অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৭

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৭
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

ঘন অন্ধকার দূর করতে বাড়ির বাইরে কৃত্রিম আলো জ্বালানো হয়েছে। দালানের ভেতর থেকেও দেখা যাচ্ছে আলোকছটা। মাহমুদ দুঃখে জর্জরিত অশান্ত তরীকে শান্ত করার প্রচেষ্টায় নামলো। কন্ঠ স্বর একেবারে ক্ষীণ করে প্রায় ফিসফিসানো গলায় বলল,

-“শান্ত হও তরী। বিল্ডিং এর সবাই জেগে আছে। এই মুহূর্তে আমাদের দেখলে সমস্যা তৈরি হবে।”
তরীর কানে শব্দগুচ্ছ পৌঁছাতেই খানিকটা কান্নার মাত্রা কমিয়ে দিল। এখন কেবল দু-চোখের কোল ঘেঁষে অশ্রুপাত হচ্ছে। মাঝে মাঝে হেঁচকি উঠছে। মাহমুদ তরীর মাথাটা ধরে বুক থেকে তুললো। যত্ন করে চোখের গরম জল মুছে দিল। কোমল স্বরে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“এভাবে কেঁদো না, তরী। আন্টি কষ্ট পাবেন। বেশি বেশি আন্টির জন্য নামাজ পড়ে দোয়া কর। নিজেকে ঠিক রাখো। মিঠু আর অরু এখন তোমার দায়িত্ব।”
তরী ঢুকরে উঠলো ছোটো ভাই-বোন দুটোর কথা ভেবে। সাথে সাথে মুখে হাত চেপে বলল,

-“আমার ছোটো ছোটো ভাই-বোন দুটোর কী হবে? অরু মাকে ছাড়া থাকতে পারেনা। এতদিন তাকে সামলাতে খুব কষ্ট হয়েছে। কাল রাতেও ঠিক করে ঘুমায়নি। এখন কোনভাবে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি। ও শুধু মায়ের কাছে যেতে চায়। মিঠু খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। বাবা নিজেদের ঘরে পর্যন্ত পা রাখছেন না। উদাস হয়ে পড়ে আছেন গেস্ট রুমে। কী করবো আমি? মা আমার উপর এত এত দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে এক নিমিষেই ফাঁকি দিলো। আমি কিভাবে সব কিছু সামলাবো?”
মাহমুদ স্বভাবসুলভ নরম স্বরেই বলল,

-“তুমি পারবে তরী। কেউ চিরদিন বেঁচে থাকেনা। তোমাকে, আমাকে, সবাইকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হবে। নিজে ঠিকঠাক ঘুমাও, খাওয়াদাওয়া করো, মায়ের জন্য দোয়া কর। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মাহমুদ ফোনের স্ক্রিন অন করে সময় দেখলো। পকেটে ফোন গুঁজে বলল,
-“রাত হয়েছে। বাসায় চলে যাও। কোন প্রয়োজন হলেই আমাকে ফোন করবে। রাত হলেও আমি আসবো।”
মাহমুদ আরও একবার তরীর ললাট স্পর্শ করলো। দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে দুই ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল তরীর কপালে। তরী নিজের ব্যথা গোপন করে একবার ক্ষীণ স্বরে শুধালো,

-“আপনি খেয়েছেন?”
প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসলো মাহমুদ। চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার।
-“বাসায় গিয়ে খাবো। তুমি এখন যাও।”

বলে মাহমুদ দ্রুত বেরিয়ে গেল। তরী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। পা দুটো যেন আর চলছেনা।
বাসায় ফিরে দেখলো অরু উঠে বসে আছে। মায়ের জন্য কান্না করছে। তরীর কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। অরুকে কোলে নিয়ে থামানোর চেষ্টা করলো। মা কিছুদিন পর আসবে বলে মিথ্যে সান্ত্বনা দিলো। অরুর কান্নার আওয়াজ পেয়ে বাবা ছুটে আসলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে দুহাত বাড়িয়ে ডাকলেন অরুকে।

-“আসো মা।”
অরু বাবার কোলে চলে গেল। তিনি তরীকে ঘুমিয়ে যেতে বলে অরুকে নিয়ে চলে গেলেন। মিঠুর ঘরের দরজা ফাঁক করে দেখলেন ছেলেটা ঘুমিয়েছে কি-না! তাকে চোখ বুজে থাকতে দেখে স্বস্তি পেলেন।

মামি সপ্তাহ খানেক থেকেই চলে গেলেন। উনারও সংসার আছে। তারপর আসলেন তিয়াসের মা। তিনি ও দুদিন থেকে চলে গেলেন। আয়েশা সুলতানা আসা-যাওয়ায় রইলেন। সংসারের একটা জিনিস এক এক জায়গায় অবহেলায় পড়ে আছে। এ এটা করেছে সে ওটা করেছে অথচ কেউ কিছুই সামলাতে পারছেনা। তরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

-“আহারে মা! তুমি চলে গিয়ে দেখো, দশজন মিলেও তোমার সংসারটা সামলাতে পারছেনা।”
অরুর এতদিনে ধারণা হয়ে গিয়েছে মা আর আসবেনা। মেয়েটা আগের তুলনায় একেবারেই শুকিয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ কাঁদে তো কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থাকে। আগের মতো দুষ্ট মিষ্টি, ঝ*গ*ড়ু*টে অরু আর নেই। কারো সাথে খুব একটা কথা বলেনা। মিঠু সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে। যখনই বাসায় আসে, তখনই মায়ের ঘরে গিয়ে কাঁদে। বাবা এখনো গেস্ট রুমে থাকেন। ভুলেও ও ঘরে উনার কদম পড়েনা। তরী গতকাল জিজ্ঞেস করলো,

-“তুমি ঘরে যাচ্ছো না কেন, বাবা?”
বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-“ও ঘরে যেতে আমার বুক কাঁপে। তোর মায়ের কত স্মৃতি ওই ঘরে পড়ে আছে।”
তরীর চোখে পানি চলে এলো। বাবা যতই একরোখা মানুষ হোন না কেন, ভালোবাসতে কার্পণ্য করেননি। বাবাকে আর কিছু বলতে পারেনি তরী।

সামনেই ফাইনাল এক্সাম। রুটিন পাবলিশ হয়ে গিয়েছে। তরী ক্লাস করতে পারেনি এতদিন। দুপুরের রান্না সামলে সবটা গুছিয়ে নিলো। শরীরটা আজ ভীষণ ক্লান্ত। বাড়িতে সে আর অরু একা। মিঠুকে ঠে*লে*ঠু*লে আজ স্কুলে পাঠিয়েছে। অরুকে খাইয়ে দুপুরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। মায়ের পর বড়ো বোন হলো দ্বিতীয় মা। যার কাছে ছোটো ভাই-বোন গুলো যত্নে থাকে। তরী তাদের ভালো রাখার সব রকম চেষ্টা করে।

ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেওয়ার কিছুক্ষণ পরই তার ছটফটানি বেড়ে গেল। শরীর কেমন লাগছে সে বলতে পারছেনা। শুয়েও শান্তু পাচ্ছেনা। উঠে বসারও শক্তি নেই।

স্কুল ছুটির পরও রামি মিঠুকে কিছুক্ষণ আটকে রাখলো। সে জানে মিঠু বাড়িতে গেলেই আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। আরও কয়েকজন বন্ধু মিলে ক্লাস শেষে ক্রিকেট এর আয়োজন করলো। স্কুলের গেইট বন্ধ হয়ে যাবে। তাই পাশের একটা বড়ো মাঠে নামলো খেলতে।

খেলা শেষ করে সন্ধ্যার একটু আগেই বাড়ি ফিরলো। ঘরে ঢুকে গোসলে চলে গেল।
এদিকে তরীর ভয়াবহ জ্বর উঠেছে। শরীরটা পুড়ে যাচ্ছে। অথচ পায়ের দিকটা বরফ শীতল। মায়ের ও ঠিক এমনটাই হয়েছিল। তরী ভয় পেলো। হুট করেই বমি পেলো। বিছানা ছেড়ে বেশিদূর যেতে পারেনি। গলগল করে বমি করে ফ্লোর ভাসিয়ে ফেলেছে। মিঠু গোসলে থাকায় কিছুই শুনতে পেলোনা। কষ্ট করে আসবাবপত্র ধরে ওয়াশরুম ঢুকে কুলি করে চোখেমুখে পানি দিলো। মাথা নিচু করে মাথায়ও পানি দিল। কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে বেরিয়ে এসে বমি পরিষ্কার করে অজু করে জায়নামাজ বিছিয়ে নিলো। মাগরিবের আজান পড়েছে একটু আগে। নামাজ শেষে আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ছেড়ে নিজের জীবন ভিক্ষা চাইলো।

-“আল্লাহ আমার ভাই-বোন দুটোর জন্য হলেও আমার জীবন ভিক্ষা দিন, আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন। আমি ম*রে গেলে ওদের কে দেখবে? বাবাকে কে দেখবে? আপনি বড়ো দয়ালু আল্লাহ। আমার মতো পাপী বান্দাকে ক্ষমা করে এই ফরিয়াদ কবুল করুন।”

অরুকে আজ আর ঘুম থেকে তোলা হয়নি। নড়েচড়ে উঠছে মেয়েটা। তরী জায়নামাজ গুছিয়ে অরুকে কোলে তুলে নিলো। মিঠুর ঘরে ঢুকে দেখলো সে গোসল করে বেরিয়েছে। বলল,
-“এত দেরি করলি যে? খেতে আয়।”
“আসছি” বলে মিঠু গেঞ্জি পরে নিলো।
খাবার সময় ঢুলুঢুলু তরীকে দেখে ভুরু কুঁচকে তাকালো মিঠু। জিজ্ঞেস করলো,

-“তুমি কি অসুস্থ আপু?”
-“কিছুনা। একটু জ্বর এসেছে। তুই চিন্তা করিস না।”
মিঠু খেয়ে উঠে নাপা বের করে এনে তরীর সামনে রেখে বলল,
-“খেয়ে নাও।”
তরী বলল,
-“এত ব্যস্ত হতে হবে না, মিঠু।”
মিঠু কাতর গলায় বলল,

-“তোমার কিছু হলে যে আমি আর বাঁচবোনা আপু। মা ছাড়া এমনিতেই আমরা অসহায়। একে অপরকে না দেখলে কেউ আসবেনা আমাদের দেখতে।”
তরী খেয়াল করলো তার পাশাপাশি ছোটো ভাইটাও দায়িত্ববান হয়ে উঠছে। সে ঔষধ খেয়ে নিলো। সেই রাতে তরীর ভীষণ জ্বর উঠলো। মাহমুদ একের পর এক কল দিয়েও রেসপন্স পেল না। তিয়াস ও একবার কল দিল। তরীর মা মা*রা যাওয়ার দিন থেকে আজ সহ মোট তিনবার কল দিয়েছে সে। তরী হু, হা করে রেখে দিয়েছে।

আজ প্রথম পরীক্ষা তরীর। হল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলো। গেইটের সামনে মাহমুদ দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। তরী এগিয়ে গেল সামনে। মাহমুদ বলল,
-“ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমায়, কিছু খাবে চল।”
তরী অদ্ভুত ভাবে হাসলো। এলোমেলো চুল, গলায় ঘামের ছাপ, শার্টের টপ বোতাম খুলে রাখা। তারচেয়ে বেশি মানুষটাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অথচ সে তরীকে নিয়ে ব্যস্ত। মৃদু হেসে তরী বলল,

-“আমার চেয়ে আপনি বেশি ক্লান্ত। চলুন একসাথে খাবো।”
মাহমুদ ও হাসলো। দুজন ঢুকলো একটা রেস্তোরাঁয়। একবার মাহমুদের চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে দিল। বলল,
-“আপনি কেমন শুকিয়ে যাচ্ছেন।”
মাহমুদ রগঢ় করে বলল,

-“বিয়ে করে অবিবাহিতের মতো থাকলে অবশ্যই শুকিয়ে যাওয়ার কথা। তুমি তো দূরে দূরে থাকছো।”
তরী ভুরু উঁচিয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। অতঃপর মাহমুদ বাহুতে মৃদু চাপড় বসালো। শরীর দুলিয়ে শব্দহীন হাসলো মাহমুদ। পরক্ষণে তরী নিজেও হেসে ফেললো।

স্ত্রী মৃত্যুর দু-মাস না যেতেই মানুষ তরীর বাবাকে বিয়ের পরামর্শ দেওয়া শুরু করলেন। তিনি সব সময়ই ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়েছেন। দু-মাস শেষ হয়ে তিনমাসের মাঝামাঝি সময় চলছে। আজও বাজারে কয়েকজন মিলে ঘিরে ধরলেন উনাকে। শুধু বাইরের মানুষ নয়, আত্মীয়স্বজনরা ও উঠেপড়ে লেগেছেন। আজ তিয়াসের বাবাও উপস্থিত আছেন। তিনি সহ আরও কয়েকজন বোঝালেন,

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৬

-“মেয়ে কতকাল তোমার সংসার সামলাবে? তাকে পরের ঘরে বিদায় দিতে হবে। তুমি কাজের বাহানায় সারাদিন বাইরে কাটাও। বড়ো মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে তোমার ছেলে আর ছোটো মেয়েটাকে দেখবে কে? সংসার সামলানোর জন্য হলেও একজন নারী দরকার। তাছাড়া শেষ বয়সে তোমার দেখাশোনা কে করবে? তাই বলছি বিয়ে করে নাও। আমরা ভালো দেখে মেয়ে দেখে দেবো।”
তরীর বাবা হ্যাঁ, না কিছুই বললেন না। চা শেষ করে বিল মিটিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলেন। কে জানে উনার ভেতর কী

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৮