সংকটময় প্রেম পর্ব ৩

সংকটময় প্রেম পর্ব ৩
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

ঠিক তখনি পিছন থেকে একটি ঝংকার তোলা কন্ঠ ভেসে আসতেই আঁতকে উঠলাম পিছনে ফিরতেই আমার অন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো…..
” লুকোচুরি খেলছিস আমার সাথে? এক চ*র মেরে তোর যে কয়টা দাঁত উঠেছে না সব ফেলে দেবো। ফাজিল। ”
ইউসুফ ভাইয়ের তীক্ষ্ণ ঝাল, কাটাযুক্ত কথাবানের সাথে সাথে আমার গালে হাত চলে গেছে। কিছুক্ষণ আগের লোকটিকে এক থাপ্প’রে মাঠের বাহিরে পাঠিয়েছেন। আমাকে মারলে নির্ঘাত মৃত্যু? আমি শুকনো ঢুক গিললাম। উনার রক্তিম চোখদ্বয়ের দিক তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললাম, ” ক..কই না.. নাহ্ তো? আমি লুকোচুরি কেন খেলবো তাও আবার আপনার মতো লোকের সাথে?”

ইউসুফ ভাইয়ের আমার কথায় তেমন পাত্তা দিলেন না। উল্টো হাত ভাজ করলেন আড়াআড়ি, ঠান্ডা গলায় বললেন” কি বুঝাইতে চাইছিস?আমার মতো লোক মানে টা কি?”
আমি টুস করে শুকনো ঢুক গিলে ফেললাম।ভয়াবহ অবস্থা। ভেবেই ফেললাম এই মাত্রাতিক৷৷সৌম্য লোকের সামনে পরবো না আর, এই লোকের বিলাই চোখ বড্ড ঘাতক। এতটাই যে চোখ দিয়েই টুপ করে গিলে ফেলবে, ঢেকুর পর্যন্ত তুলবে না। কঁপালের উপরে পরে থাকা ছোট চুল গুলো, তার সৌন্দয্য তিন গুন বৃদ্ধি করছে। আমি মনে মনে ওয়াদা করে ফেললাম, এই লোকের ছায়াতলে আর এক মুহুর্ত ও না। দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বললাম, ” দেখুন আপনার ভুল হচ্ছে. আমি তা বলতে চাইনি, আসলে..”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে পারলাম না। উনার নেশালো বিলাই চোখে হারিয়ে যেতে লাগলাম। লোকটি কেমন করে যেন তাকালো। সারা শরীর শিরশির করে উঠলো। কি যে ছিলো সেই তাকানোয়। একে বারে থমকে দিলো, বন্ধ করে দিলো কথা। উনার সফেদ বদনে সাদা পাঞ্জাবি, দীর্ঘকায় দেহে লেপ্টে আছে শিরদ্বয় উঁচু করে আছে উনার চোখের নিচের লাল তিলটা । উনি ভ্রু-কুঁচকে বললেন, “তাহলে কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরপুরুষ দেখা হচ্ছিলো তোর? এতটাই দুর্বল তোর চরিত্র ছিঃ?”

আমি বিষ্ময়ে বুঁদ। তীক্ষ্ণ ধারালো ফলার মতো বাক্য বান আমার ভিতরটা ঝাকড়া করে দিলো। চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। আঙ্গুল তুলে কোনো রকম বললাম,” আপনি বড্ড খারাপ লোক”
বলেই বেড়িয়ে গেলাম দৌড়ে ঘর থেকে। তীক্ষ্ণ বিলাই চোখ জোড়া ইউসুফ ভাই সটান ভাবলেশহীন ভাবে দাড়িয়ে রইলেন। বেটা খাটাশ, একবার সরি পর্যন্ত বললো না। অভিমান চেপে বসলো ঘাপটি মেরে, যে বাড়ির ছেলের ব্যবহার এত খারাপ, সেখানে এক পলক থাকা দায়।

আমি এক দৌড়ে নানাভাইয়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। নক করবো তার আগেই দার খুলে গেলো। গম্ভীর মুখে বের হলেন নানাজান। চিন্তিত মুখ বাবা আর মায়ের। আমি তাদের দুশ্চিন্তার কারণ ধরতে পারলাম না। দেশে ফিরতেই কেন তাদের ভুত চাপলো মাথায় আমাকে বিয়ে দিবার? কেনোই বা চাইছেন তাদের থেকে দূরে চলে যাই, কেনোই বা চাইছেন আমি এইখানেই থাকি। এগিয়ে যেয়ে কিছু বলবো বা জিজ্ঞেস করবো তার আগেই পিছন থেকে হাসি মুখে আমাকে অতিক্রম করে এগিয়ে গেলেন ইউসুফ ভাই। হাস্যজ্জল মুখে সালাম জানালেন,

“আসসালামু আলাইকুম ফুফাজান।”
বাবার মুখেও চওড়া হাসি, দু’হাত মেলে আগলে নিলেন ইউসুফ ভাইকে।বাবার খুব ইচ্ছে ছিলো, ইউসুফ ভাইয়ের মতো একটি ছেলে আল্লাহ তাকে দান করতো। উনি দোয়াও করতেন তবে আমার আগেই আমার একটি ভাই হয়, কিন্তু সে দুনিয়ার আলো দেখতে পারেনি। তাই বাবার মনে ছোট একটা আক্ষেপ রয়েই গেছে। তারপর থেকেই ইউসুফ ভাইকে নিজের ছেলের মতো দেখেন। বাবা ইউসুফ ভাইয়ের পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন,

“ওয়ালাইকুম আসসালাম ইয়াং ম্যান। কেমন চলছে দিন কাল?”
ইউসুফ ভাই বিশুদ্ধ কোমলপ্রাণ হাসলেন, টোল পড়ে গেলো সাথে সাথে গাড়ো করে। আমি হা হয়ে গেলাম। যতোই লোকটিকে দেখছি ততোই বিস্ময়বিমূঢ় হচ্ছি। ইউসুফ ভাই বুকে হাত দিয়ে বললেন,
” আলহামদুলিল্লাহ ফুফাজান।”

পাশেই মা-ও হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। ইউসুফ ভাইকে দেখে যেন মায়ের মুখের হাসিই ফুড়চ্ছে না। আমার হিংসা হতে লাগলো। আমার লুকাইত মনের কোনের ইউসুফ ভাইয়ের প্রতি হিংসা দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে লাগলো। মা কি সুন্দর পরম যত্নে ইউসুফ ভাইয়ের গালে হাত বুলিয়ে চুমু খেলেন,
প্রফুল্ল কন্ঠে বললেন, ” কেমন আছে আমার আব্বুটা? অনেক শুকিয়ে গেছো তুমি? নিশ্চয়ই ঠিক মতো খানাপিনা হচ্ছে না।”
প্রত্যুত্তর মুচকি হাসলো। যেন মুক্তা ঝরে পড়া হাসি। বলল,

” আল্লাহ যেমন রেখেছে ফুপিজান। তবে তুমি কিন্তু দিন দিন সুন্দরী হচ্ছো আরো?”
বলতেই মা লজ্জা পেয়ে ইউসুফের গাল টিপে দিলেন। বলল,
” দুষ্টু ছেলে। বড় হয়েছিস এখনো দুষ্টমি কমেনি তোর।”

ইউসুফ ভাই হাসলো শুধু। আজ যেন তার হাসির শেষ নেই। অথচ কিছুক্ষণ আগের ইউসুফ ভাই আর এখনের ইউসুফ ভাই,আকাশ-পাতাল ফারাক, দুটোই ভিন্ন মানুষ। হঠাৎ করেই টিউব লাইটের মতো মনোরমার বলা কথা জ্বলে উঠলো, ইউসুফ ভাই জ্বিনীপুত্র। তাই তার রূপ অনেক। আমি শুকনো ঢুক গিললাম, এই মুহূর্তে আমার বাবা-মা আর ইউসুফ ভাইকে দেখে মনে হচ্ছে মেলায় হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে খুঁজে পেয়েছে। আমার হিংসে হচ্ছে, মন চাইছে ইউসুফ ভাই নামক মানুষকে অদৃশ্য বন্দুক দিয়ে গু’লি করে খু’লি উড়িয়ে দিতাম। এতের আদিখ্যেতা আর সহ্য করতে না পেরে বড্ড আক্রোশ নিয়ে বললাম,” আমি এই বাড়িতে আর এক মিনিটও থাকবো না… নাহ্ আর এক মিনিট ও না।”

” তাহলে হেটে হেটে বাড়ি চলে যা।” চকিতে বললেন মা ঠাট্টা করে। আমি হতভম্ব। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার দ্রুত গাড়ি -বাসে তিন ঘন্টা। আর আমাকে হেটে যেতে বলছে? আমি বললাম, ” মা মজা করছো আমার সাথে? আমি মোটেও মজা করছি না। আমি থাকবো না এখানে। প্লিজ।”
নানা জান বললেন, ” নানু ভাই, কেউ তোকে কিছু বলেছে বল? আমি এখনি ঠাটিয়ে চর লাগাবো। দু বেলা খাবার বন্ধ, একবার বল।”

আমি কাঁদো কাঁদো মুখ করে নানাজানের দিকে তাকালাম। বলতে চাইলাম, ” আপনার প্রাণ প্রিয় নাতি… ইউসুফ? আসতে না আসতেই আমার উপর কলঙ্কের কালী লাগিয়ে দিতে চাইছে, আমি নাকি পরপুরুষ দেখি, আমার চরিত্র দুর্বল? এত বড় কথা? এত বড়। আমি যদি পাড়তাম ব্রহ্মপুত্র নদে ১০১ বার চুবাইতাম।” কিন্তু মুখে কাঠিন্য রেখে বললাম, ” নানা ভাই তোমার এলাকায় কুত্তা বিলাই বেশি, সারাক্ষণ শুধু ঘেউ ঘেউ করে, যা আমার একদম অপছন্দ। তাই থাকবো না আমি।”

বলেই তাকালাম ইউসুফ ভাইয়ের দিকে। ইউসুফ ভাই তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। হয়তো ক্ষেপে গেছেন। কথাটি তাকে বলেছি বুঝে ফেলেছেন। উনি নানা ভাইয়ের হুইলচেয়ারের পিছনে দাঁড়ালেন। গুরু গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ” কি করবে বেচারা কুত্তা, বিলাই আমাদের শহরে দুর্গন্ধ যুক্ত কোনো পেত্নী আগে দেখেনি। তাই এমন চিৎকার করছে, পেত্নীকে তাড়ানোর জন্য।”

আমি এবার হতবাক। বাবা-মা, নানাজান হাসছেন।ইউসুফ ভাইয়ের মুখেও বিশ্বজয়ী হাসি। ইউসুফ ভাই আবার আমাকে অপমান করলেন? আর এদিকে বাবা-মা হাসছে? রাগে আমার গা রি রি করে উঠছে। আমি বলেই ফেললাম, ” মা আমি এখানে আর এক মুহুর্ত ও থাকবো না।”

মা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করলেন, ” থাকতে তোমার এখানেই হবে। আর তোমার মনমানি মেনে নিচ্ছি না।”
আমি অসহায় ভাবে চাইলাম। কোনো লাভ হলো না। আমাকে সেখানে ফেলেই নানাজানের সাথে কি কি কথা বলে চলে গেলেন তারা। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম তাদের গাড়ি বড় রোড ধরে নাই হতে। আমার কান্না পাচ্ছে, হাউ মাউ করে পা ছড়িয়ে কান্না। কেমন নিষ্ঠুর আমার বাবা-মা, এভাবে অন্যের বাড়ি ফেলে চলে গেলো।

একটি বার পিছনে ফিরলো না। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না.. যেই বাবা-মা একটা দিন আমাকে চোখের আড়ালে রাখতো না.. তারা কিনা এত দূর আমাকে ফেলে চলে গেলো? ভেবেই কান্না গুলো কুন্ডলী পাকিয়ে জমা হলো কন্ঠনালিতে। বিষন্ন ভগ্নহৃদয় নিয়ে চোখ জোড়া মুছে নিলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। র্বিবর্ণ রং ঘিরে আছে চারপাশ। পাখিরা নীড়ে ফিরছে। আকাশের লালিমা আভা ঢেকে যাচ্ছে ঘন আঁধারিয়া অম্বরে।

সংকটময় প্রেম পর্ব ২

ঠিক তখনি পেটের ভিতর থেকে ভয়ংকর রকমের শব্দ করে উঠলো। পেটের ভিতরের খাদ্য পোকা গুলো যেন এবার আন্দোলন শুরু করেছে খাবার দে বলে। আমি দু’হাত চোখ মুছে নিলাম। রুম থেকে বেড়িয়েই করিডর ধরে হেটে হেটে যেতে লাগলাম রান্না ঘরের দিকে। ঠিক তখনি কারো শক্ত পোক্ত হাত টেনে নিয়ে গেলো একটি বন্ধ ঘরের মাঝে। শক্ত করে চেপে ধরলো দেয়ালের সাথে, চিৎকার করবো তার আগেই………

সংকটময় প্রেম পর্ব ৪