হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৭

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৭
রাউফুন

মাইজিনের হাতে আর ঘাড়ে অসংখ্য কা’টা, আউড়, পো’ড়ার দাগ। যা তার লাল ফর্সা শরীরে ভীষণ বিচ্ছিরি লাগছে। মাইজিন হইতো সেই দাগ গুলো ঢাকার জন্যই কালো হুডি পরে বের হতো। তার এমন দাগ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সেগুলো মা’রের দাগ। মনে হচ্ছে কেউ ব্লে’ড দিয়ে আঁচড়েছে।

ফালা ফালা করেছে ভীষণ নৃশংস ভাবে। তুলিকা সটান হয়ে দাঁড়িয়ে খুবই অস্থির হয়ে মাইজিনের খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে কা’টা, পো’ড়া যুক্ত হাত, ঘা’ড় আলতো ভাবে বুলিয়ে দিচ্ছিলো। মাইজিনের এতো এতো আঘাত এর চিহ্ন দেখে তার ভেতরটা তোলপাড় চলছে। মাইজিনের সাদা টিশার্ট পেট থেকে উঠিয়ে হুরমুর করে দেখলো তুলিকা। মাইজিন বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও পারছে না। যেনো এই মেয়েটার গায়ে অনেক জোর। হঠাৎ করে এতোটা জোর এলো কোথা থেকে এই পা’ট কা’ঠির মতো শরীরে?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘আপনার হাতে ঘা’ড়ে সারা শরীরে এতো দাগ, এগুলো কিভাবে কে’টেছে? আপনি এই জন্য এমন করছিলেন তাই না? কে এভাবে আমার মাইজিনকে আঘাত দিয়েছে? কে বলুন!’
হাত ঝামটি দিয়ে তুলিকাকে আবার সরিয়ে দিলো মাইজিন। তুলিকার গা থেকে নিজের কালো হুডি নিয়ে নিজের গায়ে গলিয়ে নিলো। চোখ রাঙিয়ে বললো,

‘এই মেয়ে তোমাকে যেতে বলছি কথা কানে যায় না? দশ মিনিট তোমার হাতে। এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাবে না হলে তুমি জানো না কত বড় বিপদ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে৷ নাউ গেট আউট!’
নির্লজ্জতার শেষ সীমা পেরিয়ে তুলিকা আবার মাইজিনকে জাপটে ধরলো। দুই হাতে মাইজিনের চিবুক আগলে বলল,
‘কেন এমন করছেন মাইজিন? আপনি তো আমাকে কতটা ভালোবাসেন বলুন? আপনি ছাড়া আমি যে ভালো নেই মাইজিন। আমিও যে আপনাকে অনেকটা ভালোবেসে ফেলেছি। আমি তো আপনার বউ বলুন?

আমি, আমি আপনার করা ছোট্ট ছোট্ট যত্ন গুলোকে যে খুব মিস করছি। রোজ অফিস থেকে এসে আমার সঙ্গে রান্না করেন, আমি বারণ করলেও শুনেন না। কত খুনসুটি আপনার আর আমার। সবকিছুই যে আমি বড্ড মিস করছি মাইজিন। আবার সব কিছু আগের মতো করে নিন না মাইজিন। প্লিজ! আমাকে এভাবে বার বার দূরে ঠেলে দেবেন না। প্লিজ! এই মাইজিন আপনি, আপনি তো আমার কান্না দেখতে পারেন না৷ সহ্য হয় না আমার চোখের পানি৷ এই দেখুন আমি কাঁদছি। কতো কাঁন্না করছি মুছে দিন না আমার চোখ। মুছে দিন আমার চোখ আপনার নিজের হাতে।’

মাইজিনের মধ্যে নিস্তব্ধতা, জড়বস্তু, পাথরের মতো দাঁড়িয়ে তুলিকার পা’গ’লামো সহ্য করে যাচ্ছে। সে ভেবেছিলো তুলিকাকে আর কোনো কঠিন কথা শুনাবে না। কিন্তু এখন তো থামছেই না মেয়েটা। ক’টা কড়া কথা না বললে মেয়েটাকে এখান থেকে বের করা যাবে না। তাই বাধ্যতামূলক তাকে চড়াও হতে হচ্ছে।
‘ওহ আপনি তো আমাকে আমার অনুমতি ব্যাতিত স্পর্শ করবেন না। এই যে আমি অনুমতি দিচ্ছি। আপনি আমার চোখ মুছে দিন৷ মুছে দিন।’ তুলিকা মাইজিনের দুই হাত দিয়ে নিজের গাল স্পর্শ করিয়ে নিজেই নিজের কপলে লেপ্টে থাকা নোনা পানি মুছে দিতে লাগলো।
‘আমার সামনে এভাবে কা’দবেন না!’

তুলিকা চোখে পানি কিন্তু সারা মুখে খুশি ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে। সে ভাবছে মাইজিন বোধহয় এবারে স্বাভাবিক হবে। তাকে আগলে নেবে। কিন্তু তার ধারণাকে ভুল করে দিয়ে আরও কিছু তিক্ত বাক্য ছুড়লো,
‘এসব ন্যাকা কান্না আমার সহ্য হচ্ছে না। লজ্জা করছে না একজন পুরুষের গায়ে এভাবে ঢলে ঢলে পরছো? মিনিমাম লজ্জাবোধ নেই তোমার হ্যাঁ মেয়ে? ছিঃ তোমাকে দয়া করে বিয়ে করেছি, একটা বাড়িতে থাকতে দিয়েছি, সুখে দিন কা’টাচ্ছো, এই কি যথেষ্ট নয়? এখন এসে আমার সঙ্গে চিপকে চিপকে যাচ্ছো? লোভী মেয়ে মানুষ কোথাকারের। আর হ্যাঁ দ্বিতীয় দিন তুমি আমার পিছু নেওয়ার চেষ্টাও করবে না। ফলটা খুবই খারাপ হবে তবে।’

তুলিকা মাইজিনের নিষ্ঠুরতম বানী শুনে থমকে গেলো মুহুর্তের মধ্যে। চারদিকে কেমন ভনভন করছে। মনে হচ্ছে সে ভুল শুনছে। সারা শরীরের শিরা উপশিরায় ঠান্ডা রক্তের শ্রোত বয়ে যাচ্ছে। মাইজিনের কঠিন বাক্যের কোনো কথায় কানে যাচ্ছে না তার। সে আবারও বেহায়ার মতো মাইজিন কে দুই হাতে আঁকড়ে ধরলো। শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মাইজিনের ঘাড়ের সমস্ত ক্ষত স্থানে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো।

তার এমন উম্মাদনা, এমন উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণে মাইজিনের ভেতর টা জ্বলে যাচ্ছে। সে না পারছে সইতে না পারছে কিছু বলতে। এমনিতেই সে তুলিকাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। মেয়েটা একটার পর একটা ধাক্কা সহ্য করার ক্ষমতা রাখতে পারবে না। মাইজিন নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো রকম বাক্য ব্যয় না করে তুলিকাকে টেনে হেচড়ে গেটের বাইরে বের করে দিলো। তুলিকাকে সোজা একটা অটোতে তুলে দিয়ে মাইজিন ভাড়া দিয়ে দিলো। নির্দিষ্ট ঠিকানায় নিয়ে নামিয়ে দিতে বললো।

‘শুনুন এই আপার মাথায় প্রব্লেম আছে। যা কিছুই হয়ে যাক তাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। জিজ্ঞেস করলেই খুব জোরদার ধুমধামে হাত চালাই। একেবারে আমার বলা ঠিকানায় নামবেন। তাছাড়া কোনো স্থানে থামবেন না!’
‘আচ্ছা ভাইয়া।’ ভয়ে ভয়ে বললো অটোওয়ালা।

তুলিকা স্তব্ধ, নিস্তেজ হয়ে বসে রইলো শুধু। মাইজিন এতোটা নিষ্ঠরতা দেখালো তার সাথে? মাইজিন? সে অটো চলতেই সে অটোর মধ্যেই উদ্ভ্রান্তের মতো গলা চিড়ে চিৎকার করে কান্না করতে লাগলো৷ কান্নার দাপটের সাথে সাথে আবোলতাবোল বকে যাচ্ছে সমান তালে। অটোওয়ালা হতচকিত হয়ে তাকিয়ে দেখলো সবটা। কিছু বলার সাহস পেলো না। সে ভেবেই নিলো মেয়েটাকে ভু’তে পেয়েছে।

বাড়িতে গিয়েই তুলিকা তার সেই আগের জামাটা পরে নিলো। মিষ্টিকেও নুশাদের ঘর থেকে টেনে আনলো৷ ঘর তালা দিয়ে যখন হন্তদন্ত হয়ে মিষ্টিকে নিয়ে নামছিলো মিষ্টি অনবরত প্রশ্ন করেই যাচ্ছিলো।
‘কি হইছে বুবুজান। আমারে এইভাবে টাইনা কই নিয়া যাইতাছো? আমারে ছাইড়া দাও। এই রাতের বেলায় কই যামু আমরা?’

‘আমাকে কোনো প্রশ্ন করিস না মিষ্টি। আমরা কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি তা আমি নিজেও জানি না। তবে এই বাড়িতে আমরা আর থাকবো না।’
‘কিন্তু আমরা এইহানে না থাকলে কই যামু? আমাগোর তো বাড়িও নাই। রাস্তায় থাকুম নাকি?’
‘একি ভাবি? আপনারা দুই বোন এমনভাবে এই রাতের বেলায় কোথায় যাচ্ছেন? কোনো বাজার লাগবে? তাহলে আমাকে দিন আমি এনে দিচ্ছি!’ মাইজিনের বন্ধু নাফিজ বললো। এই বাড়িওয়ালার মালিকের ছেলে।

‘নাহ নাফিজ ভাইয়া। আমরা এক্ষুনি এই মুহুর্তে এখান থেকে চলে যাচ্ছি। এই নিন আপনাদের ঘরের চাবি!’
‘সেকি কথা ভাবি! এভাবে তো আপনারা এই বাড়ি থেকে যেতে পারবেন না। আপনাদের এখানেই থাকা লাগবে।’
‘আপনার বন্ধুকে বলে দিবেন আমরা আর এখানে থাকবো না। তার অনেক দয়ার শরীর। তাই আমাদের দুই বোনকে দয়া করে এখানে থাকতে দিয়েছিলো। কিন্তু এখন আর তার দয়া আমাদের চাই না।’

‘ভাবি, ভাবি দাঁড়ান। আমার কথা শুনুন। আপনারা এক্ষুনি ঘরে যাবেন। আর হ্যাঁ আমাদের বাড়িটা মানে আপনারা যে রুম গুলো ভাড়া নিয়েছেন তা কন্ট্রাক্ট পেপারে সাইন করে নিয়েছেন। এক বছর এর আগে এই বাড়ি থেকে আপনারা কেউ-ই কোথাও যেতে পারবেন না। আর আমরাও এক বছর এর ভাড়া পেয়ে গেছি। তাই যেতে দিতে পারছি না।’
‘এই বাড়ি যিনি ভাড়া নিয়েছেন তাকেই বলুন এখানে এসে থাকতে।’

‘আপনারা যেতেই পারবেন না। কারণ আমরা আপনাকেই ভাড়া দিয়েছি বাড়ি। ওই কন্ট্রাক্ট পেপারে আপনার নামেই ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সো আপনারা বাধ্য এখানে থাকতে।’
দাঁতে দাঁত চেপে বাধ্য হয়ে তুলিকা আর মিষ্টি ঘরে গেলো আবারও।
রুমে গিয়ে পাগলের মতো আচরণ করতে লাগলো তুলিকা। মিষ্টি ভয়ে আঁতকে উঠলো নিজের বোনের এমন অবস্থা দেখে। তুলিকা মাইজিনের দেওয়া সমস্ত ড্রেস বের করে গায়ের জোরে টেনে টেনে ছেড়ার চেষ্টা করলো। কোনো কা’চি না পেয়ে বটি নিয়ে এলো সে। নিজের বোনের হাতে ব’টি দেখতেই মিষ্টি শিউরে উঠে।

‘এইইই বু-বুবু-জান ওটা কেন এনেছো? ওটা রাখো। ওটা রাখো বুবুজান। হাত কা’টবে কিন্তু। ফেলে দাও বলছি।’
তুলিকা কোনো কথায় কানে তুললো না মিষ্টির। ধপ করে বসে মাইজিনের দেওয়া সমস্ত পোশাক কু’চি কু’চি করে কা’টলো। কেন এমন আচরণ করলো সে নিজেও জানে। শুধু জানে এখন তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। এক সময় সে থেমে গেলো। মিষ্টি দুই হাতে মুখ চে’পে ধরে কান্না করছে। তার বুবুর এরকম অস্বাভাবিক আচরণে ভয়ে গুটিয়ে গেছে সে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে তার। হঠাৎই তুলিকা মিষ্টিকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁন্না করলো। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে আর বলছে,

‘আমাদের সঙ্গেই কেন এমন হচ্ছে বলতে পারবি বোন? প্রথমে আল্লাহ আমাদের বাবা-মাকে কে’ড়ে নিয়ে আমাদেরকে এতিম করে দিলেন। মাথার উপর থেকে ছাদ কেড়ে নিলেন। কারোর কাছেই ঠাই হলো না আমাদের দুই বোনের। ছোট বেলা থেকেই তো কষ্ট সহ্য করে আসছি বল। আর পারছি না আমি সইতে।আর কতো সইবো বলতে পারিস? এতো যন্ত্রণা যে আর নিতে পারছি না আমি। সবে একটু সুখের মুখ দেখেছিলাম সেটাও যে আর রইলো না।

সেও যে দয়া দেখালো আমাদের। যে মানুষটাকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসলাম সেই মানুষটাও যে রাতারাতি বদলে গেলো। সুখ বলে হইতো কোনো কিছু আমাদের কপালে নেইরে মিষ্টি। তা না হলে বলতো আমাদের সাথেই কেন এমন হচ্ছে? কেন? কেন?’

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৬

দুই বোন দুজনকে জড়িয়ে ধরে নিজেদের চরম বিষাদকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। কাঁন্না ছাড়া যেনো কোনো কিছুই তাদের কপালে লিখেন নি সৃষ্টিকর্তা। মিষ্টি তার বুবুকে শান্ত করার ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছে।

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৮