অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৬

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৬
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

হাঁকিয়ে আসা লা*শ*বা*হী গাড়িটা এসে থামলো গেইটের ভেতর। বাসার ভেতর লোকজনে গমগম আওয়াজ সৃষ্টি হচ্ছে। শান্তিপূর্ণ, হাসিখুশি বাড়িতে পড়লো কান্নার রোল, বিষাদের দীর্ঘশ্বাস। ভেঙে পড়লো লা*শে*র আপনজনেরা। অরু না বুঝেই কাঁদছে। সবার কান্না দেখে ঠোঁট ফোলাচ্ছে। একটু পর থেমে গিয়ে পিটপিট করে সবাইকে দেখছে। ছোটো মেয়েটা নরম গালদুটো মুছতে গিয়ে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। অদ্ভুদ লাগছে তার কাছে। সচরাচর তাদের বাসায় এমন লোকসমাগম হয়না। জায়গায় জায়গায় মানুষ জড়ো হয়ে কান্না করছে।
তরীর গলা দিয়ে পানি নামলোনা। শুধু বুক চাপড়ে চিৎকার করে কাঁদলো,

-“কেন পানি দিলাম না! কেন পানি দিলাম না তোমায়! আহারে মা! এত তাড়াতাড়ি আমাদের একা করে দিলে?”
মিঠু মেয়েদের মতো কাঁদছে আজ। নিচে গড়াগড়ি দিচ্ছে। মায়ের লা*শ গাড়ি থেকে নামানো হলো। এই সোনার সংসারে তার আর পদচারণ হবেনা। বাইরে থেকেই আসল ঠিকানায় চলে যাবে। মাটির নিচে সাড়ে তিন হাত জায়গা হবে তার আসল ঠিকানা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃ*ত্যু*র স্বাদ গ্রহন করতে হবে। তবুও আমাদের কত মায়া, কত আক্ষেপ। ইশ মানুষটি যদি আরও লয়েক বছর বাঁচতো। মিঠু পা*গ*লে*র মতো ছুটে বেরিয়ে গেল। পথিমধ্যে অনেকেই তাকে আটকানোর চেষ্টা করেছে। তাদের বৃথা চেষ্টাকে পরাজিত করে জয়ী হলো মিঠু। আশ্চর্যভাবে তার শরীরে তখন শক্তির জোয়ার। সকলকে উপেক্ষা করে করে সে গেল মায়ের কাছে। প্রাণহীন মায়ের বুকে ধুম করেই মাথা রেখে দিলো। দু’হাতে ঝাপটে ধরে চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে কাঁদছে।

-“মা, ও মা! মা গো! তুমি উঠছোনা কেন? দেখো তোমার মিঠু তোমার সব কথা শুনবে। তুমি যা বলবে তাই করবো, এবার থেকে ঠিক করে পড়বো, খাবো। সব তোমার ইচ্ছে মতো করবো। উঠোনা না মা! ও মা। মা তুমি আমার সাথে রাগ করেছো?”

ক্রমাগত শ্বাস ওঠানামা হচ্ছে মিঠুর। শরীর কেমন ঝিমিয়ে আসছে। তবুও মাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। তর আকুতিতে কিছু কঠিন হৃদয়ও ছুঁয়ে গেল। চোখের কোনে জল ভীড়লো। আলগোছ মুছে নিলো অশ্রুকণা। তরীও পা*গ*লে*র মতো ছুটে আসছে। অরুর খোঁজ তখন কারোর নেই। মিঠুর পা*গ*লা*মি দেখে তরী আরও ভেঙে গুড়িয়ে গেল ভেতর থেকে। মিঠুকে জোর করে মায়ের কাছ থেকে ছাড়িয়ে বুকে চেপে ধরলো। মিঠু এবার তরীকে ঝাপটে ধরে বলল,

-“এই আপু, মাকে বলোনা উঠতে! আমি অরুকে কাঁদাবো, তোমার সাথে দুষ্টুমি করবো। মা তখন খুন্তি নিয়ে মা*র*তে আসবে আমায়। মা কেন কথা বলছে না?”
বলতে বলতে তরীর কোলেই নিস্তেজ হয়ে ঢলে পড়লো মিঠু। মায়ের চলে যাওয়া চঞ্চল মিঠুকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তরী চিৎকার করলো,

-“কেউ পানি দাও। আমার ভাইটা ম*রে যাচ্ছে।”
আবারও সেই পানি শব্দটা তরীকে গুড়িয়ে দিল। এই পানিটুকু যদি মাকে দিত, তবে বোধহয় তার এতটা কষ্ট হতোনা। মা শেষ যাত্রায় তৃপ্তি পেতেন।
মাহমুদ এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। তরীর কাছে এসে সান্তনা দেওয়ার অনুমতি যে তার নেই। এতে বরং মৃ*ত বাড়িতে উটকো ঝামেলার সৃষ্টি হবে। মিঠুর পরিস্থিতি দেখে আর চুপ থাকতে পারলোনা। এক প্রকার দৌঁড়ে এসে তাকে পাঁজা কোল করে তুলে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেল।
তরী মায়ের মোমের মতো সাদা মুখে হাত বুলিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলল,

-“এত রা*গ আমার প্রতি? তোমার মিঠু আর অরুটাকে কে সামলাবে? আমায় কে সামলাবে মা? বাবার মতো শক্ত মানুষটাও যে ভেঙে গিয়েছে তাকে কে সামলাবে?”
বলতে বলতে অভিমান গুলো বিষাদ, অভিযোগে পরিণত হলো। কান্নায় ভেঙে পড়লো নরম হৃদয়ের মানবী। অরু মামার কোলে চড়ে নিচে এলো। সামনে ধবধবে সাদা কাপড়ে মোড়ানো লম্বা মানুষাকৃতির জিনিসটি দেখে তার কৌতুহল হলো। আঙ্গুল ইশারায় দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-“এটা কী, মামা? আপু কাঁদছে কেন? ভাইয়া কাঁদছে কেন?”
অরুকে নামিয়ে দিলেন তিনি। নিচে নেমে তরীর কোলে বসে পড়লো। তার গাল দুটো নরম হাতে ধয়ে মাথা দুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“আপু, মা আসবে না হাসপাতাল থেকে? তুমি কাঁদছো কেন?”
তরীর হাউমাউ কান্নার বাঁধ যেন ভেঙে পড়লো। মায়ের মুখের কাপড় সরিয়ে হেঁচকি তুলে বলল,

-“এই তো মা।”
অরু মাকে ঠেলে কোমল গলায় বলল,
-“ঘুমাচ্ছো কেন মা? জানো, আমি তোমার জন্য কত্তগুলো কান্না করেছি? তুমি আর হাসপাতালে যাবেনা। আমি তোমাকে যেতে দেবোনা।”
বলে মায়ের বুকের উপর উঠে পড়লো। ঝটপট পাশ থেকে একজন তাকে নামিয়ে নিলো। চোখ মুছে ভদ্র মহিলা বললেন,
-“তোমার মা আল্লাহর কাছে চলে গিয়েছে।”
অরুকে সরিয়ে নেওয়া হলো। একজন অচেনা মহিলার কোলে চড়ে তার ভালো লাগছেনা। সে কান্না জুড়ে দিল।

বাঁশঝাড়ে বাঁশ কা*টা হচ্ছে। দাফনের কাপড় কেনাকাটা শেষ। বাড়ি জুড়ে মৌ মৌ করছে আগরবাতির ঘ্রাণ। বরইপাতা সেদ্ধ পানি নাওয়া হলো মুর্দার গোসল দেওয়ার জন্য।
তরীর বাবা উপরে শক্ত আছেন। ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। পঁচিশটি বছর এই নারীর সাথে সংসার করেছেন। সংসার জীবনে কখনো তার সিদ্ধান্তের উপর কথা বলেননি স্ত্রী।

এক জায়গায় বসে আছেন তিনি। চোখেমুখে বিষাদের কালো মেঘ। তিয়াসের বাবা এসে উনাকে ধরে নিতে গিয়ে খেয়াল করলেন তরীর বাবার চোখদুটো জলে চিকচিক করছে। চোখের পানি গোপন করার চেষ্টা করেও ধরা পড়ে গেলেন।
মাকে গোসল দেওয়া হবে। তরী, মিঠু আর অরুকে ডাকা হলো। সন্তানের হাতে মায়ের শরীরে পানি দেওয়া হলো। এই নিয়মটা মানুষের বানোয়াট কি-না তরী জানেনা। শুধু রোবটের মতো পানি ঢেলে দিলো। মিঠুর জ্ঞান ফেরার পর থেকেই সে পা*গ*লে*র মতো প্রলাপ করছে। মায়ের শরীরে পানি দিতে গিয়েও তার আহাজারি কমলোনা। সর্বশেষ অরুর হাতে জগ ধরিয়ে দেওয়া হলো। তরীর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। গোসল দেওয়া শেষ।

তরী আর কাঁদছেনা। কেমন শক্ত পাথর হয়ে গিয়েছে। আয়েশা সুলতানা পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অরু উনার কোলে। তরীকে নরম গলায় বললেন,
-“মা, সবাইকেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হবে। আল্লাহ যাকে বেশি পছন্দ করেন, তাকে খুব তাড়াতাড়ি নিজের কাছে নিয়ে যান। কান্নাকাটি অনেক করেছো। মায়ের পাপ বাড়িও না আর। এভাবে কাঁদলে মুর্দা কষ্ট পায়। জুসটা খেয়ে নাও।”
তরী জুস খাচ্ছেওনা, কিছু বলছেও না। হুট করেই বসা থেকে ধপ করে পড়ে গেল। আয়েশা সুলতানা জুসের গ্লাস রেখে পানির ছিটা দিয়ে তরীকে ডাকলো।

গালে হালকা চাপড় মারলো। আবার পানি দেওয়ার অনেকক্ষণ পর চোখ খুলে তাকালো সে। তরীর মায়ের লা*শে*র শেষ সাজ সাজা হয়ে গেল। সম্পূর্ণ সাদা কাপড়ে মুড়ে গেল। আগের চেয়ে চেহারার উজ্জ্বলতা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। তরীর বাবাকে ডাকা হলো। স্ত্রীকে শেষবারের মতো দেখবেন। এবার আর তিনি চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। একবার কপালে চুমু দিয়ে কানে কানে ফিসফিসে বললেন,

-“আমি তোমার উপর সন্তুষ্ট।”
এমন ভাগ্য ক’জনের হয়? স্বামীর আগে মৃ*ত্যু, তাও স্বামী তার উপর সন্তুষ্ট। মিঠু বলল,
-“আমি আমার মাকে কোথাও যেতে দেবো না।”
বাবা মিঠুকে আগলে নিলেন বুকে। বোঝালেন,

-“এমন কথা বলেনা বাবা, তোমার মা যে কষ্ট পাবে। মায়ের খাটিয়া ধরবে না? জানাজা পড়ে মায়ের জন্য দোয়া চাইবে, যেন তোমার মা পরকালে ভালো থাকে। আল্লাহ তাকে যেন জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন। ”
মিঠু বাবাকে আঁকড়ে ধরে বলল,
-“মা কেন গেল বাবা?”
-“সবাইকে যেতে হবে।”

অল্প বয়সী মিঠুর কাঁধে জায়গা করে নিলো মায়ের খাটিয়া। এর চেয়ে করুণ দৃশ্য আর কী হতে পারে? জানাজা হলো। মাকে কবরে শুইয়ে দিয়ে সবাই বিদায় নিলো। নতুন কবরের মাটি আঁকড়ে ধরে চোখের জলে মাটি ভেজালো মিঠু। তরী আর মিঠুর পেটে খাবার পড়লোনা। অরুকে তরী খাইয়ে দিলো। ছোটো এই মেয়েটার দিকে তাকালেই তর দুঃখ বাড়ে।
মা ম*রা*র পরদিনই আস্তে আস্তে আত্মীয়স্বজনরা চলে গেল। সবাবার সংসারের ব্যস্ততা। মামি রইলেন শুধু। দুদিন পর তিনি নিজেও চলে যাবেন। আয়েশা সুলতানার মন টা*ন*ছে*না যেতে। তবে এভাবে পড়ে থাকাও যায় না। প্রয়োজন এসে যেয়ে দেখে যাবেন। মাহমুদ তরীর নাগাল পেল তার মা ম*রা*র পরদিন রাতে। ফোন করে তাদের বাড়ির পেছন দিকে ডাকলো।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৫

অপেক্ষা করছে মাহমুদ। মাথায় ওড়না জড়িয়ে কেমন হেলেদুলে আসছে তরী। এই’কদিনে মেয়েটার চেহারা মলিন হয়ে গিয়েছে। শরীরটাও অনেকটা শুকিয়েছে। তরী এসে দাঁড়ালো মাহমুদের সামনে। মাহমুদ কিছু বলার আগেই এক অভাবনীয় কাজ করে বসলো তরী। তাকে দু’হাতে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলো। তার চোখের পানিতে শার্ট ভিজিয়ে বুক ভিজলো মাহমুদের। সে তরীর মাথায় ধীরভাবে হাত রাখলো। তরীর কান্না আরও বেড়ে গেল। অসহনীয় যন্ত্রণায় খাঁমছে ধরলো মাহমুদের পিঠের দিক।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৭