এ শহরে তুমি নেমে এসো গল্পের লিঙ্ক || ইফা আমহৃদ

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১
ইফা আমহৃদ

“অপূর্ব ভাই, বরপক্ষের কান ফোঁড়ানো ছেলেটা আমার ময়না পাখির গলা চে/পে মে/রে ফেলেছে। এখন আমি সারাদিন কার সাথে কথা বলব?”
টেবিলের উপর রাখা ময়না পাখিটাকে ইঙ্গিত করে অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলাম শব্দগুলো। পরক্ষণে ঢুকরে কেঁদে উঠলাম। অপূর্ব ভাই সবে দরজা ভিরিয়ে শার্ট খোলার উদ্বেগ নিয়েছে। উপরের দু’টো বোতাম খুলেছে। আমার কণ্ঠস্বর শোনা গেল বলে মনে হলোনা, প্রতিক্রিয়া নেই। তবে আচমকা আমায় দেখে বেশ বিস্মিত। ভেরানো দরজার ছিটকিনি তুলে দিল দ্রুত। পুনরায় বোতাম লাগাতে লাগাতে এগিয়ে এলো নিকটে। পাশে বসে থমথমে গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, “তুই বদ্ধ ঘরে কী করছিলি?”

অতঃপর পুনরায় দরজা ও আমার দিকে তাকালেন। অশ্রু মিশ্রিত চোখে ঝাপসা দেখলাম তাকে। বাঁধ ভাঙা গলায় বললাম, “মামুনি আমাকে আটকে রেখেছে অপূর্ব ভাই। ঐ পাজি ছেলেটা আমার ময়নাকে গলা চে/পে মে/রে ফেলেছে। দেখুন।” অগোছালো শাড়িটা উঁচু করে টেবিল থেকে ময়না পাখি হাতে নিলাম। হাত থেকে ময়না পাখি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে বলেন, “তুই তাঁর কী ক্ষতি করেছিলে যে, তিনি এই কাজ করেছেন?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ নাক মুছতে মুছতে বললাম, “আমি কিছু করেনি বিশ্বাস করুন। ময়না পাখিটা উড়ে হঠাৎ তাঁর কাঁধে গিয়ে বসল। তিনি রেগে ময়নাটাকে ধরে দুহাতে গলা চে/পে ধরলেন। আমি কত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু তিনি ছাড়লেন না অপূর্ব ভাই। উল্টো ধাক্কা দিয়ে আমার হাঁটু ছিলে ফেলেছে।”

“বড়োরা কেউ ছিলনা? তাদের বলতি?” অপূর্ব ভাইয়ের ভ্রু কুঁচকানো কথায় ঠোঁট উল্টে বললাম, “বলেছি তো মামুনিকে, তিনি আমাকে ধমকে আপনার ঘরে আটকে রেখেছেন।”
অপূর্ব ভাই ময়না পাখির পেটে তর্জনী চেপে রাখলেন। অতঃপর অপ্রস্তুত গলায় বলেন, “মনে হয় বেঁচে আছে, তুই একটু পানি নিয়ে আয়।”

দ্রুতি পায়ে অগ্ৰসর হলাম ডাইনিং-এ। মাঝপথে অপূর্ব ভাইয়ের ডাকে থেমে গেলাম, “ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস আরু। ওয়াশরুম থেকে নিয়ে আয়।”
আমি ওয়াশরুমে গেলাম। শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে ঘরে এলাম। অপূর্ব ভাই আঁচল নিগরে পাখির শরীরে দিলেন। পেটে আলতো চাপতে শুরু করেন। তার মেডিসিন বক্স থেকে ইনজেকশন বের করে পুশ করলেন ময়নার দেহে। অতঃপর উঁচু স্থানে পাখিকে রেখে বললেন, “কাঁদিস না, তোকে আমি আরও একটা পাখি কিনে দিবো।”

মলম বের করে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “হাঁটুতে লাগিয়ে নে। সেরে যাবে।” কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরলাম মলম। শাড়িটা একটু উঁচু করে ব্যথার্ত স্থানে লাগাতেই জ্বলে উঠল। মৃদু আর্তনাদ করলাম। হাত নেড়ে জানালাম, “লাগাব না।”
“শাড়িটা উঁচু কর, আমি সাহায্য করছি।” বলেই মেঝেতে বসলেন। তাকে বাঁধা দিয়ে টানটান করে স্বযত্নে নিজেই মলম লাগালাম।

এবার অপূর্ব ভাইকে ঝাপ্টে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলাম, “জানেন, ময়না পাখিটা তিনটা ডিম দিয়েছিল। এবার ডিমগুলোর কী হবে? বাচ্চা ফুটবে না।”
“ছেলেটাকে দেখাবি চল।” দৃঢ় করে হাত ধরে অগ্ৰসর হলেন।

আমি আরশি। সকলে আরু বলে ডাকে। আজ আমার খালাতো বোন তিস্তা আপুকে দেখতে পাত্রপক্ষ এসেছে। কয়েকদিন পর তার বিয়ে। অপূর্ব আমার মামাতো ভাই, সাইকোলজিস্ট। আলাদা কিছু ক্ষমতার জন্য দেশে তার প্রচুর নামডাক। মন পড়তে তার ঝুরি মেলা ভার। মনের ডাক্তার হিসেবে তিনি পরিচিত। পাত্রপক্ষ সবে এসেছে। শাড়িটা উঁচু করে হেঁটে যাচ্ছিলাম। আমার পোষা কথা বলা ময়না পাখিটা আমাকে ডেকে বলে, “আরু সুন্দরী।”

আমি হাসি দিয়ে ইশারায় কাছে ডাকলাম ময়নাকে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল পাত্রপক্ষের কান ফোঁড়ানো একটি ছেলে। নাম জানা হয়নি। ভিড়ের কারনে আমার চুলগুলো আটকে যায় তার শার্টের। এগিয়ে যাওয়ার সময় টান পড়ল চুলে। জোরে টান দিতেই বোতাম খুলে এলো চুলের সাথে। ছেলেটা ধমক দিল, “অসভ্য মেয়ে, দেখেছ আমার শার্টের কি অবস্থা করেছ? ইচ্ছে করছে ঠাস ঠাস দু’গালে লাগিয়ে দেয়।”

চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে বললাম, “স্যরি, আমি দেখিনি।”
“চোখ আকাশে রেখে হাঁটছ যে, দেখোনি?” প্রত্যুত্তর না দিয়ে হাঁটা দিলাম সামনে দিকে। ময়না উড়ে ছেলেটিকে কাঁধে বসল তৎক্ষণাৎ। তিনি প্রচণ্ড ক্ষোভে ময়নাকে দুহাতে ধরে গলা চে/পে ধরলেন। ‘আরু’ বলে দু’বার ডেকে থেমে গেল ময়না। পেছন ফিরে ময়নাকে নিচে পড়া অবস্থায় পেলাম। সাড়া দিল না। কান্নার বাঁধ ভেঙে গেল। ময়নাকে জড়িয়ে নিয়ে উচ্চস্বরে বললাম, “আপনি আমার ময়নাকে মা/রলেন কেন?”

ছেলেটি দ্বিগুণ তেজ দেখিয়ে বলে, “তোর ময়না তো, তাই মে/রেছি। যা ফোট।”
ধাক্কা দিল বাহুতে। ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়লাম নিচে। মামুনির কাছে ছুটে গেলাম। অভিযোগ জানালাম। তিনি এলেন সাথে। কিন্তু ছেলেটাকে দেখে বাক্যটি করলেন না। উল্টো পাশের ঘরে বন্দি করে রাখলেন।
বসার ঘরে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলাম, “ঐ ছেলেটা।”

অপূর্ব ভাই হাত ছেড়ে ছেলেটির দিকে হাত বাড়ালেন। হাতে হাতে হ্যান্ডশেক করলেন। মিথ্যা হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন, “পিয়াস, আরু তোমার নামে কি-সব বলছে। তা কি সত্যি?”
“ভাই বাচ্চা মানুষ বলে ফেলেছে। আমাকে কি আপনার উমম্যাচিউড মনে হয়? মনে হয়, নিজে মে/রে আমার নাম দিচ্ছে।”
সৌজন্য হাস দিয়ে বলে, “মানুষের আচার আচরণ দেখে ৫০% আমি ধারণা করতে পারি। তাই কে কী করতে পারে তার কিছুটা ধারণা আমি করতে পারি।”

অপূর্ব ভাই তাদের সাথে আড্ডায় মশগুল হয়ে গেলেন। অদূর থেকে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছি সবকিছু। দুজনকেই উচিত শিক্ষা দিবো আমি। ধীরে ধীরে সরে এলাম দূরে। ধাক্কা লাগল শেফালীর সাথে। সন্দিহান গলায় বললাম, “কড়াই গাছের আঠালো কষ এখনো আছে শেফু?”

“হম আছে, বাবা আমাকে ফেলতে বলেছিল। ভুলে গেছি। কেন?” প্রত্যুত্তর না করে আঁচল কোমরে গুঁজে বের হলে এলাম। আঠালো কষ বালতিতে রাখলাম। শীতের রাত ঠান্ডায় অবিলম্বে জমে যায়। গুটি গুটি পায়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।‌ অপেক্ষায় রইলাম পাত্রপক্ষ বের হওয়ার। পিয়াস নায়ক ছেলেটা সবার পরে বের হলো। নিকটে অপূর্ব ভাই দাঁড়ানো। মামারাও দাঁড়িতে আছেন তাদের বিদায় দিতে‌। উপর থেকে আঠালো কষ ফেলে বালতি রেখেই ছুটে গেলাম ঘরে। শীতের ব্যথা অনুভব বেশি হলেও তোয়াক্কা করলাম না। ঘরে গিয়ে চুপচাপ কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। তুর বই পড়ছে। আমাকে দেখে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকায়। বলে, “ভাই তোকে সেই কখন পাঠিয়ে দিয়েছে। এতক্ষণ কোথায় ছিলি?”

মন খা/রা/প করে পাখির খাঁচার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। ঠোঁট উল্টে বললাম, “পিয়াস ছেলেটাকে হেব্বি দিয়ে এসেছি। অহংকারে মাটিতে পড়ছে না, দিয়েছি চুলগুলো শেষ করবে। পরের বার আসলে টাক নিয়ে আসবে। হি !হি! হি!”
“কী করেছিস?” দরজা দিয়ে প্রবেশ করল শেফালী। থমথমে তার গলা। পরক্ষণে সেই বলে, “পাত্রের ভাইয়ের গায়ে উপর থেকে কে জানো কষ ছুড়েছে। ছেলেটা চোখ মেলতে পারছে না। বেশ হয়েছে। ময়নাকে মা/রা, বুঝ কেমন লাগে।”
তুর আমার দিকে তাকাল। টেবিল ছেড়ে দরজার কাছে এলো। ভিরিয়ে দিয়ে বলে, “তারমানে তুই এটা করেছিস? বুদ্ধি হবে না তোর?”

দুহাতের আঙুলগুলো ভাঁজ করতেই শব্দ হলো বেশ। ফুঁ দিয়ে ছোটো ছোটো চুলগুলো উড়িয়ে দিয়ে বললাম, “এগুলোকে বলে বুদ্ধি। এই বাড়িতে একমাত্র আমারই বিশটা আঙুলে ত্রিশটা ফুটে।”
দুহাত গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে তুর বলে, “হাতে আঠা দেখছি না, ফেললি কীভাবে?”
“বালতিতে করে।”

দুহাত বুকে গুজে বলে, “তা বালতি কোথায়?”
“ছাদে, এইরে গেছে। ছাদে রেখে এসেছি।”
“তোর আঙুল ফুটেও লাভ হলো না। আসলে যাদের বুদ্ধি নেই, এইসব নিয়ে তারাই শান্ত থাকে।”
বলেই তুর পড়তে বসল। দরজায় করাঘাত পড়ল। ওপাশ থেকে অনবরত বলছে, “দরজা খোল দ্রুত।”
“বলছি, আমি ঘরে নেই।”

দ্রুত বিছানায় উঠে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। শেফালী দরজা খুলতেই হুরমুড়িয়ে অপূর্ব ভাই ঢুকলেন। সন্দিহান গলায় বলেন, “গরু কই?”
“তোমার গরু কাঁথার ভিতরে।”
কাঁথা থেকে মাথা বের করে নিভু নিভু চোখে দেখলাম। হাউসী দিয়ে বললাম, “আপনি আমাকে মোটেও গরু বলবেন না।‌ আমি আরু।”

অপূর্ব ভাই এদিক ওদিক তাকিয়ে বলেন, “কী করছিলি তুই?”
“ঘুমাচ্ছিলাম, আপনি এসে ডেকে তুললেন?”
“কোথায় ডাকলাম।”

এই যা। আমতা আমতা করে বললাম, “আমার নামে কেউ নিন্দা করলে আমি বুঝে যাই। আপনার বোন বলে কথা।” অপূর্ব ভাই চুপটি করে রইলেন। বলতে আসার কথাটা হয়তো ভুলে গেছেন। থমথমে গলায় বলেন, “বই কোথায় তোর? পড়তে বসিস নি কেন?”

বত্রিশ পাটি মেলে দিয়ে বললাম, “তিন বিষয়ে ফেল করেছি। স্যার দশম শ্রেণিতে উঠাবে না। কে আবার নবম শ্রেণিতে পড়ে? তাই আর স্কুলে যাবো না। ভালো করেছি না? হি! হি! হি!”

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ২