কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১১

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১১
সাবিকুন নাহার নিপা

বেশ কিছুদিন হলো সুহাস দীপার সঙ্গে কঠিন আচরণ করছে না। ধমকাধমকি করছে না কথায় কথায়। দীপার পড়াশোনায় যেন ক্ষতি না হয় সেদিকেও ভীষণ লক্ষ্য রাখছে। অফিস থেকে ফিরে টিভি দেখার বদঅভ্যাস টাও কমিয়েছে। দীপা এখন আর অল্পতেই অবাক হয় না। বোধহয় চোখ সয়ে গেছে। সারাক্ষণ রাগারাগি করে বোধহয় সুহাস নিজেও এখন ভীষণ বিরক্ত। শক্ত,খটোমটো কথা শোনার মতো অসীম ধৈর্য্য দীপার আছে। মা মরে যাবার পর নানান জনের নানান কথা শুনে দীপা বড় হয়েছে। তাই কঠিন কথায় ও’কে আর দমিয়ে রাখাও যায় না। তবে সুহাসের বোধহয় এতো অভ্যাস নেই। তাই হয়তো হাপিয়ে গেছে।

সুহাসের সঙ্গে দীপার প্র‍থম আলাপ টা মধুর ই ছিলো। দীপা সেইবার প্রথম সুহাস দের বাসায় এসেছিল। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে। এর আগে ওর মা আর শাওনের সঙ্গে দেখা হলেও সুহাসের সঙ্গে হয় নি। বাসায় এসেও প্রথমে দেখা হলো শাওনের সঙ্গে। সুহাস বাসায় নেই। রংপুরে গেছে কোনো একটা কাজে। দুদিন পর ফিরলো। সুরমা তখন বাসায় নেই। বাসায় ও আর শাওন। কলিং বেল এর শব্দ শুনে ও দরজা খুলে দিলো। সুহাস তখন ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত। দীপার আসার খবর ও তখনও জানেনা। দীপাকে দেখে একটু অবাক হলেও বুঝে নিলো যে বাবার পক্ষের কোনো আত্মীয়। কারণ বাবার আত্মীয় স্বজন রা ঢাকায় এসে ওদের বাসায় ই ওঠেন। সুহাস দীপাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকতে গেলে দীপা ভীত গলায় বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কে আপনি? কাকে খুঁজেন?”
সুহাস বিস্মিত হলো। ফোন টা কেটে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
“তুমি কে?”
দীপা শুকনো ঢোক গিলল। সুহাস শাওনের নাম ধরে ডাকলো। শাওন এসে সব শুনে হিহি করে হাসতে লাগলো। সুহাস তখন আর কিছু বলল না। রাতে খাবার টেবিলে দীপাকে বলল,

“এই আমাকে দেখতে কী চোরের মতো লাগে, নাকি পুলিশের মতো লাগে? ভয়ে কাঁপছিলে কেন?”
শাওন খাবার টেবিলে আরও এক দফা হাসাহাসি করে নিলো। দীপা সেদিন লজ্জায় ভালো করে খেতেও পারে নি।
সুহাস নিজেও অবশ্য হাসছিলো।
তারপর…..
তারপর তো কতকিছু ঘটে গেল। সেই সুহাসের সঙ্গে স্বামী সুহাসের কত তফাৎ! দীপা কাউকেই দোষ দেয় না। মানুষ তো আসলে পরিস্থিতি আর সময়ের কাছেই অসহায়।

“এই দীপা!”
দীপা লাফিয়ে উঠলো। বই খুলে রেখে সাত, পাঁচ ভাবছিল! শাওন দাঁড়িয়ে আছে ওর পাশেই।
“হ্যাঁ আপু বলো। ”
“এত্তো কী ভাবছিলে? কত্তো ডাকলাম!”
দীপা স্মিত হাসলো। শাওন বলল,
“আমাকে একটা শাড়ি দাও তো। তোমার ওই সবুজ রঙের শাড়িটা আছে না, ওটা দিও। যেটা মা তোমাকে দিয়েছিল ঈদে।”
দীপা আলমারি থেকে শাড়ি টা বের করে দিলো। শাড়ি নিয়ে শাওন চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই সুরমা বেগম এলেন। দীপাকে জিজ্ঞেস করলেন,

“আজ আবার কোথায় যাচ্ছে? মাঝখানে কদিন তো ভালোই ছিলো। ”
“আমি জানিনা মা।”
সুরমা বেগম বিরক্ত গলায় বললেন,
“তুমি জিজ্ঞেস করবা না!”

দীপা হাসলো। মাখামাখি রকমের সম্পর্ক শাওনের সঙ্গে ওর নেই। তবুও শাওন ও’কে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। সম্মান কিংবা স্নেহ যাই করুক , করে। এই গুরুত্ব টুকু দীপা খোয়াতে চায় না। ওর জীবনে ভালোবাসার মানুষ কম। ভালোবেসে আগলে রাখার মানুষও কম। ওর নিজের একটা বোন আছে। মা আলাদা বলে সেই বোন টা কখনো ওর আপন হতে পারে নি। শাওন সেখানে ব্যতিক্রম। মাঝেমধ্যে এটা, সেটা কিনে আনে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দরদাম করে নিজের জন্য যেমন এক মুঠো চুড়ি কিনে, তেমনি দীপার জন্যও কিনে। অথচ ওদের তেমন প্রানখোলা গল্প হয় না, চা খেতে খেতে আড্ডা হয় না। দীপা নিজের জড়তা কাটিয়ে গল্প করতে পারে না। তবুও শাওনের কাছ থেকে ছোট ছোট উপহার গুলো পেতে ভালো লাগে।

সুরমা বেগম রাগে গজগজ করতে লাগলেন। আজ আর শাওন কে কিছু বলবে না। একটা মেয়েকে আর কত বারন করবেন! এখন তো তার নিজেরও লজ্জা হচ্ছে।
শাওন শাড়ি ঠিক করতে করতে এলো।
“মা কুচি টা একটু ঠিক করে দাও।”
সুরমা বেগম লাউপাতা গুলো বাছতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রুক্ষ গলায় বললেন,
“পারব না। ”

শাওন পিছন থেকে মা’কে জড়িয়ে ধরে বলল,
“মা তুমি সবসময় রেগে থাকো কেন?”
“ছাড় আমাকে। তোদের আর দেখতে ইচ্ছে করে না।”
শাওন ছাড়লো না। আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“মা তোমার আর আমার সমস্যা কী জানো? আমরা দুজনেই দুজনের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে ঠিক। এটাই আসলে মেইন সমস্যা। ”

“না সেটা সমস্যা না। সমস্যা অন্য জায়গায়। আমি অনেক বাস্তবতা দেখে চুল পাকিয়েছি। তোর চুলগুলো এখনো কুচকুচে কালো। সমস্যা সেই জায়গায়।”
“এজন্যই বলি যে চুল টা কালার করে ফেলি। ”
সুরমা বেগম মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললেন,
“ছাড় আমাকে।”
শাওন ছেড়ে দিলো। যাবার সময় যখন বলল, আসি মা। তখন সুরমা বেগমের চোখে পানি এসে গেল। কারন টা ঠিক বোধগম্য হলো না তার নিজেরও। কিন্তু অনেক দিন পর সে হাউমাউ করে কাঁদলেন।

আজ আকাশে ঝলমলে রোদ উঠেছে। শাওন রিকশা নিলো। রাস্তায় জ্যাম কম। ওভার ব্রিজের পাশের ছোট দোকান গুলো আছে। গরমে লেবুর শরবত বিক্রি হচ্ছে প্রচুর। ছোট্ট দোকান টাতে ভালোই ভিড় লেগেছে। দিন টা অন্যান্য দিনের মতোই। ব্যতিক্রম কিছু নেই।

বটতলার মোড়ে রিকশা থামতেই পলাশ কে দেখতে পেল শাওন। ও’কে দেখে হাসলো। শাওন বলল,
“উঠে এসো।”
পলাশ মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু। তুমি নামো।”
“এদিকে রোদ তো।”
“আমার বাসায় চলো শাওন। চাল, ডাল ফুটিয়ে আজ নাহয় বাসায় খাই।”
শাওন রিকশা থেকে নামলো। পলাশের বাসায় ও এর আগেও একবার দুইবার গিয়েছে। পলাশ কখনোই তার সীমা লঙ্গন করে নি।
গেট দিয়ে ঢোকার সময়ও শাওন আন্দাজ করতে পারলো না যে একটু পর ই ওর জীবনে উথাল পাথাল ঝড় উঠবে।

সুহাস আজ দুপুরের দিকে বাসায় চলে এলো। শরীর টা ভালো লাগছে না। জ্বর জ্বর ভাব। এসেই শুয়ে পড়লো। দীপা জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার কী শরীর খারাপ? ”
“মনে হয় জ্বর আসবে।”
“লেবুর শরবত করে দেব?”
“লেবুর শরবত খেলে জ্বর আর আসবে না?”
দীপা থতমত খেয়ে বলল,
“না মানে সেজন্য না…. বাইরে থেকে এসেছেন তাই….
সুহাস হেসে ফেলল। বলল,

“তোমাদের একটা অদ্ভুত সাইকোলজি আছে বুঝলে! সবকিছুর সল্যুশন হিসেবে খাবার দাবার ই আগে দেখো। যাও নিয়ে আসো তোমার বিখ্যাত শরবত। ”
দীপাও হাসলো। বলল,
“আর কিছু খাবেন?”
সুহাস আবারও হাসলো। তাল মিলিয়ে দীপাও হাসলো।

শাওন বাসায় ঢুকে দেখলো বাসাটা অন্যান্য দিনের চেয়ে পরিপাটি করে গোছানো। রান্নাঘরেও কিছু খাবারের প্যাকেট। মিষ্টি জাতীয় কিছু রাখা। পরিমানে অনেক বেশী। শাওন জিজ্ঞেস করলো,
“আজও কী তোমাদের পার্টি আছে?”
পলাশ একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,
“না তো… ওগুলো.. ওই আর কী!”
শাওন সবকিছু দেখতে লাগলো। তারপর বলল,
“রান্না যে করব বাজার কই?”

“বাজার চলে আসবে। রাজু গেছে বাজারে। তোমার জন্য একটা জিনিস আছে।”
“কী জিনিস? ”
পলাশ একটা প্যাকেট হাতে দিলো৷ শাওন প্যাকেট খুলে দেখলো একটা শাড়ি। কটকটে লাল রঙের শাড়ি। শাওন হাসলো কিন্তু কিছু বলল না।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রাজু এসে হাজির হলো। হাতে বাজারের ব্যাগ। ব্যাগ থেকে কিছু ফুল উঁকি দিচ্ছে। শাওনের হঠাৎ করে কেমন যেন লাগতে শুরু করলো। ফুল যেকোনো কারনে আনতে পারে, কিন্তু ওর কেন এমন ফিলিং হচ্ছে!
রাজুর সঙ্গে শাওনের আলাপ আছে। রাজু সবসময় ই শাওন কে ভাবী বলে ডাকে। কিন্তু আজকের কথা বলার ধরন টাও কেমন সন্দেহজনক।

“আরে ভাবী প্রচুর খাওয়া দাওয়া হবে এরপর। কবজি ডুবায়ে আপনার রান্না খাব।”
শাওন হাসলো। পলাশ অতি দ্রুত বাজারের ব্যাগ টা সরিয়ে ফেলল। শাওনের মনে হলো ও আজ এখানে এসে ভুল করেছে। অবশ্য পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলা ওর চেনা আছে। ফ্ল্যাটের দরজাও খোলা। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। শাওনের মনে হলো এক্ষুনি বেরিয়ে যাওয়া দরকার। ও পলাশ কে ডাকলো। বলল,
“এই শোনো। ”
পলাশ এসে বলল,
“কোনো সমস্যা? ”

“হ্যাঁ। মা নাকি মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। আমি বাসায় যাব।’
পলাশের মুখ টা ছোট হয়ে গেল। শাওন মিথ্যেটাকে সত্যি বানানোর জন্য বলল,
“দীপা মেসেজ করলো। আমার যাওয়া উচিত। ”
রাজু ওখানেই ছিলো। ও এসে বলল,
“আরে ভাবী কই যাবেন? এইগুলা কেমন কথা?”
শাওনের আরও বেশি খারাপ লাগছে। কনফিডেন্স কমতে শুরু করেছে। পলাশ শাওনের হাত ধরে বলল,
“তুমি বদলে গেছ শাওন। আমার সঙ্গে তুমি মিথ্যা বললা।”
শাওন রেগে গেল। বলল,

“তার আগে বলো, এইখানে কী হচ্ছে? কী প্ল্যান চলতেছে তোমাদের মাথায়?”
পলাশ ওর হাত ধরে বলল,
“আমি অনেক দিন ধরে টের পাইতেছি যে তুমি আর সেই আগের তুমি নাই। বদলে গেছ। ”
কথাগুলো বলেই পলাশ কাঁদতে শুরু করলো। শাওন হতভম্ব হয়ে গেল। পলাশ শাওনের হাত চেপে ধরে বলল,
“আমি তোমার পায়ে ধরি শাওন, তুমি বিয়ায় রাজি হও। সব ব্যবস্থা করা আছে। আজকে যদি তুমি চলে যাও তাইলে তোমার মা আর আমাদের এক হইতে দিবে না।”

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১০

শাওন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। পায়ের তলায় শীতল মেঝে থাকতেও মনে হচ্ছে শূন্যে দুলছে।
আরও দুটো ছেলে ঘরের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“ওই পলাশ ভাই, কাচ্চি কয় প্যাকেট কমু? জুয়েল ভাই একশ কইলো। আরও বাড়াইয়া আনুম নাকি।”
শাওন তাকিয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে। শাওন হেরে গেছে। খুব বাজেভাবে হেরে গেছে…. ইশ!

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১২