অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৪

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৪
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

শরীরে হাত রাখা যাচ্ছে না প্রচন্ড তাপমাত্রায়। থার্মোমিটারে শরীরের তাপমাত্রা ১০৩ ডিগ্রি ছাড়িয়ে ১০৪ এ থেমেছে। ঘন্টা দুয়েক না যেতেই আবারও তীব্র জ্বরে বেঘোরে পড়ে আছেন তরীর মা। কাঁপুনির সাথে দাঁতে দাঁত ঠকঠক শব্দে বারি খাচ্ছে। শ্বাস নিতেও কেমন কষ্ট হচ্ছে। যেন ভীষণ কষ্ট করে এক একটা শ্বাস নিচ্ছেন। বাবার ডাক পেতেই ছুটে এলো তরী। অস্বাভাবিক জ্বরে শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে বারবার। এবারে তরী ঠিক তেমনটাই করল, যেমনটা অরু করেছিল। কাঁথা, কম্বলেও যখন কম্পন কমছিলনা, তখন মাকে ঝাপটে ধরে রইলো দু-হাতে। রাত অনেক হয়েছে। এদিকে মায়ের অবস্থা বেগতিক দেখে তরী বলল,

-“বাবা, মাকে হাসপাতালে নিয়ে চল।”
তরীর বাবার এই মুহুর্তে বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেলো। মেয়ের কথায় সংবিৎ ফিরতেই স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। সাথে তরীও যাচ্ছে। মাঝে তরী মিঠুকে জাগিয়ে তার রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। অরুর খেয়াল রাখতে বলে গিয়েছে৷ মিঠুর মনটাও কেমন ছোট্ট হয়ে আছে। একটু আগেই চোখের পাতায় ঘুমেরা ভীড় জমিয়েছে। এখন দুশ্চিন্তায় সেই ঘুমের রেশ বহু বহু মাইল দূরে গিয়ে ঠেকেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গাড়ির জন্য কিছুক্ষণ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। অতঃপর হাসপাতালে এসে উপস্থিত হলো তারা। মাকে ভর্তি করানো হলো।
বাবা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। শক্ত-সামর্থ্য চেহারার মাঝে কী যেন এক করুণ ছাপ দেখা দিল। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। তরী বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মায়ের অসুস্থতায় এই মানুষটা এমন ভেঙে পড়েছে। যখন জানবে সে তাদের অজান্তে, অমতে বিয়ে করে নিয়েছে, তখন কতটা চুরমার হয়ে যাবেন! ভেবেই তরীর শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। ঠান্ডা হয়ে এলো হাত পা।

দুরুদুরু বুক নিয়ে মায়ের শরীর ছুঁয়ে দেখল। জ্বর এখনো মনে হচ্ছে আগের মতোই আছে। শ্বাস টেনে টেনে নিচ্ছেন। পায়ের দিকে কম্বল টেনে দিতে গিয়ে আরেকবার শিউরে উঠলো তরী। মায়ের পায়ের দিকটা একেবারে বরফ শীতল। অথচ উপরের অংশটা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।

কোনভাবে বাবা-মেয়ে মিলে রাতটা চেয়ারে হেলান দিয়ে কাটিয়ে দিল। ফজরের আজান পড়তেই মসজিদে চলে গেলেন বাবা। সেখান থেকে এসেই তরীকে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। বাসায় ছোটো ছোটো দুজন কি করছে একা একা, কেজানে?
তরী বাবাকে রেখে বাসায় চলে এলো। অবাক হলো সে। কলিংবেল চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমে মজে থাকা মিঠু জেগে আছে! যাকে ঠেলেও সকালে ঘুম থেকে তোলা যায়না, তার চোখজোড়া চাতক পাখির মতো কিছু জানতে চাইছে। উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো মিঠু,

-“মা কেমন আছে, আপু? জ্বর কমেছে?”
মিঠুর অস্থিরতা কমাতে খানিকটা মিথ্যের আশ্রয় নিলো তরী। বলল,
-“এখন জ্বর কম আছে।”
-“আমি একবার গিয়ে দেখে আসি?”
মিঠুর চোখেমুখে ভাসছে ব্যাকুলতা। অস্থিরতায় একজায়গায় স্থির নেই ছেলেটা। ছটফট করছে। তরী বলল,
-“যাবি, এখন নয় পরে। অরু ঘুমাচ্ছে?”
মিঠু হাঁপিয়ে যাওয়া গলায় বলল,

-“রাতে জেগে গিয়ে তোমাদের কাউকে না দেখে খুব কাঁদছিল। একটু আগেই ঘুমিয়েছে।”
তরী বলল,
-“তুই একটু ঘুমিয়ে নে। আমি নাশতা বানিয়ে নিচ্ছি। একসাথে মাকে দেখতে যাবো।”
চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করছে অনিদ্রায়। তবুও মিঠু বলল,
-“এখন ঘুম আসবেনা।”

তরী জোর করে পাঠিয়ে দিল মিঠুকে। ছেড়ে দেওয়া শরীরটা কেমন শক্ত হশে উঠলো। কোমরে ওড়না বেঁধে কাজে লেগে পড়লো তরী। কাজকর্ম শেষ দিয়ে অরুকে ঘুম থেকে জাগালো। নাশতা করার সময় ছোট্ট অরুর চোখ দুটো পিটপিট করে এদিক-ওদিক ঘুরছে। আজ বাবা বা মা কাউকেই দেখছেনা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো তরীর দিকে। ঘুম ভাঙা কন্ঠের রেশ এখনো কাটেনি। ভাঙা ভাঙা গলায় শুধালো,

-“মা আর বাবা কোথায়?”
তরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“মায়ের অসুখ করেছে তো। তাই বাবা মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছে।”
অবুঝ অরু প্রশ্ন করলো,
-“মায়ের অসুখ করেছে কেন?”

-“সেটা তো আল্লাহ জানেন, অরু। তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও, আমরা মায়ের কাছে যাব।”
অরু আর দ্বিরুক্তি করলোনা। তরীর হাতে খেয়ে নিলো ঝটপট। তরী তাকিয়ে দেখলো মিঠুর খাওয়া শেষ। একটু খানি খেয়েই উঠে গিয়েছে। সে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরি। সবকিছু গুছিয়ে ছোটো ভাই-বোন দুটোকে নিয়ে তরী হাসপাতালে চলে গেল। এর মাঝে মাহমুদের এত এত কল, মেসেজ সব উপেক্ষা করলো। তরী আর ফোনের দিকে মন দেওয়ার সময় পেলোনা।

মায়ের যাবতীয় টেষ্ট করানোর পর রিপোর্ট এলো। সবটা স্বাভাবিক। কোন ধরনের প্রবলেম দেখা দেয়নি। তবে ভর্তি রইলেন তরীর মা। এবারেও স্ত্রীর পাশে রইলেন তরীর বাবা। ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে দিলেন বাসায়। জ্বরের প্রকোপ কমতির নাম নেই বরং থেকে থেকে বাড়ছে। করোনা টেস্ট করা হলো। তেমন কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। রাতে তরীর বাবাকে ডাক্তার ডেকে জানালেন,

-“আপনারা রোগী অন্য হাসপাতালে নিয়ে যান।”
অস্থির হয়ে পড়লেন তরীর বাবা। দিনের বেলা আত্মীয়-স্বজন রা অনেকেই দেখে গেলেও রাতে থাকার মতো কেউ নেই। সবাই সন্তান, ব্যস্ততা এসব অজুহাতে কেটে পড়েছেন। রাতারাতি ভাইকে ফোন করে পরামর্শ নিলেন হাসপাতালে নেওয়ার ব্যাপারে। তিয়াসের বাবা বললেন,

-“তুই এখন ডাক্তার যেখানে নিতে বলে, নিয়ে যা। আমি সকালে পৌঁছে যাবো। এখন তো অনেক রাত হয়েছে।”
তরীর বাবা মেয়েকেও আর ঝামেলায় ফেলেন নি। রাতারাতি স্ত্রীকে নিয়ে এম্বুলেন্স এ উঠলেন। যতবার গাড়ির ডাকটা কানে বেজে ওঠে ততবারই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে।

অরু কখনো মাকে ছাড়া থাকেনা। রাতে তার সাথে ঘুমায় ঠিকই, কিন্তু তার মনে একটা ভরসা থাকে মা বাসায় আছেন। অরুকে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়ে ফোন হাতে নিলো তরী। মায়ের খোঁজ নিতে হবে। সারাদিনের ব্যস্ততায় তার মাত্রই চোখ পড়লো মাহমুদের নম্বর। ফোন, মেসেজের ভীড়। তাকে একটু পরেই ফোন দেবে। আগে মায়ের খবর নেওয়া দরকার। বাবাকে ফোন করলো তরী। এম্বুলেন্স এর ডাক শোনা যাচ্ছে। বুকের ভেতর ভয়েরা হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তরী কাঁপা-কাঁপা গলায় বাবাকে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলো,

-“মায়ের এখন কী অবস্থা, বাবা?”
তরীর বাবা নিস্তেজ হয়ে এলেও, সন্তানের কাছে ভেঙে পড়লেন না। তিনি ভেঙে পড়লে যে মেয়েটাও ভেঙে পড়বে। সন্তানগুলো কার কাছে ভরসা খুঁজবে?
নিজেকে ধাতস্থ করে জবাব দিলেন,
-“তোর মাকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।”
আৎকে উঠলো তরী। মায়ের বড় কোন ক্ষতি হলো বুঝি! তড়িৎ প্রশ্ন করলো,

-“মায়ের অবস্থা কি খুব খা*রা*প?”
-“চিন্তার কিছু নেই। এই হাসপাতালে দেখছি চিকিৎসা ভালোনা। তাই অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।”
মেয়েকে মিথ্যে বলে শান্তনা দিলেন। একা বাসায় দুশ্চিন্তা করে নিজে না আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে!
বাবার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি তরীর। তবুও বাবাকে বোঝালো সে বিশ্বাস করেছে। অরু ঘুমের মাঝেই কেঁপে উঠছে। আস্তে করে তার বুকের উপর হাত রাখলো তরী। আবারও মাহমুদের কল। সময় না নিয়ে রিসিভ করলো। ফোন কানে তুলতেই মাহমুদের ব্যাকুলতা টের পেলো,

-“তরী, কোথায় তুমি? সব ঠিক আছে? তোমাকে গতরাত থেকে কল, মেসেজ কোথাও পাচ্ছিনা!”
মাহমুদের ধুপধাপ পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ভীষণ অস্থিরতায় পায়চারি করছে মানুষটা। তরী ফুঁপিয়ে উঠলো। মাহমুদ আরও অস্থির হয়ে উঠলো,

-“এই তরী, কাঁদছো কেন? বলোনা আমায়, সব ঠিক আছে? তুমি ঠিক আছো?”
তরীর হেঁচকি উঠে যাচ্ছে। রোধ হয়ে আসা গলায় বলল,
-“মা, মা ভালো নেই। এখন অন্য হাসপাতালে শিফট করেছে।”
মাহমুদ চিন্তিত কন্ঠে শুধালো,

-“আন্টির এখনো জ্বর কমেনি?”
-“তরী হেঁচকি তুলে জবাব দিলো,
-“নাহ্।”
মাহমুদ কোমল হল।
-“তরী, আগে কান্না থামাও। আন্টির কিচ্ছু হবেনা। আল্লাহ সব ঠিক করে দেবেন। তুমি কিছুক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করো।”
মাহমুদ কল কেটে দিলেও তরী ঘুমালোনা। ঘুম আসলোনা চোখে।

মাহমুদের চিন্তা অন্য জায়গায়। আগামীকালই শুক্রবার। তরীর কথা অনুযায়ী কালই তিয়াসের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা। অথচ তার এখনো তিয়াসের সাথে কথা বলা হয়নি। তরী কাছ থেকে নম্বরও নেওয়া হয়নি। তরীর মায়ের শরীর স্বাভাবিক হলে হয়তো বিয়েটা কালই হয়ে যেতে পারে। চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলো সে। রাতে তারও ঘুম হলোনা। সকালে মাকে তরীর মায়ের অসুস্থতার কথা জানানোর সময় রামি শুনলো। আয়েশা সুলতানা বললেন,
-“আমাদের দেখতে যাওয়া উচিত। আমাদের সাথে তো কোন ঝগড়াঝাটি হয়নি। আর হলেও অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।”

মাহমুদ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল হাসপাতালে তরীর মাকে দেখতে যাবে। এখন মাকেও সঙ্গে নিল। রামি এসে যোগ দিল তাদের সাথে। সেও যাবে। মাহমুদ না করলোনা। তরীকে ফোন করে হাসপাতালের নাম জেনে নিল।
তরীর বাবা চেয়ারে বসে আছেন। একটু পরই আবার কতগুলো টেস্ট করাতে নিয়ে যাওয়া হবে তরীর মাকে। সেখানে মাহমুদ আর তার মা, ভাইকে দেখে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তিনি ওদের এখানে আশা করেননি। ভেবেছেন ভাই সকালে আসবে বলেছে, সেই এসেছে।

তবে উনাদের দেখে কোনরূপ রূঢ় ব্যবহার করলেন না। চুপচাপ রইলেন। একঘন্টা সময় পর তিয়াসের বাবা এলেন। মাহমুদের মা বাসায় গেলেন না। তিনি হাসপাতালে থেকে তরীকে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন রেস্ট নেওয়ার জন্য। এতেও তরীর বাবা হ্যাঁ, না কিছুই বলেন নি। তিয়াসের বাবা আবার আধাঘন্টা না পেরোতেই কাজ আছে বলে চলে গেলেন। মাহমুদ ঘোরাফেরায় রইলো। ডাক্তারের সাথে কী কী যেন বলছে। এই মুহূর্তে একজন বড়ছেলের ভীষণ অভাববোধ করলেন তরীর বাবা। রিপোর্ট আসলো। তরীর বাবাকে ডাকা হলো ডাক্তারের চেম্বারে। উনার চোখমুখ মলিন। আতঙ্কিত চেহারা দেখে মাহমুদ তরীর বাবার সামনে সাহস করেই বলে ফেললো,

-“আমিও যাবো আপনার সাথে, চলুন আঙ্কেল।”
তরীর বাবা একবার গম্ভীর হয়ে বললেন,
-“তার দরকার নেই।”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৩

মাহমুদ বারণ শুনলোনা। তরীর বাবার সাথে ঢুকে পড়লো। ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বললেন,
-“রিপোর্ট খুব একটা ভালো নয়। রোগীর অবস্থা সিরিয়াস।”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২৫

3 COMMENTS

Comments are closed.