হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৩২

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৩২
রাউফুন

ভরা পেটটা নিয়ে নিচু হয়ে বসতে পারে না তুলিকা। টুলস এর উপর বসে কাজ করতে হয় না হলে কয়েক দন্ড দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়। মাইজিনের পুরো পুরি কাউন্সিলিং করার পর এখন সে সুস্থ। তবে স্প্লিট পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার থেকে পুরো পুরি নিরাময় হওয়া সম্ভব নয়৷ রোজ মনে করে ওষুধ টা দিতে হচ্ছে তুলিকাকে।

তুলিকা ভাবে সে না থাকলে মানুষটার কি হবে? কোথাও এক দন্ড পাঠিয়েও শান্তি পায় না সে। তারা এখন আর নাফিসের বাড়িতে ভাড়ায় নেই। রৌফ সুলতান নিজে গিয়ে জোর করে তাদের এখানে এনেছে। মাইজিনকে ছাড়া ছয়টা মাস সে খুবই খারাপ সময় কা’টিয়েছে। নাফিসদের বাড়ি থেকে এসেছে মাইজিন ফেরার পরেই। তুলিকা নিজেই সেই বাসা ছাড়তে চাইনি। তাদের প্রথম সংসার টা তো ওখান থেকেই শুরু হয়েছিলো। তাই বাড়িটার মায়া ছাড়তে চাইনি এতোটা দ্রুত। মাইজিন না থাকাই নাফিসের তাদের প্রতি করা অবদান আজীবন মনে রাখবে। উপকার কারীকে আর অবমাননাকারীকে মানুষ কখনোই ভুলতে পারে না৷

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এদিকে মিষ্টির মেট্রিক পরীক্ষা চলে এগিয়ে এসেছে। মেয়েটা দিন রাত এক করে পড়াশোনা করে। পাশাপাশি বোনের কাজে সাহায্য করে। তুলিকার শরীরে প্রেগন্যান্সির কারণে পানি ধরেছে। কাউকে না কাউকে ধরাধরি করে চলাচল কর‍তে হয়।রেশমা নামের একজন মহিলাকে রেখেছেন রৌফ সুলতান। যাতে তুলিকাকে রান্না ঘরের আশেপাশেও যেতে না হয় সেজন্য।
তুলিকা মাথার চুলকানোর জ্বালা সইতে পারছে না আর। উঁকুন হয়েছে তার চুলে। মাইজিন তুলিকাকে ধরে বসালো। টুলসে বসিয়ে নিজেও বসলো। বিলি কে’টে উঁকুন এনে দিলো।

‘আল্লাহ আমার একি জ্বালা হলো। শেষ পর্যন্ত মাথায় উঁকুনে বাসা বাঁধলো৷ এই বাবুর আব্বু মাথায় কি বেশি উঁকুন হলো?’
‘না না একটু একটু হয়েছে। মাথা তো পরিষ্কার করে দিই প্রতিদিন তাহলে থাকছে কিভাবে?’
‘রেশমা আপা বললো পোয়াতি মায়ের মাথায় নাকি একটু আধটু উঁকুন হয়। একেকজনের একেক কমপ্লিকেশন থাকে। দেখ বাবু তোমার জন্য আমার কি অবস্থা। মনে রেখো কিন্তু সব।’

‘তোমার পায়ের বড় নখের আ’চ’ড় লাগে। বসো নঁখ কে’টে দিবো।’
মাইজিন নেইল কা’টার এনে তার পায়ের নখ কে’টে দিলো। হাতের নখও কে’টে দিলো। এরপর বলল,
‘এয়্যাই বাবু দেখো তোমার আব্বুও কষ্ট করছে। বাবুর আম্মু তুমি একাই কষ্ট করছো না আমিও করছি। বাবু মনে রাখিও কিন্তু?’

‘আমি বেশি কষ্ট করছি। এই দেখুন আমার পা ফুলে গেছে পানিতে। হাঁটতেও পারি না।’
‘তোমরা কেউ-ই কিছু করছো না। বাবুর খালামনিই সব করছে! তাই না বাবু!’
‘হ্যাঁ এবার এসেছে আসল জন। দেখো মিষ্টি তোমার বুবুজান আমাকে কি বলছে আমি নাকি বাবুর জন্য কষ্ট করছি না।’
‘বাবুর জন্য যে বেশি কষ্ট করবে সে আগে কোলে নিবে।’

‘আমিই তো বেশি করছি! তাই আমিই বাবুকে প্রথমে কোলে নিবো।’
‘সবার প্রথমে আমি কোলে নিবো বুবুজান। তোমরা কেউ না!’
‘এয়্যাহ বললেই হলো। আমি বাবুর মামা আমি কোলে নিবো আগে।’
‘আরে নাফিস ভাই যে!’ নাফিসকে দেখে মাথায় কাপড় টেনে নিলো তুলিকা। উঠে বসলো আস্তে আস্তে। মাইজিন নাফিসকে জড়িয়ে ধরলো উঠে গিয়ে।

‘এতোদিন পর বোনকে মনে পরলো?’ বললো তুলিকা।
‘অনেক ব্যস্ত ছিলাম গো বোনটি। ঢাকার বাইরে গেছিলাম কাজের জন্য! এখন ফিরতেই এখানে না এসে থাকতে পারলাম না। তোমাদেরকে খুব মিস করছিলাম।’
‘ উঁহু আমাদের না বল মিষ্টিকে।’
‘এই মাইজিন তুই কিন্তু বেশি বলছিস!’

মিষ্টির মন খারাপ হলো ভীষণ। একটা বার নাফিস তার দিকে তাকাইনি পর্যন্ত। এমন কি কোনো রকম বাক্যব্যয় করেনি।
‘মিষ্টি বোন যা তো চা বসাতে বল রেশমা আপাকে।’
‘আমাদের জন্যও বসাতে বলিস তাহলে।’

‘আরে আশু, নীতি ভাবি, সাইমুম ভাইয়া, নীরব ভাইয়া আপনারা কখন এলেন! এই আশু এই তোর আসার সময় হলো?’
‘আর বলিস না বাবার শরীর তো সব সময় খারাপ থাকে তাই কোথাও যেতে পারি না৷ বয়স্ক মানুষ কখন কি হয় তার চিন্তায় খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে সবাই। আমাকেও সব দিক সামলাতে হচ্ছে।’
‘পাক্কা গিন্নি হয়ে গেছিস একেবারে। সেই যে মাইজিনকে দেখে গেলি। আর আসিস নি তাই অভিমান হয়েছে।’
‘আচ্ছা স্যরি আমার বান্ধবী।’ আশফি জড়িয়ে ধরলো তুলিকাকে।

তারা ছেলেরা এক জোট হয়ে ড্রয়িংরুমে আড্ডা দিতে বসে গেলো। আর মেয়েরা এক জোট হয়ে তুলিকার রুমে চলে এলো। মিষ্টি রেশমার সঙ্গে কাজে সাহায্য করছে আর ফাঁকে ফাঁকে নাফিসকে লক্ষ্য করছিলো। নাফিস তার সাথে কথা না বলাই রাগে দুঃখে পেয়াজ কা’ট’তে বসলো। রেশমা শুধালো,

‘মিষ্টি তুমি পেয়াজ ছুলাইতাছো ক্যালাই।?’
‘পেয়াজের জুস করুম রেশমা আপা!’
‘ওমা এটা আবার কিমন জুস। জীবনে হুনি নাই!’
‘হুনো নাই হুনবা।’
‘কিন্তু এইডা তুমি কারে খাওয়াইবা? নাফিস ভাইরে?’

মিষ্টি কটমট করে তাকালে রেশমা দমে গিয়ে নিজের কাজে মন দিলো। এদিকে কষ্টে চোখের পানি বের হচ্ছে। পেয়াজের ঝালা লাগাটা বড় কথা না ভেতরে কষ্ট হচ্ছে সেটার জ্বালাই চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পরছে।
সাইমুম, নীরব, আশফি, নীতি তারা সবাই এসেছিলো মাইজিনের এসাইলামে যাওয়ার আগে। তাছাড়া রোজ আশফির সঙ্গে তুলিকার কথোপকথন হতোই। সবটা ফোনে শুনলেও আসতে পারতো না আশফি। তার সংসারে শাশুড়ী নেই। তার উপর নীতি তখন পাঁচ মাসের প্রেগন্যান্ট।

তার শরীরে অনেক কমপ্লিকেশন থাকায় তাকে ফুল বেড রেস্টে থাকতে বলেন ডক্টর। যদিও নীতি কাজ করতে চাইতো কিন্তু আশফি তাকে কাজে হাত ও লাগাতে দিতো না। এখন তার বাচ্চার বয়স দুইমাস। কি সুন্দর ফুটফুটে একটা ছেলে বাবু হয়েছে তার। নীতির কোলে বাচ্চা এটা তুলিকা মাত্র খেয়াল করলো।
‘ভাবি আমি খেয়ালই করিনি বাচ্চাকে। এতো ঝামেলায় আমরাও ওঁকে দেখতেও যেতে পারিনি৷ একটু দিন ওঁকে কোলে নিই!’

‘এয়্যাই তুলিকা তোর এই অবস্থা। বাবু ছোট হলে কি হবে পেটে জোর কদমে কিক দেই। ব্যথা পেয়ে যাবি।’
তুলিকা মানলো না। এতো সুন্দর বাবুকে কি কোলে না নিয়ে থাকা যায়।
‘তুই চুপ কর তো আশু। আমি একটুর জন্য বাবুকে কোলে নিবো। বাবু আমাকে অনেক ভালোবাসে আমাকে কিক দিবে না।’
নীতি মিষ্টি হেসে বললো,’নেও তবে বাবুর হাত পায়ের কন্ট্রোল নেই একদম। ছোট হলে কি হবে লা’থিটা জোরেই লাগে। কোলে নাও তবে অল্প সময়ই থাকবে তোমার কাছে।’

‘আচ্ছা দিন তো। কি নাম রেখেছেন ওর?’
‘মুহিন!’
‘বাহ ভারী মিষ্টি নাম!’
তুলিকা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দুই গালে কপালে, ঠোঁটে, স্নেহের পরশ এঁকে দিলো।
‘এয়্যাই তুই দেখি জামাই আদর করছিস! জামাই বানাবি নাকি?’
‘বানালে ক্ষতি কি? এতো সুন্দর জামাইকে হাত ছাড়া করতে চাই না।’

আশ্চর্যের বিষয় হলো তুলিকার কাছে গিয়ে বাচ্চাটা শান্ত হয়েই আছে। যেনো একটু নড়লেই সে ব্যথা পাবে। আর এটাই বাচ্চাটা চাইছে না। কেমন দুই হাতে আলতো করে গলা জড়িয়ে ধরেছে তুলিকার বড্ড আদুরে ভঙ্গিতে। তুলিকা তার উচু পে’টের উপর দিয়েই বাবুকে আগলে ধরেছে।
‘দেখেছিস বাচ্চা আমার কাছে এসে কেমন চুপচাপ হয়ে আছে।’

‘ হ্যাঁ তাই তো দেখছি।’
‘বাবু মনে হয় তোমাকেই শাশুড়ী বানাতে চাইছে। এই জন্যই মহব্বত করে লাথি দেইনি এখনো।’
নীতির কথায় হেসে উঠলো তুলিকা আর আশফি।
মিষ্টি সবার জন্য শরবত নিয়ে গেলো। এই অসময়ে চা কফির বদলে শরবত দেখে একটু অবাক হয় সবাই।
‘নিন এই গরমে শরবত খেয়ে গলা ভেজান সবাই!’

‘এই সকালে শরবত? আর গরম কোথায় মিষ্টি। শীত শীত আমেজ পরেছে সবে সবে!’ বললো মাইজিন।
‘খেলে খান না খেলে নিয়ে যাচ্ছি এতো কথা কেন বুঝতে পারছি না!’
‘এই রে মাইজিন তোর বোন তো দেখছি রেগে যাচ্ছে।’ বললো সাইমুম।

‘হ্যা তাই তো দেখছি।’
‘কি রে নাফিস তুই কিছু বলেছিস নাকি?’
‘আমি? আমি কি বলবো নীরব ভাই!’
মিষ্টি সবার সামনে শরবত রাখলো। নাফিসের সামনে শরবতের গ্লাস টা শব্দ করেই রাখলো। সবাই শরবত হাতে নিয়ে মিষ্টি আর নাফিসকে দেখে মিটিমিটি হাসলো।

নাফিস শরবত মুখে দিতেই চোখ মুখ উলটে এলো।
‘তোমরা কি শরবতে পেয়াজের গন্ধ পাচ্ছো?’
‘কই না তো।’ এক সাথে জবাব দিলো তারা।
নাফিস মনের ভুল ভেবে আরেক ঢুক মুখে দিতে
উটকো করে ফেলে দিতে উদ্যত হলো। সে সময় মিষ্টি হাতে লা’ঠি এনে দাঁড়িয়ে পরলো তার সামনে।
‘খবর দার এক ফোটা শরবত ফেললে এই লা’ঠি ভাঙবো আপনার পি’ঠে!’

অবস্থার বেগতিক দেখে সাইমুম, নীরব, মাইজিন কে’টে পরেছে। আড়াল থেকে দেখছে মিষ্টি কি করে। নাফিস ভয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে অদ্ভুত স্বাদের শরবত পান করে নিলো। বার বার উলটে আসছিলো মুখ থেকে কিন্তু শেষ না করে উঠতে দেইনি মিষ্টি৷ শরবত শেষ হলে গ্লাস হাতে নিয়ে চলে গেলো মিষ্টি। আড়াল থেকে তারা তিন জন বেরিয়ে এলো।

‘প্রে’মের ম’রা জলে ডুবে না!’ সমস্বরে মৃদু চেচিয়ে নাফিসের কানের কাছে বললো তারা।
‘তোমরা সব নিমোকহারাম। সুযোগ বুঝে ঠিক সটকে পরেছো!’
‘বাচ্চা মেয়ের প্রে’মে পরার শাস্তি এটা তোর!’ আবারও এক সাথে বলে উঠলো তারা।
নাফিস বিরবির করে বলে, ‘কি করলাম যার জন্য এমন অদ্ভুত ধাঁচের শরবত পান করালো এই বাচ্চা মরিচ! তাতে কি ভালোবাসা ছিলো এতে!’

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৩১

অনেক সময় প্রেগন্যান্ট মহিলাদের মাথায় উঁকুনের উপদ্রব হয় অল্প স্বল্প। এটা নিতান্তই মজা করতেই উল্লেখ করেছি। কয়েকদিন থেকে আমার রিডার্সরা কষ্টের পার্ট পড়ে ক্লান্ত হয়ে গেছে তাই একটু হাসানোর চেষ্টা করলাম আপনাদের।
কেমন হয়েছে জানাবেন। রোজা নিয়ে লিখেছি খুব তারাতাড়ি শেষ করবো বলেই। কারণ বাকি রোজা গুলোতে লেখালেখির প্যারা রাখতে চাইছি না৷

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৩৩