এ শহরে বৃষ্টি নামুক গল্পের লিংক || লেখিকা মালিহা খান

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ১+২
লেখিকা মালিহা খান

মধ্যরাতে অচেনা একটা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রাখার চেয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি আর কি হতে পারে জানা নেই নিভ্রানের।
রাতের বেলা রাস্তা ফাঁকা।বাস চলছে সাঁই সাঁই গতিতে।ঘুমন্ত যাত্রীসমেত নিস্তব্ধ বাসটাকে মৃত্যুপুরীর সঙ্গে তুলনা করলেও ভুল হবেনা।অবশ্য চট্রগ্রাম টু ঢাকার সিটিং বাসে রাত কাটানোর জন্য ঘুমের বিকল্প নেই।
বাইরে বৃষ্টি নেমেছে।ঝমাঝম শব্দের মনমাতানো আভাস প্রকৃতির আনাচে কানাচে।
মেয়েটা বসেছিলো জানালার পাশে।বাসের অন্য সব জানালা খোলা থাকলেও ঝড়ো বাতাস শুরু হওয়া মাত্রই এই জানালাটা আটকে দিয়েছিলো সে।বৃষ্টি প্রচন্ড প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও তখন যেচে পরে কিছু বলেনি ।নিভ্রান।পাছে মেয়েটা তাকে গায়ে পরা স্বভাবের ভাবে।
হাত বাড়িয়ে জানালাটা খুলে দিলো নিভ্রান।সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির ছাঁটওয়ালা দমকা হাওয়া ছুঁয়ে দিলো তার সর্বাঙ্গ।পরম আবেশে চোখ বুজে ফেললো ।বৃষ্টি তার সাংঘাতিক পছন্দের।

মেয়েটা দূর্বল স্বরে গোঙ্গাচ্ছে।সেই করুণ সুরে চোখ মেললো নিভ্রান।পূর্ণদৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকাতেই মেঘেদের আলোর ঝলকানিতে কয়েক মুহুর্তের জন্য স্পষ্ট হয়ে উঠলো নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে ঘেরা চেহারাটা।মেয়েটা গায়ের রং একটু বেশিই সাদা।চেহারায় নিদারুন সারল্যতা।তবু অতি অপরুপের মাঝেও সব কেমন ফ্যাকাশে,নিষ্প্রান।মুখশ্রীতে ক্লান্তিকর,মলিন ছাপ ফুটে উঠেছে।
আলোর ঝাপটা চলে গেলো,আবারো আঁধারে ডুব দিলো বাহ্যজগৎ।তপ্ত শ্বাস ছাড়লো নিভ্রান।বাতাসে মেয়েটার মাথার ওড়না কাঁধের উপর পরে গেছে।চুল উড়ছে লক্ষ্যহীনভাবে।চোখেমুখে আছরে পড়ছে বারবার।দ্বিধাগ্রস্ত হাতে কয়েকবার চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিলো নিভ্রান।লাভ হলোনা।অবাধ্য চুল উড়েই যাচ্ছে।উপায়ন্তর না পেয়ে হাতে পরা শখের রাবারের রিচব্যান্ডটা খুলে নিলো নিভ্রান।চুলগুলো আলগোছে গুছিয়ে ঢিলেঢালা একটা ঝুটি করে মাথার ওড়নাটা ভালোকরে তুলে দিলো।মেয়েটার শরীরে জ্বর আছে।কাছাকাছি থাকার ফলে কপাল না ছুঁয়েই বোঝা যাচ্ছে।নিভ্রান একবার ভাবলো ডেকে তুলে দিবে।ফের ভাবলো,থাক..ঘুমোচ্ছে ঘুমোক।ডাকার দরকার নেই।শরীরটা হয়তো খুব অসুস্থ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মেয়েটার বয়স বড়জোর বাইশ কি তেইশ হবে।এতটুকুন মেয়ে একা একা অসুস্থ শরীর নিয়ে কেন রাতের জার্নি করছে ব্যাপারটা বেশ ঘোলাটে লাগলো নিভ্রানের।
মাথায় একঝাঁক প্রশ্ন নিয়েই আবারো চোখ বোজল নিভ্রান।তন্দ্রাঘোরে একটু আচ্ছন্ন হতেই সশব্দে ডুকরে কেঁদে উঠলো মেয়েটা।তাড়াহুড়ো করে চোখ মেলল সে।মেয়েটা কাঁদছে।নোনা জলে বুক ভিজছে।বারবার গোঙ্গাচ্ছে আর কোমড়ের দিকের শার্ট এমনভাবে মুচরে ধরছে যেন এখনই ছিঁড়ে ফেলবে।কান খাড়া করলো নিভ্রান।
একটু মনোযোগ দিতেই বুঝতে পারলো মেয়েটা ‘বাবা’ ‘বাবা’ করে এলোমেলো বুলি আওয়াচ্ছে।
এবার প্রচন্ড মায়া হল।দ্বিধাদন্ত ভুলে গালের পানি মুছিয়ে দিলো নিভ্রান।শার্ট ধরা হাতটার উপর আলতো করে হাত রাখতেই মেয়েটা এমনভাবে তা আঁকড়ে ধরলো যেন কোন খেই হারা নৌকা শত প্রতীক্ষার পর একটা শক্তপোক্ত খুঁটি পেয়েছে।ছেড়ে দিলেই সে আবারো ভেসে যাবে উত্তাল অর্নবে।
ছোট্ট করে শ্বাস ফেলল নিভ্রান।মাথার ওড়নাটা নামিয়ে স্নেহের সহিত কিছুক্ষণ চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে দিতেই কান্না থেমে গেলো।শান্ত,স্নিগ্ধ তটিনীর মতো ঘুমিয়ে পরলো মেয়েটা।মাথা থেকে হাত সরালোনা নিভ্রান।স্নেহার্দ্র নয়নে চেয়ে বুকের মাঝে আগলে ধরে রাখলো সারারাত।

আকাশে সুর্যের দেখা মিলেনি।কালো কালো স্তুপীকৃত মেঘ এখনো ঘুরে বেরাচ্ছে নির্বিঘ্নে।বৃষ্টি পরছে গুড়ি গুড়ি।হিমশীতল ঠান্ডা পরিবেশ।একটু শীত শীত অনুভূত হতেই ঘুম ভাঙলো রাত্রির।চোখের উপর কালো ছায়া।
কয়েকমূহুর্ত লাগলো।নিজের অবস্থানটা বুঝে যেতেই খানিকটা চমকে উঠলো সে।মাথাটা ঘুরিয়ে উপরে তাকাতেই লোকটার চিবুক চোখে পরলো।সিটে মাথা এলিয়ে ঘুমোচ্ছে।হাতটা তার চুলের ভাঁজে ডুবানো।
লজ্জা,ভয়ে অস্থির হয়ে উঠলো রাত্রি।হুড়মুড় করে সরে যাওয়ার জন্য নড়তেই ঢুলুঢুলু চোখে তাকালো নিভ্রান।রাত্রি কে সজাগ দেখে নিজেই হাতটা সরিয়ে নিলো মাথা থেকে।একধাঁচে বসে থাকতে থাকতে পিঠ ধরে গেছে।বারকয়েক পিটপিট করলো চোখ পরিষ্কার করলো সে।হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলো।সকাল সাতটা দশ।
—“আপনার জ্বর কমেছে?”ভরাট কন্ঠে প্রশ্ন করলো নিভ্রান।
উওর দিতে পারলোনা রাত্রি।জড়োসড়ো হয়ে স্তম্ভিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শুধু।তার রাতে জ্বর এসেছিলো?লোকটাই বা তাকে এভাবে কেন ধরে ছিলো?
রাত্রির উওর না পেয়ে নির্দ্বিধায় তার কপালে হাতের উল্টোপিঠ ছুঁইয়ে দিলো নিভ্রান।অপ্রস্তুত হয়ে পরলো রাত্রি।নিভ্রান দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো।নরম গলায় বললো,”জ্বর নেই।পানি খাবেন?”
একটুসময় নিয়ে মৃদুভাবে দু’পাশে মাথা নাড়ালো রাত্রি।অপরহাত তখনো আবদ্ধ নিভ্রানের হাতের মাঝে।নিভ্রান আবারো সিটে মাথা এলিয়ে দিয়েছে।চোখে রাজ্যের ঘুম।রাত্রি ইততস্ত করলো।নিমীলিত,সঙ্কুচিত কন্ঠে বললো,

—“হাত ছাড়ুন।”
মেয়েটার কন্ঠটা চিকন।শুনতে খুব মিষ্টি লাগে।নিভ্রান হাসলো।চোখ বন্ধ অবস্থাতেই স্পষ্টভাষায় বললো,
—“আপনি ধরে রেখেছেন মিস।আমি নই।”
নিজের কান্ডে নিজেই নির্বুদ্ধি,অর্থহীন হয়ে পরলো রাত্রি।দ্রুত হাতটা ছেড়ে দিতেই নিভ্রান বুকের উপর আড়াআড়িভাবে দু’হাত ভাঁজ করে আরাম করে মাথা এলিয়ে বললো,
—“পর্দাটা টেনে দিন।”
আড়চোখে লোকটাকে ধারালো নজরে দেখে নিলো রাত্রি।পরণে ব্ল্যাক কালারের পোলো শার্টের সঙ্গে ব্লু জিন্স ।চেহারায় সুপুরুষ,চালচলনে আভিজাত্যর ছোঁয়া।কথাবার্তায় ব্যাক্তিত্বটাও তেমন নড়বড়ে লাগলোনা।গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রাত্রি।সিটিং বাসে জানালার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত লাল রংয়ের পর্দা দেয়া।আস্তে করে পর্দাটা টেনে দিলো সে।ঢাকা পৌছোতে হয়তো আর ঘন্টাখানেকের মতো লাগবে।গতকাল বিকেলের দিকে শেষ খেয়েছে।রাতে কিছু খাওয়া হয়নি।সন্ধ্যায় রওনা দিয়ে বাসস্টপ পর্যন্ত আসতে আসতেই দেরি হয়ে গিয়েছে।মাথাটা ঝিমঝিম করছে।দূর্বল লাগছে খুব।ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো রাত্রি।মায়ের নাম্বারে ডায়াল করতে যেয়েও থেমে গেলো।মা এখন ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে।ফোন ধরবেনা।ফোনটা আবারো ঢুকিয়ে রাখলো সে।চোখ বুজতেই বুঝলো মস্তিষ্কের টনটনে ব্যাথাটা আবারো শুরু হয়েছে।ইদানীং আবার হুটহাট মাথাব্যাথা করে।এত ঝড়ঝাপটা হয়তো তার ছোট্ট মস্তিষ্কটা সামলে উঠতে পারেছেনা।

পরিবেশ থমকে আছে।আগত ঝড়ের পূর্বাভাস এই থমথমে ছাইরঙা গগন।হিমেল হাওয়া দলবল নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে একূল থেকে ওকূল।বাস থেমে গেছে।তম্রসারা হানা দিয়েছে।চরম আলোকশূন্যতায় ভুগছে পরিবেশ।
বাস থেমে গেছে স্টপে।যাত্রীরা নেমে যাচ্ছে ধাক্কাধাক্কি করে।গায়ের ওড়না খুলে ভালোমতো পেঁচিয়ে নিয়ে উঠে দাড়ালো রাত্রি।নিভ্রান ঘাড় ফিরিয়ে একনজর দেখে নিলো তাকে।মেয়েটা একহাতে সামনের সিট ধরে অপরহাতে নিজের ব্যাগটা তুলে নিয়েছে।চোখেমুখে ঘোর দূর্বলতা।কেমন পানসে ফিকে হয়ে গেছে।
অবিলম্বে হাত বাড়িয়ে দিলো নিভ্রান।ব্যাগের দিকে ইশারা করে নমনীয় কন্ঠে বললো,
—“আমাকে দিন।”

রাত্রি মুখ তুলে তাকালো।সচ্ছ চোখের মনিজোড়ায় কয়েকটি সুন্দরমূহুর্ত কেটে গেলো নিভ্রানের।কি অপূর্ব!ঘোর ভাঙলো রাত্রির আলতো স্বরে বলা”আমি পারবো।”কথাটায়।দ্রুত চোখের পলক ফেললো সে।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে রাত্রির হাত থেকে ব্যাগটা টেনে নিয়ে হাতবদল করে নিজের ব্যাগ আর রাত্রির ব্যাগ একহাতেই তুলে নিলো।রাত্রি আমতা আমতা করলো।চোখটা ঘোলাটে হয়ে আসছে বারবার।মাথা ঘোরাচ্ছে।তবুও অন্যর উপর নির্ভরশীল হওয়া তার স্বভাব নয়।আচমকাই বেসামাল হয়ে পরলো সে।পরমুহুর্তেই সামনের সিটটা শক্ত করে ধরে দুবার চোখের পাপড়ি ঝাপছে হাত এগিয়ে দিলো।ব্যাগটার দিকে চেয়ে এলোমেলো স্বরে বললো,
—“দেখুন আমি পারবো।দিন।”
নিভ্রান দিলো তো না ই।উল্টো রাত্রির মেলে রাখা হাত নিজের হাতের মুঠোয় টেনে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,
—“আপনি নিজে ভালোকরে দাড়াতে পর্যন্ত পারছেন না আবার ‘পারবো’ ‘পারবো’ করছেন?আসুন আমার সাথে।”
রাত্রি গোলমেলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।মাথাটা সত্যিই প্রচন্ড ঘোরাচ্ছে।এই ঠান্ডা বাতাসেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।তবুও নিজেকে সামলে নিস্তেজ স্বরে বললো,
—“আমি..”
তার বাক্য শেষ করতে দিলোনা নিভ্রান।হাতটা টেনে নিজের একটু সামনে দাড় করিয়ে দাঁত দাঁত চেপে বললো,
—“চুপ করে আস্তে আস্তে নামুন।”
কথা বাড়ালোনা রাত্রি।নিশব্দে নিভ্রানের হাত ধরে রাস্তায় নেমে এলো।রাস্তায় পানি জমেছে।কাঁদাপানিতে ঝপাঝপ শব্দ তুলে মানুষজন হাঁটছে।বাতাসের বেগ বেড়ে গেছে।নিভ্রান আশেপাশে তাকালো।রাত্রির হাতটা আরো একটু শক্ত করে ধরে খুব সাবধানে এগোতে এগোতে বললো,

—“কোথায় যাবেন আপনি?সিএনজি ঠি ক করে দেই।”
সিএনজি শব্দটা কানে যেতেই মিইয়ে গেলো রাত্রি।সিএনজিতে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত টাকা বা ইচ্ছা কোনোটাই নেই তার।কিন্তু ওটাতো আর লোকটাকে বলা যায়না।নিভ্রান ততক্ষনে একটা সিএনজির সামনে যেয়ে দাড়িয়েছে।রাত্রিকে ঠি কানা জিজ্ঞাসা করতেই সে আমতা আমতা করে ঠি কানা বলে বললো,
—“কাছাকাছিই যাবোতো,সিএনজি লাগবেনা।”
নিভ্রান নিশব্দে হাসলো।বললো,”আপনি আশেপাশে রিকশা দেখতে পারছেন মিস?তাছাড়া ঝড় ছেড়ে দিবে।এই ব্যাগ নিয়ে আপনি কিকরে রিকশায় যাবেন?”বলেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলোনিভ্রান।মেয়েটাকে সে কোনোক্রমেই একা ছাড়বে না।এমনেই দূর্বল দেখাচ্ছে।তার উপর মুঠোয় থাকা নরম হাতটার তাপ ক্রমশ বাড়ছে।আবার জ্বর উঠছে গায়ে।অসুস্থ মেয়েটাকে মাঝরাস্তায় একা ছেড়ে দেয়া কস্মিককালেও সম্ভব না তার পক্ষে।
চট করে আশেপাশে তাকালো রাত্রি।আসলেই রিকশা নেই।ঢাকাশহরের এমনেই রিকশা সংকট আর বৃষ্টির দিনে তো বলার বাইরে।ছোট্ট করে শ্বাস ফেললো সে।বিনীত স্বরে বললো,”আমি কোন একটা ব্যবস্থা করে নিবো।সমস্যা নেই।”
মেয়েটার অবসন্ন চোখজোড়া দেখে হঠাৎই কিছু একটা আন্দাজ করলো নিভ্রান।পরক্ষণেই মুচকি হেসে বললো,”ভাড়া আমি দিয়ে দিবো।আপনি ভেতরে বসেন।”
“ভাড়া আমি দিয়ে দিবো”কথাটা কানে যেতেই এতক্ষনের শান্ত মেয়েটা হঠাৎই কঠিন হয়ে উঠলো।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিভ্রানের দিকে চেয়ে নিচু তবে প্রচন্ড গাঢ় কন্ঠে বললো,

—“আমার সাহায্য প্রয়োজন নেই।”
নিভ্রান হাসলো মনে মনে।মেয়েটার কন্ঠে প্রবল আত্মসম্মানের পরিস্ফুট আভাস।এতটুকুন মেয়ের এহেন আত্নসম্মানবোধ প্রচন্ডভাবে টানলো তাকে।মেয়েটা সত্যিই ভীষণ অন্যরকম।
গলা ঝাড়লো নিভ্রান।মুখের কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে মুচকি হেসে বললো,
—“ঠিকাছে।তবে আপনাকে একা ছাড়াটা আমার সমীচীন মনে হচ্ছেনা।তাছাড়া আপনার বাসা যেহেতু কাছে আর আমার বাসা তার থেকে অনেকটাই দূরে তো স্বাভাবিকতই আমার ভাড়াটা বেশি আসবে।তাইনা?তো মোটমাট ভাড়া থেকে আপনি আপনার ভাড়াটুকু দিবেন মানে ষাট অথবা সত্তর টাকা আর বাদ বাকিটা আমি দিবো।আমি কিন্তু সাহায্য করছিনা জাস্ট হিসেবটা বলছি।”
পাল্টা জবাব দিতে যেয়েও দিতে পারলোনা রাত্রি।লোকটার যুক্তিটা কথার বেড়াজালে ফাঁসিয়ে দেয়ার মতো।
যেখানে আপত্তি করে কিছু বলা যায়না।হাঁফ ছাড়লো সে।নামানো গলায় বললো,
—“আচ্ছা,ঠিকাছে।চলুন।”
ভেতরে বসে দরজার হাতল আটকে দিলো নিভ্রান।রাত্রির হাত তখনো তার হাতের মুঠোয়।আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল ডুবানো।সিএনজি ছাড়ার আগেই মুষুলধারে বৃষ্টি নেমে গেলো।আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে জলপাত শুরু হয়েছে।সিএনজির দু’পাশের পলিথিনের পর্দা টেনে দিলো নিভ্রান।বদ্ধ জায়গাটায় শুধুই ঘনঘন উষ্ম নিশ্বাসের চলাচল।পিচঢালা রাস্তায় বৃষ্টির ফোঁটা পরছে।ঝুম ঝুম ঝুম।

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২

মেঘেদের গুড়ুম গুড়ুম গর্জন শোনা যাচ্ছে।পলিথিনের পর্দাটা একটু সরিয়ে লোহার শিঁকগুলোয় একহাত রেখে বাইরে তাকিয়ে আছে রাত্রি।বৃষ্টির ছঁটায় একটু আধটু ভিজে উঠছে হাত-মুখ।নিভ্রান হাল্কা কেঁশে গলা পরিষ্কার করলো।মুঠোয় রাখা হাতের বাঁধন ঢিলে করে দিলেও তা ছুটে গেলো না।রাত্রি নিজের অজান্তেই সজোরে খামছে ধরেছে তাকে।মুচকি হাসলো নিভ্রান।চোখ তুলে রাত্রির মুখের দিকে তাকালো।বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়েই থাকলো একাধারে।মেয়েটার সৌন্দর্য্য অপার্থিব।পাতলা ঠোঁটজোড়া মৃদু কম্পমান।বারবার চোখের ভারি পল্লব ঝাপটাচ্ছে।গালের উপর কয়েক ছিঁটা পানি।নিভ্রান শুকনো ঢোঁক গিললো।দৃষ্টি সরিয়ে ভরাট গলায় প্রশ্ন করলো,
—“নাম কি আপনার?”
ঘাড় ফিরিয়ে একপলক তাকালো রাত্রি।পরক্ষণেই মৃদু হেসে উওর দিলো,”আমি রাত্রি।”বলে আবারো বৃষ্টি দেখায় মন দিলো সে।মনে মনে কয়েকবার নামটা স্বগতোক্তির মতো আওড়ে নিলো নিভ্রান।পুনরায় বললো,
—“তো,রাত আপনি…”
তার কথা শেষ হবার আগেই শব্দ করে হেসে ফেললো রাত্রি।হাসলো নিভ্রানও।নিষ্পলক নয়নে চেয়ে থেকে
ধীরকন্ঠে বললো,
—“হাসছেন কেনো?”
কোনরকমে হাসি থামালো রাত্রি।চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নরম স্বরে বললো,
—“আমার নাম রাত-রি।রাত নয়।”
—“আমি নাহয় রাত-ই ডাকি।”

মুখে উওর দিলোনা রাত্রি।সম্মতিসূচক হাসি হাসলো শুধু।বাতাসের বেগ বেড়েছে।বৃষ্টির পানিও তীব্রভাবে ঢুকে পড়ছে ফাঁক দিয়ে।চোখের উপর কয়েকটা ঝাপটা এসে পরতেই দ্রুত পলিথিনটা ছেড়ে দিয়ে একহাতে চোখ কঁচলালো রাত্রি।
গায়ের জ্বরটা নেমে গেছে হঠাৎই।ঘাড়,গলা ঘামে ভিজে উঠেছে।নিভ্রান পকেট থেকে রুমাল বের করে এগিয়ে দিলো।ইশারা করলো ঘাম মুছে নিতে।মৌনমুখে কিছুক্ষন ইততস্ত করে অত:পর দ্বিধাগ্রস্ত হাতে রুমালটা নিলো রাত্রি।ঘাম মুছে পুনরায় নিভ্রানের কাছে দিকেই নিভ্রান তা সযত্নে ভাঁজ করে পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বললো,
—“এভাবে একা একা জার্নি করবেন না রাত।কাল কতো অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন জানেন?”
—“আমার অভ্যাস আছে।”তৎক্ষনাত উওর দিলো রাত্রি।
খানিকটা অবাক হলো নিভ্রান।ঘাড় বাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“অসুস্থ হবার অভ্যাস আছে?”
আবারো হেসে ফেললো রাত্রি।হাসতে হাসতেই বললো,
—“জার্নি করার অভ্যাস আছে।”
এবার আর হাসলো না নিভ্রান।গম্ভীর স্বরে বললো,

—“এতটুকুন মেয়ে এতদূর জার্নি করেন কেনো?আর করলেও রাতের বেলাটা এভোয়েড করবেন,বুঝলেন?”
রাত্রির চোখেমুখে হঠাৎই অদ্ভুত এক কালো ছাঁয়া খেলে গেলো।হাসিটা থেমে গেছে।ঠোঁটের আকৃতিটায় ফুটে উঠেছে বিষাদের দাগ।মাথা ঝুঁকিয়ে মুখের উপর উড়ে বেড়ানো কয়েকটা অগোছালো চুল কানের পিছে গুঁজে দিতে দিতে সে বললো,
—“আসলে,ওখানে আমার মা থাকেতো।একটা সমস্যা হয়েছিলো তাই তাড়াহুড়ো করে যেতে হয়েছে।কাল থেকে আবার ভার্সিটিতে পরীক্ষা শুরু হবে তাই গতরাতেই রওনা দেয়া ছাড়া উপায় ছিলোনা।”
—“আপনার মা ওখানে তাহলে আপনি..”
—“আমি একা থাকি।”মুচকি হেসে উওর দিলো রাত্রি।
নিভ্রান গভীর দৃষ্টিতে তাকালো।এই হাসিটার পিছে ঠি ক কতটা কষ্ট লুকিয়ে আছে বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছেনা।কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে মেয়েটার হয়তো বাবা নেই।বাবা ছাড়া একটা পরিবারকেও ঠি ক কতটা ঝড়ঝাপটা পোহাতে তা সবাই জানে।মায়া হলো নিভ্রানের।তবে মেয়েটার সাহসের বাহ্ববা দিতে হয় অবশ্যই।ঢাকাশহরে ছোট্ট একটা মেয়ের একা একা থাকা চাট্টিখানি কথা না।চারিদিকে খারাপ মানুষজন ওঁত পেতে থাকে কখন সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পরবে।

প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলো নিভ্রান।মেয়েটার মুখে বেদনা মানায় না।ব্যাক্তিগত প্রশ্ন ছেড়ে সে বললো,
—“কোন ভার্সিটিতে পরেন?”
অকপটে ভার্সিটির নাম বললো রাত্রি।লোকটাকে একেবারেই খারাপ মনে হচ্ছেনা।অভিজ্ঞতা আছে তার।মানুষের কথাবার্তার ভঙ্গি দেখলেই সে বুঝতে পারে কার উদ্দেশ্য খারাপ আর কার উদ্দেশ্য সৎ।
ভার্সিটির নাম শুনতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো নিভ্রানের।তার অফিসের কাছেই এই ভার্সিটি।কিন্তু মেয়েটার বাসাতো এদিকে।রোজ এতদূরের ভার্সিটিতে যায়?বিস্মিত কন্ঠে সে বললো,
—“আপনি যেই ঠি কানা বললেন সেখান থেকে তো অনেক দূরে হয়ে যায়।কাছাকাছি বাসা নিলেইতো পারেন।”
—“আরে না,এখনতো স্টুডেন্টকে পড়াতে যাচ্ছি।এদিকে একটা টি উশনি আছে।আমার বাসা ভার্সিটির কাছেই।এই দুদিন গ্রামে ছিলাম তাই পড়াতে পারিনি।আজকে মিস দেয়া যাবে না।তাই পড়িয়ে একেবারে বাসায় যাবো।”
বিস্ময় কমলোনা নিভ্রানের।বরং বাড়লো আরো খানিকটা।মেয়েটার কি ক্লান্তি নেই?রাতভর জার্নি করে এখন বাসায় না যেয়ে পড়াতে যাবে?অন্যকারো কথা বাদ ই দিক।তার নিজেরই তো গা ম্যাজ ম্যাজ করছে।কখন যেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিবে সেই অপেক্ষাই করছে।কন্ঠের বিস্ময়টা লুকাতে পারলোনা সে।বললো,

—“এই অসুস্থ শরীর নিয়ে?”
রাত্রি মলিনভাবে হাসলো।বললো,”অসুস্থ কোথায়?একদম সুস্থ আছি।”
তাল মেলালোনা নিভ্রান।রাত্রির চোখে চেয়ে শাসনভরা জোরালো গলায় বললো,
—“তবুও নিজের একটু খেয়াল রাখা উচিত রাত।ছোট মানুষ আপনি,এত চাপ নিবেন না।”
উওর দিলোনা রাত্রি।তবে খুব করে বলতে ইচ্ছে করলো,”নিজের খেয়াল রাখলে গেলে যে মায়ের খেয়ালটা রাখা হবেনা”।কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারলোনা।কারো কাছে নিজের অসহায়ত্ব কখনো প্রকাশ করেনা সে।নিজেকে অন্যর সামনে ছোট করা মানে নিজের আত্নসম্মান টাকে বিলিয়ে দেয়া।যা তার স্বভাবের একেবারেই বিপরীত।চোখ বুজলো সে।সিএনজিতে কাত করে মাথা ঠেকিয়ে বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দতরঙ্গ অনুভব করার চেষ্টা করলো।নিভ্রান তাকালো একবার।মেয়েটা বার বার মুগ্ধ করছে তাকে।এরকম শান্ত,সাহসী,দৃঢ় স্বভাব সে পূর্বে দেখেনি।

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৩+৪