প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সারপ্রাইজ পর্ব

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সারপ্রাইজ পর্ব
Writer Mahfuza Akter

‘অরিত্রী সেহরীশ’ থেকে ‘তরী’ হয়ে ওঠার গল্পটাই আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে জীবন বৈচিত্র্যময়! সময়ের চাকা যত দ্রুত ঘোরে, তার থেকে কয়েক গুণ কম বা বেশি তাড়াতাড়ি জীবনের মুহূর্তগুলো আবর্তিত হয়। সেই মুহুর্তগুলো আমাদের কিছু শিখিয়ে দিয়ে যায়, কিছু কেড়ে নিয়ে যায় আবার জীবনে অতি আকাঙ্ক্ষিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু সংযোগও ঘটায়।

সে যা-ই হোক! আমার কাছে জীবনের মানেটা কিছুটা অন্যরকম। জীবন আমাকে নিজের মধ্যে ভিন্ন এবং পুরোপুরি বিপরীতধর্মী দু’টো সত্তাকে ধারণ করতে শিখিয়েছে। যেখানে অরিত্রী ছিল এক আদুরে, নাজুক এবং উচ্ছ্বল সত্তা, অন্যদিকে তরী ছিল সাধারণ ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ এক বাক-প্রতিবন্ধী নারীসত্তার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক প্রতিশোধস্পৃহ মানবী। অরিত্রী হাসতে শিখেছিল, তরী হাসতে ভুলেছে! অরিত্রী কাঁদতে শিখেছিল, তরী কাঁদতে ভুলেছে! অরিত্রীর মন কোমল ছিল, আর সেই কোমল হৃদয় আঘাতে জর্জরিত হয়ে তরীর পাথর-তুল্য হৃদযন্ত্রে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। অরিত্রী ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল, আর তরী দুমড়ে-মুচড়ে গেলেও ভেঙে পড়েনি কোনোদিন!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অরিত্রীর জীবন তো তার মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথেই সমাপ্ত হয়েছিল। কিন্তু সেই উপসংহারেই ঘটেছিল নতুন সূচনা। একজন স্বাভাবিক এবং বুঝদার মানুষের কাছে তার মায়ের মৃত্যু কতটা কষ্টকর আমার জানা নেই। কিন্তু একটা অবুঝ বাচ্চার নিজের চোখের সামনে তার মায়ের খু*ন, সেই খুন আবার তার বাবার হাতে আর পরিশেষে তার মায়ের পু*ড়*তে থাকা দেহ এবং তীব্র বেদনার হাহাকার ও আর্তনাদ সেই বাচ্চাটাকে ঠিক কতটা নাড়িয়ে তুলতে পারে, সেটা আমি বুঝেছি। নিজেকে অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া কিছু মনে হয়েছিল। ভেতরে ভেতরে তো সেদিনই মরে গিয়েছিলাম! আর সেই মৃতের ভেতরই জন্ম নিয়েছিল প্রতিশোধপরায়ণ এক সত্তা! তরী!!

ভাবনায় এতোটাই মগ্ন ছিলাম যে, টেরই পাইনি হঠাৎ কেউ একজন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে অনুভব করার আগেই সে আমার চোখ আগলে ধরলো। তার স্পষ্ট যে আমার চিরচেনা! কীভাবে ভুল করতে পারি তাকে চিনতে?
“সৌহার্দ্য!”

সে চোখ ছেড়ে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। চোখে মুখে প্রচন্ড বিরক্তি স্পষ্ট! আমি সেটা লক্ষ করে ভ্রু নাচালাম,
“কী হলো? মুখের এই অবস্থা বানিয়ে রেখেছো কেন?”
“তুমি প্রত্যেকবার বুঝে ফেলো!” সৌহার্দ্য ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ঘামে তার কালো শার্টটা গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। কপালের পাশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানিগুলো জানান দিচ্ছে, সে কতটা ক্লান্ত! শুভ্র-সুন্দর মুখটা লাল হয়ে গেছে। কপাল আপনা-আপনিই কুঁচকে গেল আমার,

“তোমার এই অবস্থা কেন?”
“রিকশায় এসেছি।” বলেই সৌহার্দ্য বিছানায় গিয়ে বসলো।
“এই কাঠফাটা রোদে রিকশায় কেন? গাড়ির কী হয়েছে?”
“প্রণয়-প্রণয়ীর স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছি। ওদের স্কুলের রাস্তা একদম উল্টো দিকে। সকাল থেকে দু’টো কমপ্লিকেটেড সার্জারি করে ক্লান্ত লাগছে প্রচুর। তাই আর যাইনি!”

“আচ্ছা!”
“তুমি কী ভাবছিলে এতোক্ষণ? সেই কখন এসেছি আমি! তুমি তো টেরই পাওনি বোধ হয়! কোনো অন্য রাজ্যে ছিলে মনে হচ্ছিল।”
আমি মৃদু হেসে বললাম, “আমার ভাবনার রাজ্যে কোনো কিছুর অভাব নেই।”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকালো, “অতীতের মাঝে এতো ডুব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে?”
“নেই?”

আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বেশ শান্ত গলায় বললো,
“আমাদের জীবনের যতটুকু সময় কেটেছে, তার মধ্যে আমাদের কাছাকাছি থাকার চেয়ে দুরত্বে থাকার পরিমাণটাই বেশি। পরিস্থিতি আমাদের অদ্ভুত আর জটিল পরীক্ষায় ফেলেছে সবসময়। সেই দুঃসময়ের কথা ভেবে আমাদের বর্তমানের এই সুন্দর জীবনে আর কষ্টের রেশ এনো না।”

সৌহার্দ্য আমার কপালের মধ্যখানে ওষ্ঠের গভীর স্পর্শ এঁকে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। সৌহার্দ্যের কথায় ভেতরে একটা অদ্ভুত স্বস্তি অনুভব হলো।
এক বছর আগেও ভাবতে পারিনি যে, সৌহার্দ্যের পাহাড়সম অভিমান গলে আবার আগের মতো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাবো। তখন সৌহার্দ্যের দৃষ্টিতে নিজেকে অপরিচিত মনে হতো। সৌহার্দ্য বারবার আমায় এড়িয়ে গেলেও আমি বারবার ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম। এমন করেই মান-অভিমানে কাটছিলো আমাদের দিন!

এক রাতে সৌহার্দ্যের টেবিলে সিগারেটের প্যাকেট দেখে অবাক হয়েছিলাম। আমি থাকতে তো সে সিগারেটের অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছিল! তাহলে এটা এখানে কেন? আমার অনুপস্থিতিতে কি সৌহার্দ্য আবার……..
ভাবনার মাঝেই সৌহার্দ্য ঘরে এলো। আমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে ঘুমন্ত প্রণয়-প্রণয়ীর দিকে তাকালো। সৌহার্দ্য বিছানার দিকে এক পা এগোতেই আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সৌহার্দ্য আমার দিকে গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো,

“রোজ রোজ তোমার এই পথ আগলে দাঁড়ানোর কাহিনী ভালো লাগে না। এখানে তুমি শুধুমাত্র প্রণয়-প্রণয়ীর মা হয়ে থাকছো, মিসেস সৌহার্দ্য রায়হান হয়ে না!”
আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম। সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে সৌহার্দ্য বারান্দার দিকে চলে গেল। চোখের কোণ ভিজে এলেও জল গড়িয়ে পড়তে দিলাম না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে তড়িৎ গতিতে সৌহার্দ্যের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। সৌহার্দ্য হাতে হাত ভাজ করে আকাশের গোলাকার চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার উপস্থিতি অনুভব করতেই সে বললো,

“আরো কিছু কড়া কথা শুনতে চলে এসেছো?”
“তুমি আবার সিগারেটের অভ্যাস করেছো?”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকালো। বললো, “মানে?”
আমি হাত এগিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা দেখালাম। সৌহার্দ্য সেটার দিকে একবার চেয়ে আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো,

“তোমার কী মনে হয়? আমি তোমার মতো? ড. সৌহার্দ্য রায়হান নিজের কথা রাখতে জানে! সময়ের সাথে সাথে নিজের মনকে বদলে ফেলে না। এটা প্রহর ফেলে গিয়েছিল আমার ঘরে। সবাইকে নিজের মতো ভাবো কেন তুমি?”
দাঁতে দাঁত চেপে তাকালাম। সৌহার্দ্য বারবার আমাকে অপমান করছে। কিছু বলছি না বলে ওর কড়া কথাও বন্ধ হচ্ছে না। নিতান্তই বাধ্য হয়ে বললাম,

“তোমার কি মনে হচ্ছে না যে, তুমি বাড়াবাড়ি করছো?”
“না, মনে হচ্ছে না।” সৌহার্দ্যের কাটকাট জবাব!
“তোমার অভিমান করা সাজে, আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু সবকিছুরই একটা লিমিট থাকে, সৌহার্দ্য! কেন এভাবে আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছো?”
শেষোক্ত বাক্যে কেমন যেন একটা কাতরতা বেরিয়ে এলো আমার কন্ঠ থেকে! সৌহার্দ্য আমার চোখের দিকে অদ্ভুত শীতল দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললো,

“ধৈর্য্যের পরীক্ষা? এটাকে তোমার পরীক্ষা মনে হয়? তাহলে আমার জন্য বিগত সাত-সাতটা বছর কী ছিল? একবার অনুভব করে দেখো তো! সদ্যোজাত দু’টো বাচ্চাকে আমি দু’হাতে সামলেছি। মা নই আমি ওদের। বাবা ছিলাম। মা আর বাবার মধ্যে অনেক পার্থক্য! মায়েরা যা পারে, বাবারা তা পারে না। কিন্তু আমাকে সবকিছু পারতে হয়েছে। একই সাথে বাবা আর মায়ের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। নিজের পেশা এবং সন্তানদের একসাথে সামলেছি আমি। সন্তানদের মায়ের অভাব পূরণের জন্য পুরুষেরা দ্বিতীয় বিয়ে করে।

সবাই আমাকে বারবার বলেছিল আবার বিয়ে করার জন্য। কিন্তু আমি? আমি তো অসহায় ছিলাম! তোমার জন্য আমার মনটা মারাত্মক অসহায় ছিল। হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে তুমি ছিলে। সেখানে আরেকটা রমণীকে স্থান দেওয়ার বিন্দুমাত্র জায়গা ছিল না। তাহলে কীভাবে আরেকজনকে বিয়ে করতাম আমি? অবিচার হতো না? বিগত সাতটা বছর আমার জন্য সংগ্রামের চেয়ে কম কিছু ছিল না! প্রতিটা মুহূর্তে তোমায় ভেবেছি, তোমার অনুপস্থিতি অনুভব করেছি। কিন্তু তুমি ছিলে না! তুমি তোমার ক্যারিয়ার গড়ায় ব্যস্ত ছিলে৷ আমার জীবন এলোমেলো করে দিয়ে তুমি নিজের জীবন সুন্দর করায় ব্যস্ত ছিলে। বাহ!”

সৌহার্দ্যের গলা কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। নিজের ভেতরে পুষে রাখা সব কথা যেন আজ সে প্রকাশ করে দিলো। গাল ভিজে গেছে আমার! গলাটা ধরে এলেও কোনো রকমে বললাম,
“তুমি আমাকে ভুল বুঝছো, সৌহার্দ্য! আমি জানতাম না যে…….”
কথা শেষ হওয়ার আগেই সৌহার্দ্য আমাকে থামিয়ে দিলো,
“হুশশ্!! মিথ্যে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। সব জানি আমি। অর্থী আমাকে সব বলেছে। স্মৃতি হারানোর নাটক করেছিলে তুমি। সব জেনেও ভুলে যাওয়ার ভান ধরে ছিলে এতো বছর।”
সৌহার্দ্যের দিকে অবাক চোখে তাকালাম। সে দৃষ্টি বরাবরের মতোই উপেক্ষা করে সৌহার্দ্য তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“কীভাবে পারো তুমি, তরী? তোমার জীবনে সিংহভাগ তো অভিনয় করেই কাটিয়ে দিয়েছো! কতগুলো বছর সমাজের মাঝে বোবা হওয়ার অভিনয় করলে! আবার এতোগুলো বছর স্মৃতি হারানোর নাটক? কীভাবে করলে তুমি?”
সৌহার্দ্যের প্রশ্নটা আমার অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দিলো যেন! মলিন হেসে বললাম,

“ঠিকই বলেছো তুমি! কিন্তু কথা না বলাটা কি সত্যিই অভিনয় ছিল? আমার তখনকার পরিস্থিতি তুমি অনুভব করতে পারো, সৌহার্দ্য? একটা অবুঝ বাচ্চার নিজের চোখের সামনে তার মায়ের খু*ন, সেই খুন আবার তার বাবার হাতে আর পরিশেষে তার মায়ের পু*ড়*তে থাকা দেহ এবং তীব্র বেদনার হাহাকার ও আর্তনাদ কল্পনা করতে পারো? কতটা মেন্টাল ট্রমার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম আমি! বাকশক্তি হারিয়েছিলাম সত্যি সত্যিই।

কথা বের হতো না আমার মুখ দিয়ে। মূর্তি হয়ে গিয়েছিলাম। কয়েক বছর লেগেছিল আমার স্বাভাবিক হতে। কথা বলাও শুরু করেছিলাম একটু একটু। কিন্তু সেটাও সবার চোখের আড়াল করার সিদ্ধান্ত নেয় আমার পালিত বাবা আর তোমার বাবা মিলে। যেমন চলছিল, তেমনটাই চলতে থাকে। শুধুমাত্র এই দু’টো মানুষের সাথেই কথা বলতাম আমি। নিজের বাবার কছে নাকি সন্তানেরা নিশ্চিন্তে আর নিরাপদে থাকে। আমার জীবন তো সেটার সম্পূর্ণ বিপরীতে ছিল! নিজের জীবন বাঁচাতে নিজের বাবার থেকে পালিয়ে পালিয়ে থেকেছি আমি!”

একটা বড় শ্বাস ফেললাম! বেশ ক্লান্ত লাগছিল। সৌহার্দ্য শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কেমন নিষ্পলক চাহনি! ঢোক গিলে আবারও বললাম,
“তুমি বললে না স্মৃতি হারানোর নাটক? সব কিছু তো সত্যি সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম আমি, সৌহার্দ্য! কয়েকমাস পরে ড্রাইভিং করার সময় মাথায় বেশ আঘাত লাগে। সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। সবাই ভেবেছিল এবার আমার সব স্মৃতি ফিরে আসবে। কিন্তু না, তারপরও আমার কিছু মনে পড়েনি।

সময়ের সাথে সাথে আমার মস্তিষ্ক সচল হতে থাকে। ধীরে ধীরে একটু একটু করে আমার স্মৃতি ফিরছিলো। ডক্টর ক্লারা বাদে আর কেউ সেটা জানতো না। তিনিই জানাননি কাউকে। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন আমার মা আর অর্ণব আমার ভালো করতে গিয়ে আমারই ক্ষতি করছিলো অবুঝের মতো। যখনই আমার প্রেগ্ন্যাসির কথা মনে পড়েছিলো, তখনই আমি খোঁজ নিয়েছিলাম। আজাদ চাচা আর তার স্ত্রীর নাম্বার টা একটা ডকুমেন্টের সফট কপিতে রেখে দিয়েছিলাম। যোগাযোগ করে জেনেছিলাম, আমার বাচ্চা দু’টো মারা গেছে। চাচী তোমায় ফোন করেছিল, সৌহার্দ্য! তুমিই বলেছিলে একথা।”

সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকালো। তার মনে পড়লো বেশ কয়েকবছর আগের কথা। প্রণয়-প্রণয়ীর তখন দেড় বছর। প্রণয় প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওকে আইসিইউ-তে ভর্তি করতে হয়েছিল। প্রচন্ড টেনশনে সৌহার্দ্যের তখন মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হসপিটালে বসেই প্রণয়ীকে নিজের কোলে ঘুম পাড়াচ্ছিল সৌহার্দ্য। এমনসময় আজাদের স্ত্রী কল করেন ওকে। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল তখন সৌহার্দ্য। রাগে-দুঃখে বলে ফেলেছিল এমন কথা। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো সৌহার্দ্য।

সৌহার্দ্যকে ভাবতে দেখে কিছুক্ষণ নীরব রইলাম আমি। তারপর পুনরায় বললাম,
“প্রচুর কেঁদেছিলাম সেদিন আমি, জানো? নিজের সন্তানদের মৃত্যুর জন্য তোমাকে দায়ী মনে হতো সবসময়। এজন্যই আর ফিরিনি।”

চোখের পানিগুলো মুছে সৌহার্দ্যের সামনে থেকে সরে এলাম। বুকের ভেতর কেমন যেন অদ্ভুত শীতলতা অনুভব করলাম! ঘরের ভেতর এসেও আবার পেছন ঘুরে এক পলক তাকালাম। আমায় ওভাবে তাকাতে দেখে সৌহার্দ্য ভুবন ভোলানো এক অপূর্ব হাসি দিলো। এরপর? এর পরের সময়গুলো তো পাহাড়সম অভিমান বরফের মতো গলে জল হওয়ার গল্প!
ভেবেই আনমনে হেসে ফেললাম। নিচ থেকে প্রণয়-প্রণয়ীর হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। দু’জন চলে এলেই পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে। ওদেরকে ঘরে নিয়ে এসেই দেখলাম, সৌহার্দ্য ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে নিজের চুল মুছছে।
দু’জনকে ওয়াশরুমে নিয়ে ফ্রেশ করাতে গিয়ে প্রতিদিনের মতো আজও হিমশিম খেতে হচ্ছে আমার। সৌহার্দ্য হাসতে হাসতে বললো,

“আজও শিখে উঠতে পারলে না? দেখি, বের হও!”
আমি বের হতেই সৌহার্দ্য কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রণয়-প্রণয়ীকে হাত-মুখ ধুইয়ে ফ্রেশ করিয়ে একদম রেডি করে দিলো। আমি হতাশ গলায় বললাম,
“তোমার আট বছরের অভ্যাস, আমার তো একবছরও হলো না!”

মধু এখনই বেরিয়ে যাবে নিজের চেম্বারের উদ্দেশ্যে। ব্যাগটা গোছাতেই প্রহরের ডাক পড়লো,
“মধু, ব্রেকফাস্ট রেডি। তাড়াতাড়ি এসো। লেইট হয়ে যাবে তোমার।”
মধু ডাইনিং রুমে এসে দেখলো প্রহর ব্রেডে বাটার লাগাচ্ছে। টেবিলের ওপর রাখা কফি মগ থেকে ধোয়া উড়ছে। এছাড়াও ডিম ভাজা আর ফ্রুটচার্ট বানিয়েছে তাড়াহুড়ো করে। মধু টেবিলে বসতে বসতে বললো,

“শুধু আমারই দেরী হচ্ছে? তোমার লেইট হচ্ছে না?”
প্রহর হেসে উঠে বললো,
“আমার জন্য তুমি সবার আগে। আমার নিজের থেকেও আগে!”
“এই চেহারায়ও?”

ব্রেডের ওপর ছুরি চালানো বন্ধ হয়ে গেল প্রহরের। কেমন অদ্ভুত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মধুর দিকে। হঠাৎই হাতের সবকিছু টেবিলের ওপর রেখে গটগট করে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে।
মধু কিছুক্ষণ বসে থেকে প্রহরের পিছু পিছু গেল। বারান্দার দোলনায় বসে সিগারেট টানছে প্রহর। মধু ওর পাশে বসলো। ইতস্তত করে বললো,

“রাগ করেছো?”
“কষ্ট পেয়েছি!”
“কেন?”
“কারণটা তোমার অজানা নয়, যদিও আমার অজানা।”
মধু কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। প্রহী পূর্ণ দৃষ্টিতে মধুর দিকে তাকালো। মধু দেখতে পেল, প্রহরের চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। মধু হালকা ঢোক গিললো। প্রহর কাতর কন্ঠে বললো,

“আমায় কষ্ট দিয়ে কী আনন্দ পাও তুমি?”
মধুর এক চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। ধরা গলায় বললো,
“যেটা সত্যি, সেটাই তো বলেছি আমি! সত্যিটা শুনতে কষ্ট হলেও সেটা তো বদলানো যাবে না!”
অকস্মাৎ প্রহর মধু দুই বাহু নিজের বলিষ্ঠ হাতে আঁকড়ে ধরে বললো,
“আমার কষ্টের চেয়ে সত্যিটা তোমার কাছে বেশি বড়? তাহলে কী চাও তুমি? তোমার এই চেহারার দোহাই দিয়ে তোমাকে ছেড়ে দেই?”

মধু টলমলে চোখে তাকালো। বললো,
“ছেড়ে দাও!!”
প্রহর মধুকে ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিলো। গাল চেপে ধরে বললো,

“কোনোদিনও না। অসম্ভব! তুমি না চাইলেও তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে। তোমার মনে আমার জন্য ভালোবাসা শেষ হয়ে গেলেও তুমি আমার হয়েই থাকবে। আমার ভালোবাসা যথেষ্ট আমাদের দু’জনের জন্য।”
প্রহর মধুকে ছেড়ে দিলো। নিজের চুল আঁকড়ে ধরে রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটলো। মধুর চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। হঠাৎ মধু প্রশ্ন করলো,

“এতো ভালো না বাসলেও পারতে!”
প্রহর অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“তুমি কেন বোঝো না আমায়? তোমার বেঁচে থাকাটাই আমার জন্য অনেক! তুমি যেমন আছো, যেভাবে আছো; আমার কাছে আছো, আমার হয়ে আছো।

তুমি না থাকলে তো মরেই যেতাম আমি! তোমায় বলেছি না? পৃথিবীর হাজারো মানবীর মাঝে আমার চোখ শুধু আমার মধুকেই খুঁজবে। তোমার এক চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে তো কী হয়েছে? তুমি অন্ধ হয়ে গেলে আমার চোখে সারা দুনিয়া দেখাতাম তোমায়। তোমার জীবনটা সমাজের একটা শক্তপোক্ত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করিয়ে দেওয়ার পরও এসবকেন বলো আমায়? তুমি কোনো দিক থেকেই অসহায় নও। বরং হাজারো অসহায় নারীর এক নির্ভরযোগ্য আশ্রয় হতে হবে তোমায়!”
মধুর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেশ দেখা গেল। নাক টেনে নিজের চোখ মুছে বললো,

“আজ আমাদের বাসায় যাবো।”
“কেন?”
“আপনি বাবা হচ্ছেন।”
“ওহ!”

বেশ স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো প্রহর। পরমুহূর্তেই মধুর কথাটা উপলব্ধি করতে পেরে চোখ বড়বড় করে তাকালো প্রহর। মধু সশব্দে হাসতে হাসতে দৌড়ে পালালো। প্রহরও ওর পেছনে ছুটে যেতে যেতে বললো,,
“আরেহ! এভাবে ছুটোছুটি করো না। আমার বাচ্চাটা ব্যথা পাবে তো!”

সমাপ্ত

(দেরী হয়েছে জানি 😑 সেই জন্য সরিও! সবার রেসপন্স প্রত্যাশিত। গালাগালি করলেও কিছু বলবো না 🥲
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, হুম? 🥹)

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা শেষ পর্ব