কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১২

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১২
সাবিকুন নাহার নিপা

আজকের এই সিদ্ধান্ত পলাশ অনেক ভেবে, দশজনের বুদ্ধি নিয়ে করেছে। শাওন পড়াশোনায় ভালো, দেখতে সুন্দরী। ভালো চাকরিও পেয়ে যাবে। কিন্তু পলাশ সবকিছুতেই যে পিছিয়ে। এই ব্যাপার টা পলাশ কে বেশ পীড়া দিতো। তবুও শাওনের উপর বিশ্বাস ছিলো। কিন্তু সেই বিশ্বাস টা নড়বড়ে হয়ে গেল একটু একটু করে। রিশাবের সাথে শাওন কে দেখে পলাশ আরও ভয় পেয়ে যায়।

রিশাব কী সুন্দর! নিশ্চয়ই ভালো টাকা, পয়সা আছে। শাওনের মা একটা কিছু চাল চেলে রিশাবের সঙ্গে শাওনের বিয়ে দিবেন। শাওন যাই বলুক, পলাশ সেটা বিশ্বাস করতে পারতো না। শেষমেস পলিটিক্স ছাড়ার সিদ্ধান্ত টাও মেনে নিয়েছিল। কিন্তু সবাই বুদ্ধি দিলো যে পলিটিক্স ছেড়ে লাভ নেই, তবুও শাওনের পরিবার একটা না একটা ঝামেলা করবেই৷ জুয়েল ভাই ভদ্রলোক নিজে পলাশ কে ডেকে বোঝালেন। একটা সময়ে পলাশেরও মনে হলো যে এটাই সবচেয়ে ভালো ডিসিশন। শাওন হয়তো রেগে থাকবে, সেই রাগ না হয় পলাশ পা ধরে মাফ চেয়ে ভাঙাবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শাওন রাগে কাঁপছে। আরও একবার দূর্বল গলায় বলল,
“আমি বাসায় যাব পলাশ। আমাকে যেতে দাও।”
পলাশের চোখের জল শাওনের হৃদয় স্পর্শ করছে না আর। পলাশ ওর মতো বলে যাচ্ছে। শাওন কে সে অসম্ভব ভালোবাসে। কোনো কিছুর বিনিময়ে সে শাওন কে হারাতে চায় না। শাওনের মন কিছুতেই নরম হচ্ছে না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার বাসায় যাবার কথাই বলছে।
রাজু মাঝখানে এসে দাঁত বের করে বলল,

“আরে ভাবী রিলাক্স। বিয়ের পর একটা হানিমুন ট্যুর দিয়ে আসবেন দেখবেন সব টেনশন দূর হয়ে যাবে।”
শাওন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। রাগী গলায় বলল,
“চুপ কর বেয়াদবের বাচ্চা। আমি কী তোদের মতো রাস্তার লোক। আমার পরিবার আছে। ”
রাজুর মুখটা চুপসে গেল। অন্য ছেলেটা রাজুকে ইশারায় চলে যেতে বলল।
পলাশ এখন শাওনের পা জড়িয়ে ধরে আছে। সেই সঙ্গে চলছে কুমিরের কান্না। শাওনের রীতিমতো ঘেন্না লাগছে এখন। কিছুক্ষন রাগ দেখিয়ে হাল ছেড়ে দিলো। এভাবে রেগে কথা বলছে দেখেই বোধহয় সমাধান হচ্ছে না। শাওন খানিকটা সময় নিলো। চোখ বন্ধ করে বুকভরে নি:শ্বাস নিলো। পলাশের হাত ধরে বলল,

“শোনো, আমিও তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু আজকে আমাকে বাড়ি যেতে দাও। আমি আজ বিয়ে করলে মা আর ভাইয়াকে অনেক কিছু ফেস করতে হবে। বাবা এদের ছাড়বে না। এই বয়সে সে আমার মা’কে ছেড়েও দিতে পারেন..
শাওন আর কথা বলতে পারলো না। কান্নায় ভেঙে পড়লো। পলাশ নিজেও কাঁদছে। শাওনের চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল,
“আজকে যদি তুমি ফিরে যাও তাহলে তুমি আর কোনোদিন আমার হতে পারবে না। তোমার মা তার পছন্দের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিবেন। আমি মরে যাব শাওন। আমি সত্যিই মরে যাব।”

শাওন হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইলো। আমি মরে যাব শাওন। এই কথাটার মধ্যেই যেন স্বার্থ লুকিয়ে আছে। পলাশ শুধু নিজের স্বার্থ দেখছে! এগারো বছর! এগারো বছরের সম্পর্ক ওদের! যে সময়ে ওদের সম্পর্ক টা হয়েছিল সেই সময়ে শাওন প্রেম, ভালোবাসা ভালো করে বোঝেও না। ওর অপেক্ষায় থাকা কাতর ছেলেটার জন্য ওর মায়া হয়, খারাপ লাগে। সেদিন যদি বুঝতো যে সেই ছেলেটার মুখোশ আজ এভাবে খসে পড়বে….

জুয়েল ভাই নামের সেই ভদ্রলোক এলেন। ঘরে ঢোকা মাত্রই বিশ্রী জর্দার গন্ধে ভরে গেল। জুয়েল ভাই শাওনের সঙ্গে কথা বলতে এলেন। শুরুতেই বললেন,
“শোনো বোন, তুমি হইলা গিয়া আমার আপন বোন। আজ থেকে তোমার সব দায়িত্ব আমার। তোমার কোনো কিছুর অভাব হইবে না। এই ভাই তোমার সব আবদার পূরন করবে। তাই নো চিন্তা। আর বাপ মায়ের চিন্তা করবা না। তোমাদের কোলে একটা সোনামণি আইসা গেলে সব প্রবলেম সলভ।”

শাওন স্তব্ধ হয়ে গেল। এখন ওর ভয় লাগছে ভীষণ। এরা যদি ওর কোনো ক্ষতি করে! করতেই পারে! পলাশ তো মনে হয় তখনও হাত, পা গুটিয়ে বসে থাকবে।
শাওন নি:শব্দে কাঁদতে লাগলো। মুখ বুজে সব কিছু মেনে নেয়া ছাড়া আর তো কোনো পথ খোলা নেই। এতো ঝামেলায় ও খেয়ালও করে নি যে পলাশ ওর ফোন টা সরিয়ে রেখেছে।

বিকেল হবার পর থেকে সুরমা শাওন কে ফোন করে যাচ্ছেন। ফোন টা বেজে বেজে কেটে যাচ্ছে। দীপা ঘুমাচ্ছে বলে ও’কে আর বিরক্ত করলো না। একাই মেয়ের চিন্তায় অস্থির হচ্ছেন। এমন তো কখনো হয় না, একবার দুবার ফোন করলেই শাওন কে পাওয়া যায়। বাইরে থাকা অবস্থায় বাড়ির ফোন কখনোই ইগনোর করে না।
সুরমা বেগম না পেরে দীপা কে ডাকলেন। ডাক শুনে সুহাসও এলো। মায়ের অস্থিরতা দেখে বলল,

“বাদ দাও তো মা। টেনশন করার আর কিছু পাচ্ছ না নাকি! শাওন কী বাচ্চা মেয়ে?”
“এমন তো কখনো হয় না। অনেকক্ষন যাবত ফোন করছি তো।”
সুহাস তাও খুব একটা গুরুত্ব দিলো না। সুরমা বেগম তবুও অস্থির হলেন। দীপা শাশুড়ীর পাশে বসে রইলো। ওরও একটু একটু টেনশন হচ্ছে।

শাওনের সামনে প্লেটে বিরিয়ানি রাখা। সঙ্গে বোরহানি আর কোক। পলাশ বসে আছে পাশেই। শাওন নিশ্চুপ হয়ে গেছে একদম। কোনো কথাই বলছে না আর। মাঝখানে শাওন একবার নিজের ফোন টা চেয়েছিল, তখন পলাশ আমতাআমতা করে বলেছিল,
“কাজী সাহেব তার কাজ মিটিয়ে গেলেই দিয়ে দেব। ফোন আমি বন্ধ করিনি। ফোন বন্ধ পেলে বাড়ির লোক টেনশন করবে। তুমি খাও।”

শাওন এখন ঠান্ডা মাথায় এখান থেকে বেরোনোর পথ খুঁজছে। এখান থেকে বেরোনো দরকার। বাইরে লোকজনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কৌশলে তারা পাহাড়া দিচ্ছে। শাওন পলাশের দিকে একবার তাকালো। ঘেন্নায় ওর গা গুলিয়ে উঠলো। যে ভালোবাসাকে এতদিন ও মধুর অনুভূতি ভেবে এসেছে আজ সেটা তিক্ততায় পরিনত হলো। মায়ের কথাই বোধহয় ঠিক, অ*সভ্য বর্বর লোকেদের সঙ্গে মিশে পলাশও আর মানুষ নেই। অমানুষ হয়ে গেছে।

শাওন ঠান্ডা মাথায় বিরিয়ানি খেল। কোক খেল। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশও হলো। পলাশ দেখলো শাওন স্বাভাবিক হয়েছে। ও নিশ্চিন্ত হলো৷ মিনিট দশেকের জন্য পলাশ বাইরে গেল সিগারেট খেতে। এতো টেনশনে সিগারেট টা ভীষণ দরকার ছিলো।
সিগারেট শেষ করে রুমে এসে যা দেখলো তাতে ওর চক্ষু চড়কগাছ। যতই পুরুষবল থাকুক, প্রতিপক্ষকে কখনো বোকা ভাবা উচিত না, এই বোধ পলাশের নেই।

পলাশ দেখলো শাওন মেঝেতে শুয়ে আছে। কপাল কেটে রক্ত বেরোচ্ছে। হাত দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে অনবরত। পলাশ দৌড়ে গিয়ে শাওন কে ধরলো। শাওন তখনও পুরোপুরি সেন্সলেস হয় নি। আধো জাগরনেও আল্লাহ কে স্মরন করে যাচ্ছে অনবরত।

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১১

ওর হাতে এই একটাই অপশন ছিলো। না ও মরতে চায় নি। খানিকটা রক্ত ঝরিয়ে এখান থেকে বেরোতে চেয়েছে। ওর কাছে এখান থেকে বেরোনোর কোনো অস্রই ছিল না। ওয়াশরুমের সমস্ত কল ছেড়ে আয়না ভেঙে মুখে কাঁপড় গুজে দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রনা সহ্য করেছে। দেয়ালের সঙ্গে মাথা ঠুকেছে বারংবার।
রাত নয়টা নাগাদ বাড়ির লোক খবর পেল যে শাওন হসপিটালে আছে।

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১৩