হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৯

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৯
রাউফুন

দুই দিনের মাথায় মাইজিনের জ্বর সারলো। এতো দিন অসুস্থ ছিলো বলেই তুলিকা সেভাবেই ট্রিট করেছে মাইজিনকে। তার শরীরে দগদগে ক্ষ’ত স্থানে নিয়ম করে ওষুধপত্র লাগিয়ে দিতো তুলিকা। কিন্তু একটিবার ও এই কথা জিজ্ঞেস করেনি যে এই ক্ষ’ত স্থানের কারণ কে? কে করেছেন তার প্রতি এমন নির্মমতা, এমন নিষ্ঠুরতা! তুলিকা শুধু দেখতে চাইছে মাইজিন নিজে থেকে কখন বলে সবটা। সকালের ব্রেকফাস্ট পর মিষ্টি স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলো। এগারোটা নাগাদ তুলিকাও বের হচ্ছিলো। সে সময় মাইজিনের মুখোমুখি হতে হলো তাকে।

‘কোথাও যাচ্ছেন?’
‘হুম।’
‘কোথায়?’
‘সব কথা আপনাকে বলতে হবে?’
‘হ্যাঁ হবে! বলুন কোথায় যাচ্ছেন?’
‘একটা সিভি তৈরি করতে। আমার কিছু ডকুমেন্টস এর প্রয়োজন আছে। প্রথমে আমার ভার্সিটিতে যাবো। সেখানে ভর্তির সময় ইন্টারমিডিয়েট এর সার্টিফিকেট সহ কিছু ডকুমেন্টস দিয়েছিলাম সেগুলো যদি এখন পাই সুবিধা হবে।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘এখন নেই কেন?’
‘আগে ঐসব পুঁড়েছে এখন আমার জীবন পুড়ে শেষ হচ্ছে।’
‘ভুলেই গেছিলাম কথাটা। আমাকে বলুন আমি গিয়ে এনে দিচ্ছি আপনার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া সিভি দিয়ে আপনি করবেন টা কি?’
‘আপনার মতো শিক্ষিত মানুষকে নিশ্চয়ই এটা বলতে হবে না সিভি দিয়ে মানুষ কি করে?’

‘জানি না আমি। আপনি বলুন কি করবেন?’ ত্যাছড়া ভাবে জানতে চাইলো মাইজিন।
‘একটা চাকরি করবো। আপনার দয়ার শরীর তাই এতো দিন ঠাই পেয়েছি। সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ আপনার প্রতি। কিন্তু আর নয়। এভাবে আর কতদিন অন্যের দয়াই বাঁচবো? এবার এই আপদ আপনার ঘাড় থেকে বরাবরের মতো নেমে যাবে!’
‘মানে? কি বলছেন এসব? বউ কোনো দিন কারোর আপদ হয়?’ মশকরা করলো মাইজিন।
‘হ্যাঁ হয়। দয়ার বিয়ের বউ হয় আপদ! আপনি তো আর আমাকে ঘটা করে দেখে, সম্বন্ধ করে, আপনার বাবা মায়ের পছন্দ করা মেয়ে বিয়ে করে আনেন নি!’ নাক ফুলিয়ে বললো তুলিকা।

‘আমার জীবনের সবচেয়ে মুগ্ধ করা অনুভূতি আপনি তুলিকা। আপনি আপদ কেন হবেন? এভাবে বলবেন না প্লিজ!’
তুলিকার ভেতরের ক্রোধ সাজানো অনুভূতি, আবেগকে মুহূর্তেই অগোছালো করে দিয়েছে মাইজিনের এই সামান্য কথায়। ভেতরের সবকিছু উথাল পাথাল করছে। তাকে পুরোপুরি নিজের ক্রোধ হতে মুক্ত করে দেওয়াই বোধহয় এই মানুষটার কাজ।

‘আর হ্যাঁ লিসেন তুলিকা এরপর নিজেকে আপদ ভাবার কোনো অবকাশ কিন্তু নেই হ্যাঁ? জেনে রাখুন এবং মাথায় গেঁথে নিন আপনি কোনো চাকরি করছেন না। আপনার বরের এখনো যা আছে তা দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে সারাজীবন বসে বসে খেতে পারবেন।’
তুলিকা কয়েক সেকেন্ড মাইজিনের দিকে তাকিয়ে থেকে কণ্ঠ চড়াও করে বলে,

‘কে বলেছিলো আপনাকে আমায় বিয়ে করতে? কে বলেছিলো বলুন? কেনো এই দয়ার বিয়ে করলেন আমাকে? ছোট বেলা থেকে সবাই শুধু এই তুলিকা কে দয়াই করে গেলো। হায় কি জীবন পেয়েছি! জীবন সঙ্গী পেলাম এখন তার মুখেও শুনতে হয় তিনিও দয়া ধর্ম করেই বিয়ে করেছেন। আমি কি আগ বাড়িয়ে বলেছিলাম বিয়ে করতে? কিন্তু সেদিন কতটা অকপটে সবকিছু বলে দিলে! আপনি আমাকে দয়া করে করেছেন, ভালো খেতে পারছি, পোশাক পাচ্ছি, ভালো বাড়ি পেয়েছি থাকার জন্য! আর কি চাই? এই পর্যন্ত আপনি আমার জন্য যা কিছু করেছেন তার সবটাই আমি শোধ করে দিবো। তাই চাকরি আমাকে করতেই হবে।’

মাইজিন কথা হারিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো তুলিকার দিকে। তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ চাহনি উপেক্ষা করতে পারলো না তুলিকা। আবার পর মুহুর্তে মাইজিনের সেই এরোগেন্স ভাব বদলেও গেলো। শুধু স্থির হয়ে চেয়ে রইলো তার দিকে।
‘ হ্যাঁ আমি সবটা শোধ করে দিবো। আর সেজন্য আমার চাকরির প্রয়োজন ভীষণ! চাকরি পেলে এখান থেকে মিষ্টি আর আমি চলে যাবো। আপনার বোঝা হবো না আমরা! অনেক বোঝা হয়েছি অন্যের। এবার নিজেকেই কিছু করতে হবে। এবার সময় এসেছে অন্যের বোঝা না হয়ে নিজে কিছু করে দেখানোর। তা না হলে যেখানেই যাবো সেখানেই সবাই দূর দূর, ছাঁই ছাঁই করবে।’

কথাগুলো বলতে গিয়ে তুলিকা অনুভব করলো তার গলা ধরে আসছে। কণ্ঠনালীতে শক্ত কিছু আটকে আছে যেনো। কথা বের হচ্ছিলো না ভালোভাবে৷ মাইজিনের চেহারায় এবার বিভ্রান্ততা দেখা গেলো। এতোক্ষণে তাকে দেখা বোঝা যাচ্ছে সে অনুশোচনা বোধ করছে ভীষণ ভাবে। কিন্তু এখন এ অনুশোচনা বোধ করে কি কোনো লাভ হবে? সে তো তার শক্ত কথার বাণে তুলিকাকে ভীষণভাবে আঘাত করে ফেলেছে।

এখন এ আঘাতের ক্ষ’ত কি তার অসহায়ত্বের কথা শুনে শুকিয়ে যাবে! মোটেও না। যেভাবেই হোক, যে কারণেই হোক না কেন তার মনের সুপ্ত রাগ তো মাইজিন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। তার সঙ্গে যা কিছুই হোক না কেন, পরোক্ষভাবে তো সে ওই খারাপ ব্যবহার ডিজার্ভ করেনা তাই না? মাইজিন তাকে তার সমস্যার কথা বলতে পারতো! সে কি বুঝতো না? সে তো অবুঝ নয় একেবারে! বুঝিয়ে বা ইশারায় বললেও তো সে বুঝতো। তুলিকা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে তার মুখপানে তাকিয়ে আবার বললো,

‘জানেন, মানুষের মুখের ক’টু কথা বন্দুকের গুলির আগে কলিজায় আ’ঘাত হানে? আপনি আমাকে আপনার কথার বা’নে মে’রে’ছেন। সেই কথা গুলো না চাইলেও ফেরাতে পারবেন না আপনি। আমার বুড়ো দাদু বলতেন সব সময়। ❝সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার থেকে বেশি কিছু শেখা যায়। কারণ ব্যর্থতা কখনো থামতে দেই না। এটি চরিত্র গঠন করে। যদি তোমার সফল হওয়ার সংকল্প দৃঢ় হয় তাহলে ব্যর্থতা তোমাকে কখনোই অতিক্রম করবে না।❞ এই কথা টা কেন বললাম জানেন, আপনি হলেন আমার জীবনের সেই ব্যর্থতা। আপনার জন্য আমার হৃদয় ক্ষ’ত বিক্ষ’ত হয়েছে ঠিকই কিন্তু আমি এখনো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আপনার সামনে। আমি একটা শিক্ষা লাভ করেছি আপনার জন্য! এবারে আপনার মুক্তি। চাকরি টা পেলেই ডিভোর্স কার্যকর এর ব্যবস্থা করে ফেলবো।’

মাইজিন এই পর্যায়ে গিয়ে ভীষণ রেগে যায়!
‘এই মুহুর্তে আপনি রুমে যাবেন। এক পাও এগোলো পা ভেঙে ঘরে ফেলে দিবো। কোনো মুক্তি নেই আপনার আমার থেকে। আপনি আমার একান্ত ব্যাক্তিগত মানুষ, আমিই আপনাকে আঘাত দিবো, আমিই আপনার সেই আঘাতে প্রলেপ দিবো। কিন্তু ছেড়ে যাওয়ার কথা যেনো ভুলেও আর না শুনি। তা হলে মাইজিন সুলতানের ভালোবাসা দেখেছেন এই পর্যন্ত এরপর দেখবেন তার খড়তা!’

তুলিকা কিছু বলতে নেয় কিন্তু পরক্ষণেই মাইজিনের ক্রোধান্বিত রক্তিম নেত্রের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলার সাহস পেলো না। এর মূখ্য কারণ সে কখনোই এর আগে মাইজিনকে রাগ করতে দেখে নি। তার সামনে তো এক্কেবারেই না। উপরন্তু এই মুহুর্তে কিছু বলা মানে বিস্ফোরণ ঘটানো। তাই অবশেষে আজ আর বেরোলো না তুলিকা। এক মুহূর্ত বিলম্ব করে না অন্য রুমে গিয়ে দরজা আটকে বসে রইলো। মাইজিনও শব্দ করে রুমের দরজা লাগিয় দিলো। নাফিসকে কল করে ডাকলো এই ঘরে। সঙ্গে গিটার আনতে বললো যাতে করে রাগ টাকে দমন করতে পারে সে। কথা মতো নাফিস উপস্থিত হলো।
‘হঠাৎ কি হলো? এতো রাগের উৎস কি?’

‘আর বলিস না তুলিকা কি সব উলটো পালটা কথা বলছে। সে সময় কি বলতে কি বলে ফেলেছি ওই কথায় ধরে বসে আছে। আমি নাকি ওঁকে দয়া দেখিয়ে বিয়ে করেছি। ওঁ এখন সেই দয়ার বিয়ে থেকে মুক্তি দেবে আমাকে।’
‘তুই ভাবিকে সবটা বলছিস না কেন? আমি শিওর সত্যিটা জানলে ভাবি আর এমন করবে না!’

‘এখন বললে বলবে যে আগে তো অনেক বলার সময় ছিলো তখন কেন বলিনি। বললেই তো সবটা সমাধান হতো। এখন মনে হচ্ছে বলেও লাভ নেই। আমি মানছি আমি অনেক ভুল করেছি কিন্তু তার কারণ ছিলো! তাই বলে সে আমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলবে? সে আমাকে অন্য সব শাস্তি দিক আমি মাথা পেতে নেবো কিন্তু ছেড়ে যেতে চাইলেই মে’রে ফেলবো একেবারে!’

‘ আরে বন্ধু আমার দেখি ভাবির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। তবে আগেই যদি বলতি তবে হইতো এই পরিস্থিতি হতোই না।’
‘আরে নাফিস কিভাবে বলতাম বল তো? তখন পরিস্থিতি কি ছিলো সেটা এক মাত্র আমিই জানি। তুই তো জানিস সবটা!’
‘আংকেল না ফিরলে তো বেরিয়ে আসতে পারতি না মনে হয়। আংকেলকে জানাচ্ছিস না কেন তুই?’

‘ বাবা এসেছেন বলেই আসতে পেরেছি। ওই মহিলাও আসতে দিয়েছে ধরা পরবে বলে। ওই মহিলা যে আমাকে মিথ্যা বলে নিয়ে যাবে আমি ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি। নেহাৎ মাকে কথা দিয়েছি তা না হলে সব বলে দিতাম বাবাকে। আমি আমার মায়ের কথা রাখতে সব করতে পারি। যত যন্ত্রণায় সইতে হোক না কেন আমার। মাকে কথা দিয়েছি তাই এখনো অব্দি ওই মহিলা অক্ষত আছেন। না হলে এই মাইজিন সুলতান কখনোই তাকে ছা’ড় দিতো না।’ ক্ষুব্ধ হয়ে বললো মাইজিন।

‘আচ্ছা রিলেক্স হো। এই নে তোর গিটার। বাজিয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ কর। গিটার বাজালে তো আবার তোর রাগ পানি হয়ে যায়।’
মাইজিন গিটার হাতে নিয়ে টুংটাং শব্দ তুললো গিটারে। এক সময় এই গিটার ছাড়া সে কিছু বুঝতো না। কিন্তু এখন এই গিটার তার থেকে অনেকটাই দূরে চলে গেছে। শখের গিটার এখন সেভাবে বাজানো হয় না আর। মাইজিন জোর গলায় গান ধরলো।

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৮

❝তুমি না ডাকলে আসবো না
কাছে না এসে ভালোবাসবো না
দুরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়?
না কি চলে যাওয়ার বাহানা বানায়?
দূরের আকাশ নীল থেকে লাল
গল্পটা পুরনো!
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি,
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি!❞

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ২০