সংকটময় প্রেম পর্ব ৪

সংকটময় প্রেম পর্ব ৪
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

রুম থেকে বেড়িয়েই করিডর ধরে হেটে হেটে যেতে লাগলাম রান্না ঘরের দিকে। ঠিক তখনি কারো শক্ত পোক্ত হাত টেনে নিয়ে গেলো একটি বন্ধ ঘরের মাঝে। শক্ত করে চেপে ধরলো দেয়ালের সাথে, চিৎকার করবো তার আগেই মুখ চেপে ধরলেন ছায়ামানব, হিসহিসিয়ে বলে উঠলেন,

” আমাকে তোর কুত্তা মনে হয়?আমি কুকুরের মতো ঘেউঘেউ করি?আমি? হাউ ড্যায়ার ইউ?”
ইউসুফ ভাই ধমকে উঠলেন। আমি হতভম্ব। সামন্য কথাটুকুর জন্য খাটাশ লোকটি এভাবে টেনে আনলো, যেন আমি কোনো আসামি, লকআপ ভেঙে পালাচ্ছি। আমার আত্মা লাফাচ্ছে।এই বুঝি ১২০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে লাফিয়ে পড়বে এই বন্ধ ঘরের খোলা বেলকনি থেকে? সন্ধ্যার আলো আধাঁরি খিড়কী ভেদ করে ঢুকছে। রোডের নিয়ন বাতি জ্বলজ্বল করছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বাগানের ফুলের মিষ্টি সুগন্ধি নাকে বাড়ি খাচ্ছে। সেটুকো নিয়ন আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একজন সুঠাম, শক্ত পোক্ত দেহের অধিকারী, আমাকে চেপে ধরে আছে, ওর চুল উড়ছে, হঠাৎ খিড়কী ভেদ করে আসা মিষ্টি বাতাসে। আলো-আঁধারিতেও চোখে পড়ছে নাকের ঠিক পাশেই ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে থাকা লাল তিলটা। আমি এখন তাকিয়ে আছি হতভম্ব চোখে, ইউসুফ ভাইয়ের বিলাই চোখের তীক্ষ্ণ ধারালো নজর আমার দেহের এফোড় ওফোড় করে বেড়িয়ে যাচ্ছে যেন ক্ষনে ক্ষনে। আমি বাক্যহীন, ড্যাব ড্যাব চাহনিতে চেয়ে দেখছি তার উদ্ভট কান্ড।

ইউসুফ ভাইয়ের মন মাতানো মাতাল সুবাস ভুড়ভুড় করে ঘরময় ছেয়ে গেছে আনাচে-কানাচে। নিজ অজান্তেই হারিয়ে যাচ্ছিলাম, ইউসুফ ভাইময় পরিবেশে, তখন বাজখাঁই ধমকে উঠলেন, ” এক থাপ্পড় লাগাবো বেয়াদব মেয়ে, কথা কানে যাচ্ছে না? সে সরি?সে…… সরি রাইট নাউ!”

আমি একেবারে কেঁপে উঠলাম। হচ্ছেটা কি সেই কখন থেকে ধরতে পারছি না, প্রথমে টেনে আনলেন, এরপর নির্দয় নিষ্ঠুর লোকের মতো চেপে ধরলেন মুখ, তার উপর উল্টো পাল্টা বক বক শুরু করে দিলেন?এখন আবার সরি? লাইক সিরিয়াসলি? পেয়েছেনটা কি উনি? মগেরমুলুক? আমি নিজের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ধাক্কা দিলাম তারে। কোমরে হাত দিয়ে খেপাটে গুন্ডির মতো বললাম, ” কেনরে,? কে রে আপনি, যে সরি বলবো? হু আর ইউ?”

ইউসুফ ভাই খানিকটা দূর সরে গেছিলেন আমার দেয়া ধাক্কায় নয়, উনি ইচ্ছে করেই সরে গেছেন। আমার বল প্রয়োগে নিশ্চয়ই তার টিকিটিও লড়বে না! উনি হাত ভাজ করলেন। একরোখা, দেমাকি ইউসুফ ভাই বাঁকা হাসলেন,
” তুই আমাকে খেপিয়ে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছিসরে.. কুহু!”
আমি সেভাবেই মুখ ভেংচিয়ে বললাম, ” ওলে বাবা লে…বুইড়া বাবুটা খেপে যাচ্ছে বুঝি? কি করবেন শুনি? পাগলা কুকুরের মত কামড় বসাবেন বুঝি?”

ইউসুফ ভাই হাসলেন। কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয়ে এলেন আমার মুখোমুখি। আমি হকচকিয়ে পিছিয়ে যেতে দেয়ালে বাঁধা পড়ে গেলাম। ইউসুফ ভাই আমার পাশেই হাত রাখলেন দেয়ালে। কিছুটা ভয়ভয় চোখে তাকাতেই ইউসুফ ভাইয়ের মাদকাসক্ত চোখের নেশায় কিছু একটা ঝিলিক দিতে দেখলাম। উনি ঝুঁকে এলেন আবার। উনার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ যেন বসন্তের কোনো গানের সুরের মতো শোনালো আমার কানে। আমি নিষ্পলক চেয়ে দেখছি বিলাই চোখ জোড়ায়। উনি নরম গলায় বলে ফেললেন,

” আইডিয়া-টা মন্দ নয়?”
মুহূর্তেই আমার নেশা, ভ্রম কেটে গেলো। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন উনি।ইউসুফ ভাই ঠোঁট বাঁকালেন, হাসির জায়গায় ফুটে উঠলো শয়তানী হাসি, ” আমার বাড়ি দাঁড়িয়ে আমাকে কুকুর বলার শাস্তি এইটা!” বলেই আমার গ্রীবাদেশে মুখ ডুবিয়ে , জোরেশোরে একটা কামড় বসিয়ে দিলেন। অকস্মাৎ ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এক নেতার এমন কর্মকান্ড ভাবা যায়? এতো রাক্ষস নেতা। আমার বোধগম্য হতেই প্রথমেই দোল হয়ে গেলো অজানা-অচেনা অনুভূতি। শক্ত হয়ে গেলো আমার মেরুদণ্ড, পরক্ষণেই নিজেকে তটস্থ করে বলে উঠলো, ” রাক্ষস লোক। খাটাশ বেটা। ”

ইউসুফ ভাই মুচকি মুচকি হাসলেন। শুধালেন, ” এর পর আমার সাথে লাগতে এলেই আমার দিয়া চিহ্ন তোকে মনে করিয়ে দিবে…ইট’স ডেঞ্জার। ”
আমি রাগে ফসফস করতে লাগলাম ব্যথায় আমার কলিজা চিঁড়ে যাচ্ছে। কিছুটা ক্ষত হয়ে রক্তের ছোপ আভা ভেসে উঠছে। আমি পাশে থাকা ফুলদানিটা নিয়ে তেরে গেলাম তাকে মারবো বলে, রাগে গা কাঁপছে। কিন্তু ইউসুফ ভাইকে মারবার বদলে উলটো হোঁচট খেয়ে হুড়মুড় করে তাকে নিয়েই ঠাস করে নিচে পড়ে গেলাম ধাম শব্দ করে।

তখনি আমার ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ খুলে দেখি বিছানা থেকে নিচে পড়ে গেছি, আলুথালু অবস্থা। আমি আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম হচ্ছে টা কি? আমি এখানে কেনো? আমি না ইউসুফ ভাইয়ারে উপরে পরে গেছিলাম? ভেবেই লজ্জা লালিমা আভা ঢেকে গেলো আমার মুখ। গরম উয়ে গেলো কান। নিজের গালে নিজেকে চাপড় মেরে বোঝা চাইলাম, ” নাহ্। সব স্বপ্ন ছিলো।”

কিন্তু পরক্ষণেই আমার গ্রীবাদেশে সূচালো ব্যথা অনুভব করতেই মস্তিষ্ক জেগে উঠে। দৌঁড়ে উঠে আয়নার কাছে যেতেই থমকে যাই। ও মা একি? কিছুই তো নেই। তার মানে কি সব স্বপ্ন? আমি ভাবনায় বুঁদ। তখনি নিজের হাতে কারো আঙ্গুলের স্পষ্ট লাল দাগ দেখে চক্ষু আমার চারাক গাছ। আমি শুকনো ঢুক গিললাম। নিজের গালে আবারো চাপর মারতে লাগলাম, আসলে কি হয়েছিলো কাল? যা ঘটে ছিলো? তা কি শুধু মস্তিষ্কের খেল, কল্পনা, স্বপ্ন? নাকি সত্যিই ইউসুফ ভাই আমার সাথে????? ভাবতে ভাবতেই আবারো গলা শুকিয়ে কাঠ। আমার সারা শরীর অসার হয়ে গেলো মনে মনে ভাবছি, “মনোরমা তাহলে কি সত্যি বলেছিলো? ইউসুফ…. ইউসুফ ভাই জ্বিনী পুত্র???? ”

আমি জানালার দিকে তাকালাম। বাহিরে এখনো অন্ধকার। ঘড়ির দিতে তাকাতেই বুঝলাম চারটা বাজে। শুনেছি ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। ভেবেই ঘামতে শুরু করেছি। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে, হুট করেই শরীর ঝাড়া দিয়ে সব টেনশন ভুলে গেলাম। ইউসুফ ভাই নামক বারুদ কি করবেটা আমার? দেখে নিবো না কি?? ভেবেই আবারো কাথা গায়ে শুয়ে পড়লাম, কিন্তু মনের কুটিরে সন্দেহের বীজ বড় হতে লাগলো, ” সব ঘটনা কি সত্যি)? ”

হয়তো ওই ভয়ংকর রকমের বেয়াদব ইউসুফ ভাই ওর মস্তিষ্কে ভয়াবহ ভাবে ঘায়েল করেছে। তাই এইসব হচ্ছে। ভাবতে ভাবতেই আবারো চোখ বুঝে গেলো।
খুব সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙে নিচে নামতেই। ইউসুফ ভাই নামক তোপের মুখে পড়ে গেলাম।গতরাতের কথা মস্তিষ্ক নাড়া দিলো। তার পিছনে এক গাদা লোকের স্কোয়াট। আমি যখন রাতের ভাবনায় বুঁদ, আমাকে এলোমেলো চুলে দেখেই তাকালেন রক্তিম চোখে। নয়নে নয়নে হয়ে গেলো এক হিংস্র লড়াই। ব’লে উঠলেন দৃঢ় গলায়,” আজ কাল বড্ড বেপর্দা হয়ে গেছিস দেখছি। লজ্জা শরম কি বিদেশে পাচার করে এসেছিস? ”

আমি হা হয়ে গেলো। সেই আগের মতোই তার কন্ঠ স্বর, আমিও কম কিসে? তীক্ষ্ণ ধারালো ফলার মতো কথাবানের পাল্টা উত্তর করে বললাম, ” আপনার চোখের ডাক্তার দেখান। নেতাগীরি দেখাতে আসবেন না আমার সাথে। ”
ইউসুফ হাত ভাজ করে দাঁড়ালেন উনি।আমাকে খেয়ে ফেলবেন লুক নিয়ে তাকাতেই, আমি হালকা কেঁপে উঠলো। মুলত রাতের স্বপ্ন নাকি সত্যি ঘঠনা ভাবতে ভাবতেই আজ এই হাল আমার। উনার সফেদ মুখমন্ডলের পানে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি, গত রাতে যা হয়েছে, তা কি সত্যি হয়েছিলো? নাকি পুরোটাই আমার ভ্রম? আমি ভাবনায় বিভোর তবুও ঠাই দাড়িয়ে রইলাম পায়ে পায়ে ঝগড়া করবো বলে। ইউসুফ ভাই ঠান্ডা গলায় উঠলেন,” শোন বড় হচ্ছিস, আদবকায়দা শিখ। আমি তোর গুনে গুনে আট বছরের বড়। সো রেস্পেক্ট মি। আদারওয়াইজ বাড়ি থেকে তোর টাকা পয়সা দেয়া বন্ধ।”

কুহু খেঁকিয়ে উঠলো, ” আপনি কে রে? আমার বাপের টাকা আমি নিবো তাতে আপনার কি হ্যাঁ।”
ইউসুফ ভাই চলে যাচ্ছিলেন। আমার কথায় বাঁকা হাসলেন। টোল পড়া হাসি। বললেন” ঠিক আছে তাহলে আজ থেকে তোর বাপের টাকা দেয়া বন্ধ।”

সংকটময় প্রেম পর্ব ৩

বলেই হনহনিয়ে চলে গেলেন। আমি থম মেরে গেলাম। বেটা বজ্জাত শেষ পর্যন্ত আমার হাত খরচের টাকার উপর লোভ পড়লো। এত লোভী? কি সাংঘাতিক, দেশের নেতা সামান্য টাকার লোভ ছাড়তে জানে না, এ সামলাবে শহর, সত্যি । জনগণ কি জানে? জনগণের কানে পৌছানোই তো আমার কাজ, তাই নয় কি?? হে হে হে…

সংকটময় প্রেম পর্ব ৫