কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১৪

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১৪
সাবিকুন নাহার নিপা

দক্ষিণের জানালা দিয়ে শো শো করে বাতাস বইছে। সুরমা বেগম রান্নাঘরে শাক বাছতে ব্যস্ত। ঝোরো হাওয়া বইছে। ছাদে কাপড় শুকাতে দেয়া হয়েছিল। দীপাকে নাম ধরে ডাকলো।
“দীপা, ও দীপা…”
পরক্ষনেই মনে পড়লো যে দীপা বাজারে গেছে। ঘরে মাছ, মাংস তেমন কিছু নেই। সুহাস আবার সবজি, ভাজি এগুলো ছুঁয়েও দেখে না।

সুরমা বেগম ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন। বসার ঘর থেকে শাওনের ঘরের দরজা খোলা দেখেও ওদিকে তাকালেন না। দ্রুত পায়ে ছাদের দিকে গেলেন।
আকাশে ঘন কালো মেঘ। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। সুরমা বেগম দ্রুত হাতে জামাকাপড় গুলো তুলছেন। বৃষ্টি নামার আগে নামতে পারলে হয়। দোতলার ভাড়াটিয়া মহিলাও এসেছেন ছাদে জামা, কাপড় তুলতে। সুরমা বেগম কে দেখলেন,
“কী ভাবী সব ভালো? ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সুরমা বেগম মৃদু হেসে জবাব দিলেন,
“এই তো ভাই, তোমার কী অবস্থা? ”
ভদ্রমহিলার কাজের হাত খানিকটা শিথীল হলো। গলায় কৃত্রিম দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটিয়ে বললেন,
“শাওনের জন্য বড্ড চিন্তা হয় ভাবী। কালকে আপনার ভাইরেও বলছি…..
সুরমা বেগম দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে নামলেন। সমস্ত মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো এক মুহুর্তেই। যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই সেই একই আহা, উহু টাইপ কথাবার্তা শুনতে হচ্ছে। আর কত! আর কত শুনতে হবে এমন।

জামাকাপড় গুলো ছুড়ে মারলেন বসার ঘরের মেঝেতে। গোটা একটা জীবন কেটে গেল অশান্তিতে। এই জীবনে কী ঠিকঠাক শান্তি কখনো আসবে না। বাতাসের বেগ বাড়ছে। জানালার পাল্লায় শব্দ হচ্ছে। সুরমা বেগমের সেদিকে খেয়াল নেই। তিনি তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। এতো বুদ্ধি মেয়েটার! যে দেখতো সেই বলতো মেয়ের বুদ্ধি মা, বাবার মতো হয় নি। একদম অন্যরকম হয়েছে। কিন্তু এতো বুদ্ধি থেকে কী লাভ হলো! সেই তো নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে আনলো।
সুরমা বেগম চোখ মুছলেন। দীপা নামছে রিকশা থেকে। হাতে বাজারের ব্যাগ। এগিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু যাচ্ছেন না, আবার কার নজরে পড়বে আর কে এসে জ্ঞান দিয়ে যাবে!

দীপা ঘরে ঢুকে মেঝেতে ফেলে রাখা কাপড়গুলো উঠিয়ে রাখলো। তারপর দৌড়ে গেল শাওনের ঘরের দিকে। বারান্দার দরজা, জানালা সব খোলা। শাওন শুয়ে আছে বিছানায়। নিশ্চুপ, নির্লিপ্ত, চোখে তাকিয়ে আছে সিলিং ফ্যানের দিকে। দীপা, দরজা জানালা বন্ধ করে দিলো। ঘরটা এখন অন্ধকার হয়ে গেছে। লাইট জ্বালাতেই দেখলো খাবারের প্লেট টা যেমন রেখেছিল তেমনই আছে। শুকনো রুটি দুটো অবহেলায় পড়ে আছে প্লেটের এক কোনে। শাওন ছুঁয়েও দেখে নি। দীপা প্লেট টা হাতে নিতে নিতে বলল,

“খাবার টা খেলে না আপু… শরীর আর কত খারাপ করবে!”
শাওন জবাব দিলো না। আজকাল আর কারোর কথায় ই জবাব দেয় না। জবাব দেবার মতো কোনো কথা খুঁজেও পায় না হয়তো। চুপচাপ তাকিয়ে থাকে কেবল। দীপা প্লেট টা নিয়ে রান্নাঘরে রাখলো। সুরমা বেগম আড়চোখে দেখলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। ভাত হতে এখনো দেরি হবে। দীপা ঝটপট কিছু একটা বানানোর চেষ্টা করছে। সুরমা বেগম বাজার গুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললেন,

“দুপুরে শুধু মাছ ভাজাই করি?”
“মাছের ঝোল করুন মা। আপুর মাছের ঝোল পছন্দ। ”
সুরমা বেগম খানিকটা রুক্ষ গলায় বললেন,
“নিজের কথা ভাবো। যাকে নিয়ে ভাবছ সে চিরকাল নিজের মর্জিতে চলেছে। অহেতুক তাকে নিয়ে ভেবে তোমার আমার কী লাভ!”

দীপা কথা বাড়ায় না। এসব অভিমানের কথায় মাথা ঘামিয়ে লাভও নেই। খাবার টা নিয়ে চলে যায়। শাওন কে জোর করে উঠায়। জোর করে কিছু খাবার মুখে গুজেও দেয়। আর বলে,
“এভাবে কতদিন চলবে আপু? তুমি তো এমন না। তুমি তো সত্যিই অন্যরকম।”

শাওন তাকিয়ে থাকে অন্যদিকে। বাইরে বৃষ্টি বাড়ছে। বিকট শব্দে বাজ পড়েছে। দীপার ভীষণ মন খারাপ হয়। ওর পরীক্ষা টা না থাকলে শাওন কে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসতো। লাউকাঠী তে ওর এক ফুপু থাকেন। ওকে আদরও করেন, সেখানে বেড়াতে যেত। বর্ষাকালে পুকুর ভর্তি জল, টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ। সব মিলিয়ে দারুন সময় টা কেটে যেত।
দীপা স্মিত হেসে বলে,

“আপু শোনো, পরীক্ষাটা শেষ হলে আমরা ঘুরতে যাব কেমন! তুমি, আমি আর মা। ”
শাওন জবাব দেয় না। নির্লিপ্ত থাকে। পলাশ যখন ওকে হসপিটালে নিয়ে যায় তখনও ও জ্ঞান হারায় নি। ঠিক যে মুহুর্তে পলাশ ও’কে নিয়ে সিএনজিতে উঠলো সেই মুহুর্তে মনে হলো ও বিশ্বজয় করে ফেলেছে। আর কোনো ভয় নেই। এবার ও মায়ের কথা শুনবে। আর ভুল করবে না।

অথচ এই ভাবনাগুলো মাথায় আসার কোনো দরকার কী ছিলো! এত বছরের সম্পর্ক পলাশের সঙ্গে! কখনো খারাপ কিছু দেখে নি। সেই মানুষ টা যখন বন্ধু কিংবা সহকর্মীদের সঙ্গে প্ল্যান করে বিয়ের ফাঁদ তৈরী করলো তখন শাওনের মনে হলো এই মানুষটার সামনে অন্যরা যদি ঝাপিয়েও পড়ে ওর উপর তবে সে চুপচাপ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়েই থাকবে। কিছু করতে পারবে না।

ওই দিনের পর শাওন এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। মা, ভাইয়ার একই প্রশ্ন, কেন শাওন ওই ছেলেটার সঙ্গে বাসায় চলে গেল! একটা মানুষের কী এতটাই বুদ্ধি লোপ পায়!
আর বাবা! সে তো সবাই কে ছাড়িয়ে গেলেন। তিনি তো সরাসরি বলেই দিলেন যে, শাওন ন*ষ্ট মেয়ে। শাওন স্তব্ধ হয়ে যায়। বাবা কোনোদিন ও’কে খারাপ কিছু বলেন নি। যতটুকু স্বাধীনতা ও চেয়েছে সেটুকু স্বাধীনতা কোনোরকম প্রশ্ন ছাড়াই দিয়েছেন। সেই বাবা ও’কে এমন কথা বলতে পারলো! এরচেয়ে মায়ের মতো যদি চড়, থাপ্পড় মারতো মরে যেতে বলতো তাও হয়তো এতোটা কষ্ট হতো না।

কারো প্রশ্নের উত্তর শাওন দিতে পারে নি। কারণ নিজের বিশ্বাস, যুক্তি সব ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আজ আর ওর বলার মতো কোনো কিছু নেই। সারা পৃথিবী যদি বলে থাকে শাওন ভুল, তবে সেটাই মেনে নিতে হবে। কোনো যুক্তি, তর্ক ওর ভান্ডারে আর অবশিষ্ট নেই। সব যে ফুরিয়ে গেছে।

আর পলাশ! এই অধ্যায়ের মুখোমুখি হতে শাওন যে সাহস সঞ্চার করতে হবে তাতেই তো মনে হয় একটা যুগ কেটে যাবে।
শাওন কাঁদছে নি:শব্দে। দীপা চোখের পানি মুছিয়ে দিচ্ছে। এই কাজ টা দীপা অনেক দিন ধরেই করছে। দীপা শাওন কে জড়িয়ে ধরলো। কাঁধতে বারন করলো না। কাঁদুক শাওন।

রিশাব সেদিন ছাদ বাগানের দারুন কিছু ছবি তুলল। রিতি কিছু সবজি চাষ করেছিল ছাদে। সেগুলো তে সবজি ধরেছে। সেগুলোর ই সুন্দর ছবি তুলে শাওন কে পাঠাতে গিয়ে দেখলো পাঠানো যাচ্ছে না। প্রথম যে ব্যাপার টা মাথায় এলো সেটা হচ্ছে, শাওন কী ও’কে ব্লক করে দিলো! কিন্তু কেন!

রিশাব তারপর শাওনের নাম লিখে কয়েকটা ফোন থেকে সার্চ করলো। পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে একাউন্ট ডিএক্টিভেট করে রেখেছে। হোয়াটসঅ্যাপেও তেমন। সেদিন রাতেই রিশাব মা’কে ব্যাপার টা বলল। বাবাও তখন ছিলেন। বাবা আবার সুপার পজিটিভ লোক। সে বলল যে ওরা হয়তো কাজে ব্যস্ত আছে। শাওন হয়তো পড়াশোনায় ব্যস্ত। কিন্তু রিশাব এই যুক্তি মানতে চায় না। শাওন তো সদ্য ইন্টারমিডিয়েটে পড়া স্টুডেন্ট না যে এভাবে সবকিছু থেকে নিজেকে ডিসকানেক্ট করে পড়াশোনা করতে হবে।
রিশাব মা’কে বলল,

“মা সমস্যা না থাকলে তুমি আন্টিকে একটা ফোন করে দেখো।”
দিলশাদ গম্ভীর গলায় বললেন,
“সেটা বোধহয় জরুরী না রিশাব। ওদের সঙ্গে আমরা এতটাও ক্লোজ না যে এভাবে ফোন করে খোঁজ নিতে পারি। ”
রিশাব মায়ের যুক্তি মেনে নিয়েছে। তবে চেষ্টা করেছে যোগাযোগ করার। অসংখ্য বার ফোন করে কাস্টমার সার্ভিসের রোবোটিক গলায় বলা, ‘এই মুহুর্তে আপনার কাংখিত নাম্বারে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব না ‘ বাক্যটি শুনেছে। কিন্তু বাসা অবধি যাওয়ার সাহস হয় নি সংকোচের কারণে।

দীপা আর সুহাসের কথাবার্তা আজকাল আরও কম হয়। সুহাস ব্যস্ত থাকার ভান করে। খাবার টেবিলে কোনো কথা ছাড়াই খেয়ে উঠে যায়। একদিন রাত করে ফিরেছিল, সেদিন ঠান্ডা কড়কড়ে ভাত খেয়ে নিয়েছে। সেটা জেনে দীপার খুব খারাপ লেগেছে৷ তারপর থেকে ও রাত জেগে বসে থাকে। সুহাস একদিন রাতে বলল,
“আজ ঘুমাও নি যে?”
দীপা মিথ্যে বলল। ও আজকাল সুহাসের মতো করে মিথ্যে বলা শুরু করেছে। ও বলল,

“দিনের বেলা পড়া হয় নি। রাতে সেটা পুষিয়ে নিতে হবে।”
“ওহ! প্রিপারেশন কেমন তোমার? ”
“ওই তো চলছে।”
সুহাস বিড়বিড় করে বলল,
“এই বাড়িতে থেকে কারোর ভালো কিছু হবে।”
দীপা জবাব দিলো না। সুহাস খেতে বসলো। দীপাকে বলল,
“তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। খেয়ে বলছি।”

“আচ্ছা।”
খাওয়া শেষে সুহাস ঘরে গেল। দীপাও পিছনে গেল। সুহাস বলল,
“আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাড়ি ছাড়ব। আই মিন এই বাড়ি ছেড়ে ফ্ল্যাটে উঠব। অফিস থেকে ফ্ল্যাট পেতে এখনো বছর খানেক। তাই ভাড়া বাসাই ভরসা। তোমার ডিসিশন কী? তুমি কী আমার সঙ্গে যেতে চাও? অবশ্য এই বাড়িতে তোমাকে আমি আনিনি। তাই তোমার রেসপন্সিবিলিটি আমার না, বাট নামটা যেহেতু আমার সঙ্গে জুড়েছে সেহেতু দায়িত্ব নিতে সমস্যা নেই। এখন তুমি তোমার ডিসিশন আমাকে জানাবে। হাতে সময় কম। ভেবে জানিও।”

দীপা একটুও অবাক হলো না। এরকম একটা পরিস্থিতি হবে সেটা ও জানে। শাওনের ঘটনায় বাবার সঙ্গে তর্কযুদ্ধের এক পর্যায়ে সুহাস বলেছে যে ও বাড়ি ছাড়বে। দীপা স্বাভাবিক গলায় বলল,
“আপনাকে আমার দায়িত্ব নিতে হবে না। আপনি একাই চলে যান। আপনি আপনার মা, বোনের বিপদে স্বার্থপরের মতো দূরে থাকছেন। আপনার সঙ্গে যাবার পর আমি কোনো বিপদে পড়লে আমার সঙ্গে তো মনে হয় এরচেয়েও বেশী নিষ্ঠুর হবেন! ”

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১৩

সুহাস অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। চোখে আঙুল দিয়ে দীপা যে ওর ভুল টা ধরিয়ে দিবে সেটা বুঝতে পারে নি।

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১৫