হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৩৩

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৩৩
রাউফুন

তুলিকা কোনো রকমে শাওয়ার নিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো। সে এখন ঠিক করে কাপড় ও কাঁচতে পারে না। নিজের এই অসহায়ত্বে কাঁন্না পাচ্ছে তার। মাইজিন রোজ তার কাপড় ধুঁয়ে দিচ্ছে। এতে দিনকে দিন তার খারাপ লাগা বেড়েই যাচ্ছে। অনেক সময় অন্যের কাপড় কাঁচতে গেলে তার নিজেরই সংকোচ লাগে সেখানে মাইজিন নিঃসংকোচে তার প্রতিটি কাপড় কেঁচে দিচ্ছে। কতটা নির্বিঘ্নে খুটিয়ে খুটিয়ে কাজ করে দিচ্ছে।

‘বাবু, তুমি যে কবে আসবে। তোমার বাবার আমাদের জন্য কত কষ্ট হচ্ছে দেখেছো?’
‘কিছুই কষ্ট হচ্ছে না মাই চ্যাম্প। তোমার মাকে বলে দাও তোমার বাবা সুপার হিরো।’
মাইজিন ওয়াশরুম থেকে কাপড় হাতে নিয়ে বের হলো। বারান্দায় কাপড় মেলে দিয়ে এসে তুলিকার নাক টেনে দিয়ে বললো, ‘তুমি জানো না তুমি আমাকে কি দিয়েছো। আমাকে বাবা হওয়ার আনন্দ দিয়েছো, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় খুশি যে এনে দিচ্ছে তার অসময়ে তার পাশে থাকবো না? যে মানুষটা আমার জীবনের প্রতিটি খুশির কারণ তার জন্য এটুকু করতে পেরে আমি ধন্য! নিজের মনে এতোটা গিল্ট রেখো না মাই সুইটহার্ট!’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তুলিকার অসহায়ত্ব কমলো অনেকটা। মাইজিনের এমন কথায় সে আপ্লুত। মাইজিনকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রাখলো।
‘আমি তো মুটিয়ে গেছি। এখন খুব বা’জে লাগে আমাকে দেখতে! আপনি আমাকে আগের মতো ভালোবাসেন তো বাবুর আব্বু?’
‘নাহ আগের মতো ভালোবাসি না! ইশ কি হয়েছো তুমি!’
তুলিকার মন খারাপ হয়ে গেলো এবারে ভীষণ। ছলছল চোখে তাকাতেই মাইজিন হো হো করে হাসলো। প্রাণ খোলা সেই হাসি।

‘ওই দেখো, কেমন কাঁদুনে। মেয়েরা বোধহয় একটু বেশিই কাঁদুনে হয়! এদের চোখে কি দু তিনটে লুকোনো কুয়ো থাকে নাকি?’
তুলিকা শ্লথ পায়ে গিয়ে বিছানায় বসলো। মুখ গোমরা করে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো।
‘আগের মতো ভালোবাসি না। কারণ ভালোবাসা বেড়ে চার হাজার গুণ হয়ে গেছে। আগে তুমি শুধু মাত্র আমার স্ত্রী ছিলে আর এখন তুমি আমার সন্তানের মা। তাহলে ভালোবাসা বাড়বে না বলো তো?’
তুলিকা খিলখিল করে হাসলো।

‘আহ! এমন হাসিতে আমি বারবার ম’র’তে রাজি।’
‘মাইজিইইইন আপনি খুব পঁচা!’
‘এই কেন কেন? এত্তো এত্তো ভালোবাসছি তাও পঁচা!’
‘ পঁচাই তো। না হলে এমন মজা কেউ করে?’
‘আচ্ছা বাবা আর করবো না।’
তুলিকা উঠে মাইজিনকে সোজা হয়ে জড়িয়ে ধরতে গেলে মাঝে বাঁধা হলো তার উঁচু পেট। দুজনেই ঝলমলিয়ে হেসে উঠলো এটা দেখে।

দিনটা শুক্রবার। সকাল থেকেই তুলিকার শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছিলো। সারাদিন ওভাবেই কা’ট’লো তার। মাইজিন গেছে অন্য একটা জরুরি কাজে। যদিও সে যেতে চাচ্ছিলো না কিছুতেই। হঠাৎই পেটের বা দিকে ব্যথার উপদ্রব হলো তার। তুলিকা মিষ্টিকে ডেকে বললো, ‘মিষ্টি তোর ভাইয়াকে কল করে আসতে বল। আমার শরীর খারাপ লাগছে।’
‘বেশি খারাপ লাগছে আপু?’

‘ হ্যাঁ মনে হচ্ছে বাবু হবে। ব্যথা করছে ভীষণ!’
মিষ্টি জলদি মাইজিনকে কল দিলো। এদিকে মাইজিন জানালো তার আসতে আরও ঘন্টা খানেক লাগবে। অস্থির মাইজিন পারলে উড়ে উড়ে চলে আসে। মিষ্টি অনুচিন্তন হয়ে নাফিসসহ আশফিদের ও কল করে আসতে বললো। তারা আধ ঘন্টার মধ্যেই গাড়ি দিয়ে চলে এলো। দ্রুত হসপিটালে নেওয়া হয় তুলিকাকে। মিষ্টি জানে বাচ্চা হওয়ার আগে বাচ্চার মাকে পানি পান করাতে হয় অনেক। হাঁটাহাঁটি করাতে হয় অনেক। মিষ্টি অনেক বার তুলিকাকে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করলো হসপিটালে।

কারণ বাবুর পজিশন ভালো আছে তাই নরমাল বেবি হবে ডক্টর জানালেন। বাবু হতে হতে সন্ধ্যা সারে ছয়টাই হলো। মাইজিন অস্থির হয়ে হসপিটালে ছুটে এসে শুনলো তার একটা মিষ্টি প্রিন্সেস হয়েছে। সকলের চোখে মুখে খুশির ফোঁয়ারা। কথা মতো মাইজিন সবার প্রথমে বাবুকে কোলে নিলো। অবাক করার বিষয় হলো তুলিকা বাচ্চা হওয়ার সময় একটা ছোট আওয়াজ করেছে শুধু। পুরোটা সময় শুধু চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পরে গেছে। ঠোঁট, জিহ্বা কামড়ে ব্যথা সহ্য করেছে। তার একটাই কথা, ‘আল্লাহ্ তায়ালা মেয়েদের এই কঠিন কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা দিয়েই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন।’

তুলিকা সম্পুর্ন সুস্থ ছিলো সে জন্য তাকে বাড়ি আনা হয়েছে। পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করেছেন রৌফ সুলতান। নাতনীকে কোলে নিয়েই বলেছেন, ‘এটা তো আমার আসমা! সে আমার কাছে ফিরে এসেছে নতুন রুপে!’
রাতে বাবুর কান্নায় মাইজিনের ঘুম ভেঙে গেলো। সে আস্তে আস্তে উঠে বসলো যাতে করে তুলিকার ঘুম না ভাঙে। বাবুকে চেইক করে দেখলো সে পটি করেছে। মাইজিন বাচ্চার কাপড় বদলে দিলো। এরপর ভালো পোশাক পরিয়ে দিতেই বাচ্চা শান্ত। বুকের উপর চেপে ধরলো মাইজিন তার কন্যাকে। আহ এ যেনো অনবদ্য শান্তি, বাবা হওয়ার আনন্দ বোধহয় এতোটা তীব্র। কি শান্তি এতে মাইজিন মন উজাড় করে তা উপলব্ধি করলো। তুলিকা ভীষণ ক্লান্ত থাকাই বুঝতে পারলো না বাবা মেয়ের রাতের নিরব আলাপ চারিতা। বাবুকে বুকে নিয়েই মাইজিন ঘুমিয়ে গেলো।

সকালে বাবা মেয়ের এমন দৃশ্য দেখলো তুলিকা প্রাণ ভরে। সে মনে মনে বলল, ‘তুমি ভীষণ লাকি আমার প্রিন্সেস। এমন বাবা ভাগ্য করে পাওয়া যায়।আর তুমি সেই একজন আমার মা!’
বাবুর বয়স সাত দিন। নিয়ম অনুযায়ী বাচ্চার আঁকিকা আজ। সকলে এসেছে নিমন্ত্রিত হয়ে। যার যার মতো সবাই ব্যস্ত। মিষ্টি এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে। বাচ্চার নাম ভাবায় সংকটে পরেছে সে। তার একটাই কথা বাচ্চার নাম সে রাখবে। মাইজিন, তুলিকাও মেনে নিয়েছে বিষয়টা। কারণ খালারা তো ভাগনা-ভাগনিদের অর্ধেক মাতা। তার সম্পুর্ন অধিকার রয়েছে বাচ্চার নাম করণ করার।

‘মাম্মাম বলো তো তোমার কোন নাম টা পছন্দ? আঁতুর নাকি জেবা?’
‘ওঁর নাম টা আমিই রাখি?’
‘কে?’ পেছন ঘুরলো মিষ্টি। নাফিসকে দেখেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো সে। কারণ একটাই আজও নাফিস তার সঙ্গে কথা বলেনি। এসেই কাজ করতে ব্যস্ত হয়ে গেছে।
‘একটা মানুষের এত্তো রাগ আসে কোথা থেকে শুনি? রাগ ছাড়া কি আর কোনো ধাঁতু তোমার মধ্যে সাবমিট করেন নি আল্লাহ তায়ালা? মানে নাকের ডগায় রাগ ঝুলে থাকে মুলার মতো। তুমিও আগাও তোমার রাগও আগায় তোমার সাথে সাথে!’

‘হ্যাঁ রাগই তো করি শুধু। আপনি যে খুব ভালো মানুষ!’
‘মানে সিরিয়াসলি? তোমার রাগ উঠবে এটাতেও আমার দোষ? আল্লাহ্, আল্লাহ্, আল্লাহ্ আমাকে উঠিয়ে নাও ধরনী থেকে!’
‘রাগ টা করি কি জন্য? আপনার কথা শুনলেই রাগে আমার মাথা তিনশো ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে যায়।’
‘কই দেখি দেখি।’

‘হোয়াট?’ চোখ কোণা করে প্রশ্ন করে মিষ্টি।
‘না চেইক করে নিলাম আসলেই মাথাটা তিনশো ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরেছে কি না। আমি কি মাথা বাঁকা বউ নিবো নাকি।’
‘ইইই! নাফিসের বাচ্চা!’
নাফিসকে আর সে তল্লাটে পাওয়া গেলো না। সে উঁধাও মুহুর্তের মধ্যে। মিষ্টি রাগে ফুসছে। সব সময় এই লোকটা তাকে রাগিয়ে দেবে। উফফ সহ্য হয় না।

‘এই লোকের সঙ্গে কথা বলবো না বলেও বলা হচ্ছে। কথা না বললেও আবার মন আঁকুপাঁকু, আঁকুপাঁকু করে। করবেই তো। না করে যাবে কই। তিনশো পয়ষট্টি দিন ঘুর ঘুর করলে মন তো গলবেই। এখানে আমার দোষ কই? দিনশেষে আমিও তো মানুষ নাকি! অভ্যস্ত হয়ে গেছি তো!’
মিষ্টি যখন একা একা বিরবির করছিলো তখন নাফিস হুট করে পেছন থেকে তনু কন্ঠে বলে, ‘কিছু বলছিলে আমার বাচ্চা মরিচ?’

‘আপনি আবার এসেছেন এখানে?’
‘তুমি যে আমায় ডাকলে?’
‘আমি জীবনেও ডাকিনি আপনাকে।’
‘ওহ তাই বুঝি? কেউ আমাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এই কথা বলছিলো মনে হয়?’
‘আপনাকে আমি ভালো ভেবেছিলাম।’
‘আমি বরাবরই ভালো। তাতে সন্দেহ আছে?’

‘আছে অবশ্যই আছে। কোনো ভালো ছেলে কখনোই আড়ি পাতে না।’
‘বাড়ে আড়ি কখন পাতলাম? এতো জোরে জোরে কথা বললে যে কেউ শুনতে পাবে।’
‘এই বুড়ো আপনি বিয়ে করছেন না কেন?’
‘তুমি হ্যাঁ বললেই করে নিবো!’
‘আমার কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই আপনার মতো ভীতুর ডি’ম হাবলাকে বিয়ে করবো। তারপর আমার আর আপনার বয়সের এরকম আকাশ-পাতাল তফাৎ!’

‘তাতে কি রাজি হয়ে যাও না।’
‘কি জন্য?’
‘বিয়ের জন্য!’
‘জীবনে না।’
‘জীবনে হ্যাঁ!’
‘না!’
‘ হ্যাঁ!
‘নাহ!’
‘ ওকে নাহ!’
‘ওকে হ্যাঁ!’

মুখ ফসকে মিষ্টি হ্যাঁ বলতেই নাফিস “ইয়েএএ!”বলে লাফিয়ে উঠলো।
‘কি দিলাম তো মাত?’
‘বুইড়া দূর হোন আমার চোখের সামনে থেকে! না হলে এই বাচ্চা মরিচ সেদিন পেয়াজের শরবত খাইয়েছে, আজ মরিচের শরবত খাওয়াবে!’

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৩২

‘এই দেখো, দেখো বাবু আমাদের ঝগড়া বেশ এনজয় করছে! কেমন হাসছে।’
মিষ্টি দেখলো সত্যিই হাসছে বাবু। অজান্তেই তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। কি মিষ্টি সেই হাসি।

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা শেষ পর্ব

1 COMMENT

Comments are closed.