প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫৫

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫৫
Writer Mahfuza Akter

ক্লান্ত অপরাহ্নের শেষ প্রহর আগতপ্রায়! সারাদিনের উত্তপ্ততার শেষে সূর্য তার তেজ কমিয়ে বিদায় নিতে যাচ্ছে। নির্মল আকাশের গায়ে সদ্য সৃষ্টি হওয়া হরিদ্রাভ আভাগুলোর দিকে দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে অরিত্রী। তার চোখ দুটো অজানা কারণে অদ্ভুত প্রাপ্তিতে হাসছে। ফুরফুরে হাওয়ায় গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করলো সে। সামনের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখের ওপর পড়তেই অজানা আনন্দে ভরে গেল মন। সে ভাবতেও পারেনি, এখানে আসার পর তার এতোটা ভালো লাগবে।

অর্থী অরিত্রীর হাবভাব গুলো মনযোগ সহকারে দেখছে। মনে মনে হাসছে আর ভাবছে, মেয়েটা অসম্ভব মায়াবী। জীবনের কাছে ওর অনেক সুখ আজও পাওনা। শুধু মাত্র কাছের মানুষগুলোর বোকামির জন্য ওর জীবন এক অনাকাঙ্ক্ষিত মোড় নিয়েছে। ভাবতে ভাবতেই অর্থী বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আচ্ছা, তোর ছোটবেলার কোনো কিছু মনে পড়ে না? ছোটকালের কিছু কিছু স্মৃতি তো মানুষ কখনো ভোলে না!”
অরিত্রী অর্থীর দিকে তাকিয়ে চোখে হাসলো। বললো,
“অনেক কথা মনে পড়ে। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে দাদীর কথা। দাদী আমাকে এত্তো আদর করতো! সেটা দেখে মধু সবসময় রাগ করত আর দাদীর সাথে ঝগড়া করত। বড়আব্বু আর কাকিমনির কথা তো না-ই বলি! তবে অরুণী আমায় সবসময় মারতো। আমিও তখন কিছু বুঝতাম না!”

“সবার থেকে বেশি কে ভালোবাসতো বলে তোর মনে হয়?”
অরিত্রী ভ্রু কুঁচকে চিন্তা করলো কিছুক্ষণ। ভাবুক ভঙ্গিতে বললো,
“সবাই-ই ভালোবাসতো। কিন্তু মায়ের থেকে বেশি তো কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে না। তবে এটাও সত্যি, ঐসময়ে আমার সবচেয়ে বেশি কেয়ার করতো সৌহার্দ্য।”
অর্থী না জানার ভান করে বললো,

“সৌহার্দ্য? এটা কে? বাকি সবার কথা প্রায়ই বললেও এই নামটা তোর মুখে কখনো শুনিনি!”
“আমার কাজিন। আমার অনেক কাছের মানুষ ছিল ও। আমার থেকে বয়সে বেশ বড় হলেও ওকে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর মতো মনে হতো, যার কাছে ছিল আমার হাজারো আবদার। হয়তো ছোট ছিলাম বলে এমন মনে হতো! এখন অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। সৌহার্দ্য হয়তো এতো বছরে আমাকে ভুলেও গেছে! কিন্তু ওকে তো আমি ভুলিনি! ইন ফ্যাক্ট, আমি কাউকেই ভুলিনি।”

অর্থী মনে মনে হাসলো। ভাবলো, “সারা পৃথিবী তোকে ভুলে গেলেও সৌহার্দ্য তোকে ভুলবে না কোনোদিন। কিন্তু এই মানুষটাকে তো তুই-ই ভুলে গিয়েছিস, তরী! আফসোস!”
অরিত্রীর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে অর্থী প্রশ্ন তুললো,
“ওদের কথা এতো মনে করিস! ওদের সাথে একবার দেখা করতে ইচ্ছে করছে না তোর?”
অরিত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

“কী দরকার! প্রায় দুই যুগ পেরিয়ে গেছে। অনেকটা সময়! বদলে গেছে সবকিছুই। ওরা ওদের জীবনে ভালোই তো আছে! আমিও আমার পৃথিবীতে সুখী। সেখানেই আমি ভালো আছি। এখানে তো আমার প্রতিটা মুহুর্তে সেই সময়টার কথা মনে পড়বে! নিজের বাবার হাতে নিজের মায়ের র*ক্ত দেখার মতো কঠিন দৃশ্য দ্বিতীয়টি আছে বলে আমার মনে হয় না। এখন যাদেরকে মা-বাবা বলে জানি, তারাই আমার দুনিয়া। এদের ছাড়া আর কিছু ভাবতে চাই না আমি।”
“তাহলে কি এখানে শুধু এই দেশটা ঘুরে দেখার জন্য এসেছিস? আর কোনো উদ্দেশ্য নেই?”

অরিত্রী কিছুক্ষণ নীরব রইলো। আনমনে ভাবলো হয়তো কিছু! নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো,
“কিছু কনফিউশান আছে। সেগুলো দূর করার ইচ্ছে আছে। এখন জানি না কী হবে?”
অর্থী অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরিত্রীর দিকে। মেয়েটার মনে কী চলছে বুঝতে পারছে না ও! যেই সময়টা ও ভুলে গেছে, সেটা মনে করার কি বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ওর মনে নেই? ব্যাপারটা নিয়ে ওর মধ্যে কোনো কৌতুহল-ই দেখতে পাচ্ছে না অর্থী।

হঠাৎ ড্রাইভার সজোরে ব্রেক কষায় চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো অর্থী। দু’জনেই সামনে ঝুঁকে পড়লো। অরিত্রী কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“দেখে গাড়ি চালানো উচিত। এভাবে তো আপনি হুটহাট এক্সিডেন্ট ঘটিয়ে ফেলবেন। আশ্চর্য!”
ড্রাইভার অসহায় কন্ঠে বললো,
“আমার কী দোষ, ডাক্তার আপা? ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে মা-বাবারা এভাবে রাস্তায় ছেড়ে দিলে তো ওরা গাড়ির সামনে চলে আসবেই!”

অরিত্রী দাঁত কিড়মিড় করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো। গাড়ির দরজা খুলে সামনে এগিয়ে যেতেই দেখলো, একটা বাচ্চা মেয়ে একটা বাচ্চা ছেলেকে বকাবকি করছে! দু’জনকে দেখে সমবয়সী-ই মনে হলো অরিত্রীর। মেয়েটা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলছে,
“বলেছিলাম তোকে, ভাই! এভাবে দৌড়াদৌড়ি করতে মানা করেছিলাম। পার্ক থেকে কেন বের হয়েছিস তুই?”
ছেলেটা নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে বললো,

“প্রণয়ীর বাচ্চা! প্যানপ্যানানি বন্ধ করে আমায় টেনে তোল আগে। পায়ে বেশ জোরে ব্যথা লেগেছে। উফ্!”
প্রণয়ী নিজের সব শক্তি দিয়ে প্রণয়ের হাত ধরে টান দিলো। প্রণয় আহ্ করে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে বললো,
“উফ! আমার হাতটা শেষ করে দিলি, গাধী! হাতেও ছিঁলে গেছে, দেখ!”
প্রণয়ের হাতের কনুইয়ে ক্ষত থেকে রক্ত পড়তে দেখে প্রণয়ী অসহায় চোখে তাকালো। এখন কী করবে সে?
অরিত্রী এগিয়ে গিয়ে প্রণয়কে ধীরে-সুস্থে উঠিয়ে দাঁড় করালো। অর্থী গাড়ি থেকে নেমে ওদেরকে দেখে অবাক কন্ঠে বললো,

“আরেহ্! তোমরা এখানে এই অবস্থায় কেন?”
প্রণয়ী অর্থীকে দেখে ভরসা পেল। ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“অর্থী আন্টি, ভাই অনেক ব্যথা পেয়েছে। ওর হাত থেকে র*ক্ত পড়ছে। দেখো না!”
অরিত্রী কিছু বুঝতে পারলো না। অর্থীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুই ওদেরকে চিনিস? ওরা কারা?”

অর্থী তড়িৎ গতিতে ওদের পরিচয় বলতে গিয়েও বললো না। কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললো,
“ওরা আমার ভাইয়ের বন্ধুর ছেলেমেয়ে। এজন্য চিনি ওদেরকে।”
“অহ্, আচ্ছা! তুই ফার্স্ট এইড বক্সটা আমার লাগেজ থেকে বের করে আনার ব্যবস্থা কর। আমি ওদেরকে নিয়ে পার্কে গিয়ে বসছি।”

অর্থী মাথা নাড়াতেই অরিত্রী ওদেরকে নিয়ে পাশের পার্কে ঢুকে পড়লো। একটা চেয়ারে প্রণয়কে বসিয়ে অরিত্রী ওর সামনে ঘাসের ওপর বসে পড়লো। প্রণয়ী প্রণয়ের পাশে বসে ভাইয়ের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
অরিত্রী ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“রাস্তায় কী করতে গিয়েছিলে তোমরা?”
প্রণয়ী কয়েক বার মাথা নাড়িয়ে বললো,

“আমি যাইনি কোথাও? আমরা তো এখানে খেলতে এসেছিলাম! হঠাৎ দেখি প্রণয় পার্ক থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে। আমিও ওকে ডাকতে ডাকতে বাইরে বের হতেই দেখি ও রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে, আর একটা গাড়ি ওর কাছে এসে থেমে গেছে।”
অরিত্রী চোখ ছোট ছোট করে প্রণয়ের দিকে তাকাতেই সে ঠোঁট উল্টে বললো,
“আমার কী দোষ? রাস্তা দিয়ে একটা আইসক্রিম ভ্যান যাচ্ছিলো। আমি তো প্রণয়ীর জন্য আইসক্রিম কিনতে যাচ্ছিলাম। আমি কি জানতাম নাকি যে, ঐভাবে পড়ে যাবো।”
অরিত্রী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“যদি গাড়িটা তোমায় ধাক্কা দিতো? তখন কী হতো একবার ভেবে দেখেছো? তোমার মা-বাবা কতটা কষ্ট পেত কোনো আইডিয়া আছে তোমাদের!”

অরিত্রীর ধমকে প্রণয়ী হালকা কেঁপে উঠল। শুকনো ঢোক গিলে প্রণয়ের দিকে তাকালো। প্রণয়ে শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে অরিত্রীর দিকে। মায়ের কথা শুনলেই রাগে ওর চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। প্রণয় চায় না কেউ ওর মাকে নিয়ে কোনো কথা বলুক! ভালো বা খারাপ কোনো কথাই না। কেউ কিছু বললেই তার সাথে প্রণয় রাগারাগি করে। এখন কি অরিত্রীর সাথেও একই আচরণ করবে? ভেবেই প্রণয়ী ভীত দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু খেয়াল করে দেখলো, প্রণয়ের চোখ দু’টো আজ বেশ স্বাভাবিক। সেখানে কোনো রাগ বা ক্ষোভ নেই। কেবল অবাকতা আর কিছু খুঁজে ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে প্রণয়।

হঠাৎ অর্থী ফার্স্ট এইড বক্সটা এনে অরিত্রীর হাতে দিয়ে বললো,
“সরি, ইয়ার। বক্স খুঁজে বের করতে একটু সময় লাগায় লেইট হয়ে গেল!”
“প্রব্লেম নেই”, বলেই অরিত্রী প্রণয়ের হাত ও পায়ের র*ক্ত গুলো মুছে দিয়ে মেডিসিন লাগিয়ে দিতে লাগলো। অর্থী প্রণয়ের পাশে বসে ওর মাথায় চুমু দিয়ে বললো,
” বেশি ব্যথা লেগেছে, বাবা?”

প্রণয় এক দৃষ্টিতে অরিত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। অর্থীর কথা ওর কানে প্রবেশ করেও করলো না যেন। ব্যান্ডেজ করা শেষে অরিত্রী নিজের মুখের সামনে চলে আসা ছোট ছোট চুলগুলো সরিয়ে ফেললো। সেগুলো কানে গুঁজতেই প্রণয়ী ওর দিকে তাকিয়ে হাসিহাসি মুখে বললো,
“তুমি অনেক সুন্দর!”

অরিত্রী হাসলো। প্রণয়ীর গাল টেনে দিয়ে বললো,
“আপনিও অনেক সুন্দর। একদম প্রিন্সেসের মতো।”
প্রণয়ী খুশি হলো। বললো, “আমার পাপা আর আঙ্কেলও এটা বলে। কিন্তু আমার মা আরো বেশি সুন্দর ছিল। হয়তো আপনার থেকেও বেশি সুন্দর।”
অরিত্রী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫৪

“সুন্দর ছিল মানে?”
প্রণয় বিরক্ত হয়ে বললো,
“আমাদের মা নেই। হারিয়ে আমাদের জীবন থেকে। আমাদের পাপা-ই আমাদের মা।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫৬