শেষ বিকেলে তুমি আমি বোনাস পর্ব 

শেষ বিকেলে তুমি আমি বোনাস পর্ব 
আলিশা

স্মরণের রুমের দরজার এপাশে দাড়িয়ে স্পষ্ট দেখতে পেলাম বাবার হৃদয়ে মেয়ের জন্য উপচে পড়া ভালোবাসা। চিন্তিত মুখের অভিপ্রায়। ক্ষণে ক্ষণে ডেকে ওঠা পরম মমতা নিয়ে। ছোঁয়া আধবোজা চোখ নিয়ে বিছানার মধ্যে পরে আছে। নিমিষেই স্মরণ একটা কাচের বাটিতে পানি সহ রুমাল নিয়ে হাজির। দেখতে দেখতে সে রুমাল ভিজিয়ে কপালের মধ্যে বসিয়ে দিয়ে থার্মোমিটার খুঁজে আনলো। টেবিলের ড্রয়ার হতে বের করলো বিস্কুট, চিপ্স, ব্রেড। ছোঁয়ার মুখের নিকট একেকটা বাড়িয়ে দিচ্ছে আর সেধে যাচ্ছে। কিন্তু ছোঁয়া এসবের কিছু খেতে বড্ড নারাজ। হঠাৎ যেন আমি তার চোখে পরলাম। সে অদূর হতেই ডেকে বলল

— আন্টি, আমি বিরিয়ানি খাবো।
মায়ার একটা আস্ত স্তুপ যেন ছোট মেয়েটার কথার দরূণ আমার বুকে চেপে বসলো। স্মরণ ঝট করে পেছন ফিরে আমাকে দেখতেই বলল
— আমি অর্ডার করছি।
আমি ধীর পায়ে হেটে গিয়ে ছোঁয়ার কপালে আলতো করে হাত রেখে বললাম

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— আপনি এমন কেন? দেখছেন তো মেয়ে অসুস্থ। তারপরও এমন খিটখিট করেন কেন? আপনিও বুঝি এভাবেই বেস্ট বাবা হয়ে উঠতে চান? যে বাবা মেয়ের ভালো বোঝে না। যে বাবা মেয়ের মাতুল্য কোল চেনে না। এটা রুমাল ভেজানো হয়েছে? চুল ভিজে মাথায় পানি গিয়ে ঠান্ডা লাগবে আরো।
স্মরণ যেন বিস্মিত হলো আমার কথায়। এই বিষ্ময় ভাব কেটে উঠতে তার সময় লাগলো আনুমানিক তিনটে মিনিট। অতঃপর কড়া গলায় বলে উঠলো

— হোয়াট রাবিশ! আপনি আমাকে আমার মেয়ের ভালো মন্দ শেখাচ্ছেন?
— হয়তোবা। শিখে রাখুন। আপনি তো কথায় কথায় আমাকে হুমকি দেন এবাড়ি থেকে চলে যাওয়ার। জোর করে তো কারো ঘাড়ে চেপে বসা যায় না।
স্মরণ প্রত্যুত্তর করলো না। আমি ছোঁয়াকে ছেড়ে স্মরণের দিকে একবার তাকিয়ে দেখতে চাইলাম তার অভিপ্রায়। সে যেন শূন্য, ঘোলাটে, পুরোটাই ধোঁয়াসায় মুড়িয়ে রেখেছে। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে এক পা ফেলতেই হঠাৎ টান পরলো আমার হাতে। শুনতে পেলাম ছোঁয়ার কন্ঠ

— আন্টি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?
বুকের মাঝে কষ্ট হলো এমন মিষ্টি ডাক শুনে।
— না তো মা। মেয়েকে ছেড়ে মা কি দূরে যেতে পারে কখনো?
— তুমি এখন এত্তগুলা ভালো হয়ে গেছো। আমি এখন তোমাকে মা বলেই ডাকবো। অথৈ মা আমাকে ফাঁকি দিয়েছে। তুমি আমাকে ফাঁকি দেবে না তো?
পাকা পাকা কথাগুলো আমার চোখে জল আনতে বাধ্য করলো। আমি জড়িয়ে যাওয়া গলা নিয়ে কিছু বলতে পারলাম না। ওর যে মা নেই। ওর থেকে বহু দূরে চলে গেছে তা এতো ছোট মস্তিষ্কে না ঢুকলেও পারতো। ছোট কলিজা নিশ্চয়ই ছটফট করে।

— বাবা আম্মুর কথা মনে পরছে৷
হঠাৎই ছোঁয়া একথা বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। স্মরণ দিশেহারা হয়ে কোলে তুলে নিলো। সেও যেন অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। মেয়েকে দু’টো কথায় বুঝ দিতে গিয়ে হঠাৎই নিশ্চুপ হয়ে গেলো। খেয়াল করে দেখলাম তার চোখ বন্ধ। কান্নারত ছোঁয়াকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে। চোখের কর্ণিশ বেয়ে উঁকি দিচ্ছে একটু আধটু জল। মুহূর্তেই ঘর ছেড়ে গেলো বিষাদে। স্মরণ হঠাৎ ছোঁয়া কে ছাড়িয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আমি আগলে নিলাম ছোট মেয়েটাকে। স্মরণের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম নির্নিমেষ। মনে পরে গেলো অনেক আগের কথাগুলো।

এই মানুষটাই ছিলো আমার প্রথম ভালোবাসা! অবাক হবার বিষয় না? আমি বড্ড অবাক হয়েছি দু’দিন আগে। যেদিন সে ব্যাবসার উদ্দেশ্যে বিদেশে ছুটলো। সেদিন রাতে। ঐ তো ছোঁয়ার সাথে আমার ভারি ভাব হলো। তাকে নিয়ে এই রুমের বেলকনিতে বসে ছিলাম। একটু আধটু কৌতুহল ছিলো এই মানুষটাকে নিয়ে। সেই থেকে সকলের অগোচরে সেদিন খুঁজে ছিলাম কিছু। যদি কিছু নোটবুক মেলে? মনে দুই আনার আশা নিয়ে খামোখা এই ঘরটা দেখতে গিয়ে হাতে পেয়েছিলাম একটা অ্যালবাম। যে এলবামে দেখেছি তেরো বছর বয়সে দেখে আসা মুখটা।

এলোমেলো এক গুচ্ছ সিল্ক চুলের অধিকারী ছেলেটাকে। যার কিনা একটা অবাধ্য, জোর করে বসে যাওয়া সৌন্দর্য আছে। একটা গেজ দাঁত। এই দাঁতের হাসিটা দেখার জন্য আমি প্রত্যহ বাসা থেকে বেরিয়ে সামনের খেলার মাঠে গিয়ে বসে থাকতাম। ছোট থেকেই ভীষণ শান্ত প্রকৃতির আমি একদিন এলাহি কান্ড বাধিয়ে ঝগড়াও করেছিলাম একটা মেয়ের সাথে। কেন সে আমার ভালো লাগার মানুষটার দিকে তাকাবে এই নিয়ে। হাজারো স্বপ্ন বুনে বুনে মনের মাঝে রেখে দিতাম। এই মানুষটার নামে খোলা আকাশে চিঠি পাঠাতাম। কিন্তু সে আমাকে কখনো চেনেনি।

কখনো জানেনি তার জন্য মরিয়া হয়ে থাকতো আমার কিশোরী মন। তবে আমার সব অনুভূতি মরমর হলো একদিন। যেদিন দেখেছিলাম আমার স্বপ্নে, শয়নে, জল্পনা-কল্পনায় অবিরাম বসবাস করা মানুষটা অন্য মেয়ের রাজা। রাজা রাণীর গভীর ভালোবাসা। একে অপরের প্রতি পুকুর ঘাট আর দুবলা ঘাসের মতো আসক্ত। দিনের শুরু হয় ঝগড়ায় আর দিনশেষে শেষ বিকেলে তাদের দেখা যায় হাতে হাত রেখে নদীর তীরে বালুচরে হাঁটতে। আমার কিশোরী মন ভেঙে গুড়িয়ে যেতো তাদের এই মিষ্টি দৃশ্য দেখে। প্রথমে সৌভাগ্য ভেবে বসেছিলাম। অতঃপর দেখি আমার দূর্ভাগ্য যে আমি তাদের সাথে একই কলেজে পড়ি। প্রতিষ্ঠানটা ছিলো স্কুল এন্ড কলেজ। তারা দু’জনে কলেজে আর আমি স্কুল হলগুলোর একটাতে। একদিন আমার সাথে খুব হৃদয়বিদারক এক ঘটনা ঘটলো। স্মরণ রাজার রাণী আমাকে হুট করে একদিন রাস্তার মাঝে ডেকে বলল

” তুমি ভারি মিষ্টি। তোমার নাম কি মেয়ে? ”
আমি গোমড়া মুখে বলেছিলাম
” খেয়া জান্নাত। ”
” ওয়াও! নাইস নেম।”
” তুমি কিসে পড়?”
” ক্লাস নাইন।”
” আমি ইন্টার ফ্রাস্ট ইয়ার। তোমার বড় আপু।”
আমি মনে মনে ভেংচি কেটে বলেছিলাম

” বড় আপু না। আমার সতিন তুমি। আমার মনের মানুষ তুমি নিয়ে নিয়েছো।”
” ঐ যে দেখছো, কালো শার্ট পরা সুন্দর ছেলেটা ওকে একটু ডেকে দেবে?”
আমি আপত্তি করতে চেয়েও পারিনি। সেদিন ডেকে দেই স্মরণকে। আর বারবার মেয়েটাকে মনে মনে বলেই যাই,
” তুমি আমার সতিন। তোমাকে এত্তগুলো ঘৃণা।!”

বুঝিনি ওটুকু বয়সে দিয়ে আসা গালিটা এভাবে সত্যি হবে। এভাবে আদোতেই তার সতিন হয়ে যাবো। আমার কিশোরী বয়সের ভালোবাসার মানুষটা এভাবে আমার খুব কাছের হয়ে যাবে। কিন্তু আফসোস, দুঃখ, আমার ভাগ্য তাকে পেয়েও হারানোর পথে। সে তো চায় না আমায়। সে তো বারেবারে বোঝাতে চায় সে আমার কখনো ছিলো না, আর কখনো হবে না। তবে আমি তাকে বলে দিতে চাই

” না বাসলেন ভালো। নাই বা আপনার কাধে আমার মাথা রাখার সাহসটা দিলেন। আমি আপনার রাজ্যের রাণী না হয় নাই হলাম। পরম ভালোবাসা দিয়ে আমার খোঁপায় রোজ একটা বেলি ফুলের মালাও পরিয়ে দিতে হবে না৷ শুধু আমি যেটুকু ভালোবাসা দেই এটুকু একটু গ্রহণ করুন। আমি সব হারিয়ে অবশেষে আপনার দ্বারে। দূরে ঠেলে না দিলে কি হয় না? শুধুমাত্র জীবনের শেষ বিকেলে আমি আর আপনি কি একসাথে ঘোর কুয়াশার মাঝে হেঁটে হেঁটে বহুদূর যেতে পারি না?

শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব ৬

( ওপেন ঘোষণা আমার, গল্পের নায়িকা এবার সাবানাই হবে। গল্প ভালো না লাগলে ইগনোর করার অনুরোধ রইলো)

শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব ৭