সংকটময় প্রেম পর্ব ৫

সংকটময় প্রেম পর্ব ৫
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

সোনালী রোদ খিড়কী ভেদ করে পড়ছে হল ঘরে। আমি এলোমেলো পায়ে ভাবতে ভাবতে হাটছি, “কিভাবে শিক্ষা দেয়া যায় বেটা ইউসুফ ভাইকে?”

তখনি কিছু টুকরো কথোপকথনের আওয়াজ ভেসে এলো আমার কানে। আমি লিভিং এরিয়ায় যেতেই দেখতে পেলাম ঢোলা ঢালা থ্রি পিস পড়া একটি মহিলা থল থলে শরীর ছড়িয়ে বসে আছেন সোফায়। কথা বলছেন ছিপছিপে গড়নের মিষ্টি মুখের মধ্যবয়সী সাদা ফিনফিনে শাড়িতে আবৃত ইউসুফ ভাইয়ের মা সায়রা বানুর সাথে।বড় মামি সবসময় সাদাসিধা থাকতে পছন্দ করেন। ডাগরডোগর চোখে হালকা কাজল,ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মাথার ঘন কালো চুল গুলো সুন্দর করে হাত খোপা করে রেখেছেন। বাহির থেকে আসা সোনালী আলোয় জ্বলজ্বল করছে মামির ব্যক্তিত্ব। উনার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ জোড়া ঠিক ইউসুফ পেয়েছেন,তবে গায়ের রংটা পেয়েছেন একদম বড় মামা নওশাদের মতো। বড় মামি আমার সমাজ সেবিকা, অবলা নারীদের নিয়েই তার কাজ। ময়মনসিংহ শহরে তার একটি এনজিও আছে। বড় মামি অধিকাংশ সময় বাড়িতে থাকেন না। এখন সকাল বলেই মামির এক ঝলক দেখতে পাওয়া। মহিলা বসে বসেই বলে উঠলেন, “আজ তাহলে আসি ভাবি, বোঝেনিতো আপনার ভাই বাসায়, উনি আবার আমাকে চোখে হারায়। ”

সায়রা বানুর চোখে মুখে যেন রাজ্যের বিরক্তি।হয়তো উনার কিমতি সময় এভাবে বরবাদ করতে চাইছেন না। উনি কাঠ কাঠ গলা বললেন, ” হ্যাঁ অবশ্যই এবার আপনার যাওয়া উচিত। ভাই সত্যি চিন্তা করছে।”
মহিলা হে হে করে দাঁত কেলিয়ে হাসলো। সেন্টার টেবিলের এক গাদা খাবার আইটেম রাখা। গরম ধোঁয়া উঠা চায়ে চুমুক দিয়ে বলে উঠলেন আবার, ” এবার তাহলে আসি।”

আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মহিলার কান্ড দেখে হেসে ফেললাম। মহিলাটি আবার বসে থেকেই চলে যাবার কথা বলছেন হয়তো কাঁইকুঁই করছে। আমার খুব মজা লাগলো ব্যপারটা। মামির দাম্ভিকপূর্ণ মুখ দেখে হয়তো মনের কথা গুলো উগরাই ফেরতে পারছে না।দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতেই চলে গেলাম কাছে। সামনে এগিয়ে গিয়ে বললাম, ” আরে আন্টি এভাবে খালি মুখে কেন যাবেন, খাবার গুলো কে শেষ করবে?”

মহিলাটি আমাকে দেখে বড্ড অবাক হয়েছেন এমন ভাব করে বলে উঠলেন, ” তুমি আবার কে?”
আমি নিজের পরিচয় দিবো, তার আগেই মহিলাটা গলা ছেড়ে বলল, ” জানেন না ভাবি, অপরিচিত মেয়ে মানুষকে বাসায় রাখতে নেই, দেখা যাবে কোন অঘটন টাই না ঘটায়? এই যে আমাদের সোনারপুত্র ছেলে ইউসুফ.. মা শা আল্লাহ জ্বিনী পুত্র মতো সুন্দর… বলছি সময় থাকতেই বিয়েটা না হয় করিয়ে ফেলেন, দেখা যাবে কেউ না কেউ নিয়ে পালিয়ে গেলো? আপনারা যে সহজ সরল মানুষ। আপনি যদি বলেন, আমার কাছে মেয়ে আছে, ওই যে আমার ভাই আছে না? তার শালীকার বান্ধবীর মেয়ে, মা শা আল্লাহ, ফকফকা রং… আপনি যদি চান…”

মহিলার কথায়, বড় মামি আর আমি দু’জনেই অবাকের আকাশচুম্বী। এবার বুঝতে পারলাম মহিলার কোমর সোফা থেকে কেন উঠছে। ভেতরের কথা উগ্রবার কোনো রাস্তাই পাচ্ছিলো না বোধহয়। আমার উছিলায় বলে দিলো গড়গড় করে। বাহ্ ভাই বাহ্ বাড়িতে তাহলে কথা চলছে ইউসুফ বেটার বিয়ের?? আমি গোয়েন্দা বিভাগের মানুষদের মত, তদন্ত কমিটির সদস্য মনে করতে লাগলাম এবার নিজেকে। বড় মামি মহিলাকে ধমকে থামিয়ে দিলেন, “দেখুন ভাবি, ও আমার ননদের মেয়ে, আর রইলো ইউসুফের বিয়ের কথা? ওটা ওর ইচ্ছে। আপনার চা খাওয়া মনে হয় শেষ? নাকি আরো খাবেন? এক কাজ করি ভাবি,

আপনি বরং আমাদের বাড়ির চায়ের পাতি, চিনি আর দুধ নিয়ে চলে যান, বাসায় গিয়ে বানিয়ে খাবেন? মনোরমা!!!!”
মামির কথায় চরম অপমানে মুখ গুঁজ হয়ে গেলো মহিলার। যেন টুস করে ফুটে যাওয়া বেলুন, আমি এদিকে মুখ চেপে হাসি আটকানো বিরাট কষ্ট কর কাজটা করতে লাগলাম। মহিলা যেতে যেতে বলল, ” মেয়েটি ভালো ছিলো ভাবি, ইউসুফের সাথে মানাতো, হাইটেও মা শা আল্লাহ ৫.৮ ইঞ্চি। ”

সায়রা বানু কানে দিলেন না। উলটো যেন শুনেই নি, এমন ভাব করলেন। তা দেখেই মহিলাটি ক্ষিপ্ত হয়ে বিড়বিড় করে চলে গেলেন। মহিলা যেতেই হু হা করে হেসে ফেললাম হাত-পা ছড়িয়ে। বড় মামি নিজেও মাথা ধরে বলে উঠলেন, ” কি শুরু করেছে যে মহল্লার মানুষ, ইউসুফকে নিজ ঘরের জামাই বানানোর জন্য লাইন করে আছে। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি আর তুই হাসছিস?”

আমি মামির পাশে গিয়ে বসলাম।টুস করে উনার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। মামি দেখতে খুব খুব সুন্দরী। বড় মামা নওশাদ ও খুব সুন্দর । দু’জনের কম্বিনেশনে ইউসুফ ভাই আরো সুন্দর। মামি আমার মাথা বিলি কেটে দিতে লাগলো। আমি বললাম, ” ছেলের বয়সতো হয়েছেই, বিয়ে দিলেই পারো?”
মামি হতাশার শ্বাস ছাড়লেন, ” চাই তো আমিওরে.. কিন্তু ওঁর নাকি পছন্দ আছে।”
আমি হতবাক হয়ে চাইলাম মামির দিকে, ” কে সে?”
মামি কোনো উত্তর দিলেন না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ” চল খেতে বসবি। ”

বলেই তারা দিলেন, এদিকে আমার উসখুস মনে গোয়েন্দা রানী আবার জেগে উঠলো। ছোট বেলার একটি ঘটনার মনে পড়লো টিউব লাইটের মতো। আমি তখন ক্লাস পাইভে পড়ি। একদিন ইউসুফ ভাইয়ের রুমে বড় মামি ডাকতে পাঠায়। ইউসুফ ভাই তখন টেবিলে বসে যেন কি লিখছিলো, আমি উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করতেই ইউসুফ ভাই তার বিলাই চোখ রাঙ্গালেন, আমি ভয়ে গুটিয়ে গেলাম। কিছু বলবো তার আগেই এক ধমকে আত্মা কেঁপে উঠলো, ” এক চর মারবো বেয়াদব, কি দেখতে চাইছিস তুই? ”

আমি ভয়ে থরথর কাঁপছি, মুখে কিছু বলবো সেইটুকু সাহস ছিলো না। আমাকে চুপ থাকতে ইউসুফ ভাই আবার বললেন, ” তুই আমার রুমে কি করিস? তুই কি আদবকায়দা জানিস না? কারো ঘরে গেলে নক করে যেতে হয়? ”
বলেই আমার কান মলে দিলেন। এবার ব্যথায় আর ভয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দেই। তা দেখে অপ্রস্তুত হয়ে যান ইউসুফ ভাই। কি করবেন ভেবে পেলেন না, আমার কান্না থামাবা অনেক চেষ্টা করে আশা ছেড়ে বসে রইলেন। কিছুক্ষণ পর উঠে গিয়ে ওনার ক্লজেটে থেকে কিছু চকলেট এনে ধরিয়ে দিতেই আমি চুপ। কাঁদো কাঁদো মুখে তাকিয়ে রইলাম ইউসুফ ভাইয়ের দিকে। ভাইয়া নরম কন্ঠে শুধালেন তোর জন্য। কিন্তু তখন আমি চুপ। তা দেখে যেন উনি আরো ক্ষেপে গেলেন, ধমকে উঠে বললেন, ” এভাবে কি দেখছিস, গিলবি নাকি আমায়?”

আমি তখন দ্বিগুণ জোড়ে কান্না শুরু করে দিলাম। এবং ইউসুফ ভাইয়ের দেয়া সব চকলেট নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলাম। পিছনে ইউসুফ ভাই কি ভাবছেন না ভাবছেন তা দেখার সময় কই, নিজে বাঁচলে বাপের নাম। তবে সেদিন ইউসুফ ভাইয়ের টেবিলে, কাঠের একটি ডায়েরি দেখেছিলাম। যেখানে সুন্দর করে খোদাই করা কাঠের ডায়রির উপর লিখা ছিলো ”

বাবুইপাখি ” হঠাৎ আজ এত বছর পর উনার সেই ডায়রির কথা মনে পড়তেই টনক নড়ে আমার। ইউসুফ ভাই কাকে পছন্দ করেন নির্ঘাত ওখান থেকে জানা যাবে? বড় মামির মুখে শুনেছিলাম, ইউসুফ ভাইয়ের ডায়রি লিখার অভ্যাস আছে ছোট থেকেই। তাহলে অবশ্যই সেই ডায়রিতে কিছু না কিছু পাবো? ভেবেই খুশি খুশি লাগছে। খাবার পর পর, কাউকে না জানিয়ে পা টিপে টিপে চলে এলাম ইউসুফ ভাইয়ের রুমে। বিশাল রুমের ভিতরেই একখানা সুইমিং পুল, অন্য পাশে লাইব্রেরির মতো শত শত বই। মাঝখানে মাস্টার বেড। আমি শুকনো ঢুক গিললাম।

বিছানার উপরে ইউসুফ ভাইয়ের ছবি যেন আমাকেই গিলে খাচ্ছে। এই মুহূর্তে ইউসুফ ভাই বাড়ি নেই। উনার সাদা কালো ডিজাইনের রুমটা পরিপাটি করে সাজানো। অনেক পরিবর্তন হয়েছে কিনা? মানুষতো পরিবর্তনশীল। আমি পা টিপে টিপে রুমে ঢুকলাম। ইউসুফ ভাই না থাকলেও যেন তার উপস্থিতি রুমে বিরাজমান। এই বুঝি এসে বলবে, ” কিরে চাইনিজ বিল্লি? তুই আবার আমার ঘরে মাছ, দুধের খোঁজ করতে এসেছিস? এবার তোর মৃত্যুদন্ড?”

আমি বুকে থুতু দিলাম। কিছুই হবে না বলে নিজেকে সাহস দিলাম এবং এগিয়ে গেলাম বাঘের গুহায়। একে একে তচনচ করে সব খুঁজে ফেললাম। তবুও ডায়রির দেখা পেলাম না। ঠিক তখনি মনে হলে কেউ আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ইউসুফ ভাই ভেবেই ঘাম ছুটে গেলো। পরে মনে হলো, “, ইউসুফ ভাই তো নেই?”
কিন্তু তবুও কেন যেনো হটাৎ করেই পরিবেশটা শীতল হয়ে গেছে, উষ্ণতা কোথাও যেন হারিয়ে গেছে মুহূর্তেই। তখনি ইউসুফ ভাইয়ের ঝংকার তোলা পুরুষালী কন্ঠ গর্জন করে উঠলো,

” কি করছিস আমার রুমে?”
আমার এবার আওয়াজ গলা পর্যন্ত আটকে গেলো। পিছনে ফিরবার সাহস করে উঠতে পারছি না। এভাবে যারপরনাই ভাবে বাঘের মুখে পড়বো? কে জানতো। আমি এক ছুটে কোনো রকম পালিয়ে যেতে নিলাম। তেমই উনি হেঁচকা টানে কাছে নিয়ে এলেন। আমার ডান হাতটি মুচড়ে ধরে আমার পিঠে ঠেকালেন। দাঁত কচকচিয়ে বলে উঠলেন,

” দিন দিন বড্ড পা নড়ছে তোর? ডিরেক্ট আমার ঘরেই ডাকাতি? কেন তোর বাড়িতে তোর বাপ এসব শিখিয়েছে? ”
ইউসুফ ভাইয়ের হিংস্র ভাবে ধরায় আমি ব্যথায় মরে যাচ্ছি। তার উপর তার তীক্ষ্ণ কথাবান আমার মনটা ক্ষুন্ন করে দিচ্ছে। আমি বললাম, ” আমার বাবা আপনার থেকে যথেষ্ট ভালো আছে।”

তা শুনে উনার মাঝে কোনো হেলদোল হলো না। উল্টো একই কন্ঠে বলল, ” তা তো হবেই, তবে মেয়েটা তো আর মানুষ করতে পারলো না। নয়তো এক এক করে তেরোবার বিয়ের পিরি থেকে পালায়? আমি হলে ঠেঙ ভেঙ্গে হাতে ধরিয়ে দিতাম।”
আমার এবার কান্না পাচ্ছে, এই লোকের সাথে ঝগড়ায় কখনো পাড়বো না আমি। তবুও বললাম, ” আপনার বাপ-মা ও তো ভালো, আপনি কেন এমন খাটাশ।”

ইউসুফ ভাই আমার কথায় আরো চেপে ধরলেন। এক পর্যায় ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। রক্তিম নয়নে আঙুল তুলে শানিত তরবারি মতো আমার গলায় ইশারা করে বললেন, ” হ্যাঁ আমি খাটাশ, তবে তোর মতো পতিতালয়ের মেয়েদের মতো গলায়, হাত পায়ে পরপুরুষের কোনো চিহ্ন নিয়ে ঘুরি না প্রোস্টিটিউটের ন্যায়।”

আমি হতভম্ব। ইউসুফ ভাইয়ার কথায় তীব্র ভর্ৎসনা ছুড়ে দিয়ে দৌড়ে চলে গেলাম নিজ রুমে কাঁদতে কাঁদতে । আমার রুমে এসে দরজা লাগিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলাম। আয়নার সামনে গিয়ে নিজে গ্রীব্রা দেশ ওড়না থেকে মুক্ত করতেই থম মেরে গেলাম। স্বপ্নে দেখা দাগটি এখন স্পষ্ট, কিন্তু সকাল পর্যন্ত তো ছিলো না? তাহলে এখন কিভাবে দেখা যাচ্ছে? ভেবেই আরো কান্না পেলো।

সংকটময় প্রেম পর্ব ৪

সব রেখে ওই বদমাশ লোকটার সামনেই এভাবে হেনস্তা হতে হলো? আমি কেঁদে কুটে নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেললাম। কান্না এক পর্যায় আমার ধ্যান ভাঙ্গে ফোনের রিং টোনে, কান্নার ফলে চোখে এখন ঘোলা দেখছি, এই মুহুর্তে ইউসুফ নামক মানুষটিকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে, তবুও নিজেকে সামলে ফোনটা রিসিভ করতেই, ও পাশ থেকে ভেসে এলো,
“জান… কেমন আছো?”

সংকটময় প্রেম পর্ব ৬