প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫৮

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫৮
Writer Mahfuza Akter

“তোর সবকিছু মনে ছিল, তরী? এতো দিন তুই অভিনয় করে গিয়েছিস আমাদের সাথে!!”
তরী নির্বিকার চোখে তাকালো। ওর এমন ভাবলেশহীন দৃষ্টি দেখে অর্থী গুরুতর ভঙ্গিতে বললো,
“সৌহার্দ্যের কথা না শুনে, না বুঝে এভাবে চলে আসার মানে কী, অরিত্রী? তুই……”

“তরী! আমাকে তরী বলে ডাকবে এখন থেকে। আমি কাগজে-কলমে অরিত্রী হলেও বাস্তবে অরিত্রী সেদিনই মরে গেছে, যেদিন ওকে মাটিচাপা দিয়ে ফেলা হয়েছিল। তরী নামটা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। সেদিনের পর থেকে আমি তরী ছিলাম, আর বাকি জীবনটাও থাকবো।”
অর্থীর অবাকতা সীমা পেরোলো। হতবাক কন্ঠে বললো,
“তো…তোর সবকিছু কখন মনে পড়লো?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমি কোনো কিছু ভুলে গেলেই না নতুন করে মনে পড়ার প্রশ্ন আসবে!” তরীর ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি।
অর্থী কিছু বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকালো। তরী মলিন মুখে বললো,
“ভুলিনি আমি কিছুই! হ্যাঁ, এটা ঠিক যে কোমা থেকে উঠার পর অনেক কিছুই মনে করতে পারছিলাম না আমি। কিন্তু মাসখানেকের মধ্যেই ধীরে ধীরে সবটা মনে পড়ে গেছে আমার।”
অর্থী নির্বাক চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এতোগুলো বছর একসাথে থেকেও সে বুঝতে পারেনি, তরীর সবকিছু মনে ছিল! হতভম্ব কন্ঠেই প্রশ্ন করলো সে, “এতো বছর চুপ করে কেন ছিলি তাহলে? এসব নাটকের কারণ কী?”

“শান্তি খুজছিলাম আমি।”
অর্থী অবাক চোখে তাকিয়ে বললো, “শান্তি?”
“হ্যাঁ, মানসিক শান্তি। আমার অতীত জুড়ে শান্তির ছিটেফোঁটাও তো ছিল না! প্রতিটা মুহুর্তের বিষাক্ততা ভুলে বাঁচতে চেয়েছিলাম আমি। সৌহার্দ্য তো আমায় ফিরিয়ে দিয়েছিলো! ওর করা সেই অপমানের ঘা শুকাতেও বহুবছর লেগেছে আমার। এই দেশে কার কাছে আসতাম আমি? কার জন্য আসতাম? কেউ তো আমার নিজের মানুষ ছিল না! তাই ভেবেছিলাম, কানাডাতেই নিজের জীবনের মানে খুঁজি। ডাক্তার হয়ে গেলে অন্তত বেঁচে থাকার একটা কারণ তো থাকবে আমার!”

তরীর টলমলে চোখ দুটো অর্থীর নজরে বেশ ভালো করে ধরা খেল। কিন্তু ওর কথাগুলো পুরোপুরি ধরতে পারছে না সে। তাই বললো,
“তুই এভাবে কেন বলছিস বল তো? এ দেশে আসার একটা কারণই তো তোর জন্য যথেষ্ট! তুই তো একা নস। তোর…….”

হুট করে দরজা খুলে অর্ণব, মোহনা আর মিস্টার আফনাদ প্রবেশ করায় অর্থী কথা বন্ধ করে চমকে তাকালো তাদের দিকে। মোহনা এগিয়ে এসে তরীকে জড়িয়ে ধরলেন। আবেগপ্রবণ সুরে বললেন,
“এখানে কেন এসেছিস তুই? এখানে কেউ তোর ভালো চায় না! কেউ তোকে সুখে থাকতে দেবে না।”
মিস্টার আফনাদ বিরক্ত হলেন। চোখে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বললেন,

“আহ্! মোহনা! ও এখানে প্রফেশনাল কারণে এসেছে। কে কী ক্ষতি করবে ওর? শুধু শুধু এসব বলছো কেন?”
তরী ওনাদের দিকে একবার তাকালো শুধু। কিন্তু তাদের সাথে কোনো কথা বললো না। সরাসরি অর্ণবের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো। তরীর দৃষ্টি স্বাভাবিক। অর্ণব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। তরী হঠাৎ মুখ খুললো,
“আমাকে পাওয়ার কোনো ইচ্ছে কি আজও তোমার মনে আছে, অর্ণব ভাই?”
অর্ণবের চোখ জুড়ে বিস্ময় খেলে গেল। কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মুহুর্তেই মলিনতা এসে ভর করলো দৃষ্টি জুড়ে। কন্ঠে অতিমাত্রায় বিষাদ নিয়ে সে বললো,

“পাওয়ার ইচ্ছে আছে কি না, জানি না! কিন্তু না পাওয়ার আক্ষেপ অন্তত আছে।”
“আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম, আমাকে নিয়ে ভাবা বন্ধ করো। আমার জীবন তো জন্মের পরপরই সৌহার্দ্যের সাথে জুড়ে গিয়েছিল! তোমার জীবনে পথচলার সঙ্গী আমি হতে পারবো না কোনোদিন।”
সৌহার্দ্যের নামটা শুনে মোহনা তরীর দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। তার মানে তরীর সবকিছু মনে পড়ে গেছে! অর্ণব ততোটা অবাক হলো না। এমনটাই তো হওয়ার ছিল! তাই স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো,

“আমি সৌহার্দ্যকে বলেছিলাম, যদি তোর চোখের একফোঁটা জলের কারণ ও হয়, তবে তোকে ওর থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দেবো আমি। এতোটাই দূরত্ব সৃষ্টি হবে তোদের মাঝে যেন দুঃখের ছিটেফোঁটাও তোকে স্পর্শ করতে না পারে। আর আমি সেটাই করেছি!”

তরী দীর্ঘশ্বাস ফেললো অর্ণবের কথায়। অর্থী হা করে তাকিয়ে আছে অর্ণবের দিকে। এই ছেলে তরীকে এতোটা ভালোবাসে ও বুঝতেও পারেনি কখনো। একতরফা ভালোবাসার তীব্রতা হয়তো বরাবরই বেশি হয়!
“তোমরা এখন আমাকে একটু একা ছড়ে দাও। আজকের দিনটা অন্তত আমাকে কেউ ডিস্টার্ব কোরো না।”
তরী কথাটা বলে একমুহূর্তও দাড়ালো না। বারান্দায় দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। সবাই কথা বলার আর কোনো সুযোগ না পেয়ে নিজেরাও চলে গেল। অর্থী কিছুক্ষণ হাসফাস করলো তরীর সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু ব্যর্থ মনে ফিরে এলো সেও।

আকাশে আজ বেশ বড়সড় চাঁদ দেখা যাচ্ছে। বারান্দার রকিং চেয়ারটায় বসে সেদিকেই তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্য। প্রহর ওর পাশে দাঁড়িয়েই সিগারেটে একের পর এক টান দিচ্ছে। এতোক্ষণে সৌহার্দ্যের বলা কাহিনী শুনে বেশ গভীর ভবে ভাবছে সে।

“তরী এভাবে তোকে বলেছে? অবাক হচ্ছি আমি!”
প্রহরের কথায় সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“অন্তত প্রণয়-প্রণয়ীর কথা একবারও কি ভাবে না ও?”
প্রহর ফিচেল হাসি দিয়ে বললো, “সন্তানের দোহাই দিচ্ছিস? একদিন তরীর ভালোবাসাকেও সন্তানের দোহাই বলে ফিরিয়ে দিয়েছিলি, মনে আছে?”
সৌহার্দ্য চোখ মুখ শক্ত করে বললো,

“ভালেবাসার কাছে ভালেবাসার চেয়ে বড় দোহাই আর কিছু নেই।”
“তাহলে তোর ঐ ভালোবাসার টানেই ফিরে আসবে তরী। নিশ্চিন্ত থাক!”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “তাহলে এখন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবো আমি?”
“তোর ইচ্ছে! চাইলে হাত-পা মেলেও বসে থাকতে পারিস।”
সৌহার্দ্য বিরক্ত হলো। বিরস কন্ঠে বললো,

“মজা করিস না তো! আমাকে এটা বল যে, এতো বছর অর্থী তরীর ব্যাপারে সবটা জানতো! তবুও আমাদের কিছু জানায়নি কেন?”
“তরীর মা মিসেস মোহনা সব ঝামেলার কেন্দ্রবিন্দু। ওসব ছাড়! আমি এখন ঘুমাবো। কাল সকালে এমনিতেই ঢাকার বাইরে যেতে হবে।”
সৌহার্দ্য সন্দিগ্ধ চোখে তাকালো। বললো,

“দুই দিন পর পর শহরের বাইরে কী কাজ তোর? ঢাকার ভেতরে কাজকর্ম রাখলেই তো পারিস!”
প্রহর মলিন হাসলো। বললো,
“ব্যস্ততা বাড়লেই ভালো লাগে আমার। কাজের চাপে মনের অশান্তি একটু হলেও তো কমে!”
সৌহার্দ্য হতাশার নিঃশ্বাস ফেললো। প্রহরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কিছুটা স্বস্তি পেল মনে। ছেলেটা এতো বছর পর একটু স্বাভাবিক আচরণ করলো ওর সাথে। মধুর অনুপস্থিতি তো ওকে পাথরে পরিণত করেছিল!

মাঝরাতে কাউকে কিছু না জানিয়ে তরী গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। শহরের শেষ প্রান্তের একটা গ্রামে থাকেন আজাদের স্ত্রী। আপাতত তার সাথেই দেখা করতে যাবে সে। ভবিষ্যতে আবার কবে দেখা হবে জানা নেই।
ভোরের আলো ফুঠতে শুরু করেছে, এমন সময় সেই গ্রামে পৌঁছালো তরী। রাস্তায় হাঁটছিল কয়েকজন লোক। তাদের থেকে ঠিকানা জেনে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেল সে। একটা ছোট কুঠুরির মতো বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো। দরজার সামনে গিয়ে কড়া নাড়তেই বেশ সময় পর দরজা খুললো এক বৃদ্ধা। তরীর দিকে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বললো,

“তুমি কে গো? কাকে চাও?”
তরীর চোখ ছলছল করছে। সে ভাঙা কন্ঠে বললো,
“আমাকে চিনতে পারোনি, চাচী?”
তিনি চোখ ছোট ছোট করে ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করলো। হয়তো চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে। তাই বললো,
“কে তুমি? এমন বিদেশীদের মতো দেখতে কাউকে তো আমি চিনি না!”
“আমি তরী। সেই তরী, যার জন্য আজাদ চাচা অকালে প্রাণ হারিয়েছিল।”

আজাদ চাচার স্ত্রী আবেগান্বিত চোখে তাকিয়ে রইলো তরীর দিকে। তরীর সারা মুখে হাত বুলিয়ে দিলো। বললো,
“তরী? তুই এতোবছর পর? আমাকে এতো বছরে মনে পড়লো তোর!”
“যোগাযোগ করেছিলাম তো একবার! তারপর থেকে তো তুমি আমার ফোনই ধরোনি আর! তোমার নাম্বার অফ বলছিল বারবার।”

“আমার ফোনটা নষ্ট হয়ে গেছিলো রে! পরে আর কেনার সুযোগ হয়নি। তুইও তো শুধু নিজে বাচ্চাদের খবর নিয়েছিলি আমার থেকে। সৌহার্দ্য আমাকে বলেছিল তোর বাচ্চা দু’টো নাকি মরে গেছে! আমি ভেবেছি, তুই এই খবর শুনে বেশ কষ্ট পেয়েঢ়িস। তাই আর যোগাযোগ করবি না আমার সাথে।”
তরী মলিন হাসলো। বলল,

“যোগাযোগ কেন বন্ধ করবো, চাচী? আমার জীবন থেকে তো সবই হারিয়ে গেছে! যা অবশিষ্ট আছে, তা তো আর হারিয়ে ফেলতে চাই না আমি। আজই কানাডা ফিরে যাবো আমি। ভাবলাম, তোমার সাথে একবার দেখা করে যাই।”
বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে তরী বিদায় নিলো। এখন সে হোটেলে যাবে। আর আজ সন্ধ্যার ফ্লাইটেই সে চলে যাবে এদেশ ছেড়ে।

দুপুরের দিকে হোটেলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তরী৷ মোড় ঘুরাতেই সামনে কারো উপস্থিত দেখে চোখ খিঁচে সজোরে ব্রেক কষলো সে। গাড়ি থামানোর কিছু মুহুর্ত পর চোখ মেলে তাকালো সে। তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে বের হয়ে দেখলো, প্রণয় ওর গাড়ির সামনে বসে আছে। ওর হাঁটু থেকে অনবরত রক্ত ঝরছে।
তরীর বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। সে এগিয়ে গিয়ে প্রণয়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বললো,

“আজকে আবারও আমার গাড়ির সামনে পড়ে গেছ তুমি? কতটুকু ছিঁলে গেছে দেখেছো?”
প্রণয় রাগী দৃষ্টিতে তরীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমার দোষ! তুমিই বারবার আমাকে নিজের গাড়ি দিয়ে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করো।”
প্রণয়ের কথা শুনে তরী হা করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। হঠাৎই সৌহার্দ্য আর প্রণয়ী ছুটে এলো প্রণয়ের কাছে। প্রণয়ের কাছে বসে সৌহার্দ্য ওর হাঁটুর ক্ষত পরখ করতে করতে বললো,

“তোমাকে বলেছিলাম না, রাস্তায় না বের হতে? গাড়িতে থেকে নামতে নিষেধ করেছিলাম। বারবার অবাধ্য হও কেন তুমি আমার? এখন দে…….”
তরীর দিকে চোখ পড়ার সাথে সাথে সৌহার্দ্যের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। তরী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্য আর প্রণয়-প্রণয়ীর দিকে। এই বাচ্চা দু’টোর সাথে সৌহার্দ্যের কি সম্পর্ক?

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫৭

[আজকেই শেষ পর্ব দিতে চেয়েও পারলাম না। কাল দেওয়ার চেষ্টা করবো।]

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা শেষ পর্ব 

5 COMMENTS

  1. Ei golpo tar next part kabe asbe. Eto deri korle kivabe have? Sabai apparently prati interest hariye felbe.

  2. যে কথা রাখতে পারবেন না সে কথা বলতে যান কেন? কেউ কি আপনার কাছে জানতে চেয়েছিল শেষ পর্ব কবে দিবেন? এক গল্প কেউ ধৈর্য্য নিয়ে এতো দিন পড়ে না। শুধু ভালো লেগেছে বলে পড়েছি। আর এতেই আপনার এতো দাম বেড়ে গেছে।

  3. Please next part din
    Golpota kintu darun
    Asole sob gulo golpoi amar khub valo legeche porte

Comments are closed.