হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৩৪

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৩৪
সাদিয়া জাহান উম্মি

-‘ আম্মু এসেছিলো?’
আজ সেরে নিয়ে কেভিনে প্রবেশ করতেই আরাবীর শান্ত কণ্ঠ শুনে থমকে যায় জায়ান।তারপর জোড়ে নিশ্বাস ফেলে বলে উঠে,

-‘হুম এসেছিলেন তিনি।’
-‘ ভাই আর আপনি তাড়িয়ে দিয়েছেন তাই নাহ?’
ভ্রু-কুচকে জায়ান বলে,
-‘ তো?তুমি কি চাইছিলে?’
-‘ কিছুই নাহ।শুধু এমনিতেই বললাম।’
জায়ান এইবার আলিফাকে বলে,
-‘ ওকে খাইয়েছো?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘ কোথায় খেলো ভাইয়া?অর্ধেকখানি স্যুপ খেয়ে বলে আর খাবে না।’
আলিফার মুখে সন্তোষজনক কথা না শুনতে পেয়েই রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জায়ান আরাবীর দিকে।আরাবী মুখটা কাচুমাচু করে বলল,
-‘ এভাবে তাকাচ্ছেন কেন?’
-‘ এটা কি শুনছি আমি?’
-‘ এখন খেতে না পারলে আমি কি করব?’
-‘ না পারলেও খেতে তোমাকে হবেই।’
-‘ এটা কেমন কথা?’
-‘ এটা আমার কথা।’

আরাবী মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকালো।এই ঘাড়ত্যাড়া লোকের সাথে তর্ক করে লাভ নেই।সে জানে এখন জোড় করে এক বাটি স্যুপ গেলাবে জায়ান।তারপর এক ডজন মেডিসিন তো আছেই।এদিকে কেভিন থেকে নূর আর আলিফা বের হয়ে গেলো।জায়ান এইবার আরাবীর পাশে গিয়ে বসল।তারপর স্যুপের বাটিটা হাতে নিয়ে বলে,
-‘ দেখি মুখ এদিকে ঘোরাও।এইটা পুরো শেষ কর‍তে হবে।’

আরাবী কোন কিছু না বলে চুপচাপ জায়ানের হাতে স্যুপটুক খেয়ে নিলো।খাওয়া শেষে জায়ান যত্নসহকারে আরাবীর মুখ মুছিয়ে দিলো তারপর মেডিসিন ও খাইয়ে দিলো।আরাবী মুগ্ধ চোখে জায়ানকে দেখছে।লোকটার এই ছোটো ছোটো কেয়ারিংগুলো যে আরাবীর মনে ঠিক কতোটা প্রশান্তি দেয় তা ও বলে বুঝাতে পারবে না।আরাবী মুগ্ধ গলায় বলে,
-‘ আপনি এতো ভালো কেন?’

মেডিসিন গুলো গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত ছিলো জায়ান।আরাবীর কথা শুনে মুঁচকি হাসে ও।তারপর আরাবীর দিকে ফিরে ওর দুগালে হাত রেখে কপালে চুমু খেলো।আরাবী চোখ বন্ধ করে তা অনুভব করলো।জায়ান সরে এসে মোলায়েম গলায় বলে,
-‘ তুমি মানুষটাই এমন যে তোমার সাথে আমি শক্ত হতে পারি না।তোমাকে রাগ দেখাবো কেন?তোমাকে দেখলেই আমার সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়।মন চায় আদরে আদরে তোমায় ভরিয়ে ফেলি।’

লজ্জায় লাল হলো আরাবী।শ্বাস হয়ে আসল ভারি।আরাবীর কষ্ট হলেও ও এগিয়ে গিয়ে মাথা গুজল জায়ানের বুকে।একহাতে জায়ানের গায়ের শার্টটা খামছে ধরে বলে,
-‘ আমি তো আপনারই।’
-‘ আমি জানি তুমি আমার।আর আজীবন আমারই থাকবে।’
-‘ জায়ান?’
-‘ হু!’
-‘ শুনছেন?’
-‘ হু! বলো।’
-‘ ভালোবাসি।’

জায়ান তৃপ্তির হাসি হাসলো।তারপর প্রেমময়ী কণ্ঠে বলে,
-‘ আমিও ভালোবাসি। প্রচন্ড,অতিরিক্ত,সীমাহিন।’

হাসপাতালের করিডোরে মন খারাপ করে বসে আছে ফাহিম।সেটা লক্ষ করে নূর গিয়ে বসল ওর পাশে।তারপর বলে উঠে,
-‘ মন খারাপ?’
আচমকা নূরের গলার স্বরে একটুখানি চমকাল ফাহিম।অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে উদাস গলায় বলে,
-‘ নাহ মন খারাপ কেন হবে?’
-‘ আমি যে দেখছি আর অনুভব ও করছি আপনার মন ভীষণভাবে, বা’জেভাবে খারাপ।’
হাসল ফাহিম বলে,

-‘ তা কেন?’
-‘ এইযে আপনার চোখ দুটোই তো বলে দিচ্ছে।’
-‘ তুমি যে মানুষের চোখ পড়তে জানো আগে তো জানতাম নাহ।’
নূর আনমনা হয়ে বলে,
-‘ আমি যে গোটা আপনিটাকেই পড়তে জানি সেটাও তো জানেন নাহ। আপনায় যে আমি পছন্দ করি সেটাও তো জানেন নাহ।’
আধো আধো কথা শুনে পুরো কথার ঠাওর করতে পারলো না ফাহিম।প্রশ্ন করল,

-‘ কিছু বললে?কে কি জানে নাহ?’
থতমত খেয়ে গেলো নূর।প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্যে আমতা আমতা করে বলে,
-‘ ও কিছু না।আপনি বলুন নাহ মন খারাপ কেন?’
ফাহিম উদাস হয়ে গেলো।নিষ্প্রভ কণ্ঠে বলে,

-‘ মন খারাপ নাহ।শুধু কিছু সময়ের জন্যে আমার মস্তিষ্কটা এলোমেলো হয়ে আছে।কি হচ্ছে?কি করবো?কিচ্ছু বুঝতে পারছি নাহ।আজ মা এসেছিলো আরাবীর সাথে দেখা করতে।আমি তাকে ধমকে ধামকে অনেক কটু কথা বলে তাড়িয়ে দিয়েছি।কিন্তু এখন মন মানছে না।আমি উনার চোখে মুখে স্পষ্ট অনুশোচনা দেখতে পেয়েছি।কিন্তু আমি কি করতাম?এছাড়া উপায় নেই।আমি যদি এখন মায়ের পক্ষ নেই।আরাবী আমায় ভুল বুঝবে।ও হয়তো ভাববে মা এতো অন্যায় করার পরেও আমি উনার পক্ষ নিচ্ছি।মানে আমি ওর সাথেও অন্যায় করছি। আমি আমি বুঝতে পারছি না আমি কি করবো।আমার ঠিক কি করা উচিত। ‘

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামে ফাহিম।নূর এইবার নরম গলায় বলে,
-‘ কিছুই করতে হবে না।কোন প্রকার স্ট্রেস নিবেন নাহ।শুধু নিজেকে সময় দিন।একটু একান্তে নিজের সাথে নিজেই সময় কাটান।মন ফ্রেস করুন।তারপর আস্তে ধীরে সিদ্ধান্ত নিন আপনি কি চান।আর যেহেতু আপনি বলছেন আন্টি তার ভুল বুঝতে পেরেছেন।তার অনুশোচনা হচ্ছে।তাহলে অবশ্যই তাকে আর একবার সুযোগ দেওয়া যায়।আর রইলো ভাবির কথা।আমি এই কয়দিনে যেটুকু বুঝেছি ভাবি এতোটা পাথর মনের না।আন্টি মন থেকে ভাবির কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি নিশ্চয় আন্টিকে ক্ষমা করে দিবেন।আপনি এতো চিন্তা করবেন না।ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।’

ফাহিমের মনে নূরের কথাগুলো বেশ গাঢ দাগ কাটল।মেয়েটা তাকে এতোটা ভালোভাবে বুঝলো কিভাবে?কি করে ওর মনের ব্যাকুলতাগুলো অনায়াসে বুঝে ফেলল।ফাহিমের আচমকাই কেন যেন নূরের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করল।মেয়েটাকে কোনদিন ফাহিম একটু ভালোভাবে দেখেনি।ফাহিমকে এইভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নূর লজ্জা পেলো।আঁখি পল্লব ঝাপ্টে মাথা নিচু করে নিলো। কাঁপা গলায় বলে,

-‘ আমি আসছি চা নিয়ে। আপনি এখানে বসুন।’
-‘ নূর!’ ডেকে উঠে ফাহিম।থেমে যায় নূর।কি যেন ছিলো ওই ডাকটায়।নূরের সর্বাঙ যেন কেঁপে উঠেছে ওই একটা ডাকে।নূর পিছনে ফিরে তাকায় না।ফাহিম নিজে এসেই নূরের হাত ধরে ওকে চেয়ারে বসিয়ে দিলো।অবাক হলো নূর।ফাহিম সেদিকে না তাকিয়ে বলে,
-‘ তুমি বসো। আমি চা নিয়ে আসছি।’

ফাহিম বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো।নূর নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো।ফাহিম তার হাত ধরেছে।তাও স্বইচ্ছায়।এই প্রথম ফাহিম নিজ ইচ্ছায় ওকে একটু হলেও স্পর্শ করেছে।নূর মুঁচকি হাসল।বিরবির করে বলে,
-‘ আপনাকে তো আমার প্রেমের জালে ধরা দিতে হবেই মি.ভদ্রলোক।তৈরি থাকুন আপনি।’

জিহাদ সাহেবের সাথে হাসপাতালের কাছাকাছি একটা ক্যাফেতে এসেছে জায়ান।তারা দুজন মুখোমুখি হয়ে বসে।জায়ান দুটো কফি অর্ডার করল।নীরবতা ভেঙে জিহাদ সাহেব বলেন,
-‘ জরুরি কিছু বলবে বাবা?আরাবী ঠিক আছে তো?’
-‘ চিন্তা করবেন না আংকেল।আরাবী ঠিক আছে।’
-‘ তাহলে?’
জায়ান কিছুক্ষন চুপ থাকলো।মনের মাঝে চলা কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,

-‘ আরাবীর বাবা আপনি।জন্মদাতা না হলেও আপনিই ওর বাবা।আমিও তাই মানি।রাগ করবেন না বাবা।তবে যাই হোক সেদিনের ঘটনা আরাবীর মনে ভীষণভাবে আঘাত করেছে।ও এখন প্রায় আমাকে নিয়ে ইনসিকিউর ফিল করে।নিজেকে এতিম মনে করে ও।

আমি নাকি ওকে ত্যাগ করবো।ওকে আমি অনেক বুঝিয়ে এটুকু বোঝাতে পেরেছি যে আমি ওকে কোনভাবেই ছাড়বো না।এটা মেনে নিলেও।আরাবী নিজেকে এতিম বলেই বার বার গন্য করছে।ও নাকি কারো নাজা’য়েজ সন্তান।কারো পাপের ফল ও।তাই তো ওকে নর্দ’মার মাঝে ফেলে দেওয়া হয়েছে।এসব বলছে বার বার।’

জিহাদ সাহেবের চোখ ভিজে উঠলো।মেয়ের এতো কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারছেন নাহ।জায়ান উনার হাতে হাত রেখে বলে,
-‘ কাঁদবেন না বাবা।এখন কান্না করার সময় নয়।আমাদের আরাবীকে এই ভুল থেকে সরিয়ে আনতে হবে।যাতে ও এইভাবে নিজেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করে।’
জিহাদ সাহেব নিজেকে শান্ত করলেন।বলেন,

-‘ তো তুমি কি চাইছো?’
-‘ আমি আরাবীর আসল বাবা মাকে খুঁজে বের করতে চাইছি।জীবত হোক বা মৃ’ত। শুধু তাদের পরিচয় আর অস্তিত্বের সন্ধান করতে চাইছি।আরাবীকে তার পরিচয় মিলিয়ে দিতে চাইছি।এখন আমায় আপনার সাহায্য প্রয়োজন বাবা।’
জিহাদ সাহেব অবাক হলেও।সবটা বুঝে আসতেই নিজেকে সামলে নেন।মেয়ের ভালো যেটাতে হবে তিনি তাই করবেন।তিনি নরম নরম গলায় বলেন,

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৩৩

-‘ আমায় কি কি করতে হবে তুমি শুধু আমায় বলো।আমি আমার মেয়ের ভালোর জন্যে সব কর‍তে রাজি।’
জিহাদ সাহেবের সাপোর্ট পেয়ে সস্তির নিশ্বাস ফেললো জায়ান।যাক এইবার আর হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে না।আসল রহস্যের উন্মচন তো তাকে করতেই হবে।যা করেই হোক।আরাবীর জন্যে দুনিয়া এফো’ড় ওফোড় করে দিতেও রাজি জায়ান।শুধু তার কাঠগোলাপ ভালো থাকলেই হবে।

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৩৫