হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ২০

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ২০
রাউফুন

মাইজিন নিজের মতো করে সবটা সামলানোর চেষ্টা করছে। কোনো ভাবেই তুলিকাকে মানাতে পারছে না। রান্না ঘরে কাজের জন্য সাহায্য করতে যাচ্ছে তো রান্না ঘর থেকেই বেরিয়ে যাচ্ছে সে। রাতে মিষ্টির কাছেই শুয়ে পরছে। প্রয়োজন ব্যতীত কোনো রকম কথা বলছে না মাইজিনের সঙ্গে। এতোদিন পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেছে তাদের সম্পর্কটা ঠিক করতে। কিন্তু যতদিন ঠিক করতে গেছে সম্পর্কটা আরও অবনতির দিকে গেছে। মাইজিন নিজের ভুলের জন্য মুহুর্তে মুহুর্তে দগ্ধ হচ্ছে। কিন্তু ভুল যেহেতু করেছে শাস্তি তার প্রাপ্য। তাও ভালো তুলিকা তো তাকে ছেড়ে যায়নি। তুলিকা তার চোখের সামনে আছে এটাই বা কম কি!

মিষ্টিও বুঝতে পারছে তার বুবুজান আর মাইজিনের সম্পর্কটা ঠিক নেই। ওঁদের মধ্যে ঝামেলা লেগেই আছে। কিন্তু এখানে তার কিছু করার আছে বলে মনে হচ্ছে না। ওঁদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কথা বলতে সংকোচ করে মিষ্টির। কদিন আগে ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়ে নতুন বই এনেছে সে। নতুন বইয়ের গন্ধে মিষ্টি যেনো পড়ার জন্য আরও আগ্রহ পাই। সে মনে করে ক্লাস নাইন-টেন লাইফের সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট পার্ট। বয়সের তুলনায় বেশ ম্যাচিউর হয়ে গেছে সে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আজ শুক্রবার বন্ধের দিন। তুলিকা মাইজিনের সব জামা কাপড়, মিষ্টির আর তার জামা কাপড়, দুটো বিছানার চাঁদর, বালিশের কাভার গুলো, জানালার পর্দা, পাপস, সবকিছু সবগুলো কাপড় ভিজিয়েছে। সবকিছু ভিজতে দিয়ে সকালের রান্না করে ফেললো সে। মাইজিন নিচে গেছে নাফিসের কাছে। ওখান থেকে সোজা বাজারে গেছে। তুলিকা ততক্ষণে মিষ্টিকে শুধু জানালার গ্রিল পরিষ্কার করার জন্য বললো। একটা কাপড় ভিজিয়ে মিষ্টি গ্রিল পরিষ্কার কাজে লেগে পরলো।
সকালের রান্না হতেই তুলিকা আগে সব কিছু ধোঁয়ার জন্য গেলো। মাইজিন সেই মুহুর্তে বাজার করে ফিরলো। হাতে অনেক রকমের সবজি। এসে বিছানায় চাঁদর না দেখে বললো, ‘তুলিকা বিছানার চাদর কই?’

‘ভিজিয়েছি! আমি অন্যটা বিছিয়ে দিচ্ছি একটু পর!’
‘সমস্যা নেই আমি করে নিচ্ছি!’
‘আপনার করা লাগবে না আমিই করছি!’
তুলিকা এসে বিছানার চাদর বিছিয়ে দিলো। মাইজিন বাজার গুলো রান্না ঘরে নিয়ে গিয়ে ডালা সাজাতে লাগলো। তুলিকা এসে মাইজিনকে বাঁধা দিয়ে বললো, ‘কিচ্ছু করবেন না আপনি! আমার কাজ কি এতোটাই খারাপ হয় যে আপনি করেন? নাকি আমার কাজই পছন্দ হয় না আপনার?’

‘আরে আপনি বিছানার চাদর বিছিয়ে দিচ্ছিলেন তাই আমি বাজার গুলো ডালাই রাখছিলাম। এমন করেন কেন আপনি?’
‘রাখুন এসব।’
মাইজিন বাজারের থলেটা কিছু রেগেই রাখলো। এরপর দপদপ করে পা ফেলে পাশের রুমে গেলো।গিয়ে দেখলো মিষ্টি গ্রিল ক্লিন করছে। হুট করেই মেয়েটা তার চোখের সামনেই এতোটা লম্বা কি করে হলো? মিষ্টির হাইট এতোটা দেখে মাইজিন একটু অবাকই হয়েছে। এতোদিন সে খেয়াল করেনি কিন্তু আজকে যেনো বেশিই লম্বা লাগছে মিষ্টিকে। সে আদুরে ভঙ্গিতে বলে, ‘আরে মিষ্টি বেহনা। আমাকে দাও আমি গ্রিল পরিষ্কার করছি!’

‘আপনি যান। আমি করছি!’
‘আরে তোমার কষ্ট করার কি দরকার? আমি করি না!’
‘না ভাইয়া। বুবুজান দেখলে আমাকে বকবে!’
‘তোমার বুবুজান দেখবে না।’
‘নাহ দিতে পারছি না।’

‘বোনের মতোই জেদি হয়েছো। আমার একা একা ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে আমি অন্য প্লানেটের মানুষ! এখানে ধপ করে উড়ে এসে টপ করে পরেছি। তোমরা কাজ করবে আর আমি হা করে দেখবো?’
‘সমস্যা কোথায়? দেখতে না চাইলে না দেখুন!’
‘ হ্যাঁ আমাকে তো অমানুষ, বর্বর, জানুয়ার মনে হয় তোমাদের দুই বোনের!’
‘কাজ করতে হবে না আপনি বরং আমার সঙ্গে গল্প করুন ভাইয়া।’

মাইজিন গল্প করতেই চাচ্ছিলো কিন্তু সে সময় ধুপধাপ আওয়াজ এলো। সে দৌঁড়ে এলো। দেখলো তুলিকা কোমড়ে ওড়না পেঁচিয়ে চাদর ধুচ্ছে। মাইজিন তার কাজে সাহায্য করতে চাইলো। কিন্তু মাইজিন কে দেখেই তুলিকা ওয়াশরুমের দরজা আটকে দিলো।

‘আরে তুলিকা আপনি এমন কেন করছেন? আমাকে এভাবে আপনি দূরে ঠেলে দিতে পারেন না।’
তুলিকা আপন মনে নিজের কাজ করাই ব্যস্ত। সকল কাপড় ধোয়া শেষ হলে বালতিতে ভরে নিলো। উঠে দাঁড়ালে সে বুঝলো তার মাথাটা ঘুরছে। সকালে খাওয়া হয়নি তার মনে পরলো। এমন কি সে রাতেও খাইনি। মাইজিন অনেক জোর করেছে খাওয়ার জন্য কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।

তুলিকা নিজের মাথা ঘুরাটা তোয়াক্কা না করে বালতি ভর্তি সকল কাপড় নিয়ে ছাদের দিকে রওনা হলো। ততক্ষণে মিষ্টির গ্রিল পরিষ্কার করা হয়ে গেছে। তাই মিষ্টিও গেলো। মাইজিনকে দেখতে পেলো না কোথাও৷ বারোটা বেজে গেছে এর মধ্যেই। ছাদের সকল কাপড় দুই বোন শুকাতে দিয়ে নিচে এলো। তুলিকা ভেতরে এসে ঘর মুছে নিলো। মাইজিন গোসল সেরে নামাজের জন্য তৈরি হয়ে সবে মাত্র বেরিয়েছে। হন্তদন্ত হয়ে কিছু খুঁজছে সে।

‘কি খুঁজছেন?’
‘আমার কাপড়-চোপড় কই?’
‘ধোঁয়া হয়েছে শুকাতে দিয়েছি।’
‘একটাও কাপড় রাখেননি এখন আমি কি পরবো?’
‘আমি কি জানি!’
মাইজিন কিছু না বলে দুই গালে হাত দিয়ে বিছানা বসে পরলো। আজকে বোধহয় নামাজে যাওয়া হবে না।
‘এই নিন লুঙ্গি! আর গেঞ্জিও আছে।’
‘লুঙ্গি?’

‘ হ্যাঁ এটা আমি সেদিন কিনেছিলাম!’
‘কার জন্য?’ শুধালো মাইজিন।
তুলিকা মিনমিন করে বলে, ‘আপনার জন্য!’
‘আমার জন্য লুঙ্গি?’
‘হ্যাঁ। সব সময় তো দেখি ট্রাউজার পরেন। তাই দুটো লুঙ্গি কিনে এনেছি। আর ম্যাচিং করে দুটো গেঞ্জিও নিয়েছি। এগুলো পরে নামাজে যান।’

‘আমি জীবনেও লুঙ্গি পরিনি। কিভাবে পরবো!’
‘কোমড়ে গলিয়ে কুচি করে পেঁচিয়ে নিন!’
‘মহা মুশকিল তো। আপনি আমার সব কাপড় ধোঁয়ার জন্য কেন নিলেন!’
‘আচ্ছা আর ধুঁয়ে দিবো না!’ বলেই সে ওই রুমে চলে গেলো।
মাইজিন অসহায় মুখ করে লুঙ্গি আর গেঞ্জি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একটা আন্ডারওয়্যার ও বাকি রাখেনি। সব ধুয়েমুছে সাফ করে দিসে এই মাইয়া। হতাশ হয়ে কোনো রকমে লুঙ্গি পেঁচিয়ে নিলো। টুপি মাথায় দিয়ে নিচে যেতেই নাফিস বললো,
‘কি রে এতো দেরি কেন?’

‘এমনি!’
হঠাৎই মাইজিনকে দেখে নাফিস হো হো করে স্বশব্দে হেসে উঠলো। মাইজিন মুখ বন্ধ করে কোণা চোখে চেয়ে রইলো।
‘সা*লা তুই এটা কি পরছিস?’
‘কি আবার চোখে দেখিস না?’
‘এটাকে কি লুঙ্গি পরা বলে? পরতে পারিস না পরেছিস কেন?’
‘আমি কি সাধে পরেছি! তোর ভাবি দিয়েছে পরার জন্য!’
‘তাই বলে তোর পরা লাগবে।’
‘উপায় ও নেই৷ আমার জামা কাপড় সব ধুয়ে দিয়েছে।’

নাফিস কতক্ষন হেসে মাইজিন কে ঠিক ভাবে লুঙ্গি পরিয়ে দিলো। যেতে যেতে নাফিস বারান্দায় তাকাতেই দেখলো মিষ্টি চুল শুকাচ্ছে। ওর লম্বা চুল আর এক সাইডের ফেস দেখে নাফিসের মনে কেমন যেনো ধড়াস করে উঠলো। মাইজিন খেয়াল করার আগেই নাফিস চোখ সরিয়ে নিলো। মনে মনে বললো, ‘ তওবা তওবা। মিষ্টি একটা বাচ্চা মেয়ে। নাফিস তোর নজর ভালো কর। শেষ মেষ একটা বাচ্চার দিকে নজর দিচ্ছিস। ছিঃ ছিঃ!’
নামাজ থেকে ফিরে দেখলো খাবার টেবিলে খাবার সাজানোই আছে। মাইজিন তুলিকাকে ডাকলো। সে এসে মাইজিনের প্লেটে খাবার দিলো। মাইজিন শ্লথ কন্ঠে বললো,

‘মিষ্টি কই? বসে পরুন এক সাথে খাবো!’
‘আপনি খেয়ে নিন আমার ভালো লাগছে না। কেমন বমি বমি পাচ্ছে।’
‘কি বলছেন এসব?’
‘কিছু না।’
মাইজিন আর খেতে পারলো না তুলিকার খারাপ লাগছে শুনে। তুলিকা হেঁটে যাচ্ছিলো সে-সময় মাথা ঘুরে ফ্লোরে পরে গেলো। মাইজিন দেখে ধরতে চেয়েও পারলো না। মিষ্টিও শব্দ পেয়ে যাবেন এসেছে।
‘বুবুজানের কি হয়েছে?’

‘জানি না মিষ্টি। তোমার বুবু বললো তার নাকি খারাপ লাগছে। বলতে না বলতেই অজ্ঞান হয়ে গেলো!’
মিষ্টি শব্দ করে কাঁন্না করে দিলো। মাইজিন জলদি পানি এনে চোখে মুখে ছিটিয়ে দিলো। কিন্তু কাজ হলো না। বাধ্য হয়ে মাইজিন দ্রুত হসপিটালে নিয়ে গেলো তাকে। এদিকে মিষ্টির কাঁন্না থামছেনা। নাফিস হন্তদন্ত হয়ে দৌঁড়ে এলো। বললো,
‘কিরে ভাবির কি হয়েছে?’

‘জানি না রে ভাই। হুট করেই বললো মাথা ঘুরছে, বমি বমি পাচ্ছে! তারপর হাঁটতেই অজ্ঞান হয়ে পরে গেছে।’
নাফিস কিছু একটা ভেবে ঠোঁট চেপে হাসলো। বললো, ‘আরে বন্ধু আমাকে বলিস ভাবির সঙ্গে ঝগড়াঝাটি চলছে। আর এখন কি শুনি? তলে তলে দেখি আসল কাজ করে বসে আছিস!’
‘তুই কি মীন করছিস? আমি চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছি এদিকে তোর ইয়ার্কি!’
‘মিষ্টির ব্যবস্থা কর। আর একদম চিন্তা করিস না।’ নাফিস বাচ্চা কোলে নেওয়ার মতো করে দুই নাচালো।
কটমট করে চাইলো মাইজিন। সে কখন করলো? এরকম টা হওয়ার সম্ভাবনায় নেই। অসম্ভব ব্যাপার স্যাপার বলছে নাফিস।

‘এসব কি হচ্ছে? আমার বুবুজান অসুস্থ আর আপনি হাসছেন? অসভ্য লোক!’
নাফিস মিষ্টির কথায় তার দিকে তাকালো। কেঁদে কে’টে একশাঁ মেয়েটা। নাকটা লাল হয়ে গেছে কাঁন্নার ফলে। নাফিস কোনো কথা না বলে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো মিষ্টির দিকে। পরক্ষণেই নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো।
‘নাফিস কন্ট্রোল,কন্ট্রোল। এমন বাচ্চা মেয়ের দিকে কেন নজর দিচ্ছিস?’
ডক্টর বেরিয়ে এলেন। মাইজিন তাকে দেখতেই ছুটে গেলো।

‘চিন্তা করবেন না আপনার ওয়াইফ সুস্থ আছেন এখন। উনার কিছু ম্যাডিক্যাল টেস্ট করতে হবে। এরপর উনাকে বাড়ি নিয়ে যাবেন।’
‘ওর কি হয়েছে ডক্টর?’
‘দেখুন আমার মনে হচ্ছে উনি অনাহারে আছেন প্রায় চব্বিশ ঘণ্টার মতো। উনার খেয়াল রাখবেন এরপর থেকে খুব ভালো ভাবে। উনার রিপোর্ট গুলো কালকে এসে নিয়ে যাবেন।’

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৯

‘ওকে! থ্যাংক ইউ ডক্টর।’
মাইজিন তুলিকাকে নিয়ে বাড়ি এলো। আর নাফিস ফাঁকে ফাঁকে মিষ্টিকে দেখে যাচ্ছিলো না চাইতেও। কি করবে এখন সে? সে কি শেষ পর্যন্ত এই বাচ্চা মেয়ের প্রেমে পরলো!

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ২১