শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব ৬

শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব ৬
আলিশা

স্মরণের কথার হেরফের করতে বেশ তর্ক বিতর্ক শুরু হলো বাড়ির মাঝে। বাবা এক পর্যায়ে বলে বসলেন
— গেলে তুমি যাও স্মরণ। আমি বউমা আানার আগে মেয়ে এনেছি। তাই আমার মেয়ে আমার বাড়িতেই থাকবে। আর হ্যা, আমার নাতনি কেও রেখে যেও।

ব্যাস, এই কথাতেই সব তেজ থমকে দিতে বাধ্য হলো স্মরণ। অবশেষে সে রাগ ক্ষোভ নিয়ে দেখলাম বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে সে আমার সাথে একবার ভয়াবহ সাক্ষাৎ করে গেলো। আচমকা আমার হাত টেনে উল্কার বেগে আমার ঘরে নিয়ে গিয়ে শাসিয়ে বলল

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— বাবার জন্য কিচ্ছু হচ্ছে না। আপনি একটা বোঝা আমার কাছে। একটা কথা ভালো করে শুনে নিন। নেক্সট টাইম আমাকে কখনো ফলো করার চেষ্টা করবেন না। খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।
আমি শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তার কথাগুলো হজম করলাম। মনে মনে খুব করে জানতে চাইলাম
” আমাকে নিয়ে আপনার কি এতো সমস্যা? আমি কি আপনার কাছে ভালোবাসা চাইতে গেছি? আপনার ধার ধারে পরে থেকেছি? স্ত্রীর অধিকার চেয়েছি? তবুও?”

— আমার খেয়ার জায়গা নেওয়ার সহসটা কখনো করবেন না।
দু কদম এগিয়ে গিয়েও আবার হঠাৎ পিছু ফিরে সে একথা বলল খুব গভীর করে। তারপর আবারও তেজ নিয়ে গটগট করে হেটে গেলো। আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার যাওয়ার পানে। সে কি তবে আমাকে একটু হলেও মেনে নিলো? ভাবতেই বুকের মাঝে ঢিপঢিপ ছন্দ উঠলো। অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো তার এই কথা। আমি চোখদ্বয় চরক গাছ করে দাড়িয়ে রইলাম। একদল একপাক্ষিক ভালোবাসায় ডুবন্ত মানুষদের মতো করে বলে উঠলাম

” তুমি প্রিয় নাই বা আমাকে ভালোবেসো। শুধু আমাকে দূরে ঠেলে নাহি দিও।”
স্মরণ প্রস্থান পথ ধরায় আমার কথা শুনতে পেলো না। তবে আমি ঠিকই শুনতে পেলাম আমার মনের কথা। কেউ যেন বলে যাচ্ছে
” না প্রথম দেখাতে ভালোবাসিনি আমি তবে ধীরে ধীরে জাগলো এ অনুভূতি। আমি সারাদিন ভেবে, এই ভেবে যায় আমার রাত পেরিয়ে। ”

শেষ বিকেলের আলোটা নিভে চারিদিকে অন্ধকার নামলো। ছোয়াকে আজ পড়াতে বসালাম আমি৷ বাবার রুমে এরমাঝে একবার উঁকি দিয়ে এসেছি। দেখে বুঝলাম তার মন মেজাজ ততটা ভালো নেই। বিধায় আমি ওষুধ খাওয়ার বিষয়টা ছাড়া বাকি কোনো প্রসঙ্গ টেনে কথা বলিনি। ছোঁয়ার পড়া শেষ হতেই ওকে রাতের খাবার খাইয়ে দিলাম। কিছু সময় টিভির পর্দায় চোখ রাখলো মেয়েটা। অতঃপর টিভি দেখা কালেই ঘুমিয়ে পরলো আমার কোলে। ওকে একহাতে শক্ত করে ধরে নিয়ে আমি সোফায় ঠেস দিয়ে বসে টিভি দেখতে লাগলাম। এক সময় যেনো আমার চোখও নিভু নিভু হয়ে এলো। কখন যে কিভাবে ঘুমিয়ে গেলাম তা আমার অজানা।

ঘুম ভাভলো আমার কোলটা কেউ ফাঁকা করার তীব্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এমন অনুভব করে। ঈষৎ চমকে চোখ জোরা ঘুম ছাড়িয়ে টেনে তোলার চেষ্টায় মরিয়া হলাম। একটু চোখ খুলতেই অক্ষিপটে ভেসে উঠলো কারো অতি সুদর্শন মুখ। কাপালে কিঞ্চিৎ বিরক্তির ভাজ। চোখ জোরা তীক্ষ্ণ করে রাখা। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। ঘুমের মাঝে নিঃশ্বাসটা নিলেও এখন নেওয়া যেন একেবারে বন্ধ হয়ে গেলো। চোখের পলক ফেলতেও অস্বস্তিতে জমে যাচ্ছি। স্মরণ ছোঁয়াকে আলগোছে আমার কোল থেকে তুলে নেওয়ার জন্য বেশ যুদ্ধে নেমে গেছে। কিন্তু ঠিক জয়ী হতে পারছে না ছোঁয়া আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখায়। আমি শুধু এভাবেই নড়চড় হীন দেখে গেলাম প্রায় মিনিট দশেক। অতঃপর আস্তে করে বুকের ধুকপুক লুকিয়ে রেখে তাকে বললাম

— আজকে থাক আমার কাছে।
আমার কন্ঠ পেয়ে স্মরণ তড়িৎ গতিতে উঠে সোজা হয়ে দাড়িয়ে গেলো। বেশ খানিকটা বিব্রত ভাব তার চেহারায় জমে গেলেও তা তৎক্ষনাৎ সরিয়ে দিয়ে বলে উঠলো
— না। আমি নিয়ে যাচ্ছি।
— ঘুমানোর আগে বলেছিল ‘আন্টি আমি তোমার সাথে থাকবো’।

মনে অসীম সাহস নিয়ে একথা তাকে শুনিয়ে দিতেই সে ক্ষুদ্ধ চাহনি নিয়ে তাকালো আমার দিকে। আমিও নিষ্পাপ দৃষ্টি তার দিকে ছুড়ে দিয়ে বসে আছি। সে ক্ষণকাল আমিসহ ছোঁয়াকে পরখ করলো। অতঃপর আর কিছু না বলে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলো আমার সম্মুখ হতে। আমি তার রাগের মাত্রা পরিমাপ করে ছোঁয়াকে কোলে নিয়ে আমার ঘরের দিকে রওনা হলাম। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গায়ে কাথা চাপিয়ে আমিও শুয়ে পরলাম ওর পাশে।

খুব মিষ্টি একটা সকালে ঘুম ভেঙে গেলো। পাশ ফিরে ছোঁয়ার মায়া ভরা মিষ্টি মুখ দেখে মনটা যেন আরো ভালো হয়ে গেলো। মাত্রই যখন সাংসারিক ব্যস্ততার কথা মাথায় এলো তখন ক্যালেন্ডার বলে দিলো আজ শুক্রবার। মনে অন্যরকম অজানা আনন্দ ধরা দিলো। ঘরে প্রকৃতির আলোকচ্ছটা চিরচেনা দিনের সুর তুলল। বুকের মাঝে আনচান ভাব। এমন দিনে আগে প্রায়ই নানিমার কাছে ছুটে যেতাম। চাচি আম্মার বকাবকির কোনো সীমান্ত ছিলো না। সুযোগ ভীষণ কমই ছিলো।

কিন্তু এই সুযোগ প্রসারিত করে দিতো ওয়ারেসিয়া। আমার চাচাতো বোন৷ টুকিটাকি কেনা কেটা বা তার বস্তাভর্তি শপিংয়ের অজুহাতে আমাকে নিয়ে যেতো নানি মার কাছে। আর সে বন্ধুদের সাথে শপিং করতো। যদিও কষ্টে পার করেছি জীবন। তেরো বছর বয়স থেকে প্রথমে মামার বাড়ি তারপর চাচার বাড়িতে বেড়ে ওঠা। আজ ভীষণ মনে পরছে তাদের। একটাবারও কেউ খোঁজ নিচ্ছে না আমার? ভীষণ দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে তাদের। কিন্তু কিভাবে যাই? মনে বিষন্নতা ভর করলো। ধীরে গতিতে বিছানার থেকে নেমে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। জয়নব খালা হয়তো এসে গেছে এতক্ষণে।

রান্না অর্ধেকের বেশি খালাই করে নিয়েছিল। আমি শুধু পরিবেশনের কাজটা সম্পন্ন করলাম। খারাপ টেবিলে একে একে সব রাখতেই স্মরণের আগমন ঘটলো। সে ভীষণ ব্যাস্ততা নিয়ে পরিপাটি ড্রেসে চেয়ারে বসেই হুকুম দিলো
— খালা আমার নাস্তাটা তাড়াতাড়ি দিন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
দূর্ভাগ্যবশত খালা তখন রান্নঘরেও ছিল না। সে গেছে বাড়ির দারোয়ানের কাছে ছোট খাটো একটা বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দিতে।

— খালা নেই। নিচে গেছে।
মিনমিন করে তাকে বললাম। সে আমার কথায় একপলক আমাকে দেখে নিলো। তারপর ছোঁয়ার কথা জানতে চেয়ে বলল
— ছোঁয়া ঘুম থেকে ওঠেনি?
— না।
সে যেন চমকে উঠলো। হঠাৎই তড়িঘড়ি করে বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে বলল
— নয়টা বাজবে এখন। ওর আবার জ্বর হয়নি তো?

হঠাৎ এমন দুশ্চিন্তা ভাবমূর্তি স্মরণের মাঝে দেখে আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। অবুঝের মতো বললাম
— ঘুম থেকে দেরিতে উঠলে জ্বর আসে?
সে আমার প্রশ্নের কোনোরূপ জবাব না দিয়ে শুধু একটা রাগপূর্ণ দৃষ্টি উপহার দিয়ে ছুটলো আমার ঘরের দিকে। আমিও তার পিছু নিলাম। উল্কার বেগে ছুটে গিয়ে মেয়ের কপালে হাত রেখেই গভীর মনোযোগ দিয়ে অনুভব করতে লাগলো শরীরের তাপমাত্রা। এরই মাঝে ছোঁয়া চোখের পাতা অল্প একটু উন্মুক্ত করে ডেকে উঠলো

— বাবা?
— হ্যা মা। তোমার কি খারাপ লাগছে?
— হু।
স্মরণ কোলে তুলে নিলো ছোঁয়াকে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল
— এভাবে বুঝি একজন মা হয়ে উঠতে চান আপনি? সারা রাত পাশে থেকেও বোঝেননি মেয়েটার জ্বর এসেছে। এতোটাই যখন অনীহা তখন কাল কেন নিজের কাছে নিয়ে এলেন? আমি ওকে আমার কাছে নিয়ে যেতে চাইনি?

— আমি তো আসলে….
— আসলে বোঝাই লাগবে আপনার কাছে। এমনই হওয়ার কথা। কোন মেয়ে চাইবে একটা বাচ্চাওয়ালা সংসারে আসতে? এখনো সময় আছে চলে যেতে পারেন। আমি আটকে রাখিনি। আমি তো চাই-ই না আপনাকে।
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে গেলো স্মরণ। আমি এবার মৌনতা কে ঠাঁই দিয়ে নিঃশব্দে দারিয়ে রইলাম।

শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব ৫

সে কিছুটা সময় নিয়ে আমকে পরখ করেই চলে গেলো ঘর থেকে। তার কথাগুলো আমাকে আহত করে দিলো। আমি সত্যিই ভাবিনি ছোঁয়া অসুস্থ হতে পারে। পুরোটা রাত আমাকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে ছিলো। কিন্তু ওর শরীরের তাপমাত্রা সহনীয় ছিল। অস্বাভাবিক কিছু আমি বুঝিনি। ভাবনার মাঝে রুম থেকে বেরিয়ে স্মরণের রুমের দিকে রওনা হলাম।

শেষ বিকেলে তুমি আমি বোনাস পর্ব