হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৫০

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৫০
সাদিয়া জাহান উম্মি

পিনপতন নিরবতার মাঝে হঠাৎ তীব্র চ’ড়ের শব্দে মুখোরিত হয়ে গেল চারপাশ।শামিম অবাক হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন।আজ এতো বছরের সংসার জীবনে মিথিলা আর তার কোনদিন ঝগড়া হয়নি।মিথিলা খুবই স্বামিভক্ত একজন মহিলা।শামিম যা বলতেন তিনি তাই করতেন।আজ সেই মিথিলা নিজের প্রাণপ্রিয় স্বামির গায়ের হাত তুলেছেন।তাও এতোগুলো মানুষের সামনে।শামিম সাহেব অবাক কণ্ঠে বলেন,’ এটা তুমি কি করলে মিথু?’

মিথিলার চোখে মুখে তীব্র রাগের আভা ছড়িয়ে পরেছে।ক্রোধে ফেটে পরছেন তিনি।শামিমের কথা শুনে তিনি চিৎকার করে বলে উঠেন,’ চুপ একদম চুপ।কোন কথা বলবি না তুই।’
শামিমের আত্মা কেঁপে উঠল মিথিলার এমন ক্রোধান্বিত কণ্ঠ শুনে।এই মিথিলাকে তিনি চেনেন না।শামিম কাঁপা গলায় বলে,’ মিথু তুমি….’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিথিলা রাগে থরথর করে কাঁপছেন।তিনি বলেন,’ আমায় আর কিছু বলবি না তুই।তোর মতো মানুষের সাথে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধছে।লজ্জা করছে না তোর?একটুও কি লজ্জা করছে নাহ?আরে তোর এই জঘন্য কির্তীকালাপ শুনে তো ঘৃ’নায় আমার নিজেরই ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে।আরে সবাই ভাবে আমি নাকি একজন খারাপ মানুষ।কিন্তু তুই তো আমার থেকেও নিকৃষ্ট রে।এতোদিন ভালো সাজার এতো নিখুঁত অভিনয় করে গিয়েছিস আমাদের সাথে।

আজ তোর এই মুখোশের আড়ালে এমন জঘন্য রূপ আছে তা জায়ান আমাদের না জানালে তো আমরা জানতেই পারতাম নাহ।কি করে পারলি রে তুই?ইরা মেয়েটা নাহয় পরের মেয়ে।তাকে শুধু স্বার্থের লোভে বিয়ে করেছিস।কিন্তু আরাবী তো তোর নিজের জন্মের সন্তান।তোর রক্ত ও?কিভাবে ওর সাথে এমন করতে পারলি? তোর আহানা তোর মেয়ে হলে তো আরাবীও তো তোর মেয়ে।তাহলে কিভাবে পেরেছিলি ওই সদ্য জন্মানো বাচ্চাটাকে মে’রে ফেলার কথা বলতে?বুক কাঁপেনি তোর একবারও?এতোটা পাষাণ তোর হৃদয়।আমার তো নিজের প্রতিই ঘৃনা হচ্ছে।যে তোর মতো জা*নোয়ারকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম।’

মিথিলা বেগম শেষের কথাটুক বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন। কষ্টে তার বুকে চি’রে যাচ্ছে।সাথি আর মিলি বেগম গিয়ে উনাকে ধরলেন।মিলি বেগম বলে উঠেন,’ আপা শান্ত হন।কাঁদবেন না আপা।’
‘ ভাবি…ভাবি ও কি করে পারল এমন করতে।আমার কষ্ট হচ্ছে ভাবি।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।আমি সহ্য করতে পারছি না ভাবি।’
মিথিলা বেগম লুটিয়ে পরলেন সাথি বেগমের বুকে।সাথি আর মিলি দুজনে তাকে ধরে সোফায় নিয়ে বসালেন।আহানা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল শামিমের কাছে।শামিম ছলছল চোখে তাকিয়ে আছেন মেয়ের দিকে।যতো যাই হয়ে যাক না কেন?তিনি যতোই খারাপ হোক না কেন?

তবে একটা চিরন্তন সত্য যে তিনি মিথিলা আর আহানাকে অনেক ভালোবাসেন।আজ সেই প্রিয়তমা স্ত্রী আর নিজের সন্তানের চোখে নিজের জন্যে এতো ঘৃনা তিনি সহ্য করতে পারছেন না।বুকে ব্যথা করছে তার।মাথাটা ভণভণ করছে।আহানার চোখ থেকে অনর্গল অশ্রু গড়িয়ে পরছে।ও কান্নারত কণ্ঠে বলে,’ আগে আমি সবাইকে গর্ভে বুক ফুলিয়ে বলতাম আমার বাবা পৃথিবীর বেস্ট বাবা।শতো কোটিবার তোমার বুকে মাথা রেখে বলেছি,আই লাভ ইউ বাবা। ইউ আর দ্যা বেস্ট ফাদার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।কিন্তু আজ তোমার সম্পর্কে জেনে আমি কি বলব ভেবে পাচ্ছি না।আসলে তোমার সাথে কথা বলতেও আমার রুচিতে বিধছে। আজ শুধু এটুকুই বললাম আই হেইট ইউ। আই হেইট ইউ বাবা।ইউ আর দ্যা ওয়ার্স্ট ফাদার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।’

আহানা দৌড়ে চলে গেল।আহানা প্রতিটি বাক্য ধা’রাল ছু’ড়ির ন্যায় আ’ঘাত করেছে।তার মেয়ে তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ বাবা বলে গেল।তিনি সত্যিই তো পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ বাবা।তিনি যা করেছেন একজন বাবা তা কোনদিন করতে পারেন না।শামিম সাহেব তাকালেন আরাবীর দিকে।মেয়েটা কেমন অনুভূতিশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।তবে সেই দৃষ্টিতে যে এক সমুদ্র ঘৃ’না মিশে আছে তা খুব ভালোভাবে জানেন তিনি।

আরাবীর মুখশ্রীটা ভালোভাবে দেখলেন তিনি।ওই ছোট্ট মুখখানটায় কি প্রগাঢ় মায়া।মেয়েটা তার দেখতে একদম ইরার মতোই হয়েছে।ইরার চেহারাটাও এমন মায়ায় পরিপূর্ণ ছিল।সামনে দাঁড়ানো এই মেয়েটা তার রক্ত।তার সন্তান।এই সন্তানকেই কিনা তিনি বলেছিলেন মে’রে ফেলতে।কিভাবে নিজের সন্তানের সাথে এমন করতে পেরেছিলেন?আজ তার বুকটা বড্ড হাহাকার করছে।আরাবীর মুখ থেকে বাবা ডাকটা শুনতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু তা যে অসম্ভব। শামিম সাহেবের বুকে ব্যথাটা আস্তে আস্তে তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে।এতো এতো মানুষের ঘৃনিত দৃষ্টি তিনি নিতে পারছেন নাহ।পারছেন না তিনি।

জায়ান তাকিয়ে আছে আরাবীর দিকে।মেয়েটা কেমন পাথর বনে দাঁড়িয়ে আছে।প্রিয়তমা স্ত্রীর মনের অবস্থা বুঝতে পারছে জায়ান।আরাবীর কাছে গিয়ে ওর নরম গালজোড়া স্পর্শ করল।আরাবী নিষ্প্রাণ চোখে তাকাল।ওই দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলতেই কলিজাটা ধ্বক করে উঠল জায়ান।আরাবীকে এই অবস্থায় কোনোদিন দেখেনি জায়ান।এতো নির্বিঘ্ন, অনুভুতিশূন্য আর নিষ্প্রাণ হয়ে থাকার মতো মেয়ে তো আরাবী না।তবে আজ কেন ও এইভাবে আছে?মেয়েটা কি অধিক শোকে পাথর হয়ে গেল?কিন্তু জায়ান তো চায় আরাবী কাঁদুক।কেঁদে কেঁদে ওর বুক ভাসিয়ে দিক।কেঁদে নিলে মনটা হালকা হয়।কিন্তু এমন নিষ্প্রাণ হয়ে থাকলে তো মেয়েটা ভীতরে ভীতরে গুমরে ম’রে যাবে।জায়ান শুকনো ঢোক গিলল।নরম গলায় বলে,’ কি হয়েছে আরাবী?’

‘ কোথায় কি হয়েছে?’ আরাবীর শীতল কণ্ঠস্বরে বুক কেঁপে উঠল জায়ানের।জায়ান ধীর আওয়াজে বলে,
‘ কিছু বলছ না কেন?’
‘ কিছু কি বলার ছিল আমার জায়ান?’
জায়ান অবাক হচ্ছে আরাবীর এমন নির্লিপ্ত ব্যবহার দেখে।আরাবী ফের বলে,’ আমার ভালো লাগছে না জায়ান।আমি রুমে যাচ্ছি।এই তামাশা শেষ হলে আপনিও এসে পরুন জলদি। ‘

এই বলে আরাবী ধীরে কদম বাড়াল কক্ষের যাওয়ার জন্যে।সিড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় মাথা ঘুরে উঠল আরাবীর।তাও নিজেকে সামলে নিল।জায়ান আরাবীর টালমাটাল পরিস্থিতি দেখে দ্রুত পায়ে আরাবীর কাছে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল।এদিকে আরাবী দু ধাপ সিড়ি না পেরোতেই আবারও ওর মাথা ঘুরে উঠল।এইবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না আরাবী।শরীরের ভাড় ছেড়ে দিতেই ঝুকে গিয়ে বারি খায় সিড়ির রেলিংয়ে।

নিচে গড়িয়ে পরার আগেই জায়ান দ্রুত আরাবীকে টেনে নিজের বুকে আগলে নেয়।আরাবীকে বুকের মধ্যিখানে চেপে ধরে সিড়িতেই বসে পরে জায়ান।তারপর আরাবীর গালে হালকা চর মেরে অনবরত ডেকে চলেছে সে,’ আরাবী?আরাবী কি হলো তোমার?চোখ খুলো আরাবী?’
ডা.হোসনে আরা রোজি আরাবীকে এমন অবস্থায় দেখে দ্রুত এগিয়ে যান।ব্যস্ত কণ্ঠে বলেন,’ জায়ান। তুমি দ্রুত আরাবীকে রুমে নিয়ে চলো।আমি দেখছি ওর চেক-আপ করে।চলো বাবা।’
জায়ান ডা.রোজির কথা শুনে দ্রুত আরাবীকে কোলে তুলে নিল।ডা.রোজি আবার বলে,’ ইফতি তুই যা জায়ানের গাড়ি থেকে আমার ব্যাগটা নিয়ে আয়।’

‘ হ্যা আন্টি যাচ্ছি।’
ইফতি ছুটে চলে গেল বাহিরে।জায়ান আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না।আরাবীকে নিয়ে রুমে চলে গেল।রুমে এসেই বিছানায় সুইয়ে দিল আরাবীকে।ততক্ষনে ইফতি ব্যাগ নিয়ে এসেছে।ছেলেটা হাপাচ্ছে।যেই জোড়ে দৌড়ে গিয়েছে আর এসেছে।জায়ান আরাবীর হাত ধরে বসল বিছানার পাশে।চিন্তায় ওর চোখ মুখ শুকিয়ে গিয়েছে।অস্থির কণ্ঠে ও বলে উঠল,’ আন্টি?ও এইভাবে সেন্সল্যাস হলো কেন? কোন খারাপ কিছু হবে না-কি আন্টি?ওর মাথা থেকে অনেক রক্ত ঝরছে আন্টি। দ্রুত রক্ত থামান।’

ডা.রোজি জায়ানকে শান্ত হতে বললেন।তারপর ব্যস্ত হাতে আরাবীর মাথায় আঘাতের জায়গা পরিষ্কার করে মেডিসিন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল।এরপর ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী বের করে আরাবীর চেক-আপ করতে লাগল। চেক-আপ শেষ হতেই জায়ান অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,’ কি হয়েছে আন্টি?খারাপ কিছু?ওর জ্ঞান ফিরছে না কেন?কিছু বলছেন না কেন আন্টি?’

ডা.রোজি গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,’ প্রেসার লো আরাবীর।রক্তশূন্যতাও আছে।আর হঠাৎ করে মানষিকভাবে আঘাত পাওয়ার কারনেই সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে।’
জায়ানের চিন্তায় মুখ শুকিয়ে গেল।ডা.রোজির আবারও একটা কথায় যেন কলিজা শুকিয়ে আসল ওর।তিনি বলেন,’ এইগুলো ছোটো ছোটো কারন বললাম। এর থেকেও বড় কারন আছে।ওর এইভাবে অসুস্থ হওয়ার পিছনে।’
জায়ান কাঁপা গলায় বলে,’ কি হয়েছে আন্টি?কি এমন কারন?’

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৪৯

হঠাৎ ডা. হোসনে আরা রোজি মুঁচকি হাসলেন।হাস্যজ্জ্বল কণ্ঠে বলে উঠলেন,’ আরাবী মা হতে চলেছে জায়ান।আর এটাই হলো সবচেয়ে বড় কারন।ইউ টু আর গোয়িং টু বি প্যারেন্টস।’

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৫১