এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৩৭+৩৮

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৩৭+৩৮
লেখিকা মালিহা খান

ময়ুখমালী বিদায় নিয়েছে একটুক্ষণ আগেই। সূর্যশূণ্য আকাশটা কে পূর্ণ করতে উঠেনি স্বার্থপর চাঁদ। শুক্ল মেঘমেদুরে আচ্ছাদিত হয়েছে গোটা গোধুলীসন্ধ্যা। বর্ষণপূর্ব মেঘমোহে মায়া লেগে যাচ্ছে জগতের অঙ্গে অঙ্গে। মৃদুতা মারুতে দোদুল্যমান গোলাপি পুষ্পপাপড়ি।
ড্রইংরুমের সাজবাতির আলোতে বসে আছে সবাই। হাসিমাখা আদরে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে গোটা বাড়িটা।
মধ্যমনি রাত্রিকে ঘিরেই যেনো সবকিছু। নিভ্রান চুপচাপ বসে আছে পাশে। চোখের দৃষ্টি প্রথম থেকেই ফোনের স্ক্রিনে। রাত্রি জোরজবরদস্তি তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এতো রংমহলের সবকিছুর মাঝেও কোথাও যেনো একটা বিষাদের আভা।
দুজনকে বিদায় দেবার আগমূহুর্তে নওশাদ সাহেব বললেন,”আবার নিয়ে এসো ওকে।”
নিভ্রান কিছুক্ষণ মৌন থেকে জুতার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে গম্ভীর গলায় উওর দিলো,”আসবোনে।”
ব্যস, এতেই হাসি ফুটলো রাত্রির মুখে। এতবছরের অভিমান তো আর একদিনে ভাঙবেনা। একটু একটু করেই না হয় ভাঙুক।

রাস্তায় আজ চরম আলোর ঘাটতি। প্রকৃতিকে ঘন ঘটার আশঙ্কা নাকি শুভ্র কিছুর আবেদন জানা নেই নিভ্রানের। বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝম। পিচঢালা রাস্তার ধুলোমাটির অস্তিত্ববিনাশ। রাস্তার মোড় ঘুরতেই রাত্রি চেঁচিয়ে উঠলো,
—“ইশশ! দেখেন কত কদম!”
নিভ্রান একপলক দেখলো। কদম ছাপিয়ে নজর কাড়লো কমনীয় অঙ্গনার শোভিত রুপ। কাঁধ থেকে সরে যাওয়া আচঁল। অলঙ্কারহীন বৃষ্টির ছাঁটওয়ালা সিক্ত গলদেশ। চোখের পাপড়ির মৃদু কম্পন। রাত্রি গাড়িতে উঠেই গয়নাগাটি খুলে ফেলেছে। আচঁল আর কোমড়ের কাছের সেফটিপিন খুলে আরাম করে বসেছে। পলক পড়লোনা। নামলোনা চোখের পাতা। তীর্থ হলো মন। বিক্ষিপ্ত হলো হৃদয়। নিভ্রান গাড়ি থামালো। দরজা খুলতে খুলতে হাল্কা গলায় বললো,”এনে দেই।”
রাত্রি আবারো চেঁচিয়ে উঠলো। পাগল লোকটা। এই বৃষ্টিতে নাকি ফুল আনতে যাবে। হায়! একহাতে কোমড়ের শার্ট টেনে ধরে সে বললো,
—“নাহ্, ভিজে যাবেন। দরকার নেই।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নিভ্রান আলতো করে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। নরম গলায় বললো,”চুপ করে বসে থাকো।”বলে একমূহুর্ত দেরি না করে বেরিয়ে পড়লো সে। রাত্রি চিৎকার করলো ভেতর থেকেই,” লাগবেনা তো। আপনি ভেতরে আসেন। উফফ”।
নিভ্রান শুনলোনা কিছুই। ঝপাঝপ পা ফেলে ভিজতে ভিজতে ছিঁড়ে নিলো পাঁচ ছটা ফুল। গায়ের শার্ট ভিজে লেপ্টে গেলো মূহুর্তেই। রাত্রি মাথা বের করলো। চিৎকার করে বললো,”আপনি আসবেন নাকি আমিই নামবো?”
নিভ্রান এদিক ওদিক তাকালো। রাস্তায় মানুষ ভরা। নির্জন হলে সে নিশ্চিত বাঁধা দিতো না। কিন্তু এখন অসম্ভব। বৃষ্টিসিক্ত রাতের সৌন্দর্য শুধু যে উপভোগ করবে আর কেউ নয়। ফুলগুলো একহাতে মুঠ করে ধরে রাত্রির পাশের দরজা খুললো সে। রাত্রি হাত বাড়িয়ে নিলো। মাথা বের হওয়ার চুলের সামনের অংশ ভিজে গেছে তার। টপটপ করে পানি গড়িয়ে ঠোঁটের কাছে জমা হচ্ছে। রাত্রি মুছেছে হয়তোবা। গাঢ় লিপ্সটিক ছড়িয়ে গেছে। নিভ্রান চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। একাধারে সেই ঠোঁটের ভাঁজে। সরে যাওয়া আঁচলের খুব গভীরে। রাত্রি মুখ খোলার আগেই সে হাত ধরে টেনে বের করে দ্রুত পিছনের দরজা খুলে ভেতরে বসিয়ে দিলো। ঢুকে গেলো নিজেও। রাত্রি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো,”কি হ..”

কথা সম্পূর্ণ হলোনা। তার আগেই হাত বাড়িয়ে ওপাশের জানালার কাঁচ উঠিয়ে দিয়ে অধরে অধর ছুঁয়ে দিলো নিভ্রান। জানলার কাঁচে ঠেকে গেলো রাত্রির মাথা। কদমগুলো পড়ে গেলো নিচে। নরম হাতদুটো আঁকড়ে ধরলো পিঠ। গাড়ির ইনার লাইট নিভানো তখন। আধো আলোয়ই পিপাসায় কাতর নিভ্রান মত্ত হয়ে উঠলো। বাড়লো ছোঁয়ার প্রগাঢ়তা। অনুভূতিতে পিষ্ট হলো রাত্রি। ঠোঁটের কাছ থেকে গলায় গেলো স্পর্শ। নেমে গেলো আচঁল। সংবেদনশীল স্হান শিরশির করে নিস্তেজ হলো। নরম ভাবটা সরে হঠাৎই হিংস্র হয়ে উঠলো মোলায়েম আদর। নিভ্রান যেনো হুঁশে নেই। রাত্রি কাতরে উঠলো। পিঠ থেকে হাত সরিয়ে নিভ্রানের গালে রেখে আর্তনাদ করে বললো,
—“শান্ত হন।”
নিভ্রান শান্ত হলোনা। উন্মাদ হয়ে উঠলো আরো। হঠাৎ একটা আগ্রাসী কামড়ে চোখের জল ছেড়ে দিলো রাত্রি। একহাত দিয়ে বুকে ঠেস দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে বললো,
—“ব্যাথা পাচ্ছি।”
নিভ্রান থেমে গেলো। একফোঁটা চোখের পানি টুপ করে পড়লো তার ঘাড়ে। মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো তীব্র অনুশোচনা। সে কি করছে? ছিহ্! ঠোঁট সরে গেলো। নিভ্রান স্হির চেয়ে রইলো ভেজা গালে। রাত্রি মাথা নিচু করে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছলো।
কান্নাভেজা কন্ঠেই অপরাধীর মতো ক্ষীণ গলায় থেমে থেমে বললো,”সরি আমি…সত্যিই ব্যাথা পাচ্ছিলাম। নয়তো আপনাকে বাঁধা দিতাম না।”
নিভ্রান নমনীয় চোখে চাইলো। সরি তো তার নিজের বলা উচিত। উল্টো মেয়েটা নাকি সরি বলছে। মাথার পিছে হাত রেখে রাত্রিকে কাছে টেনে নিলো সে। কপালটা নিজের কাঁধে ঠেকিয়ে চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে কোমল গলায় বললো,
—“বেশি লেগেছে রাত?”

রাত্রি কোমড়ের শার্ট মুচরে ফুঁপিয়ে উঠলো। মানুষটা কাছে এলেই কেনো সব ভেস্তে যেতে হবে? কেন সে একটু সহ্য করতে পারলোনা? কেনো ব্যাথা পেতে হলো? কেনো আটকে দিতে হলো?
নিভ্রান দীর্ঘ: শ্বাস ফেললো। চোখ বুজে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। অত: পর নম্রভাবে বললো,”আচ্ছা, কাঁদেনা। দেখি, কোথায় লেগেছে? ওষুধ লাগিয়ে দেই, আর জ্বলবেনা।” বলে বাহু ধরে সরাতে নিলো সে। রাত্রি সরলোনা। হাতদুটো দিয়ে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ভেজা বুকের সাথে লেপ্টে রইলো।
নিভ্রান গাঢ় রাশভারি কন্ঠে বললো,
—“আমি তোমাকে চাইছি রাত। এক্ষুণি চাইছি, এ মূহুর্তেই চাইছি। খুব করে চাইছি। কিন্তু, এভাবে নয়। তোমাকে যন্ত্রনা দিয়ে নয় অবশ্যই। তোমার অনুমতি ছাড়া, শতভাগ সম্মতি ছাড়া আমি হাজারবছরও অপেক্ষা করতে রাজি।”
রাত্রি মিনমিন করে বললো,”আমি তো আপনারই।”
নিভ্রান নিশব্দে হাসলো। মাথার তালুতে ছোট্ট চুমু খেয়ে প্রসন্ন স্বরে বললো,
—“আচ্ছা, ছাড়ো। আমি ভিজে আছি। জড়িয়ে ধরে তুমিও ভিজে যাচ্ছো। জ্বর বাঁধবে। ছাড়োনারে বাবা।”
রাত্রি ছেড়ে দিলো। নিভ্রান শাড়ির আচঁল তুলে দিলো কাঁধে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ফুলগুলো কুঁড়িয়ে দিলো হাতে। রাত্রি ইততস্ত ভঙ্গিতে কি যেনো দেখলো। বামহাতটা একটু উঠিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে নিভ্রানের ঠোঁটের কাছটায় মুছে দিলো। আঙ্গুলে লেগে গেলো গাঢ় লিপস্টিক। মুছে যাওয়ার বদলে আরো ছড়িয়ে গেলো ঠোঁটের কোঁণে। নিভ্রান হেসে ফেললো। বারকয়েক ঘষে ঘষে মোছার চেষ্টা করে বললো,”গেছে?”
রাত্রি দু’পাশে মাথা নাড়ালো। নিভ্রান হাল ছেড়ে বললো,
—“থাক, সমস্যা নেই।”

বাসায় এসে শাওয়ার নিয়ে, খাওয়া দাওয়া করে রুবিনার কোলে মাথা রেখে বহুক্ষণ শুয়ে রইলো রাত্রি। মাথায় ঝট পাকিয়ে আছে গোলমেলে অনুভূতি। হচ্ছে তীব্র চিনচিনে ব্যাথা। রুবিনা মেয়ের ভেজা চুলের গোছা ছড়িয়ে দিচ্ছে বারবার।
হঠাৎই চোখ পড়লো ঘাড়ের লাল হয়ে আসা অংশে। ভ্রু কুঁচকে গেলো। পরক্ষণেই মুখে ফুটে উঠলো মিষ্টি হাসি। মেয়ের সুখের সংসার দেখাই যেনো সবচেয়ে সুখের। কিন্তু মেয়েটা এমন গোমড়া মুখে শুয়ে আছে কেনো? ও বাসায় কি কিছু হয়েছে? হলে তো নিশ্চয়ই বলতো তাকে। নিভ্রানের ডাক শোনা গেলো। উচ্চশব্দে রাত রাত করে চিল্লাচ্ছে সে। রাত্রি ঝটপট উঠে বসলো। “আসি” বলে হাঁক ছেড়ে মা কে ঘুমাতে বলে দ্রুত বেরিয়ে গেলো।
ঘরের বাতি নিভানো। ব্যালকনির কাঁচ সরানো। বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে সাড়াঘরে। নিভ্রান বালিশের সাথে হেলান দিয়ে কোলের উপর ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। স্ক্রিনে হয়তো লাল রংয়ের কিছু বের করা। সেই লাল আলোর আভায় সুদর্শন চেহারার আকর্ষন বেড়ে গেছে। কপালে পড়ে আছে কিছু চুল। রাত্রি মুগ্ধ হয়ে দেখলো।
নিভ্রান ল্যাপটপের দিকে চেয়েই একহাতে পাশের জায়গাটায় দুবার হাতের বারি দিয়ে ইশারা করে বললো,” শুয়ে থাকো এখানে, ভালোলাগছেনা আমার।”

রাত্রি তার বাচনভঙ্গি শুনে হেসে ফেললো। দ্রুত বিছানায় উঠে বসে নিভ্রানের বাহুর নিচ দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে বুকে মাথা রাখলো। পেট জড়িয়ে ধরলো। নিভ্রান অবাক হলেও কিছু না বলে ভালোকরে আগলে নিলো। রাত্রি দু’তিন সেকেন্ড মনিটরের দিকে চেয়ে থেকে বললো,
—“অফিস না আপনার নিজের? তো আপনি এতো কাজ করেন কেনো?”
—“আমার দেখেই তো কাজ বেশি।”
রাত্রি প্রত্যুওর করলোনা। ল্যাপটপের স্ক্রীনের উপরে সময় দেখা যাচ্ছে। বুকের বামপাশটায় কান পেতে সে হৃদস্পন্দন গুনলো পুরো একমিনিট। ১০৩, ১০৪, ১০৫। রাত্রি আৎকে উঠলো। সাধারণত হার্টবিট থাকে ৬০-১০০। ১০০ ও উঠেনা সচরাচর। আর এই লোকের নাকি একশোর বেশি তার সাথে এতো জোরে জোরে স্পন্দিত হচ্ছে। চোখেমুখে আশঙ্কা নিয়ে মাথা তুললো সে। কপালে গলায় এলোমেলো হাত ছুঁইয়ে বললো,
—“আপনি ঠি ক আছেন? হার্টবিট এত বেশি কেনো? একশো পাঁচ প্রতিমিনিটে। শরীর খারাপ লাগছে?”
নিভ্রান ভ্রু কুঁচকে বললো,”মানে? আমার হার্টবিট কতো তুমি কেমনে জানলে?”

—“গুনলাম তো মাত্র।”
নিভ্রান ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বললো,
—“তুমি হার্টবিট গুনছিলে? আর আমি ভাবলাম ভালোবেসে বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে বউটা আমার। আহা! এজন্যই তো হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো হু হু করে।”
—“উফফ! আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
—“পাওয়াই তো উচিত। তোমার জন্যই তো হার্টবিট বেড়ে গেলো। এখন এটা তো তোমারই কমাতে হবে।”
রাত্রি কপালের চুল কানের পিছে গুঁজতে গুঁজতে বললো,
—“পারবোনা। সরুনতো, মাথা রাখতে দিন।”
—“এখানে যে ঘুমাবে…স্ক্রীনের আলোতে ঘুম আসবে?”
রাত্রি চোখ বুজে বললো,
—“খুব আসবে।”
নিভ্রান একহাত দিয়ে চোখের উপরটা ঢেকে দিলো। আলোর প্রবেশপ্রথ বন্ধ হয়ে যেতেই মুচকি হাসলো রাত্রি।
এতো ভাগ্য তার? এতো সুখ কপালে?
নিভ্রান পাঁচআঙ্গুলে ল্যাপটপের কি- বোর্ড এফোড়ওফোড় করে কাজ শেষ করলো আধঘন্টার মধ্য। ল্যাপটপটা বন্ধ করে কোলের উপর থেকে সরাতেই রাত্রি হাল্কা গলায় বললো,”শেষ?”
নিভ্রান সচকিত গলায় বললো,

—“ঘুমাওনি?”
—“উহু। ঘুম পাচ্ছেনা।”
নিভ্রান ল্যাপটপটা বেডসাইড টেবিলে রাখলো। মৃদু শব্দ হলো। গায়ের ব্ল্যাঙ্কেটটা ঠি ক করলো। আধশোয়া শরীর সোজা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে বললো,
—“কেনো ঘুম পাচ্ছেনা?”
রাত্রি হরিণীর মতো চোখদুটি মেলে চেয়ে রইলো নির্নিমেষ। লাজলজ্জা ভেঙে আচমকাই একটু উঠে গিয়ে চোখ মেলালো চোখে চোখে। কপাল ঠেকালো কপালে। ক্ষণিকসময়ের নিরব কথোপকথন শেষে যা বোঝার বুঝে গেলো নিভ্রান। তৃপ্ত হেসে দু’হাতে কোমড় জাপটে ধরে বললো,”রাত?”

রাত্রি চোখ নামিয়ে নিলো। উষ্ণ অনুভূতিতে তপ্ত হলো আশপাশ। বৃষ্টির গতিকের সাথে তাল মিলিয়ে চললো এতদিনের অপেক্ষার অবসান।
প্রেমস্নিগ্ধ নিশাবসান হলো। প্রত্যুষের নীলাভ আভায় ছেঁয়ে গেছে পৃথিবী। ঘড়ির কাঁটা ভোর পাঁচটা বিশে যেয়ে আটকেছে। রাত্রি চোখ মেললো একটু একটু। আধো জাগ্রত তন্দ্রাঘোরের মাঝেই নিভ্রানের ঘুমন্ত চেহারায় চোখ বুলালো। তাকে বাহুডোরে গুটিয়ে নিয়ে বিভোর হয়ে আছে মানুষটা। দু’নাকের ডগা ছুঁইছুঁই। একটা উক্তি আছে,”মেয়েদের নাকি ঘুমন্ত অবস্থায় সবচাইতে সুন্দর লাগে”। অথচ নিভ্রানের ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে রাত্রির তক্ষুনি ঘোরতর মিথ্যা মনে হলো এতদিনের প্রচলিত উক্তিটা। ডাহা মিথ্যা! ঘুমন্ত অবস্থায় এই মানুষটাকে সৌন্দর্যের দিক দিয়ে কেও হারাতেই পারবেনা। কক্ষনো পারবেনা। অসম্ভব!

নিজের ভাবনায় ডুবে নিজেই হেসে ফেললো সে। গালের কাছে কিছুক্ষণ বৃদ্ধাঙ্গুল বুলিয়ে কপালের অবিন্যস্ত চুলগুলো বামহাত দিয়ে সরিয়ে গাঢ় করে ঠোঁট ছোঁয়ালো মাঝখানটায়। অনেকক্ষণ, খুব সময় নিয়ে। নিভ্রান একটু নড়েচড়ে উঠলো। ঘুমে আলগা হয়ে আসা হাতের বন্ধন দৃঢ় করলো। তবে চোখ খুললোনা। ঘুম ভাঙলোনা। বাইরে ভোরের আলো ফুটতে আরম্ভ করেছে। বৃষ্টি থামার নাম নেই। পবিত্র প্রেমের সাক্ষী থাকার জন্য সে আজ বিদায় নিতে নারাজ।
আটটার দিকে ঘুম ভাঙলো নিভ্রানের। কাঁধের কাছে মাথা রাখা রাত্রির চুলের গোছা তার নাক- মুখের উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। সুবাসিত নেশা ঘাটানো ঘ্রাণে ঝিঁমিয়ে আসলো নাসিকারন্ধ্র। হাত উঠিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিলো সে। ঘড়ির দিকে চেয়ে যত্ন করে রাত্রিকে বালিশে শুইয়ে গলা পর্যন্ত ব্ল্যাঙ্কেট তুলে দিলো। মেয়েটা ক্লান্ত। আজ আর ভার্সিটির জন্য ডাকার দরকার নেই। ঘুমাচ্ছে ঘুমাক।

রাত্রি উঠেছে দুপুরের দিকে। লোকটা তাকে ডাকেনি কেনো? ক্লাস মিস হয়ে গেলো। অভ্যাসবশত পাশ থেকে ফোন হাতে নিলো। স্ক্রিনে মেসেজ আইকন উঠে আছে। চাপ দিতেই দেখা গেলো নিভ্রানের মেসেজ,”আজকের নোটসগুলো আসার সময় নিয়ে আসবো আমি। চিন্তা করোনা।”
মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটে। ফোনটা রেখে শাওয়ার নিয়ে বাইরে বের হলো সে। টেবিলে খাবার সাজানো। নাস্তা কে বানালো? খালা ঘর মুছছে তখন। তাকে দেখেই একগাল হেসে বললো,”ভাইয়ে আপনের আর খালাম্মার নাস্তা বানায় রাখতে কইছিলো। খালাম্মার টা সক্কালেই দিয়াইসি। আপনেরটা এতক্ষণে ঠান্ডা হইয়া গেসে। গরম কইরা দিমু?”
রাত্রি চেয়ার খুলে বসতে বসতে বললো,
—“না খালা দরকার নেই। আপনার ভাইয়া খেয়েছেন?”
—“না, আমি কইলাম খাইয়া যান, কয় দেরি হইয়া গেসে, খাইবোনা।”
রাত্রির মন খারাপ হয়ে গেলো। মানুষটা না খেয়েই চলে গেছে? এমনেও দুপুরে ঠি ক মতো খায় কিনা জানেনা। কতবার বাসা থেকে খাবার বানিয়ে দিতে চেয়েছে নিবেইনা। জেদি একটা। ইশ! তার ঘুমটা সকালে ভাঙলোনা কেনো? মানুষটার এতটুকু খেয়ালই রাখতে পারেনা সে। ধ্যাত্।

সারাদিন এ ঘর ও ঘর করেই কাটলো। বিকেলের দিকে আলমারি খুলে বসলো রাত্রি। বিয়ের শাড়িটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলো পাক্কা ত্রিশমিনিট যাবত। আলমারির উপরের দিকের একটা তাকে নিভ্রানের কয়েকটা জামাকাপড় আলাদা করে রাখা। রাত্রি হাতের নাগাল পায়না অতদূরে। তাই দেখাও হয়নি কখনো। তবে আজ দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
কাজ নাই আর কি ই বা করবে এখন? বাড়তি সময়গুলোই হয় যতো অকাজের কারখানা। ডাইনিং টেবিল থেকে একটা চেয়ার এনে সেটার উপর উঠে দাড়ালো সে। এখন আরামে নামানো যাবে কাপড়গুলো।
একটা ব্ল্যাক কালারের পোলো টি- শার্ট, হাল্কা নীল রংয়ের শার্ট, গ্রে কালারের শার্ট, আর দু-তিনটা মেয়েদের চুলের চিকন কালো ক্লিপ। রাত্রি কপাল কুঁচকালো। ভাঁজ করে রাখা কাপড়গুলো দু’হাতে ধরে নামালো। সব শার্ট, টি- শার্ট তো নিচেই রাখা। এগুলো আলাদা কেনো? অদ্ভুততো।

নিভ্রান ফিরলো তাড়াতাড়িই। কলিংবেল না বাজিয়ে পকেট হাতড়ে চাবি বের করে গেট খুললো। রাত্রি ঘরে ছিলো তখন। দরজার আওয়াজ শুনতেই চট করে বেরোলো সে। নিভ্রানকে সবে ঢুকতে দেখে স্হির চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নিভ্রান একঝলক তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বামহাতটা সোজা বাড়িয়ে দিলো। অর্থ,”কাছে আসো।”
রাত্রি চুপটি করে এগিয়ে গেলো। নিভ্রান কপাল টেনে চুমু খেলো প্রথমেই। পিছন দিয়ে অপরপাশের বাহু জড়িয়ে নিয়ে বললো,” কি করছিলে?”
রাত্রি ছোট্ট করে উওর দিলো,”কিছুনা।”
ঘরে এসে চোখ গেলো বিছানায় রাখা জামাকাপড়গুলোর দিকে। নিভ্রান দেখেও না দেখার ভান করলো।
ব্যাগ থেকে একটা ক্লিয়ার ফাইল বের করে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে বললো, “তোমার নোটস। সাবজেক্ট টি চারদের থেকেই আনিয়েছি। ভুল থাকবেনা কোনো।”
রাত্রি হাতে নিলো। নিভ্রান শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে আড়চোখে আরো কিছুক্ষণ দেখে নিলো বিছানার কাপড়গুলো। রাত এগুলো বের করেছে কেনো? কিছু বুঝে গেছে নাকি মেয়েটা? হায় আল্লাহ!
শার্টটা গা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ধীরকন্ঠে বললো সে,”এগুলো বের করে রেখেছো কেনো?”
রাত্রি শুনতে না পেয়ে বললো,

—“জি?”
নিভ্রান গলা ঝেড়ে বললো,”ওগুলো বিছানায় রেখেছো কেনো? আলমারিতে ছিলোতো।”
রাত্রি সহজ গলায় উওর দিলো,”আপনি একয়টা জিনিস আলাদা করে রেখেছেন কেনো?”
নিভ্রান আমতাআমতা করলো। সে খুবই পাগলাটে স্বভাবের। এ জিনিসগুলো যত্নে রাখার পিছনেও কারণ আছে। রাত কে কি বলবে? মেয়েটা উল্টোপাল্টা ভেবে বসবে না তো? কেঁদে দেয় যদি?
রাত্রি উওরের আশায় চেয়ে আছে। নিভ্রান নামানো কন্ঠে বললো,
—“ওগুলো খুব স্পেশাল রাত।”
—“জামাকাপড় স্পেশাল হয় নাকি?”
নিভ্রান হাসলো। রাত্রি সন্দিহান কন্ঠে বললো,”হাসছেন কেনো?”
নিভ্রান ইশারা করে বললো,”নিয়ে আসো, বলছি কেনো স্পেশাল হয়।”
রাত্রি কাপড়গুলো হাতে তুলে নিলো। নিভ্রানের কাছে যেতেই তাকে টেনে উরুর উপর বসিয়ে নিলো সে। টি- শার্ট গুলো নামিয়ে রাখলো কাঁচের টেবিলের উপর। উপরের ক্নিপগুলো একসাথে করে রাখলো।

রাত্রির কানে গোঁজা চুলগুলো অযথাই আবার গুঁজে দিয়ে বলতে শুরু করলো,”এইযে কালো টি- শার্টটা এটা সেই প্রথমদিন পরে ছিলাম আমি। সেই যে তুমি বাসের মধ্যে বুকে মাথা রাখলে, জড়িয়ে ধরলে। আমি বাসায় এসে জামাটা আর ধুইনি কেনো জানো? তুমি কেমনে জানবে? আমি নিজেই জানিনা কেনো ধুইনি। শুধু মনে হচ্ছিলো মেয়েটার ছোঁয়াটা মুছে যাবে। গায়ের ঘ্রানটা মিলিয়ে যাবে। ধুয়ে যাবে পানির সাথে। তাই ওভাবেই রেখে দিয়েছিলাম। আর দ্বিতীয়, এই নীল শার্টটা…. তুমি যেদিন প্রথমবার সজ্ঞানে জড়িয়ে ধরে কান্না করলে। ওইযে মাঝরাস্তায়… ব্রিজের উপর…কষ্টগুলো একেবারে নিংড়ে দিলে বুকে। তোমার এলোপাথারি চোখের পানি লেগে গেলো শার্টটায়। আমি সেটাও ধুইনি। তোমার কান্নাগুলো লেগে আছে যে।

তারপর? তারপর এই গ্রে শার্টটা? এটা পরেছিলাম দুজনে বৃষ্টিতে ভেজার দিনটায়। প্রথম বৃষ্টিবিলাস। তোমার আমার সুন্দর মূহুর্তের চাক্ষুষ সাক্ষী। আমি আর পরিনি এটা। এই নির্লজ্জ শার্টটাও সেদিন তোমাকে ভিজতে দেখেছিলো। এটাকে আর বের করিনি। অসভ্য শার্ট।
উহুম! আর ক্লিপ? ক্লিপ… ক্লিপ গুলোও তোমারই। এ পর্যায়ে হেসে ফেললো নিভ্রান। দু’আঙ্গুলে কপাল ঘষে চোখ লুকিয়ে বলল,”এগুলো আমি নিয়ে এসেছিলাম তোমার বাসা থেকেই। ওইযে ছাতা আনতে গিয়েছিলাম যে। তুমি বোধহয় টের পাওনি। পানির গ্লাসে কদমফুল ডুবাচ্ছিলে তখন কি ভেবে যেনো বালিশের পাশ থেকে ক্লিপগুলো পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম। চোরের মতো। নিয়ে এসে রেখেদিলাম যত্ন করে। কি যে ভালো লাগছিলো।”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৩৫+৩৬

এতটুকু বলে থামলো নিভ্রান। রাত্রি পানিতে পরিপূর্ণ টলমলে চোখে চেয়ে আছে। ছোট্ট চোখে জায়গা করতে না পেরে টপ টপ করে গাল গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো কান্নারা। নিভ্রানের হাসি মিলিয়ে গেলো। গালে হাত রেখে গমগমে গলায় বললো,
—“এই মেয়ে, খবরদার! কাঁদবে না।”
রাত্রি কথা শুনলোনা। শুনলোনা তার টলমলে চোখ। অবাধ্য অশ্রু বিসর্জিত হতে লাগলো। ঠোঁট কাঁপতে লাগলো থরথর করে। ফোঁপানোর শব্দে নরম হয়ে এলো নিভ্রানের কন্ঠ,
—“এজন্যই বলতে চাচ্ছিলামনা। ধুরো, কাঁদেনা। কেনো কাঁদছো? আমি ক্লিপ চুরি করে এনেছি বলে?”
রাত্রি কাঁধে মুখ গুঁজলো। দু’হাতে গলা জড়িয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বললো,
—“আপনি ভালোনা। একদম ভালোনা।”

নিভ্রান হাসলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,” তুমি আমার জন্য কি আমি নিজেও জানিনা রাত। শুধু এতটুকু জানি, অকস্মাৎ এক বৃষ্টির দিনে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে উপহার পাওয়া আমার একমাত্র মেঘরাণী তুমি। পৃথিবীতে রাত না নামলে সব যেমন অসামন্জস্যতায় ছেঁয়ে যাবে। সূর্যের আলোয় ঝলসে যাবে সমস্ত জগৎ। তেমনি আমার জীবনে তুমি নামক রাতটা না নামলে এই প্রেমিক হৃদয় ঝলসে যাবে, জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাবে সব। দগ্ধ হবে প্রেম আর তোমার আমি।”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৩৯+৪০