বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ৩৪

বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ৩৪
ফাতেমা তুজ নৌশি

সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ লেগে যাওয়ার মতো কম্পিত হলো অভিরাজের শরীর। ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়েছে। সামনে বেশ ভীড়। চোখ দুটো ভীষণ বিচলিত। চারপাশ থেকে ভেসে আসা পানীয়র ঘ্রাণ আর উচ্চ শব্দে গান। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। কণ্ঠ থেকে কথা হারিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা নিদারুণ ব্যথা এসে গলা চে পে ধরেছে। অভিরাজ বাক্য প্রয়োগে ব্যর্থ হয়ে পাগলের মতো করতে লাগল। তাকে দেখে সামনে থাকা মেয়ে গুলো মজা নিচ্ছে।

অ শ্লী ল আচরণ করছে। অন্য সময় হলে ধমকে দিত না হয়। তবে এখন যে মুখ থেকে কথাই বের হচ্ছে না। কণ্ঠটা যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সে যতক্ষণে ভীড় পেরিয়ে বের হলো ততক্ষণে বাদামি রঙেল চুলযুক্ত মেয়েটি চলে গিয়েছে। বদ্ধ পাগলের মতো কাতরাচ্ছে ছেলেটা। ওর আচরণ বেপরোয়া হয়ে গেল। ইতোমধ্যে ভেঙে ফেলেছে দামী কিছু গ্লাস সেট। গন্ডগোল দেখে ছুটে এসেছে লাবণ্য। সেখানে অভিরাজ কে দেখে ওর চিত্ত কেঁপে উঠল। ঈশান দৌড়ে গিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরল। অনেকটা সোরগোল লেগে গিয়েছে। মানুষ জন হাসাহাসি করছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

“ভাই, ভাই এমন করছো কেন? কি হয়েছে। শান্ত হয়ে বসো। বসো ভাই।”
লাবণ্য এসে জাপটে ধরল অভিকে। অভি এক পলক তাকাল। ওর দৃষ্টি দিক হারিয়েছে। মনে হচ্ছে ভীষণ যন্ত্রণায় ভেতরের সব শেষ হয়ে যাচ্ছে।

“অভি, কি হলো তোর। শান্ত হয়ে বোস। এমন করছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”
এত গুলো প্রশ্ন করেও শান্ত হলো না লাবণ্য। ওর চোখে জল চলে এসেছে। ঈশান শক্ত করে ধরল অভিরাজকে।
“আপু কথা বাড়াস না। ভাইকে এখানে রাখা ঠিক হবে না।”
অভি’র বিশাল, শক্তপোক্ত ভারী দেহটাকে এক প্রকার টেনে নিয়েই বের হলো ঈশান। পিছু পিছু আসছে লাবণ্য। ওর শরীরের সব টুকু শক্তি হারিয়ে গেছে। অভিরাজের এমন অবস্থা সত্যিই চোখে দেখার মতো না। হুট করেই কি এমন হয়ে গেল!

অতীত
হসপিটালের ঝামেলাটা যেন শেষ হবার নয়। লোক গুলো চরম বে য়া দব। রোগী’র বয়স হয়েছিল। হার্টের পেসেন্ট ছিল। অপারেশন তো সাকসেস ফুল ই হয়েছে। তারাই টাকা বাঁচাতে বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। আর তারপর আবার হুট করেই এসে এডমিট করাল। ডাক্তার যখন পেসেন্টকে দেখল তখন প্রায় মৃ ত। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো গেল না। আর এখন সব দোষ হসপিটালের! তিক্ত হয়ে উঠল অভি’র মুখটা।

লাবণ্য নিজেও বেশ ঘাবড়ে গিয়েছে। এমনটা আগে কখনো হয় নি। কথায় আছে যা রটে তার কিছু তো বটে। লোকে এমনটাই বিশ্বাস করবে। কিন্তু আসল ঘটনা ভিন্ন। এর জন্যেই মেয়েটি সারাটা রাত হসপিটালে কাটাবে বলে ঠিক করেছে। অভি ফিরল শেষ রাতের দিকে। উষশী’র জন্য ফিরতে হলো ওকে। অবশ্য লাবণ্যকে বলেছিল। তবে মেয়েটি ওকেই পাঠাল। এত ব্যস্ততা, ক্লান্তি, রাজ্যের চিন্তা কিশোরী’র মুখের পানে তাকাতেই যেন মুছে গেল। ঠোঁট প্রসারিত করল সে। শার্টের দুটো বোতাম খুলে নিয়ে মেয়েটির নিকটবর্তী হলো। শক্ত পোক্ত হাত দ্বারা মেয়েটির বাদামি চুল গুলো মুঠোবন্দী করল। ওর শরীরের উষ্ণতা অনুভব হতেই একরাশ ভালো লাগা ফুটে উঠল কিশোরী’র মুখে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ফ্রেস হয়ে এসে দেখল উষশী’র ঘুম ভেঙেছে। ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে চারটা বাজে।

“ঘুমিয়ে পড়ো।”
“কখন এলেন?”
“মাত্রই।”
“ডাকলেন না কেন?”
“ঘুমিয়ে ছিলে তো। ঘুম নষ্ট করা কি ঠিক?”
“জানেন কতটা অপেক্ষা করছিলাম।”
“তাই?”
“হুম।”

মেয়েটি’র শ্বেত রঙা নরম গালে হাত রাখল অভিরাজ। উষশী মাথাটা কাত করে বলল,”কত ঘন্টা হলো আপনাকে দেখি না। মনে হচ্ছিল ম রে ই যাব।”
“খুব কষ্ট হচ্ছিল?”
“হুম। খুব খারাপ লাগছিল।”
“এসো আমার কাছে। আদর করে দিচ্ছি।”
মেয়েটি বিড়াল ছানার মতো এগিয়ে গেল। ছোট্ট তুলতুলে নরম প্রাণী’র ন্যায় বুকে মাথা এলিয়ে দিল। ওর পিনাট বাটারের মতো চুল গুলো গুছিয়ে দিচ্ছে অভিরাজ।

“খাবার খাও নি নিশ্চয়ই?”
“ক্ষিধে পাচ্ছিল না।”
“আসো এখন খেয়ে নিবে।”
“আপনি খেয়েছেন?”
“উহু।”
উষশী খুশি হলো। সে ঝটপট ফ্রেস হয়ে এল। অভি তখন হাতের ঘড়ি খুলছে। আয়নাতে তার মলিন মুখটা দেখতে পেয়ে আতকে উঠল কিশোরী।

“এমন দেখাচ্ছে কেন?”
“কিছু হয় নি উষশী। তুমি আসো আমার সাথে। এত টেনশন কোরো না। সব ঠিক আছে।”
মেয়েটি একরাশ মন খারাপ নিয়ে উঠে এল। একসাথে খাবার খেল ওরা। অল্পস্বল্প গল্প ও হলো। কথায় আছে মানুষ কোনো কিছু হারিয়ে ফেলার পূর্বে খুব যতন করে। অভি’র ভেতরটা কেমন যেন লাগছে। একটা যন্ত্রণা ওকে আড়ষ্ট করে দিচ্ছে।

কিছু দিন পরের ঘটনা। অভিরাজ তখন কাজ করছে। সুন্দর,শুভ্র,কিশোরী ছেলেটার পাশে এসে বসেছে। মেয়েটির শরীর থেকে বেলি ফুলের মতো সুবাস আসে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিল ছেলেটা।
“কিছু বলবে?”
“হুম।”
“স্লোভেনিয়া থেকে কল এসেছিল।”
“কবে?”
“তিন দিন পূর্বে।”
“সেটা এখন বলছো কেন?”
“বুঝতে পারছিলাম না কি করব।”
“আচ্ছা। কে কল করেছিল? নাম্বার পেয়েছে কোথায়?”
“পাপা কল করেছিল।”

অভিরাজ ল্যাপটপ রেখে সোজা হয়ে বসল। কাজের চাপে উষশী’র মলিন মুখটা দেখা হয় নি। মেয়েটি’র মনের অবস্থা অনুভব হতেই অভি বলল,”জেদি মেয়ে,এভাবে মন খারাপ করছো কেন?”
“আমাকে যেতে হবে অভিরাজ।”
একটা বাক্য অভি’র ভেতরের সবটা ভে ঙে দিল। সে কিছু সময় চুপ করে রইল। তারপর বলল,”কবে ফিরবে?”
“এক মাস পর।”

অভিরাজ একটু হাসল। মেয়েটির মাথায় হাত রেখে বলল,”সাবধানে যাবে। আর খুব দ্রুত ফিরে আসবে।”
উষশী’র ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস নেমে এল। তারপর বলল,”আমি যেদিন হারিয়ে যাই সেদিনই মমের এ ক্সি ডেন্ট হয়। লোকাল হসপিটাল থেকে ফোনে থাকা নাম্বার গুলোতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল। তবে ফল ছিল শূন্য। তারপর একদিন পাপার সাথে যোগাযোগ হয়। পাপা মমকে স্লোভেনিয়ায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। মম কোমায় চলে গিয়েছিল। তাই আমার বিষয়ে খোঁজ নিতে পারে নি। কিছু দিন পূর্বে আজাহার আঙ্কেলের সাথে যোগাযোগ হয় তার থেকেই নাম্বার নিয়ে পাপা আমার সাথে যোগাযোগ করেছে।”

অভি সব গুলো কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে বলল,”সেদিন কেন জানাও নি উষশী?”
“আপনাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। পাপা সব কিছুর ব্যবস্থা করেছে। গত তিনটা দিন আমি যেই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গিয়েছি সেই যন্ত্রণা আপনাকে দিতে চাচ্ছিলাম না।”
কতটা খারাপ লাগছে অভি’র সেটা ওর চোখ মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। মেয়েটি চাতক পাখির মতো চেয়ে। অভি’র কষ্টটা বোঝার জন্য বুকে হাত রাখল।

“খারাপ লাগছে?”
“তেমন না। তুমি তো ফিরেই আসবে উষশী। মাত্র এক মাসের বিষয়।”
“হুম। আপনাকে মিস করব মিস্টার রাগি।”
“আমিও ভীষণ মিস করব রেইন।”
এত সময়ের কান্নাটা যেন চোখ দিয়ে ঝরতে লাগল। উষশী, এক সাহসী কিশোরী, যে কি না কোনো মতেই নিজেকে অসহায় বোধ করে না সে আজ ভীষণ অসহায় বোধ করল। আর সাতাশ বছর বয়সী শক্ত পোক্ত দেহের লম্বাটে অভিরাজ নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার এক বৃথা চেষ্টা চালাল।

উষশীকে একাই যেতে হবে। একা একাধিক বার ফ্লাইট করার অভিজ্ঞতা রয়েছে মেয়েটির। তবু অভিরাজ শান্তি পাচ্ছে না। বিমানবন্দরে এসে মেয়েটিকে নানান বোঝ পরামর্শ দিচ্ছে। বার বার পাসপোর্ট আর টিকেট চেইক করে দেখছে। এদিকে ছোট্ট বরফ সাদা রঙের মেয়েটি একবারেই চুপচাপ। তিন মাস পূর্বে যে মেয়েটিকে দেখলেই বাচ্চা মনে হতো সেই মেয়েটি আজ বেশ বড়ো হয়ে গিয়েছে। মাত্র তিনমাসে কতটা পরিবর্তন এসেছে। উষশীকে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে অভিরাজ শুধাল,”কি হলো? এভাবে তাকাচ্ছ যে।”

“দেখছি।”
“কি?”
“আপনার দুটি চোখ।”
“কি দেখলে?”
“আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়।”

উষশী আর অভিরাজ একে অপরের দিকে কিছু সময় চেয়ে রইল। তারপর হুট করেই নজর ঘুরিয়ে ফেলল কিশোরী।
“সাবধানে যাবে। গিয়েই কল করবে। আর কিছু দিন সময় থাকলে আমি তোমাকে একা ছাড়তাম না রেইন।”
“চিন্তা করবেন না। আমি ঠিক ঠাক পৌছাব।”
“হুম। আর পৌছেই কল করবে। ভুলে যেও না আবার।”
“আপনাকে ভোলার সাধ্য নেই অভিরাজ।”

অভি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কোকো মিউ মিউ করছে। প্রাণীটার শরীরে হাত বুলিয়ে দিল অভিরাজ। এতেই যেন চুপ হয়ে গেল সে। কাঁধসম বাদামি রঙের চুলযুক্ত শ্বেত রঙা মেয়েটির শরীরে হাঁটুসম ফ্রক। তাকে সব পোশাকেই বড়ো সুন্দর লাগে। অন্তত অভিরাজের চোখে তেমনি মনে হয়। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে উষশী। তাদের এই দূরত্ব যেন আকাশও মেনে নিতে পারল না।

তাই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামাল। বৃষ্টি এলেই উষশী’র মন ভালো হয়ে যায়। ভিজতে ইচ্ছে করে। তবে আজ তেমন কিছুই হচ্ছে না। শুধু একটা যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে। ফ্লাইটের সময় হয়ে গিয়েছে। নিজ প্রেয়সী’র মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় দিচ্ছে অভিরাজ। তার চোখের দৃষ্টি ঘোলা হতে শুরু করল। উষশী পেছন ফিরে তাকাল একবার। এই তাকানোতেই অভিরাজের ম র ণ হলো। সে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না।

বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ৩৩

ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল মেয়েটিকে। উষশী’র হাত ছেলেটার পিঠে এসে ঠেকেছে। নরম তুলতুলে ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিচ্ছে। অথচ শক্ত পোক্ত আলিঙ্গনে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তবু কিশোরী চুপ। অভি’র মাদক মেশানো ভালোবাসার কাছে সামান্য ব্যথা নিছকই এক ফুলের টোকা।

বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ৩৫