এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৩৯+৪০

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৩৯+৪০
লেখিকা মালিহা খান

কাগজে কাগজে ভরতি বিছানা। কাবার্ড থেকে পুরাতন ফাইলপত্র ঘেঁটে অপ্রয়োজনীয় ফাইলগুলো আলাদা করছে নিভ্রান। জমে জমে স্তুপ হয়ে গেছে। বাইরে ঝলমলে মধ্যাহ্ন। ভাদ্র মাসের রৌদ্রছায়ার খেলা চলছে। এখনি নীল মেঘ আবার বিকেলেই ঘনালি জলধারা নামবে বলে। বর্ষা বিদায় নিলো আজ অনেকদিন তবু যেনো তার রেশটা রয়ে গেছে। রাত্রি ঘুমাচ্ছে বিছানার মাঝখানটায়। ছুটির দিন। শুক্রবার। দুপুরের খাওয়াদাওয়া হয়নি এখনো। বারোটার মধ্য রান্না শেষ করে ঘুম দিয়েছিলো রাত্রি। এখনো উঠেনি। মাঝেমধ্যেই ঝিঁমাতে দেখে আজকাল। নিশাদ বাসায় বেড়াতে এসেছে তিনদিন হলো। সেও নিজের ঘরেই ঘুম। সকালে টেনেটুনে নাস্তা দিয়েছিলো রাত্রি। তারপর আর হুঁশ নেই।

অলস সময়। নিভ্রান কাবার্ড সাফাই করে খালি করলো অনেকটা। দু’বছর আগের ফাইলও জমিয়ে রাখা ছিলো। কোনো কাজ নেই এগুলোর। ফেলে দিবে। রাত্রির পায়ের কাছটায় কাগজগুলো অগোছালো করে রেখেই শাওয়ার নিতে ঢুকলো সে।
বের হলো যখন তখন প্রায় অর্ধশত বা তারও বেশি কাগজের নৌকায় ডুবছে বিছানা। নিভ্রান তব্দা খেয়ে দাড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এলোমেলো চুলের গোছা একটু পর পর কানে গুঁজতে গুঁজতে মনোযোগ সহকারে নৌকার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে ব্যস্ত রাত্রি। পরণে একটা সাদা রংয়ের শাড়ি। ব্লাউজটা গাঢ় সবুজ। সদ্য ঘুম ভাঙা মায়াবী মেঘের শুভ্রতম টুকরো যেনো। ব্লাউজটায় গোলাপপাতার সবুজের ছোঁয়া। আস্ত এক প্রকৃতিকন্যা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—“কি করছো রাত?”
রাত্রি মুখ তুলে তাকালো। কপাল ভরে চুলের গোছা একপাশ ঢেকে দিলো সঙ্গে সঙ্গেই। কাগজ ভাঁজ করা থামিয়ে চুল সরালো সে। নিভ্রানের উদাম গা। টাওয়াল দিয়ে ভেজা চুল মুছছে। শ্যামবর্ণের বলিষ্ঠ দেহের রোমশ বুকে আরো একবার প্রেমে পড়লো রাত্রি। চোখ নামিয়ে বললো,
—“আপনি ভালো করে মাথা মুছবেন। ভোররাতে আপনার জ্বর এসেছিলো।”
নিভ্রান ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“জ্বর এসেছিলো? কই?”
—“জ্বর কি এভাবে দেখা যায় নাকি? আমি ছুঁয়ে দেখেছিলাম। গা গরম ছিলো।”
নিভ্রান টাওয়াল রাখলো। আয়নার সামনে যেয়ে হাত দিয়ে আলগা পানি ঝেড়ে নিলো।
—“ফজরওয়াক্তে উঠে সকাল পর্যন্ত জেগে জেগে আমাকে না দেখলে হয়না তোমার? ঘুমাও না ঠি ক ঠাক। এজন্যইতো শরীর খারাপ করে। পরশুদিন বমি করলে কতবার যেনো? দু’বার নাকি তিনবার?”
রাত্রি খোঁচাটা ধরতে পারলো ঠি কই। আরো একটা নৌকা পাশে রেখে নতুন কাগজ হাতে নিতে নিতে বললো,”ধ্যাত। সারাদিন একটাই কথা।”

নিভ্রান শার্ট গায়ে দিলো। ফোনে কি যেনো করলো। ঘড়ি পড়লো। ভেজা চুলেই চিরুনি ব্রাশ করলো। পকেটে মানিব্যাগ ঢোকালো। গায়ে পারফিউম দিলো। শেষমেষ ড্রয়ের থেকে একটা কাঁটা নিয়ে গিয়ে রাত্রির চুলে খোঁপা বেঁধে দিতে দিতে বললো,
—“শুধু শুধু টমেটো সস আরেকদিন খেতে দেখি তোমাকে।”
রাত্রি তেঁতে উঠলো,”ধুরো, যানতো আপনি।” পরক্ষণেই কি একটা ভেবে হাতের কাগজ রেখে বিছানা ছেড়ে নেমে
বললো,”ওহ না, যাবেন কেনো? দুপুরে তো খাননি। চলুন খাবেন। এই ছুটির দিনে এত সেজেগুজে যাচ্ছেন কোথায়?”
নিভ্রান ছড়ানো ছিটানো নৌকাগুলো একপাশে জড়ো করে রেখে বললো,”যাচ্ছি কাজে। তুমি এতো নৌকা দিয়ে করবেটা কি রাত?”
রাত্রি মিনমিন করলো,”জানিনাতো।”
নিভ্রান হাসলো কেবল। কিছু বললোনা। বাকি কাগজগুলো সেভাবেই পড়ে রইলো। ফেলার চিন্তা সেই কখন চলে গেছে মাথা থেকে।

নিশাদকে উঠাতে উঠাতেই সাড়ে তিনটা বেজে গেছে। এত গাঢ় ঘুম তার। বাসায় ডাকাত পড়ে গেলেও টের পাবেনা। উঠে শাওয়ার না নিয়েই ঢুলতে ঢুলতে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টানলো সে। ভাত গরম। রাত্রি মাত্র গরম করে এনেছে। ধোঁয়া উঠছে এখনো। নিভ্রান বসে আছে পাশে। নিশাদ মাথা কাত করে তার কাঁধে রাখলো। চোখ বন্ধ করলো। রাত্রি ভাত বাড়ছে তিনজনের প্লেটে। মাকে তখন ঘুমানোর আগেই খাইয়ে দিয়েছিলো। রুটিনমাফিক খাওয়াদাওয়া তার। একটু এদিক ওদিক হলে শরীর খারাপ করে। তাই সময়ের হেলাফেলা করেনা একটুও। মায়ের আবার কদিন যাবত পায়ে পানিও এসেছে। হাঁটতে অসুবিধা হয়। আবার ব্যাথাও করে কেনো যেনো।
—“ভাইয়ারে, স্বপ্নে তিন তিনটা পরীর মতো মেয়ে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছিলো। পরীর মতো না পরীই মনেহয়, ডানা ছিলোনা শুধু। একজন আপেলের টুকরো, আরেকজন লাল আঙ্গুর, আরেকজন কি জানি একটা? নাম জানি না। তারপর হঠাৎই ভুমিকম্প হলো। আর ভুমিকম্পটা ঘটালো কে জানিস? এইযে তোর বউ, আমার ভাবি।” চোখ খুলে হাতের তর্জনী সোজা রাত্রির দিকে তাক করে বললো নিশাদ। রাত্রি হেসে ফেললো। ভাত বাড়া প্লেটটা সামনে দিয়ে বললো,”সপ্নের খাবার খেয়ে আপনার পেট ভরবে না ভাইয়া। স্বাদও পাবেন না। তার চেয়ে বরং ভাত খান। কাজে দিবে।”

নিশাদ অসহায় কন্ঠে বললো,”আমি স্বাদ পাচ্ছিলাম ভাবি। আপেলটা কি যে মিষ্টি। আর আঙ্গুর? মুখে দিলেই যেনো রসালো শরবত হয়ে যাচ্ছিলো।”
—“হু বলেছে? সপ্নে মানুষ স্বাদ পায়না। সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ। আর ঘ্রান পায় ৭ শতাংশ। সপ্ন শুধুই একটা দর্শনের জিনিস। বুঝলেন?
নিশাদ কাঁধ থেকে মাথা উঠিয়ে ভাতে হাত রাখলো। চোখ ছোট ছোট করে বললো,”আপনিতো জলজ্যান্ত গুগল ভাবি।”
খাওয়া দাওয়া হলো তাড়াতাড়িই। নিভ্রান বেরিয়ে গেলো কাজে। বলে গেলো রাত হয়ে যাবে ফিরতে ফিরতে। রাত্রি সব গুছিয়ে রাখলো। নিশাদ ঘরে গিয়ে আবার শুয়েছে। রুবিনাও ঘুম তখন।

রান্নাঘরে ভ্যাপসা গরম। চায়ের পানি ফুটছে টগবগ করে। চপিং বোর্ডে চিকন চিকন করে আলু কাটছে রাত্রি। উদ্দেশ্য তেলে ভেঁজে ফ্রেন্চফ্রাই করা। কপালে ঘাম ছুটে গেছে চুলার আঁচে। হাতটা কেমন কেঁপে যাচ্ছে বারবার। ছুড়ি দিয়ে কয়েকবার বৃদ্ধাঙ্গুল প্রায় কেটেই ফেলেছিলো। অদ্ভুততো! তার তো কখনো এমন হয়না।
ঝলমলে রেস্টুরেন্টে বসে অফিসের মিটিং করছে নিভ্রান। সামনে ডিলাররা বসে আছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট। ফোন সাইলেন্ট করা। কথা বলায় ব্যস্ত সে।
“ভাবি”, “ভাবি” বলে চিল্লাতে চিল্লাতে রুম থেকে বের হলো নিশাদ। রোজ এইসময় চা দিয়ে যায় রাত্রি। আজ দিলোনা কেনো? রান্নাঘরে কোনো সাড়াশব্দও পাচ্ছেনা। ডাকছে তবু উওর দিচ্ছেনা। বুকে হঠাৎই ধুকপুকানি শুরু হলো।
অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে রাত্রি। কপালটা ফ্লোরে। চুলগুলো মুখের উপরটা ঢেকে দিয়েছে। চায়ের পানি শুকিয়ে গেছে। পাতিল পুড়ে যাচ্ছে। ছুড়িটা কিছুটা দূরে ছিঁটকে পড়ে আছে ফ্লোরে।। নিশাদ চুলাটা নিভালো। দ্রুত ফ্লোরে বসে মাথাটা কোলে তুলে নিলো। চুল সরালো। কপালের কোঁণ ফেঁটে রক্ত বেরিয়ে গেছে। এক দু’বার গালে হাল্কা হাতে থাপ্পড় মেরে রুদ্ধ কন্ঠে ডাকলো,”ভাবি? ভাবি কি হলো? উঠেন। ভাবি?”

কন্ঠে ভয়াবহ আতঙ্ক। মেয়েটার মধ্য তার ভাইয়ের জান থাকে। গলা শুকিয়ে গেছে। খানিকক্ষণ ইততস্ত করে রাত্রিকে কোলে তুলে নিলো সে। নিজের ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলো বিছানায়। জগে পানি নেই। বালিশের পাশ থেকে ফোন নিয়ে নিভ্রানের নাম্বারে ডায়াল করতে করতে ডাইনিং এ ছুটলো। পানি ঢাললো গ্লাসে। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হলোনা। বুকের ভেতর হাঁতুড়ি পেঁটা হচ্ছে। পানি হাতে ঘরে গেলো। মুখে ছিঁটালো অল্প করে। জ্ঞান ফিরলোনা। নড়চড় নেই একদম। নিভ্রানকে এবারো পাওয়া গেলোনা ফোনে। উপায় না পেয়ে ডাক্তারকে কল করলো সে। বাসায় আসতে বললো। এখান থেকে হসপিটাল অনেক দূরে। যেতে যেতে যদি কিছু হয়ে যায়। এরচেয়ে তার পরিচিত এক ডাক্তারের বাসা কাছে। তার আসতে বেশি সময় লাগবেনা।
একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতেই দেখলো হাতের আঙ্গুলও কেটে গেছে রাত্রির। বৃদ্ধাঙ্গুলের ডগা থেকে অনেকটা নিচ অবধি। টুপটুপ করে রক্তের ফোঁটা সাদা আঁচলে লেগে যাচ্ছে। নিশাদ উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁফ ছাড়লো। ফাস্ট এইড বক্স খুঁজে বসে পড়লো পাশে। কাঁপা হাতে কপালের রক্ত পরিষ্কার করলো। হাতে ব্যান্ড- এইড লাগিয়ে দিলো। পাশে ফোন রেখে লাউডস্পিকার অন করে কল দিয়েই যাচ্ছে সে। সতেরো তম বারে রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে নিভ্রানের চাপা স্বর,

—“আমি মিটিংয়ে নিশাদ। একটুপর..”
নিশাদ কথার মাঝেই বললো,
—“ভাবি সেন্সলেস হয়ে গেছে ভাইয়া। রান্নাঘরে…”
ওপাশ থেকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ানোর শব্দ হলো। তারপর হাঁটার শব্দ। গট গট। নিশাদ এপাশ থেকেই বুঝতে পারলো। নিভ্রান ঠান্ডা গলায় বললো,
—“ও মাঝেমধ্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলে নিশাদ। তুই মুখে পানি ছিঁটা।”
—“ছিঁটিয়েছি ভাইয়া। জ্ঞান ফিরেনি। তুই আয়। ভয় লাগছে।” কপাল ফাঁটার কথাটা এড়িয়ে গেলো সে। নিভ্রান প্যানিক হয়ে উল্টোপাল্টা গাড়ি চালাবে। শেষে আরেক বিপদ হবে।
গাড়ি স্টার্ট দেয়ার ঝনঝনে শব্দ। নিভ্রান বললো,
—“ডক্টর কল করেছিস?”
—“করেছি তুই আয়।”
—“আসছি”। ফোন কেটে গেলো। নিশাদ আবার পানি ছিঁটালো। এবার একটু বেশি করে। চোখমুখ ভিজে গেছে পানিতে। পাপড়িগুলো নড়লো একটু। বামহাতের তর্জনী কাঁপলো।

মহিলা ডাক্তার। মিস.নিকিতা। রাত্রির পালস চেক করছেন। নিভ্রান বসে আছে মাথার কাছে। ব্যান্ড- এইড লাগানো ডানহাতটা তার দু’হাতের মুঠোয় বন্দি। নিশাদ দাড়িয়ে আছে। রুবিনা চিন্তাপূর্ণ ভেজা চোখে চেয়ে আছে মেয়ের মুখের দিকে।
মিস.নিকিতা কিছুক্ষণ পরীক্ষা করলেন। ডাক্তাররা সাধারণত যা করেন তাই করলেন। চোখ দেখলেন। হার্টবিট মাপলেন। প্রেশার মাপলেন। কপালে আগেই ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। ক্ষতটা অত গাঢ় না।
শেষমেষ বললেন,
—“উনার তো সবকিছুই নরমাল। তাছাড়া আপনারা বললেন,দুদিন আগে বেশ বমি হয়েছিলো। আর এভাবে হঠাৎ ফেইন্ট হয়ে যাওয়া। আমার ধারনা মতে, উনি খুব সম্ভবত সন্তান সম্ভবা।”
নিভ্রান দু’বার পলক ঝাঁপটালো। অনিশ্চিত কন্ঠে বললো,”সরি?”
মিস.নিকিতা হাসলেন,”আমি একেবারে শিওরিটি দিচ্ছিনা। তবে লক্ষণগুলো প্রেগন্যান্সির সাথেই মিলে যায়।
অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। আপনিতো উনার হাসবেন্ড, আপনি আরো ভালো জানবেন।”
নিভ্রান চুপ থাকলো কিছুক্ষণ। মুঠোয় থাকা ঠান্ডা হাতটা দু’হাতে ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,”ওর জ্ঞান ফিরবে কখন?”
—“ফিরে যাবে। একঘন্টার মাঝেই। খাওয়া দাওয়ার দিকে খেয়াল রাখবেন। শরীর দূর্বল। রক্তশূন্যতা আছে।বেদানা খাওয়াবেন বেশি বেশি। আর কাল যেয়ে একটা টেস্ট করিয়ে শিওর হয়ে নিয়েন। যদি পজিটিভ হয় তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ। আর নেগেটিভ হলেও রিপোর্টে এসে যাবে।”

নিভ্রান সৌজন্যমূলক হেসে বললো,”জি অবশ্যই।”
উনি চলে গেলেন একটুপর। কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে গেলেন যাওয়ার আগে। রুবিনা হাসছেন একটু একটু। সামনে বসা নিভ্রানের চোখে মুখে কোনো অস্পষ্টতা নেই। একধ্যানে রাত্রির চুলে হাত বুলাচ্ছে ও। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন পাকাপাকি খুশির সংবাদ আসবে কালকে।
নিশাদ ফিরে এলো। নিভ্রান মলিন হেসে বললো,”মুখটা শুকিয়ে গেছে। একটু ঠান্ডা পানিতে লেবু চিনি মিশিয়ে এনে দে তো। জ্ঞান ফিরলে খাওয়াবো।”
নিশাদ এনে দিলো। নিভ্রান গ্লাসটা পাশের টেবিলে রেখে রুবিনাকে বললো,”আপনি খেয়ে শুয়ে পড়ুন আম্মু। পরে শরীর খারাপ করবে। আমি আছি ওর সাথে। চিন্তা করবেন না।”
রুবিনা গেলো জোরাজোরিতে। নিভ্রান তখনো চেন্জ করেনি। শার্ট- প্যান্টই পরে আছে। নিশাদ সোফায় বসে রইলো কিছুক্ষন। এখন একটু শান্তি লাগছে। নিভ্রান একপলক ভাইয়ের দিকে তাকালো। ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। নিশাদকে রেস্ট নিতে বলে আলতো হাতে রাত্রিকে কোলে তুলে নিলো সে। একটু কি ভার ভার লাগছে শরীরটা? দুজনের ভার? নাকি অবচেতন মন অযথাই বেশি ভেবে বসে আছে? আসলেই কি বেশি? অসম্ভব কিছু তো নয়।

রাত গভীর হবার পথে। ঘড়ির কাঁটা গড়াচ্ছে আপন স্বভাবে, নিজগতিতে। আকাশ তারা নেই। চাঁদ নেই। মেঘগুলো সাদা হয়েছে খুব কিন্তু বৃষ্টি নামছেনা। কোথায় যেনো একটা বাঁধা। অদৃশ্য কাঁটাতার। বৃষ্টির জল আঘাত পাবে। সাদা শাড়িটা লন্ড্রি বিনে রেখে দিলো নিভ্রান। রক্ত মেখে আছে আঁচলে। দেখলেই কেমন ভীত হয়ে উঠে মন। একটা শনির আশঙ্কা। কম্পমান হৃদয়। শাড়ি বদলে দিয়ে একটা আকাশী রংয়ের পাতলা কামিজ রাত্রিকে পড়িয়ে দিয়েছে সে। মিস.নিকিতা বলে গিয়েছিলো একঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরবে অথচ দেড়ঘন্টার বেশি হয়ে গিয়েছে ও নড়েনি বিন্দুপরিমানও। ঘরের বাতি নিভানো। বাইরে থেকে আগত মৃদু আলোয় আঁধার কাটছে।
নিভ্রান রাত্রিকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে রইলো কতক্ষণ। শ্বাস- প্রশ্বাসতো একদম স্বাভাবিক। কপালে কি বেশি ব্যাথা পেয়েছে? মাথাব্যাথায় জ্ঞান আসছেনা? যেদিন বমি হলো সেদিনই মধ্যরাতে উঠে বসেছিলো মেয়েটা। পেটে ব্যাথা করছিলো নাকি। সে ভেবেছে নরমাল ফুড পয়জন। কিন্তু না হয়তোবা!

বাইরের একটা ধাবিত দমকা হাওয়া শরীর ঠান্ডা করে দিলো। রাত্রি অস্ফুট আওয়াজ করলো। হাল্কা গোঙানি। নিভ্রান মাথা উঠালো। মুখ বরাবর তাকিয়ে গালে হাত রেখে দ্রুত ডাকলো,”রাত? রাত? রাত উঠো।”
রাত্রি তাকালো। আধবোজা চোখ। দূর্বল চোখের পাতা। নরম দৃষ্টি। শুকনো রুক্ষ ঠোঁট নাড়ানোর চেষ্টা। মনে পরলো সেই মাথা ঘোরানো, চোখের সামনে আচানক সব কালো হয়ে যাওয়া। কপালে কি অসহ্য একটা ব্যাথা!
মুখে হাসি ধরা দিলো নিভ্রানের। মোটা ব্যান্ডেজের উপরই ঠোঁট ছোঁয়ালো সে। রাত্রি শক্তিহীন হাতটা তার ঘাড়ে রাখলো। নিভ্রান আবার ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো একই জায়গায়। চাপা গলায় বললো,”ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে রাত, খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।”
রাত্রি হাসলো একটু। কোনরকমে ঠোঁট নাড়িয়ে তেজশূন্য কন্ঠে বললো,

—“ঠি ক আছিতো। শান্ত হন।”
নিভ্রান উঠে পরলো। আলো জ্বালিয়ে দিলো। রাত্রিকে দু’হাতে ধরে বিছানায় হেলান দিয়ে বসালো।
রাত্রি মাথা চেপে ধরলো সঙ্গে সঙ্গে। আয়নায় দেখলো কপালের ব্যান্ডেজ। আঙ্গুলের ব্যান্ডেজ টাও চোখে পড়লো সহজেই।
নিভ্রান বাইরে গেলো। ভাত নিয়ে আসলো প্লেটে করে। রাত্রি দাড়িয়ে পরেছে একা একাই। একহাতে বিছানার ব্যাকসাইড ধরে টলমলে পায়ের ব্যালেন্স রাখছে। নিভ্রান প্লেটটা নামিয়ে রাখতে রাখতে ধমকে উঠলো,
—“একা একা উঠেছো কেনো?”
রাত্রি থতমত খেয়ে মিনমিন করে বললো,”ওয়াশরুমে যাবো।”
নিভ্রান এগিয়ে গিয়ে দু’বাহু ধরলো। ভরাট গলায় বললো,
—“তো? আমাকে বললেই তো হয়। একা একা উঠবানা আর, খবরদার।”
—“উফফ! আমি ঠি ক আছিতো। আপনি অযথাই চিন্তা করছেন।”
ভাতের শেষ লোকমাটা মুখে তুলে দিয়ে নিভ্রান খেয়াল করলো রাত্রি একহাতে পেট চেপে ধরেছে। একপলক চেয়ে সে আস্তে করে বললো,

—“পেটে ব্যাথা?”
রাত্রি কপালে ভাঁজ ফেলে বিরক্তি নিয়ে বললো,
—“হু, তরকারিতে ঝাঁল বেশি হয়েছে। মরিচগুড়াটার রং সুন্দর না। আমি ভেবেছি ঝাঁল হয়না তাই পরে আরো দু’চামচ মিশালাম। এখন মুখেই দেয়া যাচ্ছেনা।”
—“দুপুরেও এটাই খেয়েছি তখন ঝাঁল লাগলোনা?”
রাত্রি ভাবলেশহীন বললো,”লেগেছে মনেহয়, তখন টের পাইনি।”
নিভ্রান নিশব্দে হাসলো। প্লেট রেখে পানি খাওয়ালো। ঠোঁট মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,”ডক্টর এসেছিলো। তোমার প্রেগনেন্সির টেস্ট দিয়ে গেছে।”
রাত্রি বিষম খেলো যেনো। চোখের দৃষ্টি এলোমেলো। কোনরকমে মুখের পানিটা গিলে নিয়ে অদ্ভুত কন্ঠে বললো সে,
—“জি?”
নিভ্রান গলা ঝেঁড়ে বললো,”মাথা ঘুরায়, বমি হয়, পেটে ব্যাথা এসব কি এমনি এমনি নাকি? বাসায় আসলেই দেখি তুমি ঝিঁমাও সারাক্ষণ। এইযে এখনো, খাবার মাঝে কয়বার হাই তুললে? চারবার। অথচ এতক্ষণ যাবত শুয়েই ছিলে। সকালে যাবো। টেস্ট করাতে। এখন ঘুম পেলে ঘুমিয়ে পড়ো।”

সে রজনীতে বিস্তর শূণ্যের জলধারা রুষ্টই থাকলো। আসবে আসবে করেও শেষমেষ অনুপস্থিত সে। কাটলো সময়। সাদা মেঘের বর্ষণের বদলে রাঙা সূর্যের রং মাখলো পৃথিবীতে। সকাল হতেই তাকে নিয়ে হসপিটালে ছুটলো নিভ্রান। কি ভীষণ গরম পরেছে আজ। ভাদ্রমাসের মাঝামাঝি। তাল পাকা গরম। ভ্যাপসা পরিবেশ। গাড়ির জানালা বন্ধ করে এসি ছেড়ে রেখেছে নিভ্রান। গাড়ি চলছে ভার্সিটির পথে। ইউরিন টেস্ট করতে স্যাম্পল দিয়ে এসেছে ল্যাবে। আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করিয়ে এসেছে। সন্ধ্যায় রিপোর্ট নিয়ে আসবে। নিভ্রান বলে এসেছে আর্জেন্ট করে দিতে।
মাঝে তেমন কথা হলোনা। নিভ্রান এক দুইবার জিজ্ঞেস করলো শরীর খারাপ লাগছে নাকি। রাত্রি মাথা নাড়িয়ে না জানালো। গাঁট হয়ে বসে আছে মেয়েটা।
ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে অফিসে গেলো নিভ্রান। রাত্রির ফাইনাল পরীক্ষা কয়দিন পরই। বেশি হলে এক দু’মাস বাকি হয়তো। শুধু বাসায় নোটস এনে দিলে কুলাবে না তার। ক্লাস করাটা খুব জরুরি। প্রফেসরের লেকচার তো আর বাসায় পাওয়া যাবেনা। মেয়েটার পড়াশোনায় চুল পরিমাণ বাঁধাও আসতে দিতে চায়না সে।

ওই বাসার টি উশনিটা ছেড়ে দিয়েছে মাসখানেক হলো। এখন বিকেলেই বাড়ি ফিরে যায় রাত্রি। মাঝেমধ্য নিভ্রানের অফিসে যায়। তারপর সেখান থেকে একসাথে বাড়ি ফিরে সন্ধ্যায়। আজ অবশ্য ব্যাতিক্রম।
নিভ্রান নিজেই চলে এসেছে গাড়ি নিয়ে। ড্রাইভার দিয়ে পাঠায়নি। হসপিটালে যাবে সে। রাত্রি মিনমিন করে বললো,”এতো তাড়াতাড়ি তো রিপোর্ট রেডিই হয়নি। বললোনা সন্ধ্যায় যেতে?”
নিভ্রান শুনলোনা কিছুই। সোজা হসপিটালে গেলো। সকালেও সে এমনই করেছে। সবার আগে যেয়ে হলপিটালে পৌঁছেছে।
রিপোর্ট সত্যিই হয়নি তখনো। সাতটার পরে দিবে। এখন বাজে পাঁচটা চল্লিশ। পাগলটা একঘন্টা বিশমিনিট অপেক্ষা করলো সেখানেই। রাত্রি গাড়ির পিছের সিটে শুয়ে রইলো। ক্লান্ত লাগছে। লোকটা আসলেই পাগল। পুরো উন্মাদ।
কাগজে স্পষ্ট ইংরেজি গোটা গোটা অক্ষরে “Positive” লেখা। আল্ট্রা রিপোর্টে দেয়া বাচ্চার বয়স
১ মাস+ অর্থ্যাৎ ৫ সপ্তাহ। সুস্থ আছে একদম। নিভ্রান রিপোর্টগুলো হাতে নিয়ে বসে রইলো কতক্ষণ। চেয়ে থাকলো নির্নিমেষ। মিস.নিকিতা কিসব যেনো বলে যাচ্ছে রাত্রিকে। নিভ্রানের কানে ঢুকলোনা। উত্তেজনায় ভেতরটা কাঁপছে। বাইরেটা নিশ্চল, শান্ত। হুঁশ ফিরলো রাত্রির ধাক্কায়। তার বাহুতে হাত রেখে চাপা স্বরে ডাকছে।

নিভ্রান পলক ফেলে বললো,”কি হয়েছে?”
রাত্রি চাঁপা গলায়ই বললো,
—“আপু ডাকছেন আপনাকে।”
নিভ্রান রিপোর্টটা কোলের উপর রাখলো। কোনরকমে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,”জি বলুন ডক্টর।”
মিস.নিকিতা হাসলেন। হাসি বজায় রেখেই বললেন,”স্ত্রীর খেয়াল রাখবেন মিস্টার।”
নিভ্রান মাথা নাড়ালো। মৃদুস্বরে সম্মতি দিলো। তার লজ্জা লাগছে কেনো যেনো। অদ্ভুত!

আকাশে চাঁদ উঠেছে। সরু অর্ধচাদ। হাসছে যেনো উচ্ছাসে ফেঁটে। ঠোঁট বাঁকা খুশির হাসি। নদীর পানিতে কি সুন্দর আলোর খেলা। ঝিলমিলে ঢেউ। হাল্কা হাল্কা স্রোত। শব্দ! দূরে একটা লন্চ যাচ্ছে। ভনভনে আওয়াজটাও মধুর শোনাচ্ছে। কি ভীষণ সম্মোহনী পরিবেশ! গাড়ি থামলো। সামনের হেডলাইটদুটো নিভলো। হাতের ড্রাই কেকের প্যাকেট থেকে শেষ টুকরোটা চিবাতে চিবাতে রাত্রি বললো,”এটা কোথায়?”
নিভ্রান তার সিটবেল্টটা খুলে দিলো। হাতের খালি প্যাকেটটা নিয়ে পকেটে ভরে ফেললো। আশেপাশে ডাস্টবিন নেই। ড্রয়ের থেকে পানির বোতল বের করে ঠোঁটের কাছে ধরে বললো,
—“হা করো, শুকনো জিনিস। গলায় আটকাবে।”
রাত্রি পানি খেয়ে আবার বললো,”বাসায় যাবেননা?” প্রশ্ন করে নিভ্রানের কব্জি টেনে ঘড়ি দেখলো সে। সাড়ে আটটার অনেক বেশি। নয়টা ছুঁইছুঁই প্রায়। তারপর আবার বললো,”দেখুন, ন’টা বাজে।”
নিভ্রান ঝুঁকে তার পাশের দরজার লক খুলতে খুলতে বললো,” এটা কোন নদীটা জানো? ওইযে ব্যালকনি থেকে দেখা যায়। তুমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখোনা? সেদিন বললে, সামনাসামনি দেখার খুব ইচ্ছে।…কাল নৌকা বানালে। বৃথা যাবে নাকি তোমার কষ্টটা? আমি নিয়ে এসেছি নৌকাগুলো। নদীর পানিতে ভাসাবো, চলো। আশেপাশে আর কোথাও নদী- নালা নেই রাত। নয়তো এতদূর কষ্ট করিয়ে আনতাম না তোমাদের।”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৩৭+৩৮

রাত্রি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলো। বিস্ময়ে চোখ ছলছল করছে। কোঁণে জ্বালা করছে। নিভ্রানের নিরবতায় ভেবে নিয়েছিলো সে হয়তো খুশি হয়নি তেমন। বাচ্চাটা হয়তো তার জন্য অনাকাঙ্খিত। কিন্তু না! লোকটা হয়তো সবার মতো প্রকাশ করতে পারেনা। অন্যভাবে প্রকাশ করে। একদম অন্যভাবে। যা শুধু সেই বুঝে। আল্লাহ শুধু তাকেই এই ভিন্নতা বোঝার ক্ষমতা দিয়েছে। আর কাউকে না।
রাত্রির চোখের পানি লক্ষ্য করে মূহুর্তেই চোয়াল শক্ত করলো নিভ্রান। কাঠকাঠ গলায় বললো,
—“খবরদার! কাঁদবেনা রাত। একদম কাঁদবেনা! পানি যেনো না পড়ে। আমি কিন্তু এক্ষুনি গাড়ি ঘোরাবো।”
রাত্রি পানি গড়ানোর আগেই মাথা ঝুঁকিয়ে ফেললো। দু’হাত কঁচলে চোখ মুছলো। অশ্রুসিক্ত কন্ঠেই বললো,
—“আপনার বাচ্চা কিন্তু আপনাকে পাগল ভাববে নিশ্চিত।”
—“ভাবুক। ভাবার কি আছে ও জানুক ওর বাবা পাগল। ওর মা-ই তো বানিয়েছে।”
রাত্রি চোখে পানি নিয়েই হেসে ফেললো। নিভ্রান চেয়ে থেকে বিরবির করলো,
—“তুমি এভাবেই হাসো রাত। সবসময় হাসো। আমি আমৃত্যু সেই হাসিতে মুগ্ধ হতে থাকি শুধু।”

নৌকাগুলো ভাসছে নদীতে। এত্তো সুবিশাল উদার নদীরও ক্ষুদ্র অংশ ঢেকে গেছে সযত্নে তৈরি করা কাগজের ভালবাসায়। পাড়ে বসে আছে দুজন মানব- মানবী। একজনের ঠোঁটে বাচ্চাসূলভ মিষ্টি হাসি। আরেকজনের চোখে সেই হাসির পানে চেয়ে থাকা গুচ্ছ গুচ্ছ মুগ্ধতা। হাত বাড়ালেই পানি। একদম ঘাটে বসে আছে তারা। এপাশটা এখন নিরব। খানিকটা দূরে নৌকা টোকা এসে ভিড়ছে। নিভ্রান আচমকাই রাত্রির কোলে মাথা রাখলো।
রাত্রি আৎকে উঠলো। কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

—“আল্লাহ! কি করেন? গায়ে মাটি লাগবে। ঘরে যেয়ে মাথা রেখেন। এখন উঠেনতো।”
নিভ্রান পাত্তা দিলোনা। বরং পাশ ফিরে পেটে মুখ গুঁজে ধীর গলায় বললো,
—“ও কি বুঝতে পারছে ওর বাবা ওর কত কাছে? এইতো অল্প একটু দুরত্ব। নয়তো ওকে ছুঁয়ে ফেলতাম। তাই না রাত?”
রাত্রি হাসলো। ঝাঁকড়া চুলে হাত গলিয়ে বললো,”ওর এখনো হাত পা হয়ইনি মনেহয়। মাত্র তো ১ টা মাসই।”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৪১+৪২