হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৫২

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৫২
সাদিয়া জাহান উম্মি

মিথিলা এসে তার আর শামিম সাহেবের জন্যে বরাদ্ধকৃত রুমটার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।মনটা কু ডাকছে তার।রাত হয়ে গেল শামিম সাহেবের দেখা পাননি তিনি।হাজার হোক স্বামি তো তার।ভালোবাসেন তিনি তাকে।সেই ভালোবাসার টানেই শামিম সাহেবকে একটি পলক দেখার জন্যে ছুটে এসেছেন।কিন্তু রুমে ভীতরে যেতে গিয়েও বার বার ফিরে আসছেন।কি করবেন তিনি?নানা দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে অবশেষে পা বাড়ালেন রুমটায়।রুমটা অন্ধকার করে রাখা।বাতিগুলো সব নিভানো।

মিথিলা বেগম এগিয়ে গেলেন। রুমটা গুমোট অন্ধকারে ছেঁয়ে আছে।সেই অন্ধকারের মাঝেই আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে ফ্লোরে কেউ শুয়ে আছে।মিথিলা বেগম ঘাবড়ে গেলেন।ওটা যে শামিম তা বুঝতে বাকি রইলো নাহ।মিথিলা দ্রুত রুমের লাউটসগুলো জ্বালিয়ে দিলো।চারদিকে আলোকিত হতেই দৌড়ে শামিম সাহেবের কাছে যান।উনার ফ্যাকাশে মুখশ্রী দেখেই মিথিলার গলা শুকিয়ে যায়।কাঁপা গলায় তিনি আলতো স্বরে ডাকেন,’ শামিম?শামিম?উঠো।এখানে এইভাবে শুয়ে থাকার মানে কি?উঠো বলছি।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিন্তু না শামিম সাহেবের বিন্দুমাত্র নড়চড় নেই।হবে কিভাবে?কোনোদিন কি এটা হয়?মৃ’ত মানুষ কি কখনো জীবত হয়?হয় না।কোনোদিনও হয় না।মিথিলার শরীর কাঁপছে।কম্পিত হাতজোড়া শামিমের গালে স্পর্শ করতেই তার রূহ কেঁপে উঠে।চোখ ভিজে উঠে উনার।আর্তনাদ করে বলে উঠেন,’ শামিম?উঠো।এটা হয় নাহ।কি করছ?আবার আমার সাথে অভিনয় করছ?কেন করছ?দেখো এইগুলো আমার ভালো লাগছে না।উঠো শামিম।’

মিথিলা উন্মাদের মতো হয়ে গেলেন।তার শামিমের সাহেবের দেহটা ঠান্ডা হয়ে আছে।মিথিলা দ্রুত শামিম সাহেবের বুকে মাথা রাখলেন।স্পন্দনের ধ্বনি শোনার জন্যে।কিন্তু ব্যর্থ হলেন।কারন শামিম সাহেবের হৃদস্পন্দন তো অনেক আগেই থেমে গিয়েছে।মিথিলা সেটা বুঝতে পেরেই ছিটকে দূরে সরে যায়।অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে থাকে শামিম সাহেবের দিকে।তারপর হঠাৎই চিৎকার করে উঠেন তিনি,’ নাহহহহহহহ! এটা হতে পারে না।কখনোই না।’

তারপর আবার উন্মাদের মতো শামিম সাহেবের কাছে যান।বলতে থাকেন,’ এইইইইই তুমি কিভাবে পারো?কিভাবে পারো আমায় এইভাবে ছেড়ে যেতে।আমি এখনো ক্ষমা করিনি তোমায়।শুনছো ক্ষমা করিনি আমি।উঠো বলছি।উঠোওওওওওওওও।’
তারপর চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন।

এদিকে আরাবীর রুমে সবার ভীড়।সবাই আরাবীর সাথে কথা বলছে।আর ব্যস্ত আরাবীকে এটা সেটা খাওয়াতে।এমন সময় হঠাৎ মিথিলা বেগমের এমন বিভৎস চিৎকার শুনে সবাই আঁতকে উঠে।আরাবী পানি খাচ্ছিলো ও নিজেও খাবড়ে যায় ফলে পানি ওর নাকে মুখে উঠে যায়।জায়ান অস্থির হয়ে দ্রুত আরাবীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।ইফতি বলে,’ এইটা ফুপির চিৎকার না?উনি এইভাবে কাঁদছেন কেন?মা চলো তো।’
ইফতির কথামতো মিলি বেগম ইফতির সাথে পা বাড়ালেন।একে একে সবাই ছুটলো সেদিকে।আরাবী একটু স্বাভাবিক হতে দেখে জায়ান বলে,’ ঠিক আছ?’

‘ হ্যা।কি হয়েছে ফুপি এইভাবে কাঁদছেন কেন?’
‘ সেটা তো ওখানে গেলেই দেখতে পাবো।’
‘ আচ্ছা চলুন তাহলে।’
তারপর জায়ান আরাবী এগিয়ে গেল ওখানে।গিয়ে দেখে মিথিলা কাঁদছেন সেই সাথে আহানাও চিৎকার করে কাঁদছে।
আহানা বলছে,’ বাবা উঠো।এভাবে তুমি আমায় ছেড়ে যেতে পারো না বাবা।আমায় এইভাবে একলা করে রেখে যেতে পারো নাহ।’

আরাবী থম মেরে গেল।কি বলছে এসব ওরা? চলে গেছে মানে?আরাবী ধীর পায়ে এগিয়ে যায়।সবাই আরাবীকে দেখে সরে দাঁড়ায়।আরাবী গিয়ে শামিম সাহেবের কাছে বসে পরেন।শামিম সাহেবের নিস্তেজ মুখশ্রীটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।কান্নারত মিথিলাকে শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করে,’ কি হয়েছে উনার?উনি এইভাবে এখানে শুয়ে আছেন কেন?’
মিথিলা আরাবীর কথা শুনে যেন আরও ভেঙে পরেন।আরাবীকে শক্ত করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,’ ও আর নেই আরাবী।ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।চলে গিয়েছে আরাবী।’

আরাবী মাথায় যেন বজ্রপাত হলো।অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো শামিম সাহেবের মৃ’তদেহের দিকে।কেমন যেন পাথর হয়ে গিয়েছে ও।কষ্ট লাগছে ওর আবার লাগছেও নাহ।হাজার হোক লোকটা ওর জন্মদাতা পিতা।আজকেই বাবা সম্পর্কে জানতে পারলো আর আজই কিনা এমন হলো?আরাবী কাঁদলো না।মূলত ওর কান্না আসছে না।কার জন্যে কাঁদবে ও?লোকটা শুধুমাত্র ওর নামেই জন্মদাতা পিতা।এছাড়া আর কিছুই নাহ।আরাবী ঢোক গিলে বড় বড় শ্বাস নিল।তারপর শামিম সাহেবের গালে স্পর্শ করল।কি ঠান্ডা শরীরটা।মানুষ ম’রে গেলে বুঝি এমনই হয়?

আরাবী অত্যন্ত শীতল কণ্ঠে বলে উঠে,’ আপনি যা করেছিলেন তা খুবই জ’ঘন্য কাজ করেছিলেন আমার মায়ের সাথে,আমার সাথে।আমার মায়ের শেষ চিহ্ন মানে আমাকে মা’রার জন্যে আমার অস্তিত্ব বিলীন করার জন্যে রাস্তায় কুকুর শিয়ালের খাবার হবার জন্যে ফেলে দিয়েছিলেন।আপনার কারনে আমার নানাজান মারা গিয়েছে।সম্পত্তির লোভে আপনি কতোগুলো পাপ করেছেন।আপনি কি ক্ষমার যোগ্য বলুন?যোগ্য না জানি।তবুও আমি আপনাকে ক্ষমা করলাম।আজ এই এতোগুলো মানুষকে সাক্ষি রেখে বললাম আমি আপনাকে ক্ষমা করলাম।আল্লাহ্ তায়ালা যেন আপনাকে জান্নাত নসিব করেন আমিন।’

তারপর মিথিলা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় আরবী।জায়ানের কাছে গিয়ে বলে,’ উনার জানাজা’র ব্যবস্থা করুন জায়ান।’
জায়ান নিঃশ্বাস ফেলে বলে,’ তুমি ঘরে যাও।আমি সব ব্যবস্থা করছি।’
অতঃপর শামিম সাহেবের মৃ’তদেহটা জায়ান, ইফতি আর ফাহিম ধরে ভালোভাবে রাখল।সাথি বেগম আর মিলি বেগম মিথিলাকে সামলাচ্ছেন।নূর,আলিফা দুজন মিলে আহানাকে।রাতটা সেইভাবেই কেটে গেল।পরেরদিন যথাসময়ে শামিম সাহেবের জানাজা দেওয়া হয়।মিথিলা আর আহানা আরাবীর কাছে গিয়ে অনেকবার ক্ষমা চান।মিথিলা নিজের কৃতকর্মের জন্যে অনেক অনুতপ্ত।শামিম সাহেবের মৃত্যুর পাঁচদিন পরেই মিথিলা আর আহানা আমেরিকা চলে যান।সবাই বারণ করেছিলো তাদের আমেরিকা যাওয়ার জন্যে।কিন্তু মিথিলা শোনেন নাহ কারো কথা।

সময় বহমান এইভাবেই কেঁটে যায় তিনমাস ।সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলছে।এর মাঝে ফাহিম তার বাবা মাকে জানায় ও নূরকে ভালোবাসে আর নূরকে যতো দ্রুত সম্ভব বিয়ে করতে চায়।ছেলের কথামতো তারা সম্বন্ধ নিয়ে যান সাখাওয়াত বাড়িতে।ফাহিম ভালো ছেলে।ফ্যামিলিও ভালো।লিপি বেগমও ভালো হয়ে গিয়েছেন।তাই আর দ্বিমত করলেন না কেউ।সেদিনই বাগদান সেরে ফেলা হয় ওদের।আর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ইফতি আর আলিফার বিয়ে সাথেই ফাহিম আর নূরের বিয়ে হবে।শামিম সাহেবের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃ’ত্যুর কারনে ইফতি আর আলিফার বিয়ের তারিখ পিছিয়ে যায়।তার উপর এর কিছুদিন পরেই আলিফা আর আরাবীর মাস্টার্সের ফাইনাল এক্সাম এসে পরে।তাই আর হয়নি ওদের বিয়ে।একেবারে পরিক্ষা শেষেই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করবেন তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

আজই আরবী আর আলিফার লাস্ট এক্সাম।এক্সাম শেষ করে আরাবী আর আলিফা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে নিজেদের প্রিয় মানুষদের।আরাবীর প্রেগ্ন্যাসির পাঁচমাস চলছে।মেয়েটা এখন অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যায়।এইযে একনাগাড়ে বসে পরিক্ষার খাতায় লিখতে লিখতে এখন ওর কোমড়ে প্রচন্ড ব্যথা করছে।তবুও মুখ ফুটে কিছু বলছে না মেয়েটা।আরাবী ব্যথাতুর মুখশ্রী দেখে আলিফা বিষয়টা আন্দাজ করতে পারল।আলিফা নরম গলায় বলে,’ তোর কি কষ্ট হচ্ছে?’
আরাবী মলিন হাসল।দূর্বল গলায় বলে,’ এইতো কোমড়টা একটু ব্যথা করছে।’

‘ তোর একটু ব্যথা মানে অনেকটা ব্যথা আমি জানি।দেখি এদিকে আয়।এখানটায় বোস।আমি ভাইয়াকে ফোন করছি।’
আরাবী ধরে করিডোরে রাখা একটা বেঞ্চে বসিয়ে দিলো আলিফা।আরাবী বেঞ্চে বসে হালকা আওয়াজে বলে,’ তাকে ফোন দেওয়ার দরকার নেই।এমনিতেই লোকটা পুরো পাগল।দেখিস নি প্রতিটা এক্সামে আমার জন্যে পুরোটা সময় অপেক্ষা কর‍ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।অফিস যেতো না সেদিন।আজও যেতো না।সেতো জরুরি মিটিং থাকায় গিয়েছে।এখন তুই ফোন করলে মিটিং ছেড়েছুড়েই চলে আসবে।’

‘ তবুও আরাবী তুই অসুস্থ।’
‘ কিচ্ছু হবে নাহ।আমি ঠিক আছি।’
‘ কিন্তু…..’
আলিফা কিছু বলবে তার আগেই দূর থেকে জায়ান আর ইফতিকে দেখে বলে উঠে,’ ওইতো ইফতি আর ভাইয়া এসে পরেছে।’

আরাবী আলিফার কথা শুনতে পেতেই সামনের দিকে দৃষ্টি রাখে।জায়ানের ঘার্মাক্ত চেহারাটা দেখে হাসল।লোকটা মনে হয় মিটিং শেষ করেই ছুটে চলে এসেছে।জায়ান দ্রুত পায়ে আরাবীর কাছে আসল।আরাবীর ব্যথাতুর মুখশ্রী নজরে আসতেই অস্থির হয়ে উঠে ও।জায়ান আরাবীর গালে হাত রেখে অস্থির গলায় বলে,’ কি হয়েছে?এমন দেখাচ্ছে কেন তোমায়?’
আলিফাই আগে হরবর করে বলে,’ ওর কোমড়ে নাকি ব্যথা করছে ভাইয়া।’

জায়ান ভয়ার্ত নয়নে তাকায়।এই মেয়েটা প্রেগন্যান্ট হবার পর থেকে জায়ান যে ঠিক কতোটা ভয়ে থাকে ওকে নিয়ে তা বলার বাহিরে।আরাবী একটু টু শব্দ করলেও ও নিজেই ব্যাকুল হয়ে পরে।জায়ান হাটু গেরে বসল আরাবীর সামনে।তা দেখে আরাবী বলে উঠে,’ আরে কি করছেন?’
জায়ান ভ্রু-কুচকালো।আরাবীর কথায় পাত্তা দিয়ে বলে,’ কোথায় ব্যথা হচ্ছে?বেশি ব্যথা করছে?আমি রোজি আন্টির সাথে কথা বলে নিচ্ছি।এখান থেকেই সোজা তার কাছে যাবো আমরা।চেক-আপ করিয়ে আনি।’

এই লোকটা এতো পাগল কেন?ভাবে আরাবী।ওর একটু কিছু হলেই হুলুস্থুল কান্ড বাধিয়ে ফেলে।আরাবী ঠোঁট উলটে বলে,’ এখনও এক সপ্তাহও হয়নি চেক-আপ করিয়েছি জায়ান।এটা সামান্য একটু ব্যথা করছে।চিন্তা করবেন না।বাড়িতে গিয়ে কোমড়ে টাইগার বাম দিয়ে ম্যাসাজ করেলেই ঠিক হয়ে যাবে।’

‘ কিন্তু তুমি….’
‘ কোন কিন্তু না।বাড়ি যাবো।ভালো লাগছে নাহ।ক্ষিদেও পেয়েছে।’
আরাবী ক্ষিদে পেয়েছে শুনে জায়ান আর কিছু বলল নাহ।অন্য সময় হলে আশেপাশে কোন রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতো।কিন্তু এখন জায়ান আরাবীকে বিন্দুমাত্র বাহিরের কোন খাবার খেতে দেয় নাহ।জায়ান নিজের হাত বাড়িয়ে দিল আরাবীর দিকে।তারপর নরম স্বরে বলে,’ চলো তাহলে।সাবধানে ঠিক আছে?’

আরাবী মুঁচকি হেসে জায়ানের হাতে হাত রাখে।তারপর পা বাড়ায় সামনের দিকে।জায়ান খুব সাবধানে আরাবীর হাত ধরে ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।আরাবী মুগ্ধ চোখে জায়ানকে দেখছে।জায়ানের ঘর্মাক্ত,ক্লান্ত মুখটা যেন জায়ানকে অন্যরকম সুন্দর লাগে।চোখ ধাধিয়ে যায় আরাবীর।এই লম্বা,চওড়া,শক্ত-পোক্ত দেহের অধিকারি সুদর্শন লোকটা ওর স্বামি।যে ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে।জায়ানের ভালোবাসায় আরাবী মাঝে মাঝে অবাক হয়।

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৫১

কেউ কাউকে কিভাবে এতোটা ভালোবাসতে পারে।আরাবীও ভালোবাসে এই লোকটাকে।খুব খুব ভালোবাসে।লোকটার স্পর্শ, লোকটার শরীরের মাতাল করা ঘ্রাণ সব সব ভালোবাসে।আর আজীবন এইভাবেই ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসতে চায়।

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ শেষ পর্ব