হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৮

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৮
রাউফুন

ঝুম বৃষ্টি। সময়টা বর্ষাকাল। বৃষ্টির দাপটে রাস্তা ঘাট কাদায় চিপচিপে হয়ে থাকে। যাকে বলে কাদায় মাখামাখি অবস্থা। একদিন এমনই এক ঝুম বৃষ্টির দিনে মাইজিন হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি আসে। নিজের কাছে থাকা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজার খুলে কোনো রকমে ভেতরে প্রবেশ করলো। তুলিকা তখন শুয়ে আছে আর বিভোর হয়ে মাইজিনের কথায় ভাবছে। সে তার ভাবনায় এতোটাই মত্ত যে দরজা খোলার শব্দ অব্দি তার কানে যায়নি। মিষ্টি স্কুল থেকে ফিরে ফ্রেশ হচ্ছে।

এদিকে মাইজিন থরথর করে কাঁপছে অনেকক্ষন বৃষ্টিতে ভেজার ফলে। যখন মাইজিন ধপাস করে ফ্লোরে পরে যায় তখনই সেই শব্দে তার ধ্যান ভাঙে। তুলিকা তাকে দেখতে পেয়ে অস্থির চিত্তে উঠে গিয়ে মাইজিনকে তুলে ধরলো। মানুষটার প্রতি যতোই রাগ করে থাকুক না কেন তার এমন করুন অবস্থায় তো আর তাকে দূরে ঠেলে দেওয়ায় যায় না। দুই সপ্তাহ কে’টে যাওয়ার পর মানুষটাকে এমন অবস্থায় দেখতে পাবে ভাবতেই পারছে না সে। তুলিকা জোর গলায় উৎকন্ঠা নিয়ে ডাকলো মিষ্টিকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘এই মিষ্টি এদিকে আয়। তোর মাইজিন ভাইয়ার কিছু একটা হয়েছে! জলদি আয়।’
মিষ্টি ছুটে এলো মাইজিনের কথা শুনেই। তুলিকার দু চোখ ভরে কান্না এলো। মানুষটার একি করুন অবস্থা! তারা দুই বোন মাইজিনকে তুলে বিছানায় বসালো।
‘মিষ্টি চুলায় সরিষার তেল আর কয়েকটা গোটা রসুন, কালো জিড়া আছে তা দিয়ে তেল গরম কর। আমি উনার ভেজা পোশাক বদলে দিচ্ছি। যাহ দ্রুত।’

‘আচ্ছা বুবুজান। ভাইয়ার এমন অবস্থা কেন? এই বিকেল বেলায় কোথায় থেকে এলো এমন কাকভেজা হয়ে?’
‘জানি না মিষ্টি। তুই দেরি করিস না যা বললাম তাই কর।’
মাইজিনের জ্ঞান ফিরেনি। তুলিকা জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা চালালো কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না। ভেজা শার্ট-প্যান্ট বদলে দিলো তুলিকা নিজেই। কিছু করার নেই এখন। মাইজিন সেই অবস্থায় নেই যে নিজের পোশাক নিজেই বদলে নেবে। শুকনো কাপড় পরিয়ে দিতেই কম্বল চাপিয়ে দিলো মাইজিনের গায়ে।

উষ্ণ অনুভব হতেই কিছুক্ষনের মধ্যেই জ্ঞান ফিরলো মাইজিনের। তুলিকা মাইজিনের বুকে, পায়ে গরম তেল দিয়ে দিলো। কালো জিরা আর রসুন মাইজিনের মুখে দিয়ে খেতে বললো। মাইজিন আবছা চোখে তুলিকাকে দেখছে। তার জন্য এখনো কতটা অস্থিরতা মেয়েটার মধ্যে। মাইজিনের যখন পুরোপুরি জ্ঞান আসলো তখন তাকে গরম চা খাওয়ালো তুলিকা। এতে করে মাইজিন খুব আরাম বোধ করলো। মাইজিন নিরবতা ভেঙে ভাঙা গলায় প্রথমে কথা বলে,

‘এতো কিছুর পরেও আপনি আমাকে নিয়ে এতোটা চিন্তিত তুলিকা? সেবা যত্ম করে সুস্থ করে তুলছেন।’
‘সর্ব প্রথমে আমি মানুষ একজন মানুষ। এজ আ’ হিউম্যান বিং আমি মনে করি একজন অসুস্থ মানুষের সেবা করাটা দায়িত্বের মধ্যেই পরে।’
‘ওহ! তাহলে বলছেন শুধুই দায়িত্ব পালন করছেন আপনি?’
‘হুম!’
‘আমার উপর খুব অভিমান জমেছে তাই না?’

‘রাগ ও অভিমান প্রায়ই আমাদের প্রিয় মানুষের কাছ থেকে আমাদের দুরে ঠেলে দেয়। আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হচ্ছে সেটা। অতিরিক্ত যেকোন কিছু পতন নিয়ে আসে। সবকিছু তাই নির্দিষ্ট সীমায় রাখাই শ্রেয় তাই না?’
‘তাহলে ধরেই নিচ্ছি আমি আপনার প্রিয় মানুষ!’
‘এখানে প্রিয় অপ্রিয়র কোনো কথা নেই। এতো দিন পর ফিরে এসে এখন আবার ঢং শুরু করেছেন কেন? এসব নাটক কিন্তু আমি বর্দাস্ত করবো না। অসুস্থ বলেই যে ছাড় পাবেন সেটা একদম ভাববেন না। আপনি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন সেসব ভুলে যায়নি কিন্তু!’

‘আপনার রাগ, অভিমানের জন্য হয়তো কেউ আপনাকে শাস্তি দেবে না। কিন্তু আপনার রাগ, অভিমানই যে আমাকে তিলে তিলে শাস্তি দেবে! আমি জানি আপনার আমার উপর অভিমান করাটা স্বাভাবিক! আমি যা করেছি আমার প্রতি আপনার এই অভিমান অনুচিত নয়। সম্পুর্ন অধিকার আছে আপনার। কিন্তু আপনার মনে হয় আমি এগুলো সব কিছু ইচ্ছে করে করেছি? তুলিকা আরও পনেরো দিন কে’টে গেছে। আমি আজ সুযোগ পেয়েছি তাই আপনার কাছে ছুটে এসেছি।’
‘কেন এলেন বলুন তো? আর আপনার এরকম অবস্থায় বা কেন?’

‘মানব হৃদয় আয়নার মত। সে আয়নায় ভালোবাসার আলো পরলে তো ফিরে আসবোই। আপনি না আমাকে অনেক ভালোবাসেন হেহেহেহে আমি জানি। আপনি চাইলেও বাঁধা দিতে পারবেন না আমার এখানে আসাটা। আমি আর কক্ষনো আপনাকে ছেড়ে যাবো না। এই কান ধরছি। আপনি চাইলে আপনার পা ও ধরতে পারি হাহাহাহ! আমি আপনার কাছেই থাকবো। একদম চিপকে চিপকে থাকবো হ্যাঁ? এই আপনার মনে আছে আপনি আমাকে অনুমতি দিয়েছিলেন আপনাকে স্পর্শ করার! আমি কিন্তু এখন আপনাকে স্পর্শ করবো। একদম কাছ ছাড়া করবো না আপনার। একদম জাপটে ধরে থাকবো।’

তুলিকা নিশ্চুপ হয়ে গেলো মাইজিনের এক সাথে বলা এতো গুলো কথায়। কেমন অদ্ভুত ঠেকছে মাইজিনের হাবভাব। মানুষ টা এমন পাগলের প্রলাপ কেন বকছে? তুলিকা সত্যিই মাইজিনকে এখানে আসতে বাঁধা দিতে পারবে না। কারণ সেই তো এই বাড়িটা ভাড়া নিয়েছে। মাইজিন আলতোভাবে চোখ বন্ধ করে কাঁপছে একাধারে। আবার চোখ খুলে তার দিকে তাকাতেই তুলিকা দেখলো মাইজিনের চোখ মুখ অস্বাভাবিক ভাবে পাংশুটে হয়ে গেছে।

শরীর কেমন জোরদমে কাঁপছে। মাইজিন জ্বরের ঘোরে আবোল তাবোল বকঁছিলো এতক্ষণ বুঝতে পারলো তুলিকা। চুপ থাকা খুব সহজ একটা কাজ। পারষ্পরিক বহু সমস্যার সমাধান শুধু চুপ থাকলেই হয়ে যায়। কিন্তু মানুষের সবচেয়ে বড় অযোগ্যাতা হচ্ছে সে মুখ বন্ধই রাখতে পারে না। অপ্রয়োজনে অনর্গল বকে যায়। এই অসুস্থ অবস্থায় চুপচাপ মাইজিন অনর্গল একটার পর একটা কথা বলেই যাচ্ছে। জ্বরের ঘোরে যত কথা আছে সব বলে যাচ্ছে মাইজিন।একেকজনের অসুস্থতা একেক ধরনের। মাইজিন অসুস্থ হলে বোধহয় বেশি কথা বলে।

মিষ্টিই আজকে রাতের রান্নাটা সারলো। কারণ মাইজিন তুলিকাকে কাছ ছাড়া করছেই না। হাত শক্ত করে ধরে আছে। মাইজিনকে রাতের খাবার খাইয়ে দিয়ে কোনো রকমে জ্বরের ওষুধ খাওয়ালো সে। মিষ্টির আজ বেশ কষ্ট হয়েছে একা একা কাজ করতে। সে বুঝতে পারলো একা একা কাজ করাটা কতটা কষ্টের৷ অথচ তার বুবুজান এতোদিন একাই কাজ করেছে। সে মনে মনে ঠিক করলো এরপর যতটা পারবে সে তার বুবুজানকে কাজে সাহায্য করবে।
রাত যখন দশটা তখন আশফির কল এলো। তুলিকা কল রিসিভ করেই বললো,’আজ মাইজিন হঠাৎ করেই এভাবে ফিরে এসেছে? আর কি সব আবোল তাবোল বকে যাচ্ছে।’

মাইজিন কিভাবে এলো তার সব কিছু বললো আশফিকে। সবটা শুনার পর আশফি বললো,
‘কি বলছিস। এটা তো খুব খুশির খবর। আগে কেন কল করিস নি? আমি জানতাম মাইজিন ভাইয়া একদিন ঠিক আসবেই। তুই প্লিজ মাইজিন ভাইয়াকে দূরে সরিয়ে রাখিস না এবারে। নিশ্চয়ই তোর ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পেরেই ছুটে এসেছে অসুস্থ অবস্থায়। দেখ মানুষ অসুস্থ অবস্থায় কিন্তু তার কাছের মানুষকেই স্মরণ করে সবার প্রথমে।’

‘যে মানুষ টার জন্য আমি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো নিশব্দে কেঁদেছি তাকে আমি কখনোই মানবো না। আমার জীবনে ফিরে আসুক এটা আমি চাই না। আমি তাকে এতো সহজেই গ্রহণ করতে পারবো না আশু। আমি এতোটাও উদার নয়।’
‘দেখ তুলি আমি মানছি মাইজিন ভাইয়া ভুল করেছে কিন্তু সেটারও নিশ্চয়ই কারণ আছে৷ তুই সেই কারণ টা কেন শুনছিস না?’

‘তিনি অসুস্থ। তার কাছ থেকে এখন আমি কিভাবে শুনবো সবকিছু? শোন আশু প্রতিজ্ঞা করার আগে একটু হলেও ভাবা উচিত। কাউকে মিথ্যা দিয়ে হাসানোর চেয়ে সত্য বলে কাঁদানোই শ্রেয়। সে আমাকে আগের মতো মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে না এখন কে বলতে পারে?’
‘জানি না আমি কিছুই। তবে আমার মনে হচ্ছে মাইজিন ভাইয়ার আরেকটা সুযোগ পাওয়ার অধিকার আছে। সেও মানুষ, তার ভুল ভ্রান্তি হবে এটা স্বাভাবিক!’

‘তোর কাছে স্বাভাবিক হলেও আমি সবটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছি না।’
‘আচ্ছা নিতে হবে না। আচ্ছা একটা কথা বলবি? কেউই কি নিজের গায়ে নিজে ওতোটা বা’জে ভাবে আঘাত করতে পারে? তুই বলেছিলি মাইজিনের শরীরে অগণিত দাগ। তবে সেটা কিভাবে হলো? দেখ আমার মনে হয় তোর মাইজিন ভাইয়ার সঙ্গে থেকে এসব বিষয় খুতিয়ে দেখা উচিত।’
‘আচ্ছা আমি দেখবো খুতিয়ে। সে সুস্থ হোক আগে।’

‘হুম তার কথা আগে শুনে নে। তার প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগে চিন্তা কর। সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত ধৈর্য্য ধর। প্রার্থনা কর আল্লাহর কাছে।’
‘আচ্ছা রাখছি।’

কল কেটে দিয়ে তুলিকা মাইজিনের কাছেই বসে রইলো এক ভাবে। বেঘোরে ঘুমোচ্ছে মানুষটা। মৃদু নাক ডাকার শব্দ পেলো সে। অতিরিক্ত জ্বর আর ক্লান্তি থেকেই মাইজিন নাক ডাকছে। অদ্ভুত শব্দ তবে সহনীয়। তুলিকা মাইজিনের মুখের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো শুধু। মানুষটা কি অনেক বেশি শুকিয়ে গেছে? মুখটা বেজায় শুকনো লাগছে আহারে। মনে হচ্ছে কতদিন নিশ্চিন্তে ঘুমাইনি। বড্ড মায়া হলো তার। এমনিতেই সে যতই বিরাগী হোক না কেন। মানুষটাকে তো সে মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসে।

এই মানুষ টার কষ্ট তো তারও সম যন্ত্রণার। সে আলতো ভাবে মাইজিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। মাইজিন নড়েচড়ে তুলিকার কোমড় পেঁচিয়ে ধরলো। কোমড় পেঁচিয়ে ধরে মাথাও এগিয়ে নিলো। এরপর কামিজের উপর দিয়েই তার ঘ্রান্দ্রেয়ীও ঘষলো। অস্বস্তিতে কুকড়ে গেলো তুলিকা। ওভাবেই বিমুঢ় হয়ে বসে বসে বিরবির করলো, ‘হুসে নেই কিন্তু ঠিকই স্পর্শ করছে। অসভ্য বদলোক। সব ছোঁয়ার ধান্দা!’
তুলিকা জোরদার নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। এভাবে আরেকটু থাকলেই দম বন্ধ হয়ে আসবে তার। তম্বন্ধে মাইজিন বললো,

‘আপনার রাগ, আপনার অভিমানে নাক ফুলানো আমার শিরার কোণে যে শিহরন তুলে তুলিকা। আপনার সুন্দর গোলাপি ঠোঁটে কল্পনায় কতবার আমার ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিয়েছি। আমার স্পন্দনে, আমার নিঃশ্বাসে বিদ্ধ আপনার মন! চাইলেই আপনি আমার থেকে দূরে যেতে পারবেনা না তুলিকা।’

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৭

‘একদম আমাকে পটানোর চেষ্টা করবেন না। এতো সহজে বরফ গলছে না।’
‘বরফ কিন্তু সহজেই গলে। আপনার মতো চালাকচতুর মানুষের মুখে এমন বোকা বোকা কথা মানাচ্ছে না।’
‘এই ছাড়ুন তো মশাই! যত্তসব!’
‘লাইসেন্স যখন পেয়েছি তখন একটা চুমু দিবো?’

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৯