অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৫

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৫
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

-“আপনারা আরও আগে কী করেছেন? এমন সিরিয়াস মোমেন্ট এ এসে হসপিটালে ভর্তি করলেন?”
কৃত্রিম শীতলতা নিস্তব্ধ কক্ষ জুড়ে বিরাজমান। তরীর বাবার হাত-পা আরও ঠান্ডা হয়ে এলো। শক্ত থাকার চেষ্টা করেও তিনি বাইরের খোলস ছেড়ে ভঙ্গুর রূপে ফিরে আসছেন। ধুকধুক করছে বুকের ভেতর। প্রবল উৎকণ্ঠার সাথে প্রশ্ন করলেন,
-“আমার স্ত্রীর কী হয়েছে?”

মাহমুদ শান্ত হয়ে বসলো। মনযোগ দিলো সামনে বসে থাকে মাঝবয়সী ডাক্তারের দিকে। উনার চোখমুখ গম্ভীর। নাকের ডগায় ঝুলে থাকা চশমা উপর দিকে ঠেলে দিয়ে রিপোর্টটা শব্দ করে রাখলেন। বললেন,
-“ফুসফুস ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে উনার। সেজন্যই শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে।”
অতঃপর প্রশ্ন করলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“আপনারা কি কোন উপসর্গ খেয়াল করেন নি?”
তরীর বাবার হাত-পা কেমন অসাড় হয়ে এলো। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছেন। হাঁক ছেড়ে ওঠা গলার স্বর একেবারে ক্ষীণ হয়ে এলো।
-“ওর তো তেমন কোন অসুস্থতা ছিলনা। মাঝে মাঝে জ্বর-টর, কাশি হতো আর বমি হতো। ডাক্তার দেখানোর পর জ্বরের ঔষধ আর বমির জন্য গ্যাসের সমস্যা বলে ঔষধ দিয়েছেন। সেগুলোই চলেছে।”
ডাক্তার বললেন,

-“অনেক সময় কোন উপসর্গ দেখা যায় না। আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল।”
মাহমুদ তরীর বাবার দিকে তাকালো। নম্রতা বজায় রেখে ভরসার গলায় বলল,
-“আপনি এত চিন্তা করবেন না আঙ্কেল। নিজেকে ঠিক রাখুন।”
অতঃপর ডাক্তারের মুখোমুখি হলো। প্রশ্ন করলো,
-“আপনারা চিকিৎসা শুরু করুন।”
ডাক্তারকে গম্ভীর দেখালো। তিনি বললেন,

-“আপনাদের আমি হসপিটাল সাজেস্ট করছি। সেখানে নিয়ে যান। এখানে এই রোগের ভালো চিকিৎসা হবেনা।”
ডাক্তারের সাজেস্ট করা হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থায় নামলো মাহমুদ। এম্বুলেন্স দেখছে সে। তরীর বাবাকে রেখে গেল সবার কাছে।
এম্বুলেন্স ঠিক করে মাহমুদ ভেতরে আসছে এমন সময় তরী এসে পড়লো হাসপাতালে। বাসায় বেশিক্ষণ দেরি করেনি। দ্রুততার সাথে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আবার এসেছে। সাথে মিঠু আর অরু। মাহমুদকে ছোটাছুটি করতে দেখে তরী জিজ্ঞেস করলো,

-“আপনি এমন ছোটাছুটি করছেন কেন?”
দ্রুত হাঁটার তাল বজায় রেখে মাহমুদ বলল,
-“আন্টিকে নিয়ে অন্য হাসোতাল যেতে হবে।”
তরীর মুখটা নিমিষেই অন্ধকার হয়ে এলো। অরুর চোখমুখও শুকিয়ে আছে। এ দুদিন তার ঠিকমতো যত্ন নেওয়া হয়নি। তরী বিচলিত হলো। উত্তেজনা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-“এখন আবার হসপিটাল কেন পরিবর্তন করতে হবে? রিপোর্টে কী এসেছে?”
মাহমুদ এক্ষুনি তরীকে কোন শক দিতে চাচ্ছে না। সত্যটা এড়িয়ে বলল,
-“এখানেও তেমন কোন সমস্যা ধরা পড়েনি। তাই অন্য হাসপাতালে নিতে হচ্ছে। আরেকবার টেস্ট করিয়ে নিলে ভালো হবে।”

তরী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। নিস্তেজ হয়ে আসছে শরীর। দু-তিন দিনে সে বড্ড ক্লান্ত। দুর্ভাগ্য তাদের না আছে খালা আর না আছে ফুফু। যে দুঃসময়ে তাদের পাশে থাকবে। মামা-মামি, চাচা-চাচিরা দেখতে আসছেন আর ব্যস্ততা নিয়ে চলে যাচ্ছেন। দুর্বল হাতে অরুর হাত ধরে এগিয়ে গেল। মাহমুদ লম্বা কদমে তাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে। মিঠুও তালে তালে দ্রুত এগিয়েছে।

তরীর বাবা ভাইকে ফোন করে স্ত্রীর রিপোর্টের ব্যাপার খুলে বললেন। তিয়াসের বাবা বললেন,
-“তুই টাকা নিয়ে চিন্তা করিস না। ভালোভাবে চিকিৎসা করা। আমরা আছি।”
তরীর বাবা “আমরা আছি” তেও ভরসা খুঁজে পেলেন না। উনার এখন মানসিক সাপোর্ট প্রয়োজন। সন্তানদের আগলে রাখার মানুষ প্রয়োজন, টাকার নয়। উনার সামর্থ্য আছে স্ত্রীকে চিকিৎসা করানোর। প্রয়োজন পড়লে জমি বিক্রি করবেন। যেসবের অভাববোধ করছেন, সেসব পাচ্ছে না। আপন মানুষগুলোই এখন দূরে সরে আছে।

তিয়াস গতরাতে একবার ফোন করে খবর নিয়েছিল। হয়তো বাবা-মায়ের কাছে শুনেছে।
সবটা আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। ছেলে-মেয়েদের সামলাবে কে? বড় মেয়েটাও নরম মনের। ছেলেটা যতই ঘাড়ত্যাড়া হোক, দিন শেষে মায়ের আঁচল না ধরলে তার শান্তি হয়না। আর অরু? তার কথা তো ভাবতেই পারছেন না।

নিজেকে শক্ত করে এগিয়ে গেলেন। হাজারো মানুষের বুক কাঁপানো শব্দ তুলে এম্বুলেন্স এগিয়ে যাচ্ছে। মাহমুদ তরীর বাবার সাথে যাচ্ছে। তরী সাথে যেতে পারছেনা অরুর জন্য। সে কার কাছে থাকবে? মাহমুদের মায়ের কাছেও থাকবেনা। ঘর সামলানোর জন্যেও একজন নারী প্রয়োজন। মায়ের কাছেও একজন থাকা লাগে। পর হয়েও মাহমুদের মা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়লেন। সঙ্গে তিনিও গেলেন।

দিন দিন অবস্থার অবনতি হচ্ছে। ভর্তির পরপরই সব দেখেশুনে অক্সিজেন দেওয়া হলো তরীর মাকে। তিনি ক্রমশই অস্থির হয়ে উঠছেন। অক্সিজেন মাস্ক টেনে খুলে ফেলার চেষ্টা করছেন। ওলট-পালট করায় শরীরের কাপড় সরে যাচ্ছে। মাহমুদের মা বারবার ঠিক করছেন। উনি চোখদুটোকে বিশ্রাম দিতে না পেরে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। মাহমুদ মাকে বলল,
-“তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও মা। আমরা আছি।”
তরীর বাবা নম্র হলেন। তিনি বললেন,

-“আপনারা দুজনেই ক্লান্ত, আমাদের জন্য অনেক করেছেন। আমি আছি এখানে, আপনারা বাসায় গিয়ে রেস্ট করুন।”
আয়েশা সুলতানা ক্লান্ত হলেও নাকচ করলেন তরীর বাবার কথা। তিনি বললেন,
-“আমাদের বি*প*দ হলে কি আপনি এগিয়ে আসতেন না? আমি আছি। মাহমুদ বরং বাসায় গিয়ে গোসল সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আয়।”

একে অপরের ঠে*লা*ঠে*লি*র মাঝে আর কারো বাসায় যাওয়া হলোনা। তবে আয়েশা সুলতানা একটু চোখদুটোকে বিশ্রাম দিলেন।
মাহমুদের ফোনে কলেজ থেকে কল এল। সে কলেজ থেকে কোন ছুটি নেয়নি। তরীর মাকে নিয়ে গতকাল রাতে এখানে এসেছে। সে জানিয়ে দিল আজ আর যেতে পারবেনা।

বাসা থেকে এই হাসপাতালের দূরত্ব অনেক। তবুও তরী অরুকে নিয়ে মাকে দেখতে আসবে। রামি ওদের বাসাতেই ছিল গতকাল। মিঠু রামি দুজনের কাছে অরুকে কয়েকঘন্টার জন্য রেখে তরী ছুটলো হাসপাতালে। অর্ধেক পথ এসে সে রাস্তা ভুল করলো। ফোন করলো বাবাকে। তিনি এসে তাকে হাসপাতালে নিয়ে এলেন। মাকে মুখে পানি দেওয়া কড়াভাবে নিষিদ্ধ। তিনি ছটফট করছেন পানির জন্য। কেউই ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞায় পানি দিচ্ছেনা। তরীকে দেখতে পেয়েই মা কথা বললেন। ঠোঁট দুটো ভারী হয়ে এসেছে। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। অক্সিজেন মাস্ক সরানোর চেষ্টা করে অস্পষ্ট ভাবে কথা বলছেন। চোখের কোল ঘেঁষে পানি গড়িয়ে কান স্পর্শ করলো। তরীকে বলল,

-“আমাকে কেউ পানি দিচ্ছে না, মা। তুই আমাকে পানি দে। আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে।”
বারবার জিহবা দ্বারা শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে চলেছেন তিনি। তরী মায়ের কষ্ট নিতে পারলোনা। ইচ্ছে করলো পৃথিবীর সকল পানি এনে মায়ের তৃষ্ণা মেটাতে। সে ডাক্তারের আড়ালে বোতলের মুখ খুলে একটু পানি নিলো মায়ের মুখে দেবে বলে। তখনই ডাক্তারের আগমন। তিনি তরীকে ধমকে উঠলেন।
-“রোগী মা*রা গেলে দায়ভার আপনাদের। কতবার না করেছি পানি দেবেন না!”

তরী আর এগোলো না। ওভাবে খোলা অবস্থাতেই পানির বোতল রেখে দিল। তার মনে মাকে হারানোর ভয় ঢুকলো। ডাক্তার হার্টবিট চেইক করছেন। খুবই দুর্বলভাবে চলছে সব। তিনি চলে যেতেই মা আবারও কষ্ট করে বললেন,
-“আমাকে একটু পানি দে, তরী। আমি জীবনে আর কিছু চাইবোনা তোর কাছে। একটু পানি দে না মা!”
তরীর গাল, গলা ভিজে আছে। চোখদুটো জলে টইটম্বুর। ইচ্ছে করছে মাকে বোতলের সবটুকু পানি খাইয়ে দিতে। আবার মাকে হারানোর ভয়ে পিছিয়ে গেল। বাসায় মায়ের ফোন আছে। মিঠু ফোন দিয়ে জানালো অরু কাঁদছে। তরী বিদায় নিলো স্বার্থপরের মতো।

সন্ধ্যার পরই তরীর মায়ের অস্বাভাবিক ছটফট, চোখ বড়ো বড়ো করে তাকানো দেখে আয়েশা সুলতানা দৌঁড়ে বাইরে গেলেন। মাহমুদকে বললেন ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসতে।
ডাক্তার আসলেন। তরীর মায়ের নিস্তেজ শরীর পড়ে রইলো। চোখ দুটো খুলে রেখেছেন।

রাতে তরী হুট করেই দেখলো সবাই এসে তাদের বাসায় ভীড় জমিয়েছে। চাচা-চাচি, মামা-মামি, আত্মীয়-স্বজন সবাই আসছে। কারো কারো চোখে দুঃখের, কারো চোখে লোক দেখানো পানি। তরী মিঠু কেউই বুঝলোনা সবাই এখানে কেন আসছে! কেন কাঁদছে?
তরী অবাক হয়ে মামিকে জিজ্ঞেস করলো,
-“সবাই এখন বাসায় কেন, মামি?”
মামি তরীকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।
-“তোর মা আর নেই, তরী।”

তরীর পায়ের তলার মাটি স্বরে গেল। মামিকে ছাড়িয়ে অবাক হয়ে বলল,
-“এসব অলক্ষুণে কথা কেন বলছেন মামি? আমার মাকে আমি দেখে এসেছি। মা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবেন।”
মিঠু মেয়েদের মতো চিৎকার করে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে। অরু কিছু না বুঝেই কাঁদছে। তরীর কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না। দুপুরে জ্যান্ত মাকে দেখে এলো। অরুকে কোলে নিয়ে মিঠুকে ধরলো,
-“এই মিঠু ওঠ। এমন কাঁদছিস কেন? মায়ের কিচ্ছু হয়নি।”

সবাই তরীকে বোঝাতে ব্যস্ত তার মা আর বেঁচে নেই। তরী কারো কথা শুনতে নারাজ। বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে এম্বুলেন্স এর ডাক। এবার তরীর কলিজা কেঁপে উঠলো। অরুকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়েই শরীরের ভর ছেড়ে দিল। তার পূর্ণজ্ঞান আছে। কে কী বলছে, সব শুনছে। শুধু নড়তে পারছেনা, কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। মা এমন স্বার্থপরের মতো উড়াল দিলো? এত দ্রুত?

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৪

তিয়াসের মা এসে তরীকে ধরে উঠানেন। মামি পানি এগিয়ে ধরলো মুখের সামনে।
তরীর মনে পড়লো মা কতটা কাতর গলায় একটু পানি চেয়েছিল তার কাছে। সে নিষ্ঠুরের মতো পালিয়ে এসেছে। পানি দেয়নি মাকে। এই পানিও যে তার গলা দিয়ে নামবেনা।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৬