এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৩+৪

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৩+৪
লেখিকা মালিহা খান

গন্তব্য পৌছে গেছে সিএনজি।পুরোটা সময় চোখ বন্ধ করেই কাটিয়েছে রাত্রি।চলন্ত বাহনটা হুট করে থেমে যেতেই চকিতে চোখ মেললো সে।নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসতেই নজর গেলো নিভ্রানকে ধরে রাখা হাতটার উপর।রাত্রির দৃষ্টি অনুসরণ করেই নিভ্রান ফিচেল গলায় বললো,”এবারো আপনি ধরে রেখেছেন।”

লজ্জা পেলো রাত্রি।নিভ্রান ঠোঁটে দুষ্টুমিমাখা হাসি।সেদিকে চোখ পরতেই লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নামালো সে।তড়িঘড়ি করে হাতটা ছেড়ে দিয়ে ব্যাগ থেকে নিজের ভাগের টাকা বের করে নিভ্রানের দিকে এগিয়ে দিয়ে মিনমিনে কন্ঠে বললো,”আপনি একসাথে দিয়ে দিয়েন।”
ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো নিভ্রান।রাত্রি ঠায় ধরে রয়েছে টাকাটা।বোঝাই যাচ্ছে সে কোনোক্রমেই নিভ্রানকে পুরো ভাড়া দিতে দিবেনা।মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে টাকাটা হাতে নিলো নিভ্রান।রাত্রি দেরি করলোনা।দ্রুত পলিথিনটা সরিয়ে দরজার হাতল ঘুরালো।নিভ্রান কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলো।ততক্ষনে বেরিয়ে পরেছে রাত্রি।মাথার উপর একহাত দিয়ে বৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করে অন্যহাতে ব্যাগটা নেয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেই টনক নড়লো নিভ্রানের।চোখের পলকে টাকাটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাত্রির ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে অপরপাশের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো সে।একপ্রকার দৌড়ে হাতের ছাতাটা খুলে রাত্রির মাথার উপর ধরলো।ঘটনার আকস্মিকতায় থতমত খেয়ে গেলো রাত্রি।লোকটা ছাতা কখন হাতে নিলো?
নিজে ভিজে তার উপর ছাতা ধরে রেখেছে কেনো?তার ভাবনার মাঝেই নিভ্রান মৃদু ধমকের স্বরে বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—“আপনি কি পাগল নাকি রাত?এই বৃষ্টিতে কেউ এভাবে বেরিয়ে পরে?”
বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো রাত্রি।বললো,
—“আপনি নিজেই তো ভিজে যাচ্ছেন।”বলেই নিভ্রানের বাহুতে আলতো করে ধরে তাকে ছাতার ভিতরে নিয়ে এলো রাত্রি।কুঁচকানো ভ্রু জোড়া ঠি ক করে ঠোঁট চেপে মৃদু হাসলো নিভ্রান।বললো,”বৃষ্টি আমার ভীষণ পছন্দ রাত।ভিজতে বেশ লাগে।কিন্তু আপনিতো বৃষ্টি বিদ্বেষী।আপনি কেনো ভিজবেন?”
মাথা ঝুঁকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো রাত্রি।একহাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাসতে হাসতেই বললো,
—“আপনাকে কে বলেছে আমি বৃষ্টি বিদ্বেষী?”
—“ওইযে গতরাতে বাতাস শুরু হওয়া মাত্রই যখন আপনি জানালা আটকে দিলেন তখন।”বলে সিএনজির ড্রাইভারকে একটু অপেক্ষা করতে বলে সামনে এগোলো নিভ্রান।তার পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চললো রাত্রিও।স্টুডেন্টকে বাড়ির গেটের ছাউনির ভেতরে ঢুকে যেতেই মুচকি হেসে হাতটা বাড়িয়ে দিলো রাত্রি।বললো,
—“দিন,এটুকু আমিই পারবো।”

স্মিত হাসলো নিভ্রান।ব্যাগটা রাত্রির কাছে দিয়ে নিজের ডানহাতটা রাখলো রাত্রির মাথার উপর।হকচকালো রাত্রি।চোখমুখ প্রশ্নাত্বক হয়ে উঠলো।নিভ্রান সেই চাহনী উপেক্ষা করে কোমল স্বরে বললো,”সাবধানে থাকবেন রাত।”
রাত্রি আমতা আমতা করলো।মা বাদে এমন আদরমাখা কথা সে শেষ কবে কার কাছ থেকে শুনেছিলো মনে পরছেনা।মুখের চোয়াল ভারি হয়ে উঠলো।চোখ জ্বালা করছে।কিন্তু এই মাঝরাস্তায় লোকটার সামনে কেঁদে ফেলা একেবারেই বাচ্চাদের মতো একটা কাজ হবে।বারকয়েক ঢোঁক গিলে কান্নাগুলো লুকিয়ে ফেললো সে।নিভ্রান আর সময় নষ্ট করলোনা।আলতো করে মাথার দুবার বারি দিয়ে হাত সরিয়ে নিলো।বললো,
—“ছাতাটা ধরুন।ফেরার সময় প্রয়োজন হতে পারে।’না’ করবেননা একদম।”
লোকটার আদেশভরা চোখের দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারলোনা রাত্রি।ছাতাটা নিয়ে বললো,
—“ধন্যবাদ।কিন্তু আপনাকে ফেরত দিবো কি করে?”
ঠোঁটের কোঁণ প্রসারিত হয়ে গেছে নিভ্রানের।রাত্রি যে এত সহজে মেনে যাবে সে আশা করেনি।বৃষ্টি মাথায় নিয়েই দু সিঁড়ি নেমে গেলো নিভ্রান।গলা বাড়িয়ে বললো,

—“যান,আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে।আর আমার ছাতা আমি নিজেই ফেরত নিয়ে যাবো।আসি,আল্লাহ হাফেজ।”
রাত্রির উওর শোনার আগেই কাঁদাপানিতে ঝপাঝপ শব্দ সৃষ্টি করে দ্রুত সিএনজিতে উঠে গেলো নিভ্রান।রাত্রি
বিমূঢ় হয়ে চেয়ে থেকে ছাতাটা বন্ধ করে চুপচাপ ভেতরে ঢুকে গেলো।
সিএনজিতে উঠে বসতেই ফোন বেজে উঠলো।পকেট থেকে দামি মোবাইলটা বের করে মুচকি হাসলো নিভ্রান।
মা ফোন দিয়েছে।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তেজী স্বর ভেসে আসলো,
—“বাড়িতে পৌছেছিস?একটা ফোন পর্যন্ত দেস না।কতবার বলি গাড়ি নিয়ে চলাফেরা কর।চট্রগ্রাম থেকে ফিরলি তাও বাসে করে।কি দরকার ছিলো এই ঝড়বাদলের মধ্য?”
নিভ্রান নির্বিকার ভঙ্গিতে উওর দিলো,
—“সবসময় তো গাড়িতেই আসা যাওয়া করি মা।এবারই শুধু বাসে আসলাম।আমি আর আধঘন্টার মধ্যই পৌছে যাবো।পৌঁছেই তোমাকে ফোন দিতাম।বুঝলে?কেনো যে এত টেনশন করো তুমি।”
নাহিদা হাসলেন।বললেন,

—“একা একা না থেকে তোর নিজের বাড়িতে চলে আয় বাবা।তাহলেইতো আমি চিন্তামুক্ত হয়ে যাই।”
তপ্ত শ্বাস ছাড়লো নিভ্রান।মা প্রতিদিন নিয়ম করে এই একটা কথা বলবেই তাকে।দিনশেষে রাত নেমে আসা যেমন বাধ্যতামূলক তেমনই দিনশেষে একবার হলেও মায়ের এই কথাটা শোনাও যেনো বাধ্যতামূলক।একথাটার পর আর কখনোই কথা বাড়ায়না নিভ্রান।এবারো ব্যাতিক্রম হলোনা।ভরাট গলায় সে বললো,
—“আচ্ছা রাখছি মা,পরে কথা হবে।বিকেলে ফোন দিবোনে।”
বিরস কন্ঠে সম্মতি জানিয়ে ফোন রাখলেন নাহিদা।ছেলের এই একরোখা জেদি স্বভাব সেই ছোট থেকে।
একবার যা বলে দিবে সেই কথার নড়চড় হবেনা কখনো।পৃথিবী উল্টে যাক তবু সে নিজের সিদ্ধান্তে অনড়।

দুপুরের হয়ে গেছে প্রায়।বৃষ্টি থেমেছে অনেক আগেই।তবে আকাশ মেঘলা হয়ে আছে।রুমে ঢুকেই ধপ করে বিছানায় বসে পরলো রাত্রি।শুয়েও পরলো প্রায় সাথেসাথেই।শরীর ভেঙে ঘুম আসছে।আবার ক্ষুধাও লেগেছে প্রচন্ড।বেশ কিছুক্ষণ মরার মতো পরে থেকে উঠে বসলো সে।গা থেকে ওড়না সরিয়ে চুলে হাত দিতেই একটু খটকা লাগলো।তার চুলতো বাঁধা ছিলোনা।এতক্ষণ খেয়াল করেনি।চুলে ঝুটি বাঁধলো কখন?
দ্রুতহাতে ঝুঁটিটা খুললো সে।হাতের মুঠোয় রিচব্যান্ডটা আসতেই ভ্রুজোড়া আপনাআপনিই কুঁচকে এলো।
ছেলেদের হাতের রিচব্যান্ড।মাঝখানে আবার সাদা ইংলিশ অক্ষরে লেখা,”NIVRAN”।কালো রংয়ের মধ্য সাদা অক্ষরগুলো ফুটে রয়েছে।তারমানে হয়তো লোকটা তাকে এটা দিয়ে ঝুঁটি বেঁধে দিয়েছিলো।আর নিভ্রান?নিভ্রান কি লোকটার নাম?এমন নাম হয় নাকি কারো?মাথা ঘামালোনা রাত্রি।দেখা হলে ফেরত দিয়ে দিবে ভেবে ব্যান্ডটা পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে রেখে ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বের করে নিয়ে গোসলে ঢুকে গেলো।

বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকে নিভ্রান।মা,বাবা,আর ছোট ভাইও শহরেই থাকে কিন্তু আলাদা।সে নিজের ফ্ল্যাট কিনেছে কয়েকবছর হয়ে গেছে।এরপর আর বাড়ি যায়নি।চট্রগ্রাম গিয়েছিলো নিজের অফিসের একটা কাজে।বাবার অবশ্য নিজস্ব ব্যাবসা আছে কিন্তু সেটায় তার আগ্রহ নেই।
রুমে এসে জামাকাপড় বদলে একেবারে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরোলো নিভ্রান।বাসার মেইড সব রান্নাবান্না করে দিয়ে যায়।এই তিনদিন সে ছিলোনা আজকে ফিরবে আগেই বলে রেখেছিলো তাই সকালে এসেই ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে খাবার রেডি করে দিয়ে গিয়েছে।এজন্য অবশ্য তাকে বেশ মোটা অংকের বেতন দেয়া হয়।
ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে রুমের এসি চালিয়ে দিলো নিভ্রান।জীবনে তার টাকার অভাব না থাকলেও সুখের বড়ই অভাব।এইযে একা একটা ফ্ল্যাটে সে থাকে।যতই বলুক না কেনো তার কোন সমস্যা হচ্ছেনা কিন্তু দিনশেষে একটা পরিপূর্ণ পরিবারের অভাবটাইতো তার নিত্যদিনের সঙ্গি হয়।

দ্বিতীয় সাক্ষাত টা হতে তেমন দেরি হয়নি।পরেরদিন বিকেলে টি উশনি করিয়ে বাসার নিচে নামতেই নিভ্রানের মুখোমুখি হয় রাত্রি।তব্দা খেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।লোকটাকে সে এইসময় এখানে আশা করেনি।ভাবেনি এত তাড়াতাড়ি আবার দেখা হবে।লোকটা নিশ্চয় ছাতা ফেরত নিতে এসেছে।কিন্তু লোকটা জানলো কি করে সে আজ বিকেলে পড়াতে এসেছে?সে যাই হোক,সে তো ছাতাটা সঙ্গে আনেনি।মূহুর্তেই কপালে সুক্ষ্ন চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠে রাত্রির।
তাকে দেখেই ঠোঁট এলিয়ে হাসে নিভ্রান।জবাবে সৌজন্যমূলক হাসি হাসে রাত্রি।
নিভ্রান বলে,
—“কেমন আছেন?”
রাত্রি ক্ষীণ কন্ঠে জবাব দেয়,”জি ভালো”বলে একটু সময় নেয়।তারপর কাঁচুমাচু করে বলে,আপনি নিশ্চয় ছাতাটা নিতে এসেছেন?”
চোখ ছোট্ট ছোট্ট করে তাকায় নিভ্রান।পরক্ষণেই গোলমেলে কন্ঠে বলে,
—“জি,ছাতাটা নিতেই আসলাম।”
দপ করে নিভে যায় রাত্রি।অপরাধীর মতো চোখ নামিয়ে বিনীত কন্ঠে বলে,
—“আমি তো আসলে সেটা সঙ্গে আনিনি।আপনি একটু কষ্ট করে আমার সাথে বাসা পর্যন্ত যেতে পারবেন?
না হলে আপনার এড্রেস দিন আমি গিয়ে দিয়ে আসবোনে।”
নিভ্রান মুচকি হাসে।রাত্রির মাথায় হাত রেখে সহজ গলায় বলে,
—“আরে,আপনি এত সিরিয়াস হচ্ছেন কেনো রাত?একটা ছাতাই তো।চলুন,আপনার বাসায়ই চলুন।”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক
লেখিকা মালিহা খান
পর্ব-৪

নীলরঙা গাঢ় বিকেল।বাহ্যজগৎ অলৌকিক নিরুপম।আকাশে শুভ্রনীলের বিশাল আধিপত্য।কয়েকটুকরা বিশুদ্ধ মেঘে বাউন্ডুলে যুবকের মতো কখন থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।প্রকৃতি ঘিরে আর্দ্রতার ছোঁয়া।
মেইনরোডের এখানে ওখানে পানি জমে আছে।সেই পানিতে রাস্তার ধারে বেড়ে উঠা বৃক্ষরাজির সুনিপুণ প্রতিচ্ছবি নতুন আয়নার মতো দৃশ্যমান।সময়টা চোখে আটকে থাকার ন্যায় সুন্দর।
ফুটপাতে ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটছে রাত্রি।তার পাশাপাশিই হাঁটছে নিভ্রান তবে তার পা রাস্তায়।রাত্রির মতে নিভ্রান তার তুলনায় খুব বেশি লম্বা।তাই পাশাপাশি হাঁটলে তাকে খুবই ছোট দেখায়।পথচারীরা নাকি কটুচোখে তাকায়।সেজন্যই সমান সমান বজায় রাখতে সে হাঁটছে ফুটপাতের উপর আর নিভ্রান রাস্তায়।

রাত্রির পরণে হাল্কা গোলাপি রংয়ের সাদামাটা ফুলহাতা কামিজ।মাথায় ওড়না টানা।একপাশে ঝুলছে পিঠের মধ্যখান পর্যন্ত দৈর্ঘ্যর মোটা বেনি।বামহাতে হ্যান্ডব্যাগ।ডানহাতটা খালি।সেই খালি হাতটাই নিজের শুদ্ধ স্পর্শে পূর্ণ করে দিলো নিভ্রান।আলতো করে টেনে নিলো নিজের হাতের মুঠোয়।সাথেসাথেই চমকে উঠলো রাত্রি।চোখেমুখে শিহরণ।ঠোঁটের মাঝে কিন্চিৎ ফাঁক।নিভ্রান স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
—“এত কিনার ঘেঁষে হাঁটছেন।কখন যেন পিছলে পড়ে যান।পড়লে তো সেই ধরতেই হতো তাই পড়ার আগেই ধরলাম।”
প্রতিবাদ করে কিছু বলতে যেয়েও হেসে ফেললো রাত্রি।নিভ্রানের এতবর্ষের সংযমী চোখজোড়াও বেহায়ার মতো চেয়ে চেয়ে অনুভব করলো সেই অসহনীয় হাসিটা।আলো হ্রাস পাচ্ছে।সন্ধ্যার আগমনী বার্তা মেয়েলি সুরে জানান দিচ্ছে,”আমি প্রায় এসেই পরেছি।”হঠাৎই এক দৈবাৎ হাওয়ার আগমন।কানের পিছে গোছানো চুলগুলো উড়ে চোখমুখ ঢেকে ফেললো নিমিষেই।মাথার ওড়নাটা পরে গেলো।চোখ বুজে চুল সরাতে গিয়ে তাল হারিয়ে ফেললো রাত্রি।পড়ার আগেই নিভ্রান তাকে সাবধানে রাস্তায় নামিয়ে নিলো।
কানের পিছে চুল গুঁজে দ্রুত চোখ মেললো রাত্রি।নিভ্রান তখন খুব ঘনিষ্ঠে।গায়ের পারফিউমের হাল্কা গন্ধটা পর্যন্ত তীব্রভাবে নাসিকারন্ধ্রে আঘাত হানছে।অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দু’কদম দুরত্ব সৃষ্টি করে নিলো রাত্রি।নিভ্রান ফোড়ন কাটলো,

—“বলেছিলাম না আপনি পড়ে যাবেন।”
—“আমি পড়িনি।আপনিই আগে আগে নামিয়ে দিলেন।নতুবা আমি ঠিকই সামলে নিতাম।”একহাতে মাথার ওড়নাটা তুলে নিতে নিতে আপত্তি করে উঠলো রাত্রি।সচরাচর সে এত কথা বলেনা।তার তো কথা বলার মানুষই নেই।একা একা থাকে।পড়াশোনা আর টি উশনি নিয়েই সারাদিন কেটে যায়।রাতে পাঁচ দশমিনিট মায়ের সাথে কথা বলে।তারপর একঘুমে রাত পাড়।ব্যস,এতটুকুই তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা।
এত সহজে সে কখনো কারো সাথে মিশেনা।কথা বলা তো অনেক দুর।কিন্তু এই লোকটার সাথে কেনো যেনো খুব সহজ হয়ে গেছে মাত্র দুদিনেই।লোকটার অমায়িক ব্যবহার,টানটান ব্যক্তিত্ব অনায়াসেই তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে।
রাস্তার ধারে অযত্নে বেড়ে উঠা কদমগাছ।সবুজ পাতাগুলো চকচক করছে।বৃষ্টি বোধহয় প্রকৃতির ধোয়ামোছা করার বিশ্বস্ত কর্মী।যখনই তা নোংরা-ধুলোময় হয়ে উঠে তখনই সে দুহাত মেলে যত্নকরে তাকে স্নান করিয়ে দিয়ে যায়।শহরজুড়ে নরম আঁধার নেমে এসেছে।রাত্রি যেখানে ভাড়া থাকে সে বাড়িটা তিনতলা।মোড় ঘুরলে প্রথম বাড়িটাই তার গন্তব্যস্হল।সেই মোড়েই আছে কদমগাছটা।কেউ হয়তো খুব সযত্নে লাগিয়েছিলো কিন্তু সময়ের পালাবদলের আর খেয়াল রাখা হয়নি।এই বর্ষার মাঝামাঝিতে অজস্র কদম শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে গাছটার।রাত্রি রোজই দেখে কিন্তু উচ্চতাটা একটু বেশিই উপরনিচ হওয়ার কুবাদে ফুল পাড়ার বাসনাটা সেখানেই চুরমার হয়ে যায়।নিভ্রান হাটছিলো নিশব্দে।সময়টা পার হয়ে যাচ্ছে ভেবে মনটা একটু বিষাদগ্রস্থ।ঘোর কাটলো রাত্রির হঠাৎ দাড়িয়ে পড়ায়।ঘাড় বাকিয়ে তাকাতেই রাত্রি চন্চল কন্ঠে বলে উঠলো,

—“আচ্ছা,আপনিতো অনেক লম্বা।আপনি আমাকে একটা ফুল নামিয়ে দিতে পারবেন?”
প্রথমে কথাটা বোধগম্য না হলেও কদমগাছটার দিকে নজর যেতেই অর্থটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো।উওর না দিয়ে অবিলম্বে রাত্রির দিকে একটু ঝুঁকে উপরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো নিভ্রান।খুব সহজেই দুটো কদম ছিঁড়ে নিলো।রাত্রির মাথাটা তার বুকের কাছে।উত্তপ্ত নিশ্বাসগুলো প্রেমঝড়ের মতো আছরে পরছে।রাত্রির অস্বস্তির মাত্রাটা বাড়ার আগেই সোজা হয়ে দাড়ালো নিভ্রান।ফুলগুলো রাত্রির দিকে বাড়িয়ে বললো,”ধরুন,আরো দিচ্ছি।”
সযত্নে ফুলগুলো হাতে নিলো রাত্রি।গালদুটো লাল রংয়ের আভায় সজ্জিত।হাসলো নিভ্রান।আবারো হাত বাড়াতে উদ্যত হতেই সে মিনমিনে গলায় বললো,
—“আর লাগবেনা।”
থেমে গেলো নিভ্রান।রাত্রি তখন ফুলগুলো দিকে আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠোঁটের কোঁণ প্রসারিত করে রেখেছে।
নিভ্রানের বুঝতে সময় লাগলোনা,এই আঁটসাঁট,গম্ভীর মেয়েটার মাঝে একটা চন্চল ছটফটে মনও লুকিয়ে আছে।শুধু পৃথিবীর ভারি দায়ভারে তা বেরিয়ে আসতে অক্ষম।”

চাবি ঘুরিয়ে দরজার লক খুললো রাত্রি।নিভ্রান তার পিছে দাড়ানো।এতদূর লোকটা এসেছে এখন ছাতা দিয়ে বাসায় বাইরে থেকেই বিদায় করে দেয়াটা প্রচন্ড বেয়াদবের মতো একটা কাজ হয়ে যাবে।পারিবারিক শিক্ষাটা বেশ শক্তপোক্ত রাত্রির।দরজা খুলে আগে নিভ্রানকে প্রবেশ করতে বললো সে।নিভ্রান মুচকি হেসে বললো,
—“আরে না না,ভেতর যাবনা রাত।আপনি ছাতাটা এনে দিন শুধু।”
রাত্রি ভ্রু কুঁচকালো।লোকটার পোশাক-আশাক,হাতের দামি ঘড়ি,বুকপকেটে ঢুকানো রোদচশমা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে সম্রান্ত পরিবারের ছেলে।মূহুর্তেই চোখের ভাষা কঠিন হয়ে গেলো রাত্রির।অনেকটা শক্ত গলায়ই সে বলে উঠলো,
—“দেখুন,আমি বুঝতে পারছি আপনি বড়লোক মানুষ।তাই বলে আমার বাসায় ডুকতে পারবেন না এমনতো কোন কথা নেই।আপনি কিন্তু ইনডাইরেক্টলি আমাকে অপমান করছেন।”

চোখ ছোট ছোট করে তাকালো নিভ্রান।মেয়েটা কতদুর পর্যন্ত ভেবে ফেলেছে।সে তো যেতে চাচ্ছেনা কারণ বেশ দেরি হয়ে গেছে।গাড়ি নিয়ে রাত্রির স্টুডেন্টের বাসার সামনে গিয়েছিলো তখন।দুপুর থেকেই দাড়িয়ে ছিলো শেষমেষ বিকেলে রাত্রির দেখা মিলে।ওখান থেকে রওনা দেয়ার সময় একবার গাড়িতেই ফিরতে চেয়েছিলো কিন্তু রাত্রির সাথে হেঁটে আসার লোভটা সামলাতে পারেনি বিধায় গাড়িটা ওখানেই ফেলে এসেছে।
এখন আবার ওখানে যেয়ে গাড়ি নিয়ে তারপর বাসায় যেতে হবে।অনেকটা সময়ের ব্যাপার।
কিন্তু মেয়েটা যেভাবে কঠাক্ষ নজরে চেয়ে আছে এখন ভেতরে না গেলে সত্যিই খুব খারাপ দেখাবে।
পায়ের জুতা খুলতে শুরু করলো সে।গম্ভীর স্বরে বললো,
—“আপনি বড্ড বেশি ভেবে ফেলেন রাত।এরপর থেকে আর কখনো আমার সামনে এসব বড়লোক-ছোটলোকের তফাত দেখাতে আসবেন না।আই জাস্ট হেইট ইট।”বলেই একবার রাত্রির চোখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো নিভ্রান।
রাত্রি চুপ হয়ে গেলো।সে হয়তো ভুল মানুষকে ভুল কথা বলে ফেলেছে।লোকটার চেহারায় অসীম গাম্ভীর্যতার চিহ্ন।
একরুমের একটা ছোট্ট বাসায় থাকে রাত্রি।রান্নাঘর আছে।ছোট একটা বসার জায়গায় মতোও আছে কিন্তু সেখানে কোন সোফা বা টেবিল নেই।

রাত্রিকে মোটেও বিচলিত বা লজ্জিত দেখালো না।সে আস্তে করে রুমের দরজাটা খুলে নিভ্রানকে বললো,
—“আপনি বিছানায় বসেন।”আরো একবার মুগ্ধ হলো নিভ্রান।সাধারনত দেখা যায় মানুষজন খুবই কুন্ঠিত বোধ করে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে।লজ্জিত হয়।কিন্তু রাত্রির এই বিন্দুমাত্র লজ্জিত না হওয়াটাও মন কাড়লো নিভ্রানের।মেয়েটা খুবই স্বাভাবিক নিজের সাদামাটা জীবনযাত্রা নিয়ে।
স্টীলের গ্লাসে করে পানি নিয়ে আসলো রাত্রি।কদমদুটোর ডাঁটা পানির মধ্য ভিজিয়ে পড়ার টেবিলের এককোণে চাপিয়ে রাখলো।পকেট থেকে ফোন বের করলো নিভ্রান।রাত্রি বললো,
—“চা খাবেন?”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ১+২

—“না মিস,আপনি বসতে বলেছেন আমি বসেছি।তাছাড়া আমি চা খাইনা।”
রাত্রি মুখ লটকিয়ে ছোট্ট আলমারিটা খুললো।ছাতাটা বের করে বলল,
—“ওহ,আপনি কফি খান তাইতো?কফিও আছে।খাবেন?।”
রাত্রির কথা বলার ঢং দেখে হেসে ফেললো নিভ্রান।বললো,”কিছুই খাবোনা,ছাতাটা দিন আমি চলে যাবো।দেখুন দেরি হয়ে গেছে।”দীর্ঘ:শ্বাস ফেললো রাত্রি।ছাতাটা নিভ্রানের হাতে দিয়ে বললো,
—“আপনি জানলেন কিকরে আমি আজ বিকেলে পড়াতে গেছি?”
এক আঙ্গুলে কপাল ঘষলো নিভ্রান।ঠোঁট চেপে কিছু একটা ভেবে নিয়ে জোরালো কন্ঠে বললো,
—“ইটস্ আ কোইন্সিডেনস।”

মিনিটদশেক আগেই বেরিয়ে পরেছে নিভ্রান।কাপড়চোপড় বদলে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো রাত্রি।উদ্দেশ্য রাতের খাবার রান্না করা।রান্নাঘরে ঢুকেই স্বস্তির একটা শ্বাস ফেললো সে।বাড়িতে আসলে চা,কফি কিছুই নেই।ওসব নিতান্তই সৌজন্যতার খাতিরে বলেছিলো।নিভ্রান যদি কোনোভাবে ‘হ্যাঁ’ বলে দিত তবে বেশ ঝামেলা পড়তে সে।ভাগ্য ভালো নিভ্রান মানা করে দিয়েছে।মনে মনে হাসলো রাত্রি।এসব বিষয়ে তার ভাগ্যে আবার খুব সাথে থাকে।

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৫+৬