হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৩১

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৩১
রাউফুন

মাইজিনের সিকনেস যখন দিনকে দিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছিলো তখনই অত্যন্ত খুশির এক বার্তা বয়ে এলো তাদের সংসারে। আজকে টেষ্ট করার পর তুলিকা জানতে পেরেছে সে মা হতে চলেছে। সে হাউমাউ করে কাঁন্না করে দিয়েছিলো। তার ভেতরে আরেকটা সত্তার অনুভব করলো মন প্রাণ দিয়ে। চোখের পানি বাঁধন ছাড়া। সে খুশিতে মাইজিনের কাছে ছুটে যায়। শুয়ে থাকা মাইজিনের বুকের উপর শুয়ে তাকে দুই হাতে জাপটে ধরে। মাইজিনকে জড়িয়ে ধরার পর তার কান্নার বেগ দ্বিগুণ হাড়ে বেড়ে যায়।

মাইজিনের ঘুম ভেঙে যায় এতে। সে তুলিকাকে সম্পুর্ন ভাবে জড়িয়ে ধরে আলতো হাসে। হেসে বলে, ‘এই পা’গ’লি এভাবে কাঁদছো কেন? কি হয়েছে? এতো কান্নাঁ কিভাবে করো তুমি?’
‘মাইজিন আমি আজকে ভীষণ খুশি। আপনি শুধু এখন সুস্থ হলে আমরা সম্পুর্ন। আমরা খুব শীঘ্রই একটা ফ্যামিলিতে পরিপূর্ণ হবো মাইজিন।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মাইজিন উঠে বসে। তুলিকা সেভাবেই পরে থাকে মাইজিনের বুকে। কান্নার দাপট কমার বদলে বাড়লো আরও। মাইজিন তাকে চেয়েও শান্ত করতে পারলো না। মাইজিন তুলিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর শান্ত করতে চাইছে।
‘খুশি তুমি তবে এভাবে কাঁদছো কেন?’
‘আপনি জানেন না কেন কাঁন্না করছি। জানলে আমার চেয়েও বেশি খুশি আপনি হবেন। আল্লাহ যে কত বড় একটা উপহার দিয়েছেন আমাদের সেজন্য খুশি। আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া। এবার আপনি খুব শীঘ্রই ভালো হয়ে যাবেন।’

‘কি হয়েছে বলবা?’
‘আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন মাইজিন।’
যেনো এর চেয়ে মধুর বাক্য আর একটিও নেই। মাইজিনের দু-চোখ ভরে উঠে। সেও জাপটে ধরে তুলিকাকে। কাঁন্না করতে করতে দু’জনেই হারিয়ে যায় কোথাও যেনো।
‘এখন আপনি কাঁদছেন কেন?’
এরকম স্বাভাবিক মুহুর্তেই ঘটে অযাচিত, অস্বাভাবিক ঘটনা। মাইজিন হুট করেই হিংস্র হয়ে তুলিকাকে সরিয়ে দিলো নিজের থেকে।

‘বাচ্চা, বাচ্চা হবে? ও এলে ওঁকেও পঁচা মহিলাটা মা’র’বে। মা’রা’র পর৷ ধা’রা’লো ব্লে’ড দিয়ে আঁ’চ’ড়ে দিবে। ওর নরম ছো’ট্ট শরীর র’ক্তা’ক্ত করে মরিচের প্রলেপ লাগাবে সেই ক্ষ’ততে। আহঃ আমি সহ্য করতে পারবো না। তুমি জানো না কত ব্যথা। কত ব্যথা জানো না! না না এটা হতে পারে না। হতে দিবো না আমি।’
ঠিক এই ভয় টাই পাচ্ছিলো তুলিকা। আর সেজন্যই কাঁন্নায় ভেঙে পরছিলো বার বার। মাইজিন মাথার চু’ল টেনে ধরলো। আঃ আঃ করে চিৎকারে ঘরের জিনিস পত্র ভাঙতে থাকে।

‘বাচ্চা আসবে না। না, না আসবে না ওঁ। ওঁকে এতো কষ্ট দিতে দিবো না। না না দিবো না কষ্ট। আমার বাচ্চা কষ্ট পাবে না।’
মাইজিন ডাইনিং টেবিলের উপর থেকে ফল কা’টা’র ছুড়ি আনে। তুলিকার দিকে আগাই এক পা এক পা করে। ভয়ে আঁতকে উঠলো তুলিকা। গুটি শুটি হয়ে পিছনে পিছিয়ে গেলো সে।
‘মাইজিন ওঁ আমার আর আপনার বাচ্চা। আমরা ওঁকে এক সাথে মানুষ করবো। ওঁকে কষ্ট পেতে দিবো না।’
‘না না বাচ্চা মানেই কষ্ট। আমাকে, আমাকে মে’রেছে। খুব মে’রেছে। তুমি আসো, আসো আমার কাছে। ওঁকে পে’ট থেকে ফেলে দিবো শুধু। আসো না! কোনো কষ্ট হবে না আমার বাচ্চার।’

তুলিকা সুযোগ বুঝে অন্য রুমে চলে যায়। দরজা আটকে দিয়ে নাফিসকে কল করলো সে। ঘটনা খুলে বললে সে রওনা দিলো এখানে আসার জন্য। মিষ্টি এক্সাম দিয়ে ফিরে নি এখনো। আজ লাষ্ট এক্সাম তার। মাইজিনকে এতো দিন যে সে কিভাবে সামলেছে এক মাত্র সেই জানে। প্রতিটি মুহুর্তে গুমরে গুমরে কেঁদেছে সে। মাইজিনের শারীরিক অবস্থার কথা শুনে চেচিয়ে কেঁদেছে সে। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তার। সে ভেবেছিলো বাচ্চার কথা শুনে মাইজিন একটু ভালো হবে। সে যখন খুশিতে তার সঙ্গে সঙ্গে কাঁদছিলো, তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করছিলো, তখন এক মুহুর্তের জন্য ভীষণ খুশি হয়ে গেছিলো সে।

নাফিস আসলে দরজা খুলে দিলো তুলিকা। কারন সে দৌঁড়ে মিষ্টির রুমে চলে এসেছিলো। নাফিস এসেছে সে জানে। তাই দরজা খুলে দিয়ে বিছানায় বসে জোরে কাঁন্না করে দিলো।
‘ভাবি আবার কি হয়েছে? এই দুইদিন তো কোনো রকম পা’গ’লামি করে নি শুনলাম। শুনে ভালোও লাগছিলো। কিন্তু আজ আবার এরকম কেন হলো?’
‘উনি এতোদিন তো পারিপার্শ্বিক ভাবে আমার বা মিষ্টির ক্ষতি করতে চান নি। কিন্তু আজ? আজ যখন সে জানতে পারলো সে বাবা হতে যাচ্ছে তখন সে এই বাচ্চাকে মে’রে ফেলতে চাইছে। সে আর বাচ্চা চাইছে না। আমি এখন কি করবো নাফিস ভাই?’

‘ভাবি প্লিজ শান্ত হোন। আপনি এভাবে কান্না করলে কি করে হবে? আপনাকে এবার ভালো থাকতে হবে আপনার সন্তানের কথা ভেবে। এভাবে ভেঙে পরবেন না।’
‘আর কতো বলতে পারেন? আপনার বন্ধুর এই অবস্থা আমি আর সইতে পারছি না। ডক্টর এর কথা মতো তো সবই করছি। আমি ভেবেছিলাম একটু ইম্প্রুভ করেছে মাইজিন। কিন্তু আজকের পর মনে হলো তাকে ঠিক করতে আমি ব্যর্থ! আমি ব্যর্থ! আমি হেরে যা-ওয়া একজন মানুষ!’

নাফিস কি বলে স্বান্তনা দিবে ভেবে পেলো না। এই মেয়েটা প্রাণ-পণে চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজের স্বামীকে সুস্থ করতে। দিন রাত খে’টে যাচ্ছে যাতে মাইজিনের অবস্থা ভালো হয়। কিন্তু নাফিসের মনে হচ্ছে আজকের ঘটনার পর ভালো সাইক্রেটিসকে দেখাতেই হবে।

‘শুনুন ভাবি এবারে আমাদের লাস্ট স্টেপ গ্রহণ করতে হবে। সব কিছু তো চেষ্টা করলাম। তবে মাইজিন যদি নিজে উপলব্ধি করতে পারতো সে সত্যিই সমস্যায় ভুগছে তাহলে তা সমাধানের পথও মাইজিন বের করতে পারতো। কিন্তু সে তা বুঝতে পারেনি। সেক্ষেত্রে আমাদেরকে ওঁর পাগলামির ভিডিও করে ওঁকে স্বচক্ষে দেখাতে হয়েছে সে কি করে। ওঁর অবচেতন মনে যা কিছু আসতো সেটা শুধু আমাদেরকে শেয়ার করতে বলেছিলাম। ওঁ সেটা করেওছে। এবং বিশ্বাস করেছে। ডক্টর বলেছিলো বন্ধুত্বকে কাজে লাগান। যেহেতু আমি ছাড়া আর কোনো বন্ধু ওঁর নেই সেখানে আমাকেই তো ওর পাশে থাকতে হবে। নিয়মিত মেডিটেশন করানো, আমি নিজে ওঁকে এটাতে সাহায্য করেছি

(মেডিটেশন এক প্রকার মনের ব্যায়াম।এটি সচেতনভাবে দেহ মন এবং মস্তিষ্ককে শিথিল করার আধুনিক বৈজ্ঞানিক এবং সহজ প্রক্রিয়া।মেডিটেশনের মাধ্যমে আমরা মনকে একাগ্র করি, নির্দিষ্ট কিছুক্ষনের জন্য নিজেকে দূরে সরিয়ে আনি দৈনন্দিন জীবনের শত সমস্যা থেকে।এতে মনে প্রশান্তি আসে, ধীরে ধীরে কাজে মনোযোগ বাড়ে, নিজের প্রতি বিশ্বাস ফিরে আসে। বিজ্ঞানীদের মতে,

“মনোদৈহিক ৭৫ ভাগ রোগের কারণই টেনশন।তাই মেডিটেশন করলে আপনি অনায়াসেই শতকরা ৭৫ ভাগ মনোদৈহিক রোগ থেকে মুক্তি পাবেন। আর পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারও একটি মনোদৈহিক সমস্যার অন্তর্গত।” )
আপনি, আমি, মিষ্টি একমাত্র ওর কাছের বন্ধু। আমাদের কাছে ওর মনে হওয়াটা তো শেয়ার করেছে। আমি খেয়াল করতাম ও যখন সবকিছু শেয়ার করতো কতটা হালকা হতো। ওকে রিল্যাক্স দেখাতো সে-সময়। কতটা হালকা অনুভূব করতো ওঁ।

আমি জানি মাইজিন ইম্প্রুভ করছে। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আবার যদি এরকম লক্ষ্মণ দেখা যায় তবে সেক্ষেত্রে মনোরোগ বিদের সঙ্গে দেখা করাতে হবে৷ সুনির্দিষ্ট ধরন অনুযায়ী পথ্য, তথ্য কিংবা পরামর্শও জরুরি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আমাদের এবারে মাইজিনকে সাইকোলজিক্যাল থেরাপি দিতে হবে। এটাই লাষ্ট সুযোগ ভাবি তবেই মাইজিনকে এই ডিসঅর্ডার থেকে বের করে আনতে পারবো। এবং আমাদেরকেও সাহায্য করতে হবে। ওঁকে রিহ্যাবে দিতে হবে। আপনি এবারে নিজেকে শক্ত করুন। আর যেহেতু মাইজিন ফার্স্ট স্টেজে সেহেতু সে খুব তারাতাড়ি সেরে উঠবে।’

‘আমি আপনার আমার জন্য এই অনবদ্য পরিশ্রম ভুলবো না নাফিস ভাই। আমি আপনাকে সারাজীবন মনে রাখবো। কে এতোটা করে বলুন তো আজকাল নিজের বন্ধুর জন্য?’
‘এরকম বললে কিন্তু আমি আর আসবো না। আপনি বোধহয় এখনো আমাকে নিজের বড় ভাই হিসেবে ভাবতে পারেন নি। তাই এতোটা ফর্মালিটি দেখাচ্ছেন। এভাবে ফর্মালিটি দেখালে কিন্তু আমি খুব রাগ করবো এবারে।’

‘আপনিও তো ফর্মালিটি দেখাচ্ছেন ভাই।’
‘মোটেও না। আমি কোন সময় আপনার সঙ্গে ফর্মালিটি করলাম?
‘এই যে নিজেকে বড় ভাই দাবী করছেন অথচ আপনি সম্বোধন করছেন! এটা কি ফর্মালিটি নয়?’
‘তবে কি বলবো?’
‘বোন বলবেন। তুই অথবা তুমি বললে খুশি হবো।’
‘ঠিক আছে।’
এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। তুলিকা নাফিসকে বসতে বলে পীপহোলে চোখ রাখলো। সে চমকে উঠলো রীতিমতো।
‘কি হলো এভাবে চমকে উঠলে কেন?’
‘নাফিস ভাই শাপলা আন্টি এসেছে।’
‘কিহ?’

‘ হ্যাঁ। কি করবো এখন? উনি কেন এসেছেন বলুন তো?’
‘কিছু হবে না দরজা খুলে দাও।’
তুলিকা দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলে দিতেই শাপলা হুরমুরিয়ে তুলিকার পায়ের উপর পরলো। তুলিকার পা ধরে কাঁন্না করতে করতে বললো, ‘আমাকে বাঁচাও মা। তুমিই একমাত্র পারো আমাকে বাঁচাতে। দয়া করো আমাকে।’
‘একি আপনি এভাবে আমার পা ধরছেন কেন?’
‘ক্ষমা করো আমাকে। নইলে তোমার শশুড় আমাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেবে!’

তুলিকা আর নাফিস হতভম্ব। কি বলছে এসব এই মহিলা? শাপলার কান্না দেখে তুলিকার বিন্দুমাত্র খারাপ লাগছে না। এই মহিলার জন্য আজকে তার ভালোবাসার মানুষ টার এই অবস্থা। এই মহিলাকে ক্ষমা করার প্রশ্নই আসে না।
‘আপনার যা শাস্তি প্রাপ্য তা আপনি পাবেন মিসেস শাপলা সিদ্দিকা। আপনি একজন মা হয়ে সন্তানের মতো ছেলেকে এভাবে কি করে নির্যাতন করতেন বলুন?আপনার বুক কাঁপে নি একটুও। ছোট থেকে একটা না-বালক ছেলেকে দিনের পর দিন এমন অ’ত্যা’চার করেছেন যে এখন সে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে। আপনার কোনো ক্ষমা নেই। যান এখান থেকে।’

মাইজিনকে ছোট থেকে যেভাবে অত্যা’চার করেছে ঠিক সেটারই রিফ্লেক্টশন তার উপর পরেছে। সে বেশির ভাগ সময় যখন পা’গ’লামি করে তখন শাপলার করা অ’ত্যা’চা’রে’র কিছু অংশই বেশি আওড়াতে থাকে। নিজের প্রাণ প্রিয় স্বামীর প্রতি অন্যায় সে গ্রাহ্য করলো না৷ দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো শাপলাকে। তম্বন্ধে রৌফ সুলতান এসে শাপলাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন। পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে আবারও ফিরে এলেন তুলিকার কাছে। শাপলা অনবরত চিৎকার করে তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইছিলো। তার মুক্তির জন্য ছটফট করছিলো।

তুলিকার ভেতরে ভেতরে খারাপ লাগা কাজ করলেও মাইজিনের প্রতি হওয়া অন্যায়ের কথা ভেবে সেই খারাপ লাগাকে উড়িয়ে দিলো। শাপলাফ বোঝা উচিত যন্ত্রণা কি জিনিস।যে যন্ত্রণা তিনি মাইজিনকে দিয়েছেন। যার ফলস্বরূপ আজকে মানুষ টা স্প্লিট পার্সোনালিটি ডিসওর্ডারে ভুগছে। তাকে কোনো দিনও ক্ষমা করতে পারবে না তুলিকা। কোনো দিন ও না। তুলিকা বসে পরলো ফ্লোরে৷ হাঁটুতে মুখ গুঁজে হামলে কাঁন্না করে দিলো। নাফিস, রৌফ সুলতান তাকিয়ে দেখলেন একটা মেয়ের ভে’ঙে গুড়িয়ে যাওয়াকে। যে স্বামীর এরকম অবস্থা জেনেও তার হাত ছাড়েনি। অন্য কেউ হলে বোধহয় কবে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতো। দুনিয়ায় বাঁচা বড্ড কঠিন।বড্ড কঠিন।

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৩০

‘আমি আপনার সঙ্গে কার অন্যায় কারীকে ক্ষমা করিনি মাইজিন।আমি ক্ষমা করতাম কি করে বলুন? ওই মহিলাকে ক্ষমা করলে যে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। কিছুতেই না।’

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৩২