প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫৪

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫৪
Writer Mahfuza Akter

সৌহার্দ্য বিস্মিত চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার সামনাসামনি একটা গাড়ি থেকে প্রহর বেরিয়ে আসছে। অথচ কিছুক্ষণ আগেও প্রহরের সাথে ওর কথা হয়েছে ফোনে। প্রহর জানিয়েছিল, সে সকাল সকাল শহরের বাইরে গিয়েছে একটা কেইস নিয়ে ইনভেস্টিগেট করার জন্য। তার মানে, প্রহর ওকে মিথ্যে বলেছিল! কিন্তু এর পেছনে কারণ কী? কী এমন কারণে প্রহর মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছে? আর এয়ারপোর্টে-ই বা কেন এসেছে?
ভাবনার মাঝেই সৌহার্দ্য খেয়াল করলো, প্রহর ঘুরে তাকাতেই ওর দৃষ্টি-ও সৌহার্দ্যের ওপর পড়েছে। কপালে ঈষৎ ভাজের রেখা ফুটিয়ে প্রহর সৌহার্দ্যের দিকে এগিয়ে এলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে প্রশ্ন করলো,

“তুই এখানে হঠাৎ? ”
সৌহার্দ্যও পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“আমারও একই প্রশ্ন! তুই তো আমাকে বলেছিলি…..
সৌহার্দ্যের কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রহর বললো,
“গিয়েছিলাম ঢাকার বাইরে! কাজ শেষ করে ফিরেও এসেছি। মধু আসবে আজ। তাই তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হলো।”
সৌহার্দ্য অবাক হলো। তাড়াতাড়ি হলেও এতোটা দ্রুত আসার তো কথা না! সে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এতো তাড়াতাড়ি কীভাবে?”
প্রহর মলিন হেসে বললো,
“আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? জেরা করছিস? ট্রেনে এসেছি।”
সৌহার্দ্য নিজের প্রতি নিজেই বিরক্ত হলো। এভাবে এতো প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি। প্রহর তো কখনো ওর কাজ নিয়ে মাথা ঘামায় না! তাহলে সে কেন এতো ভাবছে? প্রহরের স্বাভাবিক মুখভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সৌহার্দ্য অহেতুক বেশি বেশি ভাবছে, সন্দেহ করছে। ব্যাপারটা আসলেই দৃষ্টিকটু। প্রহরের ওপর চোখ বন্ধ করে সে ভরসা করতে পারে। হয়তো এটা ভেবেই প্রহর ওকে ভুল বুঝবে না!
চিন্তার জগতে ভাটা পড়লো প্রহরের প্রশ্ন শুনে,

“তুই বললি না তো? কেন এসেছিস?”
সৌহার্দ্য একটু চমকালো। নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
“ডক্টরের টিম আসবে আজকে। তাই তাদের রিসিভ করতে আসতে হলো।”
সৌহার্দ্যের চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। প্রহর ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বললো,
“কোত্থেকে আসবে?”
“কানাডা থেকে আসবে শুনলাম।”
প্রহর হালকা হেসে বললো,
“তাহলে তো ভালোই হয়েছে! অর্থীও সেই টিমের সাথেই আসছে।”

সৌহার্দ্য বিরস মুখে হাসার চেষ্টা করলো। প্রহর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো সেটা। সৌহার্দ্যের এখানে আসার ব্যাপারটা ওর নিজের কাছেও খুব ভালো লাগেনি। তবুও দায়বদ্ধতার জন্য আসা ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না। তাই সৌহার্দ্যের কাঁধে হাত রেখে বললো,
“মাঝে মাঝে পার্সোনালিটির চেয়ে প্রফেশনালিজমকে বেশি প্রায়োরিটি দিতে হয়। ওদের সাথে একবার দেখা করেই তুই চলে যাস না-হয়! এখন চল এগিয়ে গিয়ে দেখি।”

দু’জনে দুই পা এগিয়ে আসতেই দেখতে পেল, ডক্টর শাহেদ দশ-বারো জন ডক্টরকে সাথে নিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। সৌহার্দ্য মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলানোর চেষ্টা করলো। প্রহর সবার বাদামি চুল ও শুভ্র ফকফকে মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে কাঙ্ক্ষিত মুখটা দেখতে ব্যর্থ হলো। ভ্রু কুঁচকে ভাবলো, তার মানে কি অর্থী আসেনি?
ডক্টর ক্লারা প্রহরকে আগে থেকেই চিনতেন। অর্থী-ই ওনার সাথে প্রহরকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। তিনি এগিয়ে গিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রহরকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন,

“হাও’স গোয়িং অন, মাই বয়? কত বছর পর তোমাকে দেখলাম! কানাডা যাওয়া তো বন্ধ-ই করে দিয়েছো! হোয়াট’স দ্য রিজন?”
প্রহর খানিকটা হাসার চেষ্টা করে বললো,
“এমনিতেই! তেমন কোনো ব্যাপার না, ম্যাম। অর্থীকে দেখতে পাচ্ছি না যে! ও কোথায়?”
“আসলে ও ওর এক ফ্রেন্ডের সাথে আসতে চেয়েছিল। বাট আনফরচুনেটলি ওরা ফ্লাইট মিস করেছে। ওদের সাথে কন্ট্যাক্ট করার অনেক চেষ্টা করেছি। ওরা খুব সম্ভবত নেক্সট ফ্লাইটে চলে আসবে। আমি যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি আবার!”

প্রহরের পাশে সৌহার্দ্যকে দেখে সবাই ওর দিকেই উৎসাহিত চোখে তাকিয়ে রইলো। সৌহার্দ্য প্রথমে ব্যাপারটা খেয়াল না করলেও যখন বুঝতে পারলো যে, সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে, তখন বিব্রত মুখে হাসার চেষ্টা করলো। একটা মেয়ে হাসি মুখে এগিয়ে এসে সৌহার্দ্যের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
“হ্যালো! আ’ম ডক্টর আনফা, স্পেশালাইজড ইন প্যাথলজি। ইউ আর ডক্টর সৌহার্দ্য রায়হান, রাইট?”
সৌহার্দ্য ভ্রুকুটি করে হাসার চেষ্টা করলো। হাত না মিলিয়ে বললো,

“ইয়েস, আই এ্যাম। গ্ল্যাড টু নৌ এবাউট ইউ!”
ডক্টর ক্লারা এগিয়ে এসে সৌহার্দ্যকেও এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“তোমার ব্যাপারে ওরা অনেক গল্প শুনেছে। অর্থী সবসময় তোমাদের নিয়েই বকবক করতো। এজন্য এরা দেখেই চিনে ফেলেছে।”
সৌহার্দ্য মলিন হাসলো। কিন্তু প্রহরের মুখে হাসি নেই। অর্থী ফ্লাইট মিস করার মানুষ না। বাংলাদেশে আসার জন্য সবসময় মুখিয়ে থাকে মেয়েটা। কোনো সমস্যা হয়নি তো!

অর্থীর মুখ জুড়ে বিরক্তি। কপাল কুঁচকে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে সে। অন্য দিকে অরিত্রী ঘর জুড়ে পায়চারি করছে। ওকে একবার পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে অর্থী বিরস মুখে বললো,
“এই ছেলেটা অসহ্য! সব কিছুতে ওর এমন ইন্টারফেয়ারেন্স কেন? তুই ওকে কখনো কিছু বলিসও না!”
অরিত্রী থমথমে মুখে চুপচাপ বেডে বসলো। কালকের আগের দিন এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বের হতেই পার্কিং এরিয়ায় অর্ণব ওদের ধরে ফেলেছিলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অরিত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেছিলো,

“অর্থীর কথায় লাফালাফি বন্ধ কর। আমি আগেই জেনে ফেলেছি যে, তুই আজকে বাংলাদেশে যাচ্ছিস! কোথাও যাওয়া হচ্ছে না তোর। লাগেজ নিয়ে ভেতরে যা।”
কথাগুলো ভাবতেই রাগে মুখ লালাভ বর্ণ ধারণ করলো অরিত্রীর। বিরবির করে বললো,
“বাংলাদেশে যাওয়া আগে আমার শখ ছিল, কিন্তু এখন সেটা আমার জেদ। আমি তো যাবোই! দেখি আমাকে কে আটকায়?”

অর্থীর দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“আজকে রাতের কোনো ফ্লাইট বুক করে ফেলো। আজকেই আমরা বাংলাদেশ যাচ্ছি!”
অর্থী চমকালো। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“আর ইউ শিয়র? অর্ণব তো তোর এই বাড়ি থেকে বের হওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে!”
“এজন্যই এখান থেকে বের হতে হবে আমায়। অর্ণব ভাই কে আমাকে ঘর বন্ধী করে রাখার। উনি আমার কাজিন, ওনার কোনো রাইট নেই আমাকে কোনোকিছু করা থেকে আটকানোর। সো, আমরা আজই যাচ্ছি।”

অর্থী হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। অরিত্রীর এমন রাগী রূপ কখনো দেখেনি ও। সবসময় হাসি-খুশি, প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ের এমন রাগী রূপও আছে? ভেবেই অবাক হলো অর্থী। তাই বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো,
“কিন্তু কীভাবে যাবো?”
অরিত্রী রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো,
“তুমি তোমার বাসায় যাও। রাত দশটায় এয়ারপোর্টে থেকো। আমিও পৌঁছে যাবো, ডোন্ট ওয়ারি।”

অর্থী মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। রাত একটার ফ্লাইটে টিকিট বুক করে অরিত্রীকে জানিয়ে দিলো সে। অরিত্রী খুশিমনে নিজের দরকারী জিনিসপত্র আরেকদফা গুছিয়ে নিলো। রাত আটটার দিকে অর্ণব এলো। কিন্তু অরিত্রী ওর সাথে দেখাও করলো না। সেদিনের পর থেকে অরিত্রী ওর সাথে একবারও দেখা করেনি, একটা কথাও বলেনি। অর্ণব কষ্ট পেল। কিন্তু অরিত্রীর চাওয়া সে পূরণ করতে পারবে না। তাই দেখা করার চেষ্টা না করেই আবার ফিরে গেল। মোহনাকে এখনো অরিত্রীর এসব কাহিনী জানানো হয়নি। জানানো যাবেও না। এমনি খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য মিস্টার আফনাদকে কল দিলো অর্ণব। এখন তো সেখানে দিন! তেমন ব্যস্ত হয়তো তিনি না!

অরিত্রী দশটা বাজার কিছুক্ষণ আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। কিন্তু গেইটের গার্ড ওকে বাইরে যেতে দিলো না। অর্ণব নাকি নিষেধ করে গেছে। অরিত্রী রাগী চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। হুট করে কাঁধের ব্যাগ থেকে ক্লোরোফোর্ম বের করে গার্ডের মুখে স্প্রে করে দিলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লোকটা অজ্ঞান অবস্থায় ঢলে নিজের চেয়ারে বসে পড়লো।
এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে অর্থী বারবার অরিত্রীকে কল করছে। দশটায় আসার কথা ছিল। আর এখন এগারোটার ওপরে বাজে। ওর ধারণা, মেয়েটা হয়তো আজ আর আসতেই পারবে না! শুধু শুধু ওকে দিয়ে খাটালো। বিরক্ত হয়ে সামনে তাকাতেই অরিত্রীকে নিজের ব্যাগপত্র নিয়ে এগিয়ে বসতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। বললো,

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫৩

“তুই চলেই এলি! কিন্তু কীভাবে?”
অরিত্রী রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো,
“ম্যাজিক!”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫৫