সংকটময় প্রেম গল্পের লিংক || সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

সংকটময় প্রেম পর্ব ১
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

“তোমরা আমায় যত বার বিয়ের পিরিতে বসাবে, ততবার আমি পালিয়ে যাবো।”
বউয়ের সাজে বসে আছি আমি। এইটা নতুন কিছু নয়, এই নিয়ে গুনে গুনে তেরো বার এই বউ সাজ। গায়ে লালটুকটুকে লেহেঙ্গা তার সাথে ভাড়ি ভাড়ি গহনা। আমার অমতেই বিয়ের পিরিতে বসতে বাধ্য করছেন বাবা-মা বার বার। কিন্তু আমি-ও কম কিসে? ছোট একটি চিরকুট বের করে ঘটাঘট লিখে ফেললাম কথাটুকু।

মুখের চুইংগামের সাহায্যে চিরকুট চিপকে দিলাম আয়নায়। এর পরেই আমার বড় আলমারিটা খুলে এটেসেটে কেবিনেটে ঢুকে বসে পড়লাম ঘাপটি মেরে। সাথে আছে পপকন আর সেভেন আপ। আজকের মেলোড্রামা নিজের চোখে দেখবো, প্রতিবার পালিয়ে যাই বাসা থেকে যার জন্য পরিবারের রিয়েকশন কেমন হয়, দেখতে পারি না। তাই এবার প্ল্যান চেঞ্জ সবাই বাহিরে খুঁজবে ঘরে তো আর খুঁজবে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাই এইবার লুকাবোই নিজের বাড়িতে, এবং স্ব চোখে দেখবো স্টার জলসার সিরিয়ালের মতো ঘর, সংসারের টান টান উত্তেজনা।ভাবতেই খুশি খুশি লাগছে। আমি আরাম করে বসলাম। আলমিরার কি-হোলটা আজ বড় করে কানা করে নিয়েছি। একদম পার্ফেক্ট দেখাচ্ছে এখান থেকে। আমি হাতের ঘড়ি দেখলাম রাত আটটা। বাহিরে চলছে বর এসেছে বর এসেছে চিৎকার। আমি সচেতন চোখে উৎপেতে রইলাম। কিছুক্ষণের মাঝেই আমার চাচাতো বোন আরু হেলতে দুলতে এসে ঢুকলো। ঘরে না পেয়ে ওয়াশরুম চেক করলো। ফট করেই আতঙ্ক মুখ সাদা হয়ে গেছে যেন ভুত দেখেছে।এক দৌড়ে চলে গেলো চেঁচাতে চেঁচাতে,

“চাচী, চাচাজান, কুহুপু আবার পালিয়েছে।”
কিছু সেকেন্ডের মাথায় আমার মাকে নিয়ে ছুটে এলো । ঘরময় চোখ বোলাতেই চোখে পড়লো আয়নায় চিপকে থাকা চিরকুটের দিকে। চিরকুট হাতে নিয়েই এক চিৎকার করলেন” ও আল্লাহ গো… কুহু আবার ভাইগা গেলো। ও কুহুর বাপ, তুমি কই!”

বলতে বলতেই সেখানেই ফিট খেলেন। আমি মাকে হুট করে পড়ে যেতে দেখে খানিক ভয় পেলাম। লাফ দিয়ে নেমে যাবো তার আগেই বাবার আগমন। ভয়ে আবার গুটিয়ে নিলাম নিজেকে। এখন বের হলে নির্ঘাত মৃত্যু।গুনে গুনে চার পাঁচটা থাপ্পড় পড়বে ঠাস ঠাস গালে, আবার বাবা টেনেটুনে নিয়ে বিয়ের পিরিতে বসিয়ে দিবেন নিশ্চয়ই। আমি ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। এবং পপকন চিবাতে লাগলাম ঘনঘন। ঘন্টা খানেক আমাকে খোঁজাখুঁজি করার পর সকলেই হতাশ, নিরাশ হয়ে বসে পড়লেন আমার ঘরেই।

মা কাঁদছেন। আমার কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু তারাতো আর আমার কষ্ট বোঝেন নি। আমি কেঁদেছে,পা ছড়িয়ে কেঁদে কুটে নাকের পানি-চোখের পানি এক করেছি, কিন্তু তাদের মায়া হয়নি। তাহলে আমি কেন করবো মায়া। ভাবতে ভাবতে চোখ ভর্তি করে পানি চলে এলো। আমি চোখের পানি মুছে ফেললাম। এদিকে বাবা মাকে হতাশার সুরে বলল, ” কুহুকে কোথাও পেলাম না। বরযাত্রী এবারো বউ ছাড়া বিদায় হলো। সম্মানটা এবার একে বারে মাটির সাথে মিলে গেলো।”

মা ফুপিয়ে উঠলেন। আঁচলে মুখ ঢেকে বললেন, “আগেই বলেছিলাম জোরজবরদস্তি করো না মেয়েটার সাথে। বিদেশে থেকেছে এতকাল, কিছুদিন হলো এলো। আর তুমি কি শুরু করলে? ”
বাবা পাশেই বসে পড়লেন মাথা হেট করে। হয়তো তিনিও বড্ড ভেঙ্গে পড়েছেন। মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
“তুমি কি জানো কেন আমি ওকে বিয়ে দিয়ার জন্য তাড়াতাড়ি করছি?”

দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো দু’জনের।একে একে সবাই সান্তনার বানী দিতে লাগলো। কেউ কেউ আবার কটুকথাও শোনালো। আমার বড় চাচী বলে উঠলেন মুখ বাকিয়ে, ” আগেই বলছিলাম, মেয়েকে এত পড়িয়ে লাভ নাই, বিয়া দিয়া দাও। তোমরাই শোনলা না। এবার দেখো, গুনে গুনে তেরোবার মুখে চুনকালি লাগিয়ে দিলো। এলাকায় মুখ দেখাবার জো নাই।”
বড় চাচির কথায় আমার রাগে গা রি রি করে উঠলো। এখান থেকে বের হয়েই আঙ্গুল তুলে দেখাতে ইচ্ছে করলো আমার, দেখুন চাচি নিজের মেয়ে তো এক বুইড়া বেটার সাথে পালিয়ে গেছে, আর আসছেন আমাকে কথা শোনাতে? আর যাই হোক আমি কোনো বুইড়া বেটার গলায় ঝুলি নাই।

কিন্তু মুখে কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। আমি হাই তুললাম। তন্দ্রা চলে এসেছে। এসব ড্রামা দেখতে দেখতে কখন যে চোখ বুঝে গেলো বুঝলামি না। ফট করে হাতের পপকর্নের বাটি টা ছিটকে পড়ে গেলো ঘুমের তালে হাত থেকে, এবং গড়িয়ে পড়লো ঠিক মায়ের পায়ের কাছে। সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেলো ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। মা এক ধমক দিতেই তন্দ্রা ছুটে গেলো। আলমারির দাড় হাট করে খোলা দেখে আকাশ থেকে পড়লাম।

মা বাবা সহ সকলেই টেরা চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি বিপাকে পড়ে গেলাম আমতা আমতা করে বললাম, ” হাই আম্মা, হাই আব্বা”
কেউ কোনো উত্তর দিলো না। হয়তো শকড খেয়ে গেছেন। আমি কি করবো এই মুহূর্তে বুঝতে পারলাম না। ক্যাবলা কান্তের মতো হেসে ফেললাম। আলমারি থেকে নামতে নামতে আহ্লাদু সুরে মিন মিন করে বললাম, ” আম্মু আমি শুধু লুকোচুরি খেলছিলাম। কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম…”

কথাটুকু শেষ হবার পূর্বে দাবাংমার্কা চর পড়ল আমার গালে। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। মা তখন ক্ষিপ্ত কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বললেন,” তোর কাজ কর্মে আমাদের নাক কাটা যাচ্ছে আর তুই লুকোচুরি খেলছিস? এত বড় দামড়ি মেয়ে বিয়েকে খেলা ভাবছে?”

মা হাঁপাচ্ছেন। বাবা পাশেই মাকে সামলাচ্ছেন,তীক্ষ্ণ নজরে আমাকে বার বার কে*টে নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছেন। আমি গালে হাত দিয়ে মাথা নত করেই রইলাম। চোখ জোড়া আমার ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। আমার দিকটা কেন তারা বুঝতে পারছেন না? আমি পড়াশোনা শেষ করতে চাই, সুন্দর ভুবনের আনচে কানাচে ঘুরে বেড়াতে চাই। আমার অজানা সেই পছন্দের মানুষটিকে কাছে পেতে চাই, তাকেই অর্ধাঙ্গ করতে চাই। অথচ তারা আমার পায়ে বিয়ে নামক বেড়া জালে আটকে দিতে চায়ছে! আমি কান্নার দমকা কমাতেই শুকনো ঢুক গিললাম। বললাম, ” মা আমি বিয়ে করবো না। তোমরা যত যাই করো, বিয়ে করা আমার জন্য অসম্ভব। ”

মা এবার ধপ করে বসে পড়লেন মাটিতে। বিয়ে বাড়ির হৈ-হুল্লোড় পরিবেশ পরিনতি হয়েছে শোকময়। হয়তো আমার কথায় কষ্ট বেশি পেয়েছেন তারা, বাবা এবার ঠান্ডা স্বরে শুধালেন, ” যতটুকু সম্মান ছিলো তুমি আমার সব টুকু সম্মান আজ শেষ করে দিলে, এই জন্যই বুঝি এত দিন তোমাকে লালন পালন করেছি, বিদেশ পাঠিয়েছি? ”
আমি উত্তর দিলাম না। মা তখন বলে উঠলেন, ” তোমাকে আর এখানেই রাখবো না, নানা বাড়ি পাঠিয়ে দিবো।”
মায়ের কথায় আমি আর বাবা দু’জনেই চমকে উঠি, একসাথে বলি, ” কি….!”

” আমার বাপের বাড়ি পাঠাবো এবার মেয়েকে, সেখান থেকেই বিয়ে দিবো ওর।”
বাবা চেচালেন, ” মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? তুমি চাও আমার মেয়েকে ওই ডাকা*তদের বাড়ি পাঠাই।”
মা চোখ রাঙ্গালেন বাবার দিকে, ” ভুলে যেও না যাকে ডাকা*ত বলছো, তার মেয়েকেই পালিয়ে এনে বিয়ে করেছে।”
বাবা চুপ করে গেলেন। কপালে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম। মা নিজের শেষ ডিসিশন জানিয়ে দিলেন। আমি নিজেও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমার নানা আনোয়ার চৌধুরীকে ময়মনসিংহ এলাকায় এক নামে চিনেন। খুব বড় রাজনৈতিক পরিবার।

আমার নানার দাদার দাদা আমল থেকেই চলে আসছে রাজনীতি। রাজা জমিদারদের বংশধর তারা। তাদের পূর্বপুরুষেরা শাসন করে গেছে ময়মনসিংহ সহ আরো কিছু অঞ্চল। অনেকই তাদের অত্যচারি রাজা, জমিদার ও বলতেন। ময়মনসিংহ শহরে তার হুকুমেই নাকি চলতো সব। কথা খেলাপি হলে শোনা যেত বন্দুকের শব্দ। তখন তারা দিনে রাতে মানুষ খু*ন করে ফেলতেও পিছপা হতো না।। ভয়ে থাকতো তখন নিরীহ মানুষ গুলো। তবে নানার দাদা মরহুম হলেও এখনো নাম ডাক ভয়ংকর রকমের।

নানা বাড়ির কথা মাথায় আসতেই চট করেই আমার মাথায় যা আসে তা হলো আমাদের ইউসুফ ভাই। এই লোকের মতো খাটাশ জগতে একটাও নেই। শুনেছি এখন উনি ময়মসিংহ শহরের বড় নেতা হয়েছেন। বড় হওয়ার পর আর নানা বাড়ি পা পড়েনি আমার। শেষ দেখেছিলাম তারে তখন তিনি এইচএসসির প্রথম বর্ষে পড়তেন। এখন কেমন দেখতে কে জানে। তবে মার মুখে তার ভয়ানক ভয়ানক কর্মকান্ডের কাহিনী শুনেছি। তার পরিবারের লোক তাকে জালিম বলে থাকে।

পূর্ব পুরুষের রক্ত যেন টগবগিয়ে জেগে উঠেছে এই লোকটির শরীরে। ওই লোকটাকেই ছোট থেকেই ঘৃণা করি আমি। যখন তখন নাকে ডগার উপর ঝুলতে থাকে রাগ। হঠাৎ হঠাৎ রক্তিম চক্ষু দিয়ে ঘায়েল করে ফেলে দেহের আনাচ কানাচ। মায়ের সাথে ছোট বেলায় যাওয়া হয়েছে বার কয়েক। এই বদমেজাজী লোকের কাছে কতটাই না হেনস্তা হতে হয়েছে। এখনো মনে আছে কুহুর, তার তখন সাত বছর। ভুল করেই ইউসুফের গায়ে কুলির পানি ফেলে দিয়েছিলো। আর ইউসুফ ওকে গাছের উপর উল্টো লটকে দিয়ে ছিলো। ভেবেই গলা শুকিয়ে কাঠ। আমি মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়লাম,” আমি যাবো না মা। ”

মা আমাকে ধাক্কিয়ে সরিয়ে দিলেন। হুমকি সাথে বলে গেলেন, “ব্যাগ গোছা আমরা আজকেই বের হবো।”
আমি চিৎকার করে উঠলাম, ” আমি যাবো না, যাবো না, ব্যস যাবো না।”
কিন্তু মা শুনলেন না। সোজা বের হয়ে দরজা বাহির থেকে লাগিয়ে দিলেন। আমি বিস্ময়ে বুঁদ কি হতে চলেছে আমার লাইফে… ইউসুফ ভাই নামক তোপ.. এবার না আমাকে উঁড়িয়ে দেয়।

আমি শুকনো ঢুক গিললাম। কিছু ঘন্টা পর ঢাকা থেকে জ্যাম ঠেলে পদার্পন হলো ময়মনসিংহ। ঢোল ঢক্কর বাজিয়ে আমন্ত্রণ জানালেন আনোয়ার চৌধুরী। আনোয়ার চৌধুরীর বিরাট বাড়িতে পা পড়তেই…হা হয়ে গেলাম…থমকে গেলো আমার পৃথিবী… হঠাৎ করেই….

সংকটময় প্রেম পর্ব ২