এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৯

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৯
ইফা আমহৃদ

আকাশে মস্ত বড়ো চাঁদ। চাঁদের পাশে একটি উজ্জ্বল সুখতাঁরা দেখা যাচ্ছে। দখিনা হাওয়াতে আমার অবাধ্য চুলগুলো উড়িয়ে যাচ্ছে। মেঘলা আকাশের সাথে তাল মিলিয়ে আমার মনটাও ভিশন ভার। চোখের জল শুকিয়ে গেছে। দরজা খোলা খ্যাঁক খ্যাঁক শব্দ শুনতে পেলাম। জানালার গ্ৰিল ধরে উঠে বসলাম। মামি এসেছেন। মাথায় হাত রেখে বলেন,

“তোর এক মা নেই তাতে কি? পারুলের সাত ভাই থেকে চার ভাই চার ভাবী আছে। তারা ঠিক তোর যত্ন নিবে।”
মামি মায়ের কোমর জড়িয়ে বললাম, “মা এখন কোথায় মামি? আমাকে কখনো আরু বলে ডাকেনি। আমি আমার জীবনে কখনো মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পারি নি। মায়ের আঁচলে মুখ মুছতে পারি নি। মা এত স্বার্থপর কেন মামি? এই পৃথিবীতে একা কেন রেখে গেল?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মামির কাছে কোনো প্রত্যুত্তর নেই। মগডালে একটা ডাহুক পাখি ডেকে চলেছে তার সুরেলা কণ্ঠে। সেই সুর পৌঁছে গেছে ময়নার কানে। ময়না ঘুমিয়ে ছিল। ঘুম ভঙ্গ হতেই ময়না তিনবার ডাকল আমাকে, “আরুপাখি, আরুপাখি, আরুপাখি।”
আমি অশান্ত মন নিয়ে ময়নার দিকে তাকালাম। আমার বলতে ময়না আছে শুধু। কিছুক্ষণের ভেতরে শেফালী ও তুর ঘরে এলো। মামি মাকে উদ্দেশ্যে করে বলে তুর,

“মা, তুমি কি আজকে আমাদের সাথে ঘুমাবে?”
“হ্যাঁ, আরুর সাথে একটু শুতে চেয়েছিলাম। জানি ঘুম আসবে না। তবে ওর ঘুমটা জরুরি। অসুস্থ শরীর নিয়ে জেগে থাকলে আরও অসুস্থ হয়ে যাবে।” বলেই মামি মশারি টানাতে লাগলেন। শহরে থাকতে একদিন আমি মশারি টানিয়ে ছিলাম। তারপরে অপূর্ব ভাই স্প্রে করে মশা তাড়িয়েছেন। ছোটো মামি ভাত নিয়ে হাজির হলেন। বড়ো মামির হাতে দিয়ে বললেন, “ভাত খাবার পর ওষুধ দিও। খেতে না চাইলে জোর করে দিও।”

ঠোঁট কামড়ে বললাম, “হঠাৎ আমার মা মা/রা গেল কেন মামি। যাওয়ার আগেও কত সুস্থ দেখেছিলাম।”
“মায়ের মন ম্যাজিক জানে, তারা জানে মেয়ের বিপদ আপদ। তোর মা প্যারালাইড থাকলেও প্রাণ ছিল। সেদিন আপা ফোন করে বলল, ‘তুই আগুনের ভেতরে আটকা পড়েছিস। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। জ্ঞান নেই।’ তখন আমি তোর পাশের কাছাকাছি ছিলাম। আমার কথা নিশ্চয় সে শুনতে পেয়েছে। একটু পরেই দেখলাম, চোখ উল্টে যাচ্ছে, হাত পা ঠান্ডা কেমন হয়ে যাচ্ছে। আমরা দ্রুত হাসপাতালে নেই। জানতে পারি তোর মায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। দুইদিন নিজের সাথে লড়াই করে চলে যায় না ফেরার দেশে।”

আকাশের সুখতারা হঠাৎ করে জ্বলে উঠল। আমি তাকাতেই মিষ্টি করে হাসল। আমিও হাসলাম। এতক্ষণ সঞ্চয় করে রাখা অশ্রু ধারা এবার অবাধ্য হয়ে গাল গড়িয়ে ঝরে পড়ল। মামি গালে হাত দিয়ে সেই পানিটুকু মুছিয়ে দিলেন। আচম্কা নিয়ন্ত্রণ হীন হয়ে জড়িয়ে ধরলাম মামিকে। ভেতরের চিৎকার গুলো প্রকাশ পেল বিলম্বে। মামি আমাকে শান্তনা দিলেন না। কেউ আমাকে শান্তনা দিতে চাইলে তিনি হাতের ইশারায় থামিয়ে দেন তাদের। চোখের ইশারায় বলে, “কাঁদ আরু, একটু কাঁদ। ভেতরের কষ্টগুলো বের করে নিজেকে হালকা কর।”

কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠেছে। বিছানার চারপাশে মশারি গুঁজে আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন মামি। চুলগুলো টেনে দিতে দিতে ঘুমাতে বললেন। আজ বাড়িতে মৃ/ত্যুর শোক আছে, কালকেও থাকবে, থাকবে পরশু। ধীরে ধীরে শোক বিলিন হয়ে যাবে। তিস্তা আপুর বিয়ের ফুল ফুটবে‌। শুধু আমার মা থাকবে না।

মাঝরাতে শুয়ে পড়েছে সবাই‌। আমার চোখে ঘুম নেই। বাইরে দুইশ পাওয়ারের বাতিটা সর্বোচ্চ আলো ছড়াচ্ছে। বিছানার পাশ থেকে ওড়না নিয়ে বাইরে হাঁটা দিলাম। আমার মা গত দুইদিন ধরে কিচ্ছু খায়নি। রান্নাঘরে থেকে খাবার থালায় নিয়ে বের হলাম বাড়ি থেকে। বাইরের পরিবেশ অন্য ধরনের। চিরচেনা সেই মা মা গন্ধ। বড় হয়ে যাচ্ছি‌।

মাকে রাখা হয়েছে তার তিন ভাইয়ের কাছাকাছি। অন্য দিনগুলোতে রাতের বেলা কবরের সামনে গেলে প্রচুর ভয় পেতাম। আজ ভয় নেই। আমার অভয় মা আছে। তিনি আমাকে তার অদৃশ্য ডানা দিয়ে আগলে রাখবে। মাকে রাখা হয়েছে সেখানে বকুল ফুলের গাছ আছে‌। আমি গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসলাম। খাবারের থালাটা গাছের পাশে রেখে অস্ফুট স্বরে বললাম, “তোমার ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নিও। কেউ তোমার খোঁজ না রাখলেও আমি রাখব মা।”

‘তোমার ম/র/ণকালে কাঁদবে যেজন, সেজন তোমার আপনজন, থাকতে জীবন যায় না চেনা মানুষেরই মন।’
সকালের আলো ফুটেছে‌। চাঁদ মামা অদৃশ্য হয়েছে সূর্যের আগমনে। তারা একজন অন্যজনকে প্রচুর ভয় পায়। বিরোধী পক্ষ। কাঁধে শীতল হাতের স্পর্শ পেলাম। ঘুম ঘুম দৃষ্টিতে তাকালাম আগন্তুকের দিকে। অপূর্ব ভাই এসেছেন। কখন যে চোখের পাতা লেগে এসেছিল খেয়াল করা হয়নি। অপূর্ব ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে সৌজন্য হাসি দিয়ে বললাম, “এত সকালে আপনি উঠেছেন।”

অপূর্ব ভাই পাশে বসে বললেন, “আমি তো রোজ সকালেই উঠি। আজ নতুন বুঝি?”
“ওহ্।” সংক্ষিপ্ত জবাব। অপূর্ব ভাই পুনরায় প্রশ্ন করলেন, “পায়ের ব্যথা ভালো হয়নি। ক্ষতটা দিলি তো তাজা করে।”
তাকালাম পায়ের দিকে। সত্যি ক্ষতটা তাজা হয়েছে। শরীরের ব্যথার চেয়ে মানসিক ব্যথা বেশি জোড়ালো হয়েছে আমার। চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি পড়ল‌। অপূর্ব ভাই আলতো করে মুছে দিয়ে বললেন, “চোখের পানির মূল্য সীমাহীন। তাই ফেলতে নেই।”

নিজেকে সামলে আরেকবার হাসলাম আমি। অপূর্ব ভাই তার হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “বাবা তোকে ডাকছে। তাড়াতাড়ি চল। আজ তোর জীবনের একটা বড় ঘটনা ঘটতে চলেছে।”
হাতের উপর হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই প্রকট হলো ব্যথা। হাতটা খামচে ধরে ধরলাম। দু’হাতে আবদ্ধ করে থালাকে ইঙ্গিত করে বললেন, “খাবারের থালা এখানে কেন এনেছিস?”

“মায়ের জন্য এনেছিলাম। কিন্তু খাবার কোথায় গেল?”
“শে/য়া/ল কু/কুর বা বন্য প্রাণী খেয়ে গেছে। তারা তোর মায়ের জন্য দোয়া করবে। বেশি বেশি দান সদকা দিবি। তোর মায়ের শান্তির জন্য।”

মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। অপূর্ব ভাই আমাকে ধরে হাঁটতে লাগলেন। আমিও ছোটো ছোটো পা ফেললাম। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম। কতগুলো গাড়ি থেমে আছে। গুনে নিলাম ‘তিনটা’ গাড়ি। উঠান পেরিয়ে ঘরে ঢুকলাম। বৈঠকখানায় মামারা বসে আছেন। তাদের থেকে কিছুটা দূরত্ব চোখ পড়তেই থেমে গেলাম। সেই ট্রেনের মানুষটি। ইমদাদুল হোসেন মৃধা। অস্ফুট স্বরে বললাম, “আপনি এখানে চাচা।”
অতঃপর সবার দিকে তাকিয়ে বললাম, “ইনিই তিনি। আমাকে ট্রেন থেকে তার বোনের বাড়ি নিয়ে গেছিলেন। ভালো মানুষ।”

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৮

বড়োমামা গম্ভীর গলায় বিদ্রুপ করে বলেন, “তোর কাছে ভালো হতে পারে। কিন্তু আমাদের পরিবারের কাছে জ/গ/ন্য। আমাদের পরিবারের সুখ করে নিয়েছে। ইনি তোর বাবা।”
মুহুর্তেই সব বিশ্বাস দূর হয়ে গেল। ঘাড় কাত করে মানুষটিকে দেখলাম। মুখশ্রীতে কত মিল। এ যেন আমি। তার প্রতি জমিয়ে রাখা আমার শত অভিযোগ। ঝাঁপসা চোখে তাকিয়ে বললাম, “আপনি কি সত্যি আমার বাবা? না-কি আমার মায়ের খু/নি, প্র/তা/রক, ছলনাকারী।

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ২০