হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৪৯

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৪৯
সাদিয়া জাহান উম্মি

‘ ফুপা ওরফে রাশেদুল শামিম শেখই হলো আরাবীর জন্মদাতা পিতা।’
জায়ানের ঠান্ডা কণ্ঠে বলা এই এক বাক্যের শব্দটা যেন পুরো সাখাওয়াত বাড়িতে বজ্রপাত ঘটাল।প্রচন্ডরকম ছটকা খেলেন সবাই।এযে মোটেও আশা করেননি কেউ।আরাবী মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে।জায়ানের বলা বাক্যটি তার বুকে তীব্র ঝড় তুলে দিচ্ছে।এই লোকটা কিভাবে ওর বাবা হতে পারে?কিভাবে?আরাবী কাঁপা কণ্ঠে বলে,’ এ..এসব আপনি কি বলছেন জায়ান? উনি আমার…মানে আমার বা..বাবা কিভাবে?’

জায়ান শক্ত কণ্ঠে বলে উঠে,’ এই সত্যিটাই তোমাকে মানতে হবে আরাবী।কষ্ট হলেও মানতে হবে।এই জঘ’ন্য নিকৃষ্টতম মানুষটাই হলো তোমার আসল জন্মদাতা।’
নিহান সাহেব বলেন,’ কিন্তু শামিম কিভাবে আরাবীর বাবা হবে? শামিম তো আমেরিকায় থাকে।মানে কিভাবে কি? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।তুমি সবাইকে সবটা পরিষ্কারভাবে বলো জায়ান।’
মিথিলা চেঁচিয়ে উঠলেন আকষ্মিক,’ থামো তোমরা।কি শুরু করলে তোমরা হ্যা? এই জায়ান যা বলছে সব মিথ্যে।সব মিথ্যে।সব এই মেয়েটার ষড়যন্ত্র।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শেষ কথাটা আরাবীকে উদ্দেশ্য করে বলল মিথিলা।জায়ান মিথিলার কথায় তাচ্ছিল্যভরা হাসল।তারপর একটা কাগজ বের করে সবার সামনে তুলে ধরে বলে,’ এই হলো ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট। যা ফুপা দেশের আসার পরের দিনই আমি খুব সাবধানে করিয়ে নিয়েছি।কি বলেন তো প্রমান ছাড়া তো আবার কেউ কোন কিছুতে বিশ্বাস করে না।’
আরাবী হাত এগিয়ে দিল ডিএনএ টেস্টের রিপোর্টটা চাইলো।জায়ান আরাবীকে সেটা দিল।আরাবী পুরো রিপোর্টটা ভালোভাবে পরল।যেখানে স্পষ্ট তার আর শামিমের ডিএনএ মেচ হয়েছে লিখা আছে।’
রিপোর্টটা পরে আরাবী জায়ানের উদ্দেশ্যে বলে,’এই লোকটা আবার বাবা হলে।আমার মা কোথায় জায়ান?’

‘ মা আর এই দুনিয়াতে নেই আরাবী।’
কথাটা শুনে দুকদম পিছিয়ে গেল আরাবী।বহু কষ্টে বলে,’ কি..কিভাবে হলো এসব?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল জায়ান।আর হোয়ালি না করে একে একে অতীতের সবকিছু খুলে বলল সবাইকে।সব শুনে ধপ করে সোফায় বসে পরল আরাবী।আলিফা আরাবীকে দুহাতে আঁকড়ে ধরল।ডা.হোসনে আরা রোজি আরাবীর কাছে গিয়ে অপরাধি কণ্ঠে বলে,’ আমায় ক্ষমা করে দিও আরাবী।

আমি কিভাবে যেন এই পাপ কাজটা করে ফেললাম।আমায় মাফ করে দিও।’
আরাবী চোখ বন্ধ করে বড় নিশ্বাস নিলো।তারপর দৃষ্টি তাক করল ডা.রোজির দিকে।শান্ত গলায় বলে,’ নিজেকে আর দোষারোপ করবেন না আন্টি।এই দুনিয়ায় সবাই টাকার পাগল।টাকার বিনিময়ে মানুষ মানুষ’কে মে’রে ফেলে।তাতে ওদের বিন্দুমাত্র আফসোস হয় না।আর আপনি তো তাও নিজের পাপ বুঝতে পেরেছেন।অনুশোচনায় ভুগেছেন।আমি বেঁচে আছি জেনেও ওই নি’কৃষ্ট লোকটাকে কিছু জানান নি।নাহলে যে ওই লোকটা আমাকেও মেরে ফেলত।আমি তো আরও আপনার কাছে ঋণি হয়ে গেলাম।’

আরাবী এইবার জায়ানকে বলে,’ ওই লোকটাকে জিজ্ঞেস করুন জায়ান।এই লোকটা কেন করল এসব আমার মায়ের সাথে?কেন আমাকে ম’রার জন্যে ফেলে এসেছিল ময়লার আবর্জনার স্তুপে?’
জায়ান রাগি গলায় শামিমকে বলে,’ শুনেছেন? ও কি বলল?কেন করেছিলেন এসব? আর হ্যা? অবশ্যই মিথ্যা কথা বলবেন নাহ।সবাই এখন আপনার আসল রূপ দেখে নিয়েছে।’

শামিম চুপ করে আছে।আহানার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরছে।নিজের বাবার এমন জ’ঘন্য রূপ যে এভাবে ও জানতে পারবে ভাবেনি কোনদিন।আহানা একপা একপা করে শামিম সাহেবের কাছে যায়।শামিম ওকে দেখেই আঁতকে উঠেন।মেয়ের চোখের অশ্রু যে উনি দেখতে পারেন না।শামিম অস্থির হয়ে বলেন,’ মা তুই কাঁদছিস কেন?’
‘ এখনও বলবে আমি কাঁদছি কেন?আমার বাবা যে এতো বড় একজন অপরাধি এসব জেনেও কি আমায় কষ্ট পেতে তুমি বারণ করছ?’

‘ ওরা মিথ্যে বলছে মা।তুই তো জানি…’
শামিমকে থামিয়ে দিল আহানা।ধরা গলায় বলে,’ আর মিথ্যে বলো না বাবা।দয়া করে সবাইকে সবটা বলে দেও। কেন তুমি এমন করেছ?কেন এইভাবে একজন মানুষের জীবনটা ধ্বং’স করে দিলে?’
শামিম মেয়ের চোখে জল দেখে আর কোন কথা বাড়ালেন না।সোফায় বসে পরলেন।বাইশ বছর পর যেহেতু অতীত সবার সামনে এসে পরেছে তাহলে আর লুকিয়ে লাভ নেই।শামিন বলতে শুরু করলেন,’ তখন আহানা সবে জন্ম নিয়েছে।মিথিলা আর আমার সংসার বেশ সুখেরই ছিল।

হঠাৎ একদিন বাংলাদেশ থেকে ফোন আসে বাবা না-কি খুব অসুস্থ।আমায় দেখতে চান।আহানা যেহেতু ছোটো আর মিথিলাও অসুস্থ তাই ওদের ছাড়া আমি একাই বাংলাদেশে আসলাম।বাংলাদেশে এসে বাবাকে সুস্থ্য করার জন্যে এদিক সেদিক ছুটোছুটি করতে লাগলাম।এভাবে একজন হার্ট সার্জনের সাথে দেখা হলো আমার।সে আর কেউ না আরাবীর মা মানে ইরা ছিল।বাবার চিকিৎসা সূত্রে আমাদের সম্পর্ক বেশ ভালোভাবে জমে গেল।একসময় বেশ গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এরপরেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম।এদিকে মিথিলার সাথে যোগাযোগ হলেই সে জিজ্ঞেস করত আমি কবে ফিরব।আমি ইনিয়ে বিনিয়ে নানান কারন দিয়ে দিতাম।মিথিলার জন্যে আমার খারাপ লাগত।হাজার হোক ওকে ভালোবাসি তো।

কিন্তু আরেকদিকে ইরার বাবার বিশাল সম্পত্তির লোভটাও সামলাতে পারেনি।ইরা ছিল বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।ওকে বিয়ে করলেই ওই সব সম্পত্তির মালিক আমি হবো।এর মাঝে বাবা সুস্থ্য হলো বাবাকে আমার পরিকল্পনার কথা জানালাম।বাবা বলল ছেলে মানুষ তিন চারটা বিয়ে করলেই বা সমস্যা কোথায়?যেই ভাবা সেই কাজ আমি বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে গেলাম ইরার বাসায়।কিন্তু ওর বাবা সম্পর্কটায় মত দিলেন না সাথে সাথে।তিনি কিছুদিন সময় চাইলেন। অনেক রাগ লাগছিল আমার।কিন্তু ইরার জন্যে আমায় ভালো সাজার অভিনয় সাজিয়ে যেতে হলো।

কিন্তু কে জানত এইটাই আমার জন্যে কাল হবে?ইরার বাবা লোক লাগিয়ে আমার খোজখবর নিয়ে জানতে পারলেন আমি বিবাহিত।ইরা সেসব শুনে অনেক ভেঙে পরেছিল।আমি আবারও ওকে মিথ্যে বললাম।বললাম ওর বাবা আমায় পছন্দ করেননা।ওর বিয়ে যাতে আমার সাথে না হয় এই জন্যেই তিনি ওকে এসব মিথ্যে কথা বলেছে।আরও অনেক মিথ্যে অজুহাত দিলাম।ইরা আমার প্রেমে এতোই অন্ধ ছিলো যে আমার এইসব মিথ্যেকে বিশ্বাস করে নিলো।ওকে বললাম চলো পালিয়ে বিয়ে করে ফেলি।কারন বাবা যেমনই হোক সন্তানকে তো আর ফেলে দিতে পারেননা।

তাই বিয়ে একবার করে নিলে আজ হোক বা কাল মেনে নিবেনই।ইরাও আমার কথায় সম্মতি দিয়ে পালিয়ে গেল আমার সাথে।বিয়ে করে নিলাম আমরা।তারপর যখন ইরার বাবার কাছে গেলাম।তিনি ইরাকে ত্যাজ্য সন্তান করে দিলেন তাড়িয়ে দিলেন ওকে।এভাবে কেটে গেল কয়েকদিন।অনেক প্ল্যান সাজাতে লাগলাম কিভাবে ইরার বাবাকে হাত করব।এর মাধ্যেই ইরা একদিন আমায় জানাল ও মা হতে চলেছে।এটা আমি চাইনি সন্তানটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল।তবে বাবা আমায় বুদ্ধি দিল এই সুযোগটা হাত ছাড়া করতে না।

মেয়ের ঘরের নাতি-নাতনি হওয়ার সংবাদ পেলে ইরার বাবা আর মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারবে না।আমিও তাই সেই কথা শুনে ইরাকে নিয়ে ওর বাবার কাছে গেলাম।স্বভাবমতো তাই হলো মেয়েকে দেখে ইরার বাবা আর মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারেননি।সময় ভালোই কাটছিল কিন্তু ইরার বাবা তখনও আমায় পছন্দ করতেন না।শুধু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সব মেনে নিতেন।একদিন মিথিলার সাথে কথা হয় আমার।আহানার অবস্থা নাকি অনেক খারাপ।আই সি ইউ তে ভর্তি।মেয়ের আমার এই অবস্থার কথা শুনে আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি।

ইরাকে ভুলভাল বুঝিয়ে দিয়ে আমি চলে যাই আমেরিকা।এইটাই সর্বনাশ হয়ে দাঁড়াল আমার জন্যে।আমার অনুপস্থিতিতে ইরার বাবা আমার সকল বিরুদ্ধে সকল প্রমান একসাথে করে ইরাকে সব বলে দেয়।আহানা সুস্থ্য হতেই আমি আবার দেশে ফিরে আসি।তখন ইরার গর্ভাবস্থার শেষ মাস চলছিল।আমি আসতেই আমার সাথে ওর তুখোর ঝগড়া লাগল।আমি এতোসব সহ্য করতে না পেরে ওর গায়ে হাতও তুললাম।মারধোর করলাম ওকে।তারপর বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে গেলাম।ইরার বাবা সেদিন বাড়ি ছিলেন না।ব্যবসার কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন।

সেদিনই ইরার পেইন উঠে বাড়ির কাজের মেয়েটা ইরাকে নিয়ে হস্পিটাল যায়।আমি বাড়ি এসে সেটা জানতে পারি।আর তখনই হাসপাতাল পৌছাই।হাসপাতালে এসেই রোজির সাথে আমার দেখা হয়।ওর থেকে জানতে পারি ইরা আর নেই।আর এদিকে ইরার বাবাও ইরাকে সম্মত্তি লিখে দেয়নি তখনও।তাই আমিও সম্মত্তি পেতাম নাহ।তাই রোজিকে টাকা দিয়ে ওর মুখ বন্ধ রাখতে বললাম বাচ্চাটা সন্তান বেঁচে আছে।বাচ্চাটাকে মে’রে ফেলতে বলে আমি চলে যাই ইরার লাশ নিয়ে।বাড়িতে ইরার লাশ নিয়ে যাই সাথে একটা ম’রা বাচ্চার ব্যবস্থা করে নিয়ে যাই।

ইরার বাবাকে জানানো হয়।তিনি দ্রুত ছুটে আসেন।ইরাকে দাফন করা হয়।ইরার বাবা সম্পূর্ণ দোষ চাপালেন আমার উপর। আমি নাকি ইরাকে মেরেছি।পুলিশ কেইস ও করেন।কিন্তু উপযুক্ত প্রমান না পাওয়ায় ওরা আমার কিছুই করতে পারেন নাহ।আমারও ফিরার সময় হয়ে যাচ্ছিল।এখানে থেকেই বা কি লাভ?কিছুই তো পায়নি। এর কয়েকদিন পরেই আমি আমেরিকা চলে যাই।পরে বহুদিন পর জানতে পারি ইরার মা একমাত্র মেয়ের এই অবস্থা সহ্য করতে না পেরে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর কয়েকদিন পরেই নাকি মারা যান।ইরার বাবাও একা হয়ে পরেন।

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৪৮

তার বছর খানিক পর তিনিও মারা যান।আমি আবার ফিরে আসি সম্পত্তির জন্যে। কিন্তু সেবারও আমায় শূন্য হাতে ফিরতে হয়।কারন ইরার বাবা তার সকল সম্মতি বিক্রি করে স্কুল, হাসপাতাল,এতিমখানা তৈরি করে গিয়েছে ইরার নামে।বাদ বাকি টাকা অন্যান্য এতিমখানায় দান করে দিয়েছেন।সেবারও আমার হতাশ হয়ে ফিরতে হয়।আমার সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।কিছুই করতে পারিনি।ভেবেছিলাম এইসব অতীতের সত্য কোনদিন কেউ জানতে পারবে না।কিন্তু…কিন্তু জায়ান তুই?তুই তা হতে দিলি না।দিলিনা আর লুকায়িত অতীতকে লুকিয়ে রাখতে।আমায় অন্ধকার গর্তের থেকে টেনেটুনে বের করেই আনলি।

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৫০