন আমি তোর পাশে থাকব। স্বার্থপরতার সাথে কিংবা স্বার্থহীন ভাবে। এটা নিয়ে পৃথিবীতে কে কি ভাববে সত্যিই আমার যায় আসে না অভি।”

লাবণ্য চলে গেল। হয়ত তার চোখ দুটি সিক্ত হতে শুরু করেছিল। অভি ধীর স্থির ভাবে বসল। মেয়েটিকে কিছুতেই বোঝানো গেল না। অথচ ওর ভেতরের চাওয়াটা যে একেবারে অনুচিত সেটাও নয়। প্রতিটা মানুষ চায় তার প্রিয় মানুষের সঙ্গ পেতে। যেমনটা অভিরাজ চায় উষশীকে, কিংবা উষশী চেয়েছিল অভিরাজকে। ঠিক তেমনি লাবণ্য চেয়ে চলেছে। অথচ তিনটি জীবন তিনটি ব্যাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে। অভি তখন খাবার খাচ্ছে। দরজার কাছে এসে দাঁড়াল ঈশান। একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,”ডেকেছিলে ব্রো?”

“হুম। এদিকে এসে,বোস পাশে।”
“বল,কি বলবে।”
“খেয়েছিস?”
“না। একটু পর খাব।”
“ঠিক আছে। যেটার জন্য ডেকেছিলাম। হুট করেই জব ছেড়ে বিজনেসে আসার ইচ্ছে হলো কেন?”
“জবের টাকায় পোষায় না।”
“এতদিন তো দিব্যি চলছিল।”
“হুম। বাট ব্রো সামনে পার্টনার হবে। দোক্কা হলে খরচ তো বাড়বে তাই না?”
“বিয়ে করবি?”

“না করার তো কিছু নেই।”
“গুড ডিসিশন। বাট সেটা ছোঁয়া হয়ে থাকলে ভুলে যা।”
মুখ ফিরিয়ে নিল ঈশান। অভি নিরুপায়। করুণ তার চোখের দৃষ্টি।
“ছোট থেকেই বড়ো আদরে বড়ো করেছি তোকে। এমন কিছু করিস না। যাতে ভালোবাসার জায়গাটা ঘৃণায় পরিনত হয়।”
অভি উঠে গেলেও বসে রইল ঈশান। তার দুটি চোখ জ্বালা করছে। অধর রাঙানো অতৃপ্তির হাসি। সে যখন নিজেকে গোছাতে চায় তখুনি একটা ঝড় এসে সব লন্ডভন্ড করে দেয়।

অতীত
উষশীদের লোকাল গার্ডিয়ানের নাম আজাহার আহমেদ। ভদ্রলোক দীর্ঘদিন শহরের বাহিরে ছিলেন। ফিরেই অভিরাজের সাথে দেখা করতে এসেছেন। খবরটা যখন থেকে পেয়েছে তখন থেকেই বুকের ভেতরটা কেমন ছটফট করতে লাগল। বেশ কিছু সময় বসে রইল ছেলেটা। লাবণ্য এসে দু বার ডেকে গিয়েছে। অথচ এক পা এগোনোর সাহস হচ্ছে না। বেশ সময় নিয়ে নিজের মন মস্তিষ্ককে বুঝিয়ে বেরিয়ে এল। অভি’র লম্বা চওড়া দেহটা দৃশ্যমান হতেই উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক। হাত মিলিয়ে বললেন,”আমি আজাহার আহমেদ।”

“জী বসুন।”
“উষশী’র মম সাব্রিয়া আমার বন্ধু। আমার আন্ডারেই এসেছিল ওরা।”
“উষশী’র মা বাবা’র কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। ওদের বাসাটা বন্ধ আছে।”
“জানি আমি। আসলে দীর্ঘদিন ধরে শহরের বাইরে ছিলাম। তাই খোঁজখবর হয় নি। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা না।”
“উষশী’র মম। আই মিন সাব্রিয়া পলের বাবার বাড়ির ঠিকানা নিশ্চয়ই জানেন?”
মুখটা বির্বণ হয়ে গেল আজহারের। তিনি একটা হতাশার নিশ্বাস ফেললেন।

“আসলে সাব্রিয়া এতিম ছিল। ওর বাবার ফ্যামিলি বলতে কেউ নেই।”
“আপনি কত সময় ধরে চিনেন ওনাকে?”
“ভার্সিটি থেকে। আমরা একই ভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করেছি।”
বেশ সমস্যায় পড়ল অভিরাজ। উষশীকে নানা বাড়ি সম্পর্কে একবার জিজ্ঞাসা করেছিল। তবে এই বিষয়ে কোনো উত্তর করতে পারে নি কিশোরী।

“উষশী’র বাবার ঠিকানা তো থাকার কথা?”
“সরি। বাট বাধ্য হয়েই বলতে হচ্ছে ওদের ডিভোর্স হওয়ার কথা চলছিল। সেই জন্যেই দেশে পালিয়ে এসেছিল সাব্রিয়া। যাতে করে ডিভোর্সটা না হয়। এসব যদিও সিক্রেট ছিল তবু বলতে বাধ্য হলাম।”
এই ধাক্কাটা আসলেই সামলানোর মতো ছিল না। বেশ ধাক্কা খেল অভিরাজ। বুকের ভেতর কেমন করে উঠল। উষশী’র ভবিষ্যৎ কতটা বিঘ্ন হতে চলেছে সেটা ভেবেই কষ্ট হচ্ছে।

উষশী’র নরম তুলতুলে হাতটা অভিরাজের বুকে লুটপাট চালাচ্ছে। মেয়েটি তখন থেকে হাতের সাহায্যে কি যেন আঁকুবুঁকি করে চলেছে। এতেই যেন সবটুকু সুখ খুঁজে পায় কিশোরী। ওদের পায়ের কাছে বসে আছে কোকো। পরম আনন্দে খাবার খাচ্ছে প্রাণীটা। অভি’র সমস্ত ধ্যান আজ অন্যদিকে। আজাহারের বলা কথা গুলো নিশ্চয়ই মিথ্যে নয়। উষশীই বলেছিল সে তার মায়ের সাথে এসেছে। বাবার কথা খুব বেশি স্মরণ ও করে না মেয়েটি। এতেই বোঝা যায় কথা গুলো সত্য। বাবা মায়ের বিচ্ছেদ হওয়ার কথা জানলে নিশ্চয়ই কষ্ট পাবে। তাই বিষয়টি চেপে গেল সে। একটা সময় পর উষশী বলল,”সব অসহ্য লাগছে। আপনি এমন আপসেট হয়ে আছেন কেন?”

“আপসেট?”
“হ্যাঁ। তখন থেকে দেখছি কেমন চুপচাপ।”
“চুপচাপ তো প্রায়ই থাকি।”
“মিস্টার রাগি,কি হয়েছে?”
“কিছু হয় নি উষশী।”
“মিথ্যে বলছেন?”
“উহু।”

কথাটা বিশ্বাস হয় নি কিশোরী’র। তাই সে রাগ দেখিয়ে চলে যাচ্ছে। ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে হেসে উঠল অভিরাজ। শব্দ করে হাসার দরুণ পেছন ঘুরে তাকাল কিশোরী। নাক কুঁচকে বলল,”কোকো,এখানে থাকার দরকার নেই। মিস্টার রাগি বদলে গিয়েছে।”
“জেদি মেয়ে শুনে যাও একটু।”
“শুনব না।”
“আরে।”
“কথা বলবেন না আমার সাথে।”

লম্বা কদমে চলছে কিশোরী। অভিরাজ সময় খরচ না করে উঠে এল। উষশী এক নজর তাকিয়ে বলল,”মিথ্যেবাদী।”
“সরি। আর কখনো মিথ্যে বলব না। তাকাও আমার দিকে।”
কথার শেষে নিজেই মেয়েটিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে। ছেলেটার ফর্সা সুন্দর মুখশ্রী’র পানে নিরলস ভাবে তাকিয়ে আছে উষশী। দুজনের দৃষ্টি যেন কোথাও হারিয়ে গিয়েছে। একটা মিষ্টি সুবাস আসছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। প্রেমের বৃষ্টি। আর সেই বৃষ্টিতে শুরু হবে ওদের বৃষ্টিভেজা আলাপন।

অভিরাজ কফি বানাচ্ছে। আর উষশী হা হয়ে দেখছে সেটা। ছেলেটা’র শরীর ঘেমে গিয়েছে দেখে খারাপ লাগল। কিশোরী উঠে গিয়ে টিসু আনল। তারপর নিজ হাতে মুছিয়ে দিল। ওর আচরণে কেমন সুখ অনুভব হচ্ছে। কতটা যত্ন,মায়া,ভালোবাসা নিয়ে তাকাল অভিরাজ সেটা ভাষায় ব্যক্ত সম্ভব না। ওর পলকহীন দৃষ্টি দেখে উষশী বলল, “দুষ্টুলোক নজর সরান।”
“চেষ্টা তো করছি। তবে সরাতে পারছি না। এত ভয়ংকর কেন তুমি?”

“বিদ্রুপ করলেন নাকি ভালোবেসে বললেন?”
“দুটোই।”
“কেমন করে?”
“দাঁড়াও দেখাচ্ছি।”
অভি এগিয়ে আসতে চাইলে বাঁধা দিল উষশী। একটু আগে লাবণ্যকে ড্রয়িং রুমে দেখে এসেছে। বাড়ির সহযোগী ও কাছেই আছেন। ওর থমকে যাওয়া ভয়ার্ত মুখটা দেখে হেসে উঠল অভিরাজ। হাত ধুঁয়ে নিয়ে একদম নিকটে এসে দাঁড়াল।

“আজকাল খুব লজ্জা পাচ্ছ রেইন।”
“সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?”
“উহু মোটেও স্বাভাবিক না। অত্যন্ত তোমার কালচারের সাথে বড়ো বেমানান।”
“ঠিক। আমার কালচারে এই আচরণ একদম স্বাভাবিক নয়। তবে আপনার কালচারে খুবই স্বাভাবিক অভিরাজ।”
উষশী’র মুখে নিজের নাম শুনে ভালো লাগল ওর। তাই আরেকটু দূরত্ব কমিয়ে নিল। বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকালে ও কিশোরী অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। তার ভেতরটা উত্তপ্ত। অথচ সামনের জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে। সেই সাথে আসছে বেলা ফুলের মিষ্টি সুবাস।

“এই কালচারের সাথে মানিয়ে নিচ্ছি। জানেন আমি খুব করে চাই আপনার সাথে জীবনের শেষ প্রহর অবধি কাটাতে। আর সেই জন্যেই বড়ো ভয় হয়। হারিয়ে না ফেলি।”
বর্তমান

চোখ খুলল অভিরাজ। সামনেই বিশাল একটা নদী। এখানে মানুষ জন নেই। শুনশান সুন্দর একটা পরিবেশ। নদীর সুন্দর জলের দিকে তাকিয়ে নিজের অতীত ঘুরে এল সে। শেষ দিন গুলোতে নিজেকে খুব করে মানিয়ে নিয়েছিল উষশী। পরিবেশের সাথে বেশ মিশে গিয়েছিল। হারিয়ে ফেলার ভয় পেত। অথচ এসব নাকি অভিনয় ছিল। ব্যপারটা কল্পণা করতেও কষ্ট হয়। মেয়েটা ওকে ছেড়ে গেল। সেই সাথে দিয়ে গেল এক বুক যন্ত্রণা! নিজের কষ্টের স্মৃতি পেরিয়ে জায়গাটা থেকে উঠে এল। শীতল হাওয়ায় কেমন ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে। এদিকে তখন থেকে ফোন বেজে চলেছে। ধ্যান হতেই তুলল সেটা। লাবণ্য’র বিচলিত কণ্ঠ।

“অভি! এটা কি করলি তুই? কত সময় ধরে অপেক্ষা করছি আমরা। ওনারা বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন।”
অভিরাজ নিশ্চুপ। সে কিছু ভাবছে। অপর পাশ থেকে হ্যালো হ্যালো করছে লাবণ্য।
“সন্ধ্যার পর ওনাদের জন্য পার্টির আয়োজন কর। আমি আসছি।”
“ঠিক আছে। সাবধানে আয়।”

হোটেলে ফিরে ঈশানের দেখা মিলল না। অভি বেশ বিচলিত হয়ে পড়ল। ঘরের চারপাশ খুঁজে নিয়ে কল করল। ফোন সুইচ অফ বলছে। এবার বেশ চিন্তা হচ্ছে। লাবণ্যকে কল করে জানাতেই লাবণ্য বলল সে আসছে। চারপাশে খুঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যার ঠিক পূর্বে ছেলেটার দেখা মিলল। পার্কের বেঞ্চে বসে আছে। দৃষ্টি যেন প্রাণহীন। ধীর স্থিরভাবে পাশে বসল অভিরাজ। তার বুকের ভেতরটা এখনো ধীম ধীম করছে।

“সন্ধ্যায় পার্টি রেখেছি। সেই সাথে মিটিং ও চলবে। যেহেতু বিজনেসে এসেছিস। তাই দায়িত্ব নিতে হবে।”
হু,না কিছুই বলছে না ঈশান। অভি ভরসা দিতে কাঁধে হাত রাখল। এতেও নড়ল না ছেলেটা। খানিক বাদে বলল,”ভাই আমি আর নিতে পারছি না। যন্ত্রণায় পুরো শেষ হয়ে যাচ্ছি। ছোঁয়া’র কান্না গুলো সহ্য হচ্ছে না। কেন এমন হতে হলো?”
অভি’র হৃদয়টা ভে ঙে যাচ্ছে। ভবঘুরে,চটপটে ঈশানের সাথে এই ঈশানের একদমই মিল নেই। দুজন যেন দুই পৃথিবী’র মানুষ। সময় মানুষকে কতটা পাল্টে দেয়।

বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ৩০

**যারা অভিরাজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করেছেন তাদের জন্য বলছি অভি কিন্তু লাবণ্যকে কখনো উসকে দেয় নি। আবার লাবণ্যকে আমরা যারা চরম লেবেলের ছ্যঁছড়া বলছি তাদের বলছি লাবণ্য কিন্তু এখানে একজন প্রতিযোগী। সবাই তার প্রিয় মানুষকে পাওয়ার প্রতিযোগিতায় নামবে। এখন কে কোন উপায়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে সেটাই দেখার বিষয়। আমি এই ব্যাখাটা দিতাম না তবে মনে হলো দেওয়া উচিত।**
**অতীত কবে শেষ হবে? সত্যি বলতে আমি এই উত্তরটা দিতে চাই না। কারণ গল্প লেখক এর প্ল্যান মতো আগাবে। আপনারা একেক জন একেক ভাবে গল্পটা চাইবেন আমি কয় জনের টা মিলাব?**

বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ৩৩