এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৩৫+৩৬

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৩৫+৩৬
লেখিকা মালিহা খান

তিনটে কালো কুচকুচে কাক লাইন ধরে কারেন্টের তারের উপর বসে আছে। গলা থেকে মাথার অংশটা কালো, ধূসর নয়। এগুলো সাধারণ কাক না, এদেরকে বলা হয় দাঁড় কাক। রাত্রি ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে সূর্যের রশ্নি উপেক্ষা করেই সেদিকে তাকালো। বিষণ্ণার মতো চেয়েই রইলো অনেকক্ষণ, ছোটবেলায় বাবা বলতো দাঁড়কাক নাকি রাতের বেলা ভূত হয়ে যায়। বাসার ছাদে ঘুরে বেড়ায়। ড্রইংরুমের সোফায় শুয়ে থাকে। বারান্দার রেলিংয়ে ঝুলে থাকে। সেই গল্প শুনে সবসময় দুষ্টামি ছেড়েছুড়ে চুপটি করে শুয়ে পড়তো সে। আর কোনোকিছুতে ছোটাছোটি থামানো না গেলেও এই দাঁড়কাকের ভয়ে সবসময় দমিয়ে রাখা যেতো তাকে। আর বাবা সেই সুযোগটাই সবসময় কাজে লাগাতে।

রাস্তার ট্রাফিক সিগন্যালের সবুজ বাতিটা লাল হলো। ভাবনা কাটিয়ে মানুষজনের হুড়মুড় মিছিলে যোগ দিলো রাত্রিও।
ভার্সিটি শেষে নিভ্রান রোজ গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। আজকেও পাঠিয়েছিলো কিন্তু সে আবার পাল্টা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। রোজ রোজ ওই বদ্ধ বাহনে চড়ে শহর ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগেনা। জীবনে একটু হাঁটাহাঁটির প্রয়োজনও আছে। শরীরের হাড়ে মরিচা ধরে যাবে নয়তো। বৃদ্ধ হবার আগেই লাঠির সাহায্য লাগবে। কিন্তু ওই পাগলটা কি আর বুঝবে সেসব? নিশ্চিত একটু পর ফোন দিয়ে ধমকাধমকি করবে। সেজন্য আগেভাগেই ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছে সে। এখন পড়াতে যেতে হবেনা। স্টুডেন্ট সকালে জানিয়ে দিয়েছে তারা আজ বাসায় থাকবেনা কোথায় যেনো যাবে তাই রাত্রির ছুটি।
এবড়োথেবড়ো ধাক্কাধাক্কির মাঝেই একটা শক্ত হাত কোথথেকে যেনো এসে সেখান থেকে টেনে বের করে আনলো তাকে। রাত্রি হকচকালো। সামনের মানুষটার দিকে তাকানোর আগেই মনে মনে ঝাঁঝালো ধমক দেওয়ার প্রস্তুতি নিলো। কত বড় সাহস! রাস্তার মাঝে হাত টানাটানি করে।
তার ধমক শুরু হবার আগেই হাতের মালিকের তুমুল বিরক্তিসূচক তিতা কন্ঠ শোনা গেলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—“ধ্যাত ভাবি, আপনাকে এই যুদ্ধ যাত্রা থেকে উদ্ধার করতে যেয়ে তো আমার সর্বনাশ হয়ে গেলো। ইহহি। ছিহ্। ইয়াক।”
রাত্রির হতভম্ব ভাবটা কাটলো না। নিশাদ দাড়িয়ে আছে। চোখমুখ অস্বাভাবিক। বিশ্রিভাবে কুঁচকানো। চোখের বাদামী শেডের রোদচশমার উপর দিয়েও বোঝা যাচ্ছে চোখ কুঁচকে রেখেছে ছেলেটা। মাথার চুলে সাদা সাদা আঠালো পদার্থ। একহাতে রাত্রির হাত ধরে অপরহাতে রুমাল দিয়ে চুল মোছার চেষ্টা করছে সে।
রাত্রি হাল্কা ঠোঁট নাড়িয়ে বললো,”ভাইয়া, আপনি..”বাকিটা শেষ হলোনা। নিশাদ খেঁকিয়ে উঠে বললো,
—“ওয়াক থু। ছিইইহ, ভাবি মুছেন এগুলা। ইয়াক! বমি পাচ্ছে আমার।”
রাত্রি একসেকেন্ড চেয়ে থেকে পায়ের পাতা একটু উঁচু করলো। রুমালটায় হাত দিয়ে বললো,
—” আপনি হাত সরান, আমি মুছে দিচ্ছি। কিছু হয়নি।”

নিশাদ হাত সরিয়ে নিজেই একটু ঝুঁকে দাড়ালো। রাত্রি ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করলো। রুমাল ভিজিয়ে নিয়ে সেটা দিয়ে চুল পরিষ্কার করলো। নিশাদ ঘ্যান ঘ্যান করেই যাচ্ছে। রাত্রির হাতের বোতলটা ছিনিয়ে নিয়ে সে বললো,
—“এই মাঝরাস্তায় আমি শাওয়ার নিবো কিভাবে? আপনার কাছে কি একবালতি পানি হবে? নাকি এতটুকুই?”
রাত্রি জোরজবরদস্তি হাসি আটকিয়ে আস্তে করে বললো,”এতটুকুই।”
—“একটু পানি রাখবেন না সাথে? ধুরো, আচ্ছা পাবলিক টয়লেটে কি গোসলের ব্যবস্থা থাকে?”
রাত্রি চুলটা ভালোমতো মুছে দিয়ে হাত নামালো। রুমাল দেখিয়ে বললো,
—” গোসল করা লাগবেনা। এইযে দেখুন, সব পরিষ্কার হয়ে গেছে।”
নিশাদ একপলক তাকালো। পরমূহুর্তেই বমি করার ভঙ্গি করে বললো,
—“ওয়াক…ছি! ভাবি ছি! ফেলেন এটা। ধরে রেখেছেন কেনো? ইয়াক।”বলে নিজেই রাত্রির হাত ঝেড়ে রুমালটা রাস্তায় ফেলে দিলো। গড়গড় করে বোতলের অবশিষ্ট পানিটুকু রাত্রির দু’হাত মুঠো করে টেনে তার ওপর ঢেলে দিলো। তপ্ত গলায় বললো,
—“সাবান কিনে আনি দোকান থেকে। আসেনতো সাথে।”

রাত্রি বারণ করার চেষ্টা করলো। নিশাদ শুনলোনা। দোকান থেকে সাবান কিনলো। মিনারেল ওয়াটার কিনলো দু’তিন বোতল। রাস্তার ধারে দাড়িয়েই সাবান পানি দিয়ে হাত ধোঁয়ালো রাত্রির। নিজের চুলে ঢেলে দিলো পুরো একবোতল পানি। পুরো পাগলের ভাই বদ্ধপাগলের বেগতিক কাজকর্মে হতবিহ্বল হয়ে রইলো রাত্রি। সে কি নিজেও পাগল হয়ে যাচ্ছে? মাথা ঘুরাচ্ছে কেনো?
পানিটানি ঢেলে নিশাদ হাফগোসল সেড়ে ফেলেছে। রাত্রি মিনমিন করলো,”আপনি এখানে কিভাবে এলেন?”
—“আগে বলেন আপনি এখানে করছেন টা কি? মানুষের চাপাচিপায় আলুভর্তা হবার শখ? এতো পছন্দ আলুভর্তা? বাসায় বানিয়ে খেলেই তো পারেন। আলু নেই বাসায়? ভাইয়া এনে দেয়না? এতো কিপ্টা হয়ে গেছে ও?”
রাত্রি বেকুবের মতো বললো,

—“আপনার আমাকে আলু মনে হলো?”
—“মানুষভর্তা বললে কেমন যেনো বিদঘুটে শোনায়। হিংস্র হিংস্র লাগে। অবশ্য আপনার কথাও ঠি ক। আপনাকে আলু শব্দটা মানায়না। বড়জোড় চিকন বেগুনের মতো লাগে। আচ্ছা বেগুন কি ভর্তা করা যায় ভাবি? কিভাবে করে বলেনতো? আমি খাইনি কখনো।”
রাত্রি উওর দিলোনা। নিশাদ পানির বোতলগুলোর ছিপি আটকিয়ে একসাথে করে পাশের ময়লার স্তুপে ছুড়তে ছুড়তে বললো,
—“ওই জেদিটা আপনাকে এভাবে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটায় তাইনা? অফিসের ভেতরেও কি এক কেবিন থেকে অন্য কেবিনে গাড়িতে বসে যায় ও?”
রাত্রি তাড়াহুড়ো করে বললো,
—“না না উনি তো গাড়ি পাঠিয়েছিলেন। আমিই হেঁটে এসেছি।”
নিশাদ তাকে টেনে নিয়ে গাড়ির দরজা খুললো। বসিয়ে দিয়ে ইশারা করে বললো,”সিটবেল্ট বেঁধে নেন। যে রাস্তা এদিকে। মাথা ঠুকে মরবেন নয়তো।”
রাত্রি সিটবেল্ট বেঁধে নিলো। নিশাদ পাশে বসে গন্তব্যর ঠি কানা জিজ্ঞেস করলো। রাত্রি জানালো,”সে মার্কেটে যাচ্ছিলো। বেতন পেয়েছে গতকাল। সেই দিয়ে একটু জিনিসপত্র কেনার জন্যই যাওয়া।”
গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে সামনের ড্রয়ার খুলে পারফিউমের বোতল বের করলো নিশাদ। ছিট ছিট করে মাথার উপর স্প্রে করে রাত্রির দিকে চেয়ে বললো,”গন্ধ লাগছে এখনো?”

শপিংমলে আজকে ঢের ভিড়। জম্পেশ কেনাকাটা চলছে। নিশাদ কাজকর্ম ছেড়ে রাত্রির সাথে সাথে ঘুরছে। ঘেমে নেয়ে একাকার পিঠ। রাত্রির ব্যাগশুদ্ধ কাঁপছে থরথর করে। ফোনের উপর ফোন দিয়ে যাচ্ছে নিভ্রান। সে ধরার সাহস পাচ্ছেনা। ভাইব্রেশনের শব্দ বাইরে অবধি শোনা যাচ্ছে। নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,”ফোন ধরছেন না কেনো?”
রাত্রি কাঁচুমাচু করলো। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ফোন বের করলো। কয়েকসেকেন্ড স্ক্রিনে চেয়ে আচমকাই রিসিভ করে নিশাদের কানের সাথে চেপে ধরলো ফোনটা। দ্রুত বললো,
—“আপনি কথা বলেন। আমাকে বকবে।”
নিশাদ বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো। অগোছালো ভাবে ফোনটা ধরে বললো,
—“আ…হ্যালো..”
ওপাশে কিছুক্ষণ নিরবতা। তারপর প্রশ্ন ভেসে আসলো,” তুই রাতের সাথে?”

—” না, ভাবির ফোন চুরি করে নিয়ে আসলাম আরকি।”
—“রাত কোথায়? দে তো ওকে।”
নিশাদ ফটাফট উওর দিলো,
—“ভাবি কথা বলবেনা। তুই নাকি বকবি।”
নিভান উত্তেজিত গলায় বললো,
—“বকবোনা? আমি গাড়ি পাঠিয়েছি আর ও এই গরমে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছে। কই তোরা এখন?”
—“মার্কেটে।”
নিভ্রান চুপ থাকলো কিছুক্ষণ। রাগ সামলে ঠান্ডা স্বরে বললো,
—“আচ্ছা, তুই একটু ওর সাথেসাথেই থাকিস।”
নিশাদ উওর দিলো,
—“তুই না বললেও থাকতাম।”

আকাশটা বড্ড গাঢ় নীল। একটু একটু সাদা মেঘের ভাঙা টুকরো ছিঁটকে আছে। স্তুপ স্তুপ অপরাজিতার বাগান মনে হচ্ছে যেন। অর্ধচাদটা নির্নিমেষ জ্যোতি ছড়াচ্ছে সেই বাগানে।
রাত্রি শপিং ব্যাগগুলো খাটে বিছিয়ে বসেছে। নিভ্রান টাওয়াল দিয়ে নিজের ভেজা চুল ঘঁষতে ঘঁষতে পাশে বসলো। তিনটা একইরকম কালো পান্জাবি। নেড়েচেড়ে ভালো করে দেখলো তিনটা একেবারে সেইম। কপালে ভাঁজ পড়লো,
—“এতকিছু কি? একইরকম তিনটা কিনেছো কেনো?”
রাত্রি শাড়ির ভাঁজ খুলে দেখতে দেখতে উওর দিলো,
—“আপনার, বাবার, আর ভাইয়ার। আচ্ছা, এটা কেমন হয়েছে?সুন্দর না? ওইযে আম্মুর জন্য একইরকম কিনেছি।” অফ ওয়াইট রংয়ের শাড়িটা দেখিয়ে বললো রাত্রি। মুখের তৃপ্তিকর মিষ্টি হাসিটা সব সৌন্দর্য ছাপিয়ে গেছে। নিভ্রান মুচকি হাসলো। কপালের চুল সরিয়ে দিয়ে বললো,”খুব সুন্দর হয়েছে রাত। কিন্তু এতকিছু কিনার কি দরকার ছিলো? তোমার কষ্টের টাকা। আমাকে বলতে, আমি কিনে দিতাম।”
—“টাকা নিয়ে কি আমি কবরে যাবো নাকি? টাকা তো খরচ করার জন্যই। তাছাড়া আপনি আমার ব্যয়ের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। জমিয়ে রেখে কি করবো?”

নিভ্রান নরমভাবে তাকে আগলে ধরলো। কাছে টেনে চুলের সাইডে চুমু খেয়ে বললো,”আচ্ছা ঠি কাছে, গোছানো হলে চলো খেয়ে নেই। আন্টিও না খেয়ে আছেন আমাদের জন্য।”
রাত্রি “হু, যাচ্ছি” বলে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।
—“নিজের জন্য কিছু কিনোনি?”
রাত্রি একপলক কি যেনো ভাবলো। অত:পর এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে উওর দিলো,
—“কিনেছিতো।….ওইযে দুলগুলো। আপনার হাতের কাছের প্যাকেটটায় আছে। বের করে দেখেন।”
নিভ্রান বের করলো। চারজোড়া সিলভার কালারের ঝুমকা। একেকটা একেকরকম। দুটো ছোট সাইজের আর দুটো একটু বড়। নিভ্রান হাতের তালুতে একটা রেখে পরখ করতে করতে বললো,
—“শুধু এইগুলো?”
রাত্রি মুচকি হেসে উওর দিলো,
—“এগুলোই পছন্দ হয়েছে। আর কিছু ভালোলাগেনি।”
—“নিশাদ জানে আমরা কাল যাবো?”
—“না তো।”
—“তো এগুলো কিভাবে কিনলে?”
—“কিনেছি। উনি বুঝেনইনি।”
নিভ্রান লম্বা শ্বাস ফেললো। এ মেয়েকে বোঝা মুশকিল!

নদীর নীরে সোনারঙা রোদ। ঘর্মাক্ত দুপুরের ঝলমলে রোদে দাড়িয়ে চুলের পানি ঝাড়ছে রাত্রি। গায়ে মেরুন কালারের একটা জামদানী জড়ানো। গলার সোনার চেনের ছোট্ট হীরের পাথরটা চিকচিক করছে। কানের তুলনামূলক বড় পাথরের দুলদুটো রিফ্লেক্ট করছে রোদের আলোয়। এই ধরণীর সৌন্দর্য নয় এ যেনো! অপার্থিব কিছুর ছোঁয়া সর্বাঙ্গে!
হঠাৎই বরফ ঠান্ডা কোমড়ে তপ্ত স্পর্শ পেতেই চাপা গলায় চিল্লিয়ে উঠলো সে,
—“ও আল্লাহ! এটা বারান্দা। মানুষ দেখবে।”
নিভ্রান সদ্য গোসল করে আসা পানিতে পরিপূর্ণ বুক দিয়ে রাত্রির পিঠ ভেজাতে ভেজাতে বললো,
—“তো কি হয়েছে?”
গাঢ় গোলাপি বাগানবিলাসে ঠাসা পুরো বারান্দা। রেলিংয়ের বাইরে পর্যন্ত এসে পড়েছে কিছুটা। পনেরো তলা বিল্ডিং এর অন্য কোনোকিছু নজর কাড়লো না রাত্রির। হাতের তর্জনী উঁচিয়ে সেই বারান্দা ধরে ফ্লোর গুনতে গুনতে বারো নম্বরে যেয়ে ঠেকলো। নিভ্রান সিটবেল্ট খুলে দিচ্ছিলো। রাত্রিকে আঙ্গুল দিয়ে গুনতি করতে দেখে হেসে ফেললো সে,
—“কি করছো?”

রাত্রি একবার ঘাড় ফিরালো। আবারো নজর দিলো সেদিকে। সূর্যের আলো সরাসরি এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে গাল মুখ। বেগুনী রশ্নির প্রভাবে তাকাতে না পেরে চোখ কুঁচকে গেছে। পিটপিট করে চিনদেশীয় মানুষের মতো করে তাকাচ্ছে সে। ছোট্ট নাকের ডগা টা রক্তশোভিত লাল। ঠোঁটের উপর ঘামের কণা। নিভ্রান রুমাল বের করলো। পাতলা করে ভাঁজ করে খুব সাবধানে ঘাম গুলো মুছিয়ে দিলো। ঠোঁটে মেরুণ রংয়ের লিপস্টিক দেয়া, হাত লেগে গেলে ছড়িয়ে যাবে। রাত্রির এই রংয়ের লিপস্টিক ছিলনা। আসার পথে কিনে দিয়েছে।
গলার উল্টে যাওয়া লকেটটা সোজা করে দিয়ে হাত বাড়িয়ে দরজার লক খুলে দিলো সে। রাত্রি কপালের কাছে হাত দিয়ে রোদের আলো থেকে বাঁচার চেষ্টা করে বললো,
—“ওই বারান্দাটা কি সুন্দর তাইনা? আপনারা কোনটায় থাকেন?”
নিভ্রান তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো। কয়েকসেকেন্ড চেয়ে থেকে চাপা গলায় বললো,”ওখানেই থাকি….মানে থাকতাম।” রাত্রি বুঝলো নিভ্রানের স্হির চোখের ভাষা। চুপ করে গেলো সে। প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্য বললো,”চলুন, যাই।”
নিভ্রান সোজা হয়ে বসলো। গাড়ির চাবিটা খুলে নিয়ে পকেটে ভরলো। বের হয়ে পিছের সিট থেকে রাত্রির নিয়ে আসা ব্যাগগুলো একসাথে তুলে নিলো। অত:পর রাত্রির পাশের দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে। ছোট্ট করে বললো,” কুঁচি নেমে গেছে, সাবধানে।”
রাত্রি একহাতে কুঁচি উপরে টেনে ধরলো। নিভ্রানের হাত আঁকড়ে নেমে দাড়ালো। ভারি শাড়িটায় একশো একটা সেফটিপিন ঢুকিয়ে এসেছে তবু নেমে যাচ্ছে। নেহাতই বেশ সুন্দর লেগেছিলো সেজন্য কিছু না ভেবেই এটা পরে ফেলেছিলো। আগে থেকে এতো বিড়ম্বনা জানলে কস্মিককালেও এর ধারে কাছে যেতোনা।

দুপুর তখন দুইটা সাইত্রিশ।
নওশাদ সাহেব সকালে খবরের কাগজ পড়তে পারেননি। নাহিদা ডাইনিংয়ে খাবার সাজাচ্ছে। এই ফাঁকে তিনি সোফায় বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে হাতে ধরা কাগজটায় চোখ বুলাচ্ছেন। কাপের তলের শেষ অংশটুকু গলার ভেতর চালান করে দিয়ে হাঁক ছাড়লেন তিনি,”আরেক কাপ দাওতো নাহিদা।”
নাহিদা চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। গরম কন্ঠে বললেন,
—“তোমার এই চা খাওয়ার অভ্যাস যাবেনা? এইযে দুইদিন পরপর প্রেশার হাই হয়ে কাঁপতে থাকো। সব তো এই চায়ের জন্যই। এই চা ই মারবে তোমাকে। আমি বলে দিলাম।”
—“আহা! চায়ে করি দোষ প্রেশারের সাথে ওর কি সম্পর্ক?”
—“তুমি..”তার কথার মাঝেই কলিংবেল বাজলো। নাহিদা থেমে গেলেন। একপলক নওশাদ সাহেবর দিকে তাকিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। মনে মনে গজগজ করলেন কিছুক্ষণ। মানুষজন সব অসময়ে আসে।
রাত্রি সামনে দাড়িয়ে আছে। পিছে নিভ্রান। নাহিদা দরজা খুলে থ বনে গেলেন অকস্স্যাৎ। হাত থেমে গেলো। পা ধরে আসলো। অদ্ভুত দৃষ্টিতে চোখ বুলালেন বারকয়েক। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। তিনি কি সত্যি দেখছেন? ঠোঁটের মাঝে ফাটল ধরলো অজান্তেই। রাত্রি মিষ্টি হেসে বললো,”আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”

নাহিদা আবার পলক ঝাপটালেন। অনাকাঙ্খিত আনন্দগুলো ধারণ করার চেষ্টা করলেন। তার ছেলে এসেছে? সত্যি? এতগুলো বছর পর?
চোখ খুশিতে খুশিতে কানায় কানায় ভরে উঠলো। টলমল করলো ঠোঁট। রাত্রি নিজেই একটু সাইডে সরে দাড়ালো। নাহিদা কেঁদে উঠলেন। হাত বাড়িয়ে নিভ্রানকে ধরলেন। নিভ্রান অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো,
—“কান্নাকাটি করছো কেনো?”
এই দুপুরবেলা কান্নাকাটির শব্দ শুনে নওশাদ সাহেব মুখের উপর থেকে কাগজটা সরিয়ে এদিকে ঘাড় ফিরালেন। নিভ্রান আর রাত্রিকে দেখে একাধারে চেয়ে রইলেন কতক্ষণ। মুখের কোথাও একটা সুপ্ত আনন্দ। চোখের কোঁণে চাপা হাসি থেকে জন্মানো ভাঁজ। রাত্রি তাকে সেখান থেকেই সালাম দিলো। নওশাদ সাহেব হাতছানি দিয়ে ডেকে সহাস্য মুখে বললেন,”আসো আসো, ভেতরে আসো।” রাত্রি সাইড দিয়েই ঢুকে গেলো। নওশাদ সাহেব এগিয়ে এসে তার মাথার হাত বুলালেন। স্নিগ্ধ চোখে দেখে বললেন,” মাশআল্লাহ….কেমন আছো মা?”

নাহিদার কান্নাকাটি থেমেছে। বহুকষ্টে আচঁল দিয়ে চোখ মুছলেন তিনি। নিভ্রান একপা দু’পা করে ভেতরে ঢুকলো। চোখ বুলালো বড় ড্রইংরুমটায়। বাসায় আসেনা আজ কতবছর। কতকিছু বদলেছে। ল্যান্ডফোনের পাশের লাল শোপিস টা নেই। বেসিনের উপরের কাঁচটা বদলেছে। ড্রাইনিং টেবিলটা নতুন। তার রুমটা কি এখনও আগের মতোই আছে? নাকি ধুলোমাটি জমে ফিকে ঝন্জালের স্তুপ হয়ে গেছে? খুব গোপনে একা অসহ্যকর দীর্ঘ: শ্বাস বেরিয়ে এলো। নিভ্রান ঢুকতেই নওশাদ সাহেব রাত্রিকে বসতে বলে নিশব্দে ভেতরে চলে যেতে উদ্যত হলেন। কেন যেনো অসস্তি লাগছে। খুব অসস্তি। নিভ্রান একনজর তার দিকে তাকালো। অত:পর সোফায় ব্যাগগুলো রেখে বললো,”তুমি থাকো রাত, আমি সন্ধ্যায় এসে নিয়ে যাবোনে।”
রাত্রি না না করে উঠলো। খপ করে ধরে ফেললো নিভ্রানের বাহু। তড়িঘড়ি করে বললো,”নাহ্, আপনি কেনো যাবেন? আপনিও থাকবেন।”

নিভ্রান শান্ত গলায় বললো,”জেদ করেনা। আমি এসে নিয়ে যাবো সন্ধ্যায়।”
রাত্রি হাতের চাপ দৃঢ় করলো। কিছু একটা ভেবে চোখমুখ অসহায় করে কাতর গলায় বললো,”প্লিজ..”
নিভ্রান নিষ্প্রভ নয়নে তাকালো। মেয়েটা জানে এমন করলে সে মানা করতে পারবেনা। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো সে। সম্মতি দিয়ে বললো,”আচ্ছা, ঠি কাছে।”
নাহিদা ব্যস্ত গলায় বললেন,”জানিয়ে আসবিনা? আমিতো তেমন কিছুই রান্না করিনি। হায় আল্লাহ।”
নিভ্রান সোফায় বসতে বসতে বললো,” এতো ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আমরা খেয়ে এসেছি। তুমি এসে বসোতো সামনে।”
—“ধুর, চুপ কর। তা কি হয়? আমি যাই। তুই কি খাবি বল। রাত্রি তুমি কি খাবে?”
রাত্রি উওর দেবার আগেই ধুম করে দরজা খোলার শব্দ হলো। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো নিশাদ। চোখমুখ ফুলে মনে হচ্ছে মৌমাছি কামড়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। পরণের টি-শার্ট কুঁচকে কুঁচকে আছে। চুল উদ্ভ্রান্তের মতো। দু’হাতে চোখ ডলতে ডলতে সে বললো
—“সমস্যাটা কি? বললাম আমি আজকে একটু ঘুমাবো। ছুটির দিন, হাউকাউ করোনা। নাহ্, দুপুর না গড়াতেই মাছের বাজার বসে গেছে। আর বাসায় কাকে না কাকে ঢুকিয়েছো পুরো ভাইয়ার মতো গলা।”

—“ওটা আমিই নিশাদ। আমার মতো গলা আবার কার হবে? আর এই ভরদুপুরে কিসের ঘুম? একটুপর বিকাল হয়ে যাবে।”
নিশাদ চকিতে তাকালো। চোখের ঘুম উড়ে ছাঁই। মনিগুলো বড়ো বড়ো করে বুকে থুতু ছিটিয়ে সে বললো,
—“মা, সোফায় বসা মানুষটাকে কি তুমিও দেখতে পাচ্ছো? নাকি শুধু আমিই দেখছি। হরর কিছু নয়তো? ভাইয়ার মতো সেজেছে কেনো? দেখি, ধরা যায় নাকি।” বলেই এগিয়ে এসে নিভ্রানের চোখ মুখ হাতালো সে।
নিভ্রান চেঁচিয়ে উঠলো,
—“হুরর, কি করিস?”
রাত্রি ফিক করে হেসে ফেললো। হাসলো নাহিদাও। ইশশ…ঘরটা যেনো আলোয় আলোয় ঝলসিয়ে যাচ্ছে।

রুমটা সেই আগের মতোই গোছানো। বিছানা ঝাড়া। ফ্লোর মনে হচ্ছে আজই ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে।
বাগানবিলাসের গোলাপী স্তুপের ছায়ায় ব্যালকনির দরজাটা পর্যন্ত গোলাপী আভায় সুসজ্জিত। পর্দার নিচ দিয়ে কেমন অদ্ভুত আভাযুক্ত রশ্নি সাদা ফ্লোরে বিছিয়ে আছে। নিভ্রান অবাক চোখে দেখলো সব। সন্দেহজনক গলায় প্রশ্ন করলো,
—“এ ঘরে থাকে কেউ?”
নিশাদ মৃত গলায় উওর দিলো,
—“তুই নাই কে থাকবে ভাই?”
—“সব এত গোছানো কেনো? তালাও দেয়া ছিলোনা।”
নিশাদ কিছু বলতে যেয়েও আটকে ফেললো যেনো। কি একটা জানি অভিদের মতো লুকিয়ে ফেললো। রাত্রি যেয়ে পর্দা সরালো। ব্যালকনির দরজাটা খুলতেই প্রাণখোলা হাসিতে ভরে গেলো ঠোঁট। বাগানবিলাসের রাজ্য যেনো। সে হাত বাড়িয়ে দুটো পাতা ছিঁড়লো। নিশাদ গলা ঝেঁড়ে এড়িয়ে গিয়ে বললো,”ভাবি, তাহলে নিয়েই আসলেন ভাইয়াকে। আ’ম ফিলিং প্রাইড অফ মি।”
রাত্রি ঘুরে বললো,”কেনো?”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৩৩+৩৪

—“আমি দেবর বলেইতো আপনি অসম্ভব কে সম্ভব করতে পারলেন।”
রাত্রি হাসলো কেবল। উওর দিলোনা। নিভ্রান কিছুক্ষণ থম ধরে বসে রইলো বিছানায়। ইচ্ছা হচ্ছে সব ছেড়েছুড়ে আবার পরিবার নিয়ে সময় কাটাতে। এখানেই থেকে যেতে আজীবন। কিন্তু নাহ, ওইযে ইগো। ইগো জিনিসটাই বারবার আটকে দিচ্ছে। কাঁটাতার বিছিয়ে রেখেছে গলায়, মনে, সবখানে।
খানিকবাদে নিভ্রান ওয়াশরুমের জন্য সেখান থেকে যেতেই রাত্রি হুড়মুড় করে বললো,
—” এবার আমাকে বলেন জলদি। সব এতো গোছানো কেনো? আমি দেখেছি আপনি কিছু লুকাচ্ছেন।”
নিশাদ হেসে ফেললো। মেয়েটা এতটুকুন হলেও বেশ বিচক্ষণ। সবদিকে খেয়াল আছে তার। ওর কাছে লুকানোর মতো কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে সে হাসতে হাসতেই বললো,”বাবার কড়া আদেশ আছে ভাবি। ঘরের কোনো জিনিসে যেনো একফোঁটা ধুলোও না জমে। সেজন্যই মা রোজ সকাল সকালই খালাকে দিয়ে এই সবকিছু পরিষ্কার করিয়ে রাখে। ঘর অগোছালো হবে কি করে?”
রাত্রি আকাশ থেকে পড়ে বললো,

—“বাবা? উনার আর বাবার মধ্য না রেশারেশি?”
নিশাদ তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
—“সে তো বাইরে বাইরে। ভেতরে ভেতরে দেখেন গিয়ে দুজনেই বেরধক ভুগছে।”
রাত্রি অবাক হয়ে হতাশভাবে বললো,
—“আপনি উনাকে বলে দিতেন বাবার কথা। এসব শুনলে, একটু হলেও অভিমান কমতো। রাগ ভেঙে যেতো।”
—“আর বাবা এদিকে আমাকে ভেঙে দিতো। এসব কোনোকিছু যাতে ভাইয়ার কানে না যায় এ ব্যাপারে আগে থেকেই কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে তার।”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৩৭+৩৮