বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৩২

বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৩২
জাওয়াদ জামী

কুহু সিক্তার রুমে এসে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়।
” কুহু রে, তুই আজকাল আমাকে পর করে দিয়েছিস ! কতশত গোপন ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, কিন্তু আমাকে জানাস না। এই দুঃখ কোথায় রাখি। ” সিক্তা কুহুকে দেখা মাত্রই ন্যাকা কান্না শুরু করেছে।
এদিকে কুহু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সিক্তার পানে চেয়ে আছে। ও সিক্তার কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছেনা।

” কি বলছিস! কিসের গোপন ঘটনা! আমি বুঝতে পারছিনা সিক্ত, ইট্টু খুলে বল। ” কুহু সব সময়ই সিক্তাকে সিক্ত ডাকে।
” তোকে যে তাহমিদ ভাইয়া পছন্দ করে তা একটিবারও আমাকে জানাসনি! আবার তোকে নাকি বিয়েও করতে চেয়েছে, তাও আবার আব্বুর সামনে কনফেস করেছে! এটা ভাবা যায়!
সকালে আম্মু যখন দিদুনকে এসব জানাল, তখন দিদুন বলল, সে-ও সব জানে। সবাই সব কিছু জানে, শুধু আমি ছাড়া! এভাবে আমাকে হিট দিতে পারলি? ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সিক্তার কথা শুনে কুহুর মাথা ঘুরছে। বাড়িসুদ্ধ সবাই এই কথা জেনে গেছে!
” দেখ সিক্ত, আমি এসবের কিছুই জানিনা। অযথা আমাকে খোঁ’চা’বি’না। ” ইচ্ছে করেই কুহু, বিষয়টা গোপন করে। সিক্তা সবটা জানলে কুহুকে খে’পি’য়ে মা’র’বে।
” বুঝি, সব বুঝি। বিয়ে না হতেই, আমি পর হয়ে গেছি। বিয়ের পর দেখা যাবে, আমাকে চিনবিইনা। ” সিক্তা মুখ বেঁকিয়ে বলে।

কুহু কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে।
তাহমিদের ঘুম আসছেনা। বড়মার সাথে কুহুর কি কথা হল, তা জানতে অস্থির হয়ে আছে। কুহু কি রাজি হয়েছে? যে ত্যা’ড়া মেয়ে ও। ও যে কি করবে তা বোধগম্য নয় তাহমিদের। সারারাত বিছানায় উথালপাতাল করছে তাহমিদ। পুরো রাত নির্ঘুম কাটায়।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আফরোজা নাজনীন নামাজ আদায় করে, সোজা রান্নাঘরে আসেন। একটু পর তাহমিনা আক্তারও আসেন। তাহমিনা আক্তার উসখুস করছেন। তিনি কুহুর মতামত কি তা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন।

” তাহমিনা, এবার আর আমাদের নতুন সম্পর্কে জড়াতে কোন বাঁধা রইলনা। তোর ছোট বউমা অবশেষে পেয়েই গেলি। তবে ভালো করে শুনে রাখ, দ’জ্জা’ল শ্বাশুড়ির পার্ট কিন্তু করতে পারবিনা। আমার ভাইঝি বড্ড বোকা। পাহাড়সম দুঃখ মুখ বুজে সইবে, তবুও মুখ ফুটে কিছু বলবেনা। ”
আফরোজা নাজনীনের কথা শুনে তাহমিনা আক্তার বুঝে নেন কুহু রাজি হয়েছে। তিনি অতি উত্তেজনা বশত তার বড় জা’কে জড়িয়ে ধরেন।

” ভাবি, আমি পৃথিবীর সেরা শ্বাশুড়ি হয়ে দেখাব। কুহু মাকে, কোন অভিযোগের সুযোগই দিবনা। ধন্যবাদ ভাবি, আমার কথা রাখবার জন্য। ”
” ধন্যবাদ দিচ্ছিস কেন! আর আমি তোর সাথে মজা করলাম। আর তুই সিরিয়াসভাবে নিলি! আমি খুব ভালোভাবেই জানি, তুই শ্বাশুড়ি হিসেবে কেমন। ”
” ভাবি, আমি একটু আসছি। বেশি দেরি হবেনা। ” কথাটা বলা মাত্রই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন তাহমিনা।
তাহমিদ বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়ছিল। তবে বই শুধু মুখের সামনে ধরেই আছে। পড়ায় মনযোগ দিতে পারছেনা। এমন সময় হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢোকেন তাহমিনা আক্তার।

” বাবু, তুই উঠেছিস? একটা খুশির খবর আছে। এবার মা’কে পর করে দেয়ার সময় তোর এসেছে। বড় ছেলে বিয়ে করেই তার মা’কে পর করে দিয়েছে। এবার ছোট ছেলের পালা। ” হাসিমুখে বলেন তাহমিনা। তবে তার মুখে হাসি থাকলেও, বড় ছেলের এরূপ পর হওয়ার তীব্র য’ন্ত্র’ণা তাকে কুঁ’ড়ে কুঁ’ড়ে খায়।
তাহমিদ মায়ের কথা শুনে উঠে বসে। ততক্ষণে তাহমিনা তার ছেলের পাশে বসেছেন।

” শোন মা, দুনিয়ায় ধ্বং’স’য’জ্ঞ বাঁধলেও, আমি তোমার ছেলে আর তুমি আমার মা’ই থাকবে। পর হয়ে যাওয়ার মত সন্তান তুমি জন্ম দাওনি। আর সন্তানকে সেভাবে মানুষও করনি। তাই তোমার ছোট ছেলেকে হারানোর ভয় তুমি করোনা। ” কথাটা বলেই পরক্ষণেই তাহমিদ ওর মায়ের পুরো কথার মর্মার্থ উদঘাটন করে। তারপরও জিজ্ঞাসু নয়নে মায়ের দিকে তাকায়।
তাহমিনা আক্তারও ছেলের দৃষ্টি বুঝতে পেরে জবাব দেন, ” কুহু রাজি হয়েছে। এবার শুধু ভালো দিনক্ষণ দেখে সব ঠিক করার পালা। তার আগে তোর বাবার সাথে কথা বলতে হবে। তার ছেলের এত আনন্দের দিনে, বাবা হয়ে সে পাশে থাকতে পারছেনা। ”

তাহমিদ মা’কে জড়িয়ে ধরেছে।
” শোন মা, আজ যা বলার বলেছ, কিন্তু ভবিষ্যতে কখনোই এমন কথা বলবেনা। তোমার ছোট ছেলে তার মা’কে যেমন সম্মান দিতে জানে, তেমনি একজন মায়ের তার সন্তানের প্রতি কি কি অধিকার, তাও তার জানা আছে। আবার স্ত্রীর ওপর সকল দ্বায়িত্ব-কর্তব্য পালনের সকল নিয়ম সম্পর্কে সে সচেতন। একজন সন্তানের কাছে তার মায়ের স্থান এব স্ত্রীর স্থান সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অবগত। তাই এই স্থান গুলিয়ে ফেলার কোন সম্ভাবনাই তোমার ছেলের নেই। ”

ছেলের কথা শুনে হাসেন তাহমিনা আক্তার। তিনি ভালোই তার ছেলেকে জানেন। আর কুহু সে-তো নরম কাদামাটি। ওকে যেভাবে গড়ে তোলা হবে, ও সেভাবেই গড়ে উঠবে। সম্পর্কের মূল্যায়ন করতে জানে এই মেয়ে।
” মা, সেই মেয়ে এখন কোথায়? আজকাল তার ভিষণ অহমিকা হয়েছে। ”

” ওর একটুও অহমিকা নেই বুঝলি। ও বরাবরই চুপচাপ ধরনের। আজ ও সিক্তার রুমে আছে। এবার উঠে ফ্রেশ হয়ে নে। এখন আমি যাই। তোর বড়মা একাই রান্নাঘর সামলাচ্ছ। ” তাহমিনা আক্তার রুম থেকে বেরিয়ে আসেন।
তাহমিদ মায়ের কথা না শুনে পুনরায় বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। ওর ভিষণ ঘুম পাচ্ছে। সারারাতের ঘুমেরা এখন চোখের পাতায় চেপে বসেছে। আর মায়ের মুখে আনন্দের খবর শুনেই সকল টেনশন নিমেষেই উবে গেছে। তাই ঘুমেরা রাজত্ব করছে চোখের পাতায়। আর ঠোঁটে মেখে রয় হাসির রেশ।

চোখ বন্ধ করে সটান হয়ে শুয়ে থাকে তাহমিদ। এক সময় ঘুমিয়েও যায়। কিন্তু তখনও ঠোঁটের কোনে লেগে আছে প্রশান্তির হাসি।
কুহু ঘুম থেকে উঠে দেখল সিক্তা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঘড়ির দিকে চোখ পরতেই দেখল নয়টা বেজে গেছে। ফজরের নামাজ আদায় করে, আবার বিছানায় গড়াগড়ি দিতেই কখন যে ঘুমিয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। ঝটপট করে বিছানা ছাড়ে কুহু। ফ্রেশ হয়ে নিচে নামে।

ওর বেশ লজ্জা লাগছে। সবার সাথে কথা বলবে কেমন করে, ভাবতেই লজ্জা পাচ্ছে। গতকাল অব্দি ও এই বাসায় আফরোজা নাজনীনের ভাইঝি হিসেবে সমাদৃত হত। কিন্তু আজ থেকে আরেকটা সম্পর্কের অধিকারবলে এই বাসায় সমাদৃত হবে। কতইনা বিচিত্র এই জীবন! ও কি ভাবতে পেরেছিল, সেদিন বিয়ে করতে অস্বীকার করার পর আবারও সেই মানুষটাই ওকে বিয়ে করতে উদগ্রীব হয়ে যাবে!

” এইযে, ছোট নাতবউ, এত কি ভাবছ শুনি? চোখের সামনে আমি জলজ্যান্ত মানুষ বসে আছি, কিন্তু তুমি দেখেও দেখছনা! নাকি শ্বশুর বাড়ি পছন্দ হয়নি? ” আয়েশা সালেহার কথায় লজ্জায় মাথা নিচু করে কুহু৷
আয়েশা সালেহা কুহর হাত ধরে ওকে নিজের পাশে বসান৷
” দেখি আমার লজ্জাবতী লাজুকলতাকে। এখনই এত লজ্জা পেলে বিয়ের পর কি করবে শুনি! একটু লজ্জাতো আমার নাতির জন্য রাখ। নাকি বাসর ঘরে আমার নাতির লাজুকলতা দেখার সৌভাগ্য হবেনা! ”

” দিদুন প্লিজ, এভাবে বলোনা। ”
” মা, একবার কষ্ট করে এদিকে আসবেন। আজ নাহয় সবার সাথে এক টেবিলে বসে নাস্তা করবেন। ” তাহমিনা আক্তার শ্বাশুড়িকে অনুনয় করেন।
” হ্যাঁ বউমা, আজ আমি নাতি-নাতনীদের সাথে নাস্তা করব। আমার মন আজ ভিষণ ভালো। তুমি তাহমিদ আর সিক্তাকে ডাকো। ”

কুহু দিদুনকে ধরে ডাইনিং টেবিলের নিয়ে এসে একটা চেয়ারে বসিয়ে দেয়।
কিছুক্ষণ পর তাহমিদ আর সিক্তা নিচে নামে।
কুহু দিদুনের পাশে বসে এটাসেটা গল্প করছিল।
সিক্তা তাহমিদের সাথে খুনসুটি করতে করতে এগিয়ে আসছে।
তাহমিদকে একনজর আঁড়চোখে দেখেই কুহু দিদুনের দিকে মনযোগ দেয়। তাহমিদ কুহুকে দেখেও না দেখার ভান করে চেয়ার টেনে বসে।

” শুভ সকাল। কেমন আছো, দিদুন?”
” শুভ সকাল, নতুন জামাই। আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি। এবার তোমার খবর বল। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন থেকে তোমাদের আর তুই বলে ডাকবনা। ”
দিদুনের মুখে নতুন জামাই ডাক শুনে তাহমিদের বুকের র’ক্ত ছ’ল’কে উঠে।
সিক্তা দিদুনের কথায় হৈহৈ করে উঠে।

” ভাইয়া, আমি কিন্তু তোমার নতুন আত্নীয় হলাম। এবার ট্রিট দাও। ট্রিট ছাড়া চলবেনা। ”
” নতুন আত্মীয় হয়েছিস, এটা আজ বুঝলি গ’র্দ’ভ? আমিতো সেই কবে থেকেই সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তোদের মোটা মাথায় ঢুকলে তো। এজন্য তোদের কোন ট্রিট নেই। ”
” কি! তুমি আবার আমাদের কবে জানিয়েছ? অযথা ভাও দিওনা। ট্রিট চাই, দিতে হবে। ”
” এতই যখন ট্রিটের শখ, তবে যা সিনিয়র রাশেদিনের কাছ থেকে নিয়ে নে। আমার কাছে এত ছ্যাঁ’চ’ড়া’মো করে লাভ নেই। ” তাহমিদের কাটকাট জবাব শুনে মুখ ফোলায় কুহু।

” সোনা মা, তুই ক্লাস করবিনা আজকে? ” আফরোজা নাজনীন মাংসের বাটি টেবিলে রেখে জিজ্ঞেস করেন কুহুকে।
” ফুপু, আজ এগারোটায় এবং সাড়ে বারোটায় ক্লাস আছে। আমি দশটার দিকে বের হব। ”
” তাহমিদ, তুই কখন যাবি বাপ? তোর ক্লাস নেই আজকে? ”
” বড়মা, আমার আজকে সাড়ে দশটা থেকে ক্লাস আছে। এক্ষুনি আমাকে বের হতে হবে। ”
” তুই গাড়ি নিয়ে যাস। কুহুকে নিয়ে আমি যাব। ওকে নামিয়ে দিয়ে একটু শপিংয়ে যেতে হবে। ”

সকলের কথার মাঝে কুহু অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, এখন পর্যন্ত তাহমিদ ওর দিকে একবারও তাকায়নি!
বিকেলে ক্লাস করে ফেরার পথে তাহমিদ কুহুর হোস্টেলের সামনে দাঁড়ায়। বড়মা কুহুকে নিয়ে ফিরতে বলেছে। কুহু কলেজে ক্লাস শেষে, কোচিং করে হোস্টেলে আসে ওর জামাকাপড় নিতে। তাহমিদ হোস্টেলের সামনে এসে কুহুকে ফোন দেয়। কুহু ঝটপট ফোন রিসিভ করে।

” আসসালামু আলাইকুম। ”
” আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। ” ব্যাস এতটুকু বলেই ফোন কেটে দেয় তাহমিদ।
কুহু বাইরে আসলে তাহমিদ গাড়ির পেছনের দরজা খুলে দেয়, আর নিজে বসে ড্রাইভারের পাশে। কুহু শুধু নিরবে তাহমিদের নির্দেশ পালন করে।

বিঃদ্রঃ আমার বাসায় আল্লাহর রহমতে মাসের দশদিনই মেহমান থাকে। আমি নিজেও অসুস্থ। বিপি হাই, সকাল-রাতে দুইটা ট্যাবলেট খেতে হয়। এছাড়া হরমোনের প্রবলেম, হাঁটুর ক্যালসিয়াম শুকিয়ে যাচ্ছে, হাড়ে ক্ষয় ধরেছে। এদিকে ছেলেও চিররুগ্ন। একদিন ভালো থাকলে তিনদিনই অসুস্থ থাকে। আমার কোন হেল্পিং হ্যান্ড নেই। নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয়। এর মাঝেই আমি নিয়মিত গল্প দেবার চেষ্টা করি।

বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৩১

আপনার অনেকেই অভিযোগ করেছেন, আমি নিয়মিত গল্প দিইনা, পার্টগুলো ছোট হয় । আমি বলব, আমি চেষ্টা করি সময় মেইনটেইন করে লিখবার জন্য।

বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৩৩