সংকটময় প্রেম পর্ব ২

সংকটময় প্রেম পর্ব ২
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

আনোয়ার চৌধুরীর বৃষ্টি বিলাস বিরাট বাড়িতে পা পড়তেই…হা হয়ে গেলাম…থমকে গেলো আমার পৃথিবী… হঠাৎ করেই….চোখ পড়লো বিড়াট ফুল বাগানের পাশটার সমাবেশে। গোল করে বসে আছে একটা দল,তাদের সবার গায়ে সাদা পাঞ্জাবি,যেন এক দল সাদা কবুতর। তাদের মধ্যবিন্দু হয়ে বসে আছেন এক যুবক। পিঙ্গল চুল। চমৎকার আর্কষনীয় সুডৌল চওড়া বুক। লম্বা সুঠাম দেহের শক্ত পোক্ত শরীর।

এত বড় দলটার মাঝের মধ্যে বিন্দু বসে থাকার যুবকের লম্বাটে মুখে, শক্ত ঘন দাড়ি ভর্তি চোয়ালে ফুটে উঠছো দাম্ভিকতা।যা আলাদা দাপুটে, প্রভাবশালী প্রকাশিত হচ্ছে। গুরু গম্ভীর মুখ করে বসে শুনছেন সবার কথা. যেন কোনো রাজা তার রাজ্যের বৈঠকে বসে শলাপরামর্শ করছেন। এক একজন যো হুকুম যো হুকুম করে জয়গান করছে.. আমি হা হয়ে গিলছি, ভিতর থেকে একটা কথাই কেউ বলছে… “এই যুবক কি আদো মানুষ? নাহ্… নাহ্… এই নিকৃষ্ট পৃথিবীর বুকে এমন সৌম্য সৌন্দর্য কোনো মানুষের হতে পারে না।। তাহলে কে সে? কোনো জ্বিনী পুত্র????

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমি শুকনো ঢোক গিললাম। হঠাৎ করেই যুবকের চোখ পড়লো আমার উপর। আমার শ্বাস আটকে গেলো। দম নিতেই ভুলে গেলাম। এক জোড়া বিলাই চোখের তীক্ষ্ণ নজর আমার উপর পড়তেই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হয়ে গেলো। এই নজরে আমাকে ভিতর থেকে যেন ক্ষুন্ন করার ক্ষমতা রাখে। আমি ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। চোখ জোড়া তখনো আমার উপর। আমি মায়ের পিছনে লুকিয়ে পড়লাম ফট করে।

এমন ভয়ংকর সুন্দর যুবকের নজরে কি যেন আছে, যা আমার দেহকে কাঁপিয়ে তুলেছে। মস্তিষ্কে তখন ঘন্টা বেজে উঠলো, এই ব্যক্তিই সেই আত্মঘাতী লোক। যার ভয়ে আমি নানা বাড়ি আসতাম না। এই সেই যুবক, যার জন্য আমার জীবনের নানা বাড়ির সুখ থেকে বঞ্চিত। উনি আর কেউ না ঝগড়াটে, পাগলাটে ইউসুফ ভাই।তিক্ত হয়ে উঠলো আমার মন। অজানা ব্যথা শুরু হলো বুকের মধ্য খানে। কেন এই যুবককে এত সুন্দর হতে হলো। আমার ব্যথিত মন আরো ক্রোদন করে উঠলো । আমি মায়ের হাত ধরলাম টেনে বললাম,

“মা আমি থাকবো না, আমি এখানে থাকবো না। বাবা প্লিজ বোঝাও না। তোমরা যা বলবে তাই হবে। আমি এখানে থাকবো না।”
মা সপাটে উত্তর দিলেন, ” তোমার জন্য এই জায়গায় সঠিক। এখান থেকে বিদায় করবো, এবার পালিয়ে দেখাও।”
আমি কাতর চোখে বাবার দিতে তাকালাম। আর যাই হোক, বাবা আমাকে সব সময় সাপোর্ট করেছেন। তাহলে কেন বিয়ের ব্যপারে এমন করছেন?আমি বুঝতে পারছি না, কেন বাবা উঠে পরে লেগেছেন বিয়ে করানোর জন্য আমাকে। কিন্তু বাবা আমার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন, আমার ভিতর টা এবার হু হু করে কেঁদে উঠলো, ” বাবা প্লিজ… আমাকে কেন তোমরা এভাবে টর্চার করছো?”

বাবা উত্তর দিবার পূর্বেই একটি কন্ঠ ভেসে এলো, ” কে আমার নাতনিকে টর্চার করছে?”
আমি পিছনে ফিরে তাকালাম। আমার নানাজান ওরফে আনোয়ার চৌধুরী হুইলচেয়ার বসে আছেন। তার পিছনে বাড়ির কেয়ারটেকার আনসার মিয়া, নানাজানের হুইলচেয়ার ঠেলে এদিকে আনছেন। নানা জানের মুখে হাসি। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ জোড়াও হাসছে। নানাজানের বয়স হলেও এখনো শক্ত পোক্ত উনি। তবে এক দূর্ঘটনায় উনার পা দু’টি অচল হয়ে গেছে। তবুও তার দাপট কমে নি। আমি নানাজানের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। বিচার দিবার সুরে বললাম,” নানাজান বাবা আমাকে বিয়ে দিবার জন্য উঠে পরে লেগেছে, আমি বিয়ে করবো না এখন, অথচ বাবা শুনছেন না।”

নানাজান অবাক হয়ে গেলেন যেন আমার কথায় কাঠিন্য কন্ঠে দেখলেন নিজের মেয়ের দিকে,” আমার নাতনিকে বিয়ে দিচ্ছো আর আমি জানি না? নিশ্চয়ই এই গাধাটা না করেছে আমাকে জানাতে?”
বাবা চমকে তাকালেন, মেয়ের সামনে শশুরের মুখে গাধা শুনে কিছু হকচকিয়ে গেছেন বোধহয়। মায়ের দিকে তাকিয়ে তেজী গলায় বললেন, ” কায়া, তোমাকে আমি আগেই বলেছিলাম, আসবো না আমি। দেখছো তো তোমার বাবা আমাকে কিভাবে অপমান করছে মেয়ের সামনে? শশুর বাড়ির খেদমত বুঝি এমন হয়?”

প্রতিবারই বাবা আর নানাজানের মাঝে অদৃশ্য লড়াই চলে, নানাজানের একমাত্র আদরের মেয়েকে পালিয়ে বিয়ে করার জন্য কারাবাস করাতে চেয়েছিলেন নানাজান বাবাকে। কিন্তু এক মাত্র মেয়ের কথা ভেবেই শান্ত হয়েছেন।
মা বাবাকে বোঝালো, ” একটু শান্ত হও। ” এর পর নানাজানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বাবা তোমাকে সব খুলে বলছি…”

কথাটুকু বলে বাড়ির ভিতরে চলে গেলাম আমরা। নানাজান হাঁক ছাড়লেন, ” মনোরমা ”
মনোরমা দ্রুত ছুটে এলেন, আমাদের দেখেই চওড়া করে হাসলেন, ” ছোট আপা…আফনেরা কেমন আছেন..কত দিন পর আইছুন। আপনোগা ছাড়া বাড়িডা কি খালি খালি লাগে গো আফা..? ”
বলতে বলতে মনোরমা চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেললেন। তা দেখেই নানাজান ধমকে উঠলেন,
” মনোরমা নাটক একদম বন্ধ করো। কুহুকে তার রুমে নিয়ে যাও।”

মনোরমা আরো নতজানু হয়ে গেলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে ভয়ে তার প্রাণ পাখি একদম উড়েই গেছে। মনোরমা আত্মাকিত স্বরে বললো,” ছোট আফা, দাদাজান বহুত ভালা মানুষ তয়, মাঝে মাঝে জ্বিনে আছর করে।”
আমি চমকে তাকালাম মনোরমার দিকে, মনোরমা হতাশ কন্ঠে গড়গড় করতে লাগলেন, ” আমার মায়ে কাছে হুনছি, ছোডো ভাই যখন জনম হয়, ঘর নাকি বড়ই আলোকিত হইছিলো। দাই মা বলছিলো, ‘ জ্বিনের বাদশার পোলা, ফকফকা রং।বড়ই সৌইন্দর্য।’ আমি বিম্ময়ে বুঁদ হয়ে চাইলাম মনোরমার দিকে। উনি বুদ্ধিজীবিদের মতো বলল, ‘এই জন্যই তো দেহেন না ছোডা ভাই মেলা সুন্দর তার চোক্ষু বিলাই চোক্ষু। ‘ আমি এবার মনোরমার কথায় হকচকিয়ে গেলাম। গভীর ভাবনায় পড়ে গেলাম। ভয়ংকর রকমের চিন্তার ভাজ পড়লো মাথায়। তাহলে কি সত্যিই সে জ্বিনী পুত্র???

গভীর চিন্তা নিয়ে মনোরমার দেখানো বিশাল রুমটার বিশাল বেলকনিতে দাঁড়ালাম। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার সমাবেশ। আমি গভীর নয়নে তাকিয়ে পর্যবেক্ষন করতে লাগলাম ইউসুফ ভাই ওরফে জ্বিনী পুত্রকে। উনি হাত উঁচু কাউকে কাছে ডাকলেন। লোকটি কাছে আসতেই দাম্ভিকপূর্ণ মুখে ছেয়ে গেলো কাঠিন্য, কঠোর কিছু শব্দবান শোনালো মনে হলো। দূর থেকে কোনো রা, শব্দ বোঝা গেলো না। হঠাৎ করেই ইউসুফ ভাইয়ার পেশীবহুল শক্ত হাত উঠি ঠাস করে থাপ্পড় বসালো। থাপ্পরের জোর এতোই ছিলো, যে আমি দোতালা থেকে শুনতে পেলাম।

থাপ্পরের শব্দে হালকা কেঁপে উঠলো আমার বুক। বাবা গো বাবা। লোকটি এক থাপ্পরেই যেন মাঠের বাহিরে। আমি স্পষ্ট দেকতে পাচ্ছি, ইউসুফ ভাইয়ের লাল লাল চোখ মুখ। হাতে রগ ফুলে গেছে। আমার বুক ধড়াম ধড়াম করে শব্দ করছে। আমি মুখে হাত দিয়ে দেখছি এই অদ্ভুত কান্ড। তার এই হাতের থাপ্পড় যদি আমার গালে পরে নিঘার্ত মৃত্যু। আমি শুকনো ঢুক গিলাম। তখনি ইউসুফ ভাই পিছনে ফিরলেন। তার সাথে চোখাচোখি হবার আগেই টুস করে নিচে বসে পড়লাম। হৃদপিণ্ড ৮০ গুন স্পীড ধরেছে এবার।

আমি আবারো উঁকি দিলাম, উনি দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। সমাবেশ ভেঙ্গেছে। একে একে সকলেই উনার সাথে হাত মিলে চলে যাচ্ছেন। কি অদ্ভুত কিছুক্ষণ আগের কাঠিন্য চেহারায় নেমে এসেছে শীতলতা। ঠোঁটের কোনে আলতো মুচকি হাসি। উনি হাসেন কম উনার হাসির দাম যেন অনেক। উনি হাসলে যেন মুক্ত ছড়ায়। তার বাঁকা টোল পড়া হাসির মায়া পড়েছিলাম। এবং নামহীন চিরকুট লিখে বইয়ের পাতায় রেখে ছিলাম।

কিন্তু এই খাটাশ বেটা ঠিকি ধরে ফেলে। এবং আমার প্রিয় ডায়েরি কেড়ে নেয়, তার সাথে সাথে লম্বা চুলের এক গাছি কেটে নেয়। সেদিন কি কান্না আমার। হু হু করে কেঁদেছি। ওর জন্য বুইড়া বয়সে আদিল হতে হয়েছিলো। আমি আহ্ করে শ্বাস ছাড়লাম। আবার উঁকি দিতেই উনার চোখে চোখ পড়ে গেলো। আমি ধাম করে নিচে বসতেই কোমড়ে ব্যথা পেলাম। মুখ দিয়ে মৃদু চিৎকার বেড়িয়ে গেলো।

সংকটময় প্রেম পর্ব ১

মুখ চেপে ধরে এক চোখে উপরে তাকাতেই দেখলাম উনি এদিকেই তাকিয়ে আছেন ভ্রু-কুচকে। উনার বিলাই চোখ জোড়া দিয়ে দেখছেন। হয়তো কিছু আঁচ করতে পেরেছেন। আমি কিছুক্ষণ সময় নিলাম। এর পর আলতো পায়ে উঠে উঁকি দিতেই, ও মা নেই.. কেউ নেই.. এখানের এত লোক কিছুক্ষণেই গায়েব। সাদা কবুতরের মতো জায়গাটা এখন সবুজে ঘেরা। আমি স্বস্তির শ্বাস ছাড়লাম। ঠিক তখনি পিছন থেকে একটি ঝংকার তোলা কন্ঠ ভেসে আসতেই আত্মকে উঠলাম পিছনে ফিরতেই আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো…..

সংকটময় প্রেম পর্ব ৩